You dont have javascript enabled! Please enable it! কর্নেল মাসুদের বন্দিজীবন ও নির্যাতন - সংগ্রামের নোটবুক

কর্নেল মাসুদের বন্দিজীবন ও নির্যাতন

লে. কর্নেল মাসুদুল হুসেন খান ছিলেন জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। রেজিমেন্ট ঢাকা ব্রিগেডের অংশ। এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন ঢাকার কসাই বলে খ্যাত ব্রিগেডিয়ার জাহান যে আরবাব এই লােকটির মতাে ধূর্ত, কুকর্মে উৎসাহী, নীতিজ্ঞান-বিবর্জিত পশুসুলভ অফিসার পাক সামরিক বাহিনীতেও খুব বেশি ছিল না। এই আরবাবই আরেকজন লে. কর্নেলের (নামটি মনে নেই) সাথে ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত হয়েছিলেন বগুড়ার স্টেট ব্যাংক লুট করার অপরাধে। শােনা যায় উপরস্থ অনেকেই ভাগ পেয়েছিলেন, তাই নানা বাহানা করে সেই কোর্ট মার্শালের রায় কার্যকরি করা হয় নি। পূর্ব পাকিস্তানের পতন যখন অবশ্যম্ভাবী বলে জানা গেল, তখন এই আরবাব এখান থেকে বদলি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত হন। যেহেতু আরবাবের চরিত্রের মতাে গুণাধিকারী ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রিয় ছিলেন, তাই তার পক্ষে মেজর জেনারেল ও পরে লে. জেনারেল পদে উন্নতি পেতে বিশেষ অসুবিধা হয় নি। ১৯ মার্চ আরবাব তাঁর পাঞ্জাবি সৈন্য ও অস্ত্রসহ জয়দেবপুর গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করতে। সেখানে গিয়ে তিনি, তার পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পাঞ্জাবি গােলন্দাজ বাহিনী বুঝতে পারে যে, কাজটিকে যতাে সহজ ভাবা হয়েছিল বাস্তবে তা নয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রত্যেক সৈনিকই ছিল তার ব্যক্তিগত গুলি। ভরা অস্ত্রে সুসজ্জিত। একেতাে এই অভিজ্ঞ ও চৌকস সৈনিকরা জানতাে যে। তাদেরকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, তখনকার সময় এইরূপ আদেশও ছিল যে আইন-শৃঙ্খলা মােকাবিলার জন্য সৈনিকদের সর্বদা সশস্ত্র থাকতে হবে।  অতএব, আরবারের সাহস হয় নি এসব সৈনিকের অস্ত্রাগারের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু তিনি যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন জয়দেবপুরের সাধারণ মানুষ সড়কের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রেললাইনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মালবাহী গাড়ির বগি ফেলে দিয়ে সড়কপথ বন্ধ করে দিলাে। জয়দেবপুর স্টেশনের নিকট এই রেলক্রসিংটি অবস্থিত ছিল বলে আশপাশে পড়ে থাকা মালগাড়ির অভাব ছিল না। ব্যর্থতার ক্ষোভ ও অর্পিত কাজটি না করতে পারার কারণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নাখােশ হবেন, অতএব চাকরিতে ক্ষতি হবে, এই আশঙ্কায় আরবাব ছিলেন ক্ষুব্ধ। তিনি উচ্চস্বরে কর্নেল মাসুদকে আদেশ করলেন যেন সড়ক-বন্ধক এই মুহূর্তেই সরানাে হয়।

মাসুদও সৈন্যদেরকে সেই আদেশ দিলেন এবং সৈনিকরা আদেশ মেনে গাড়িগুলােকে সরাতে লাগলাে। কিন্তু আরবাবের চিৎকার শােনা গেল, ‘গুলি কর, গুলি কর এক্ষুণি। মাসুদ বােঝাতে চেষ্টা করলেন যে, এই অগ্নিঝড়া সময়ে জনতার ওপর গুলি চালানাে ও বারুদের স্কুপে অগ্নিসংযােগ করা একই কথা। তবুও চিত্তার, গুলি কর। অগত্যা মাসুদ গুলির হুকুম দিলেন। কিন্তু তার অধস্তন অফিসার জনতার মাথার ওপর দিয়ে বেশির ভাগ গুলি করলেন। এই দেখে আরবাব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন; কিন্তু ততক্ষণে সড়ক-বন্ধক সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আরবাব ঢাকা ফিরলেন। তবে দিনটি মাসুদের জন্য ভালাে যায় নি। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট সশস্ত্র থাকার কারণে তাদের নিরস্ত্র করা গেল না এবং রেল ক্রসিংয়ে বাঙালির দ্বারা গুলি চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা করা গেল না, এই ক্ষোভ আরবাবের মন থেকে মুছে যাওয়ার কথা নয়। এসব ব্যর্থতার জন্য মাসুদই দায়ী। অতএব, তাকে ২৩ মার্চ ঢাকায় ডেকে এনে বন্দি করা হলাে। তার স্থলে আর একজন বাঙালি লে. কর্নেল রকিবকে দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হলাে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে দিয়ে রকিবের কাছে চার্জ হস্তান্তর করার প্রহসনও ঠিকমতাে করা হলাে। কিন্তু রকিবকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গ্রহণ না করে ২৮ মার্চ বিদ্রোহ করে সমস্ত যুদ্ধ সরঞ্জামাদিসহ ময়মনসিংহ চলে গিয়ে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করলাে। বলা বাহুল্য, এই বিদ্রোহের দায়ভারও বাধা মুরগি’ কর্নেল মাসুদের ওপর চাপানাে হলাে। ২৮ মার্চ তাকে ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোয়ার্টার গার্ডের এক কামরায় বন্দি করা হয়।

মাসুদ ২৫/২৬ মার্চ রাতে ঢাকার হত্যাযজ্ঞের প্রচণ্ড গােলাগুলি বিস্ফোরণের শব্দ নিজেই শুনলেন ও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘােষণাও শুনলেন।  এখানে বলে রাখা দরকার যে, রেজিমেন্টাল কোয়ার্টার গার্ডে অন্তরীণ হয়। কেবল সিপাহি পদবির সৈনিকরা। এর চাইতে উচ্চপদস্থ, এমনকি হাবিলদার ও সুবেদারদেরও কোয়ার্টার গার্ডে অন্তরীণ হওয়ার নিয়ম নেই। তারা বন্দি হলে তাদের ওপর গার্ড দিয়ে তাদের কামরাতেই বন্দি অবস্থায় রাখতে হবে। ভাগ্যের পরিহাস, কয়েকদিন পর মেজর মান্নান (পরে মন্ত্রী এবং বর্তমানে বিকল্প ধারার নেতা), কর্নেল রকিব (দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক) এলেন এই কোয়াটার গার্ডের পাশের কামরা দুটোতে। পরে তাদেরকে পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসাররা এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাসুদ ওখানেই থেকে গেলেন।  এপ্রিল মাসের ৭ কি ৮ তারিখে মাসুদকে পেছন-মােড়া করে হাতকড়া পুরানাে হলাে ও বিমানে কলম্বাে হয়ে করাচি নেয়া হলাে। তবে মাসুদ এ সময় একটি কারণে স্রষ্টার প্রতি হাজার শুকুর প্রকাশ করেন যে, শেষ মুহূর্তে ১৪ ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ সাদুল্লাহ তাকে বিমানে দেখতে পান এবং হুকুম দেন যে মাসুদের হাতকড়াটা পেছন মুড়ে না দিয়ে হাত দুটো সামনে রেখে দেয়া হােক। বিমানযাত্রায় এইরকমভাবে দু’হাতে কড়া পরা অবস্থায় মাসুদ বাথরুমে যাওয়া ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় কাজ সারতেন। হাতকড়া পরা অবস্থায় মাসুদ করাচি পৌছেন ও ৬৬ মিডিয়াস কামান বাহিনীর কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। পুনরায় বিধাতার নিকট মাসুদের হাজার শুকরিয়া, তাঁকে কোয়ার্টার গার্ডে একজন পাঞ্জাবি সুবেদার চিনতে পারেন ও তাঁর হাতকড়া খুলে দেন। মাসুদ অনেক দিন পর রাতে দু’হাত ভােলা অবস্থায় থাকতে পেরে একেবারে মরার মতাে ঘুমােন।  পরদিন ওই কামান বাহিনীর রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট মাসুদকে কোয়ার্টার গার্ডে দেখতে এসে তাঁর কবজির ঘড়িটি খুলে নিয়ে বলে, “তুমি একজন গাদ্দার ও বিহারিদের কসাই। তােমার হাতে ঘড়ি শােভা পায় না।’ পরে ঘড়িটি অ্যাডজুট্যান্টের হাতের শােভা বর্ধন করেছিল।

এর দু’তিন দিন পর মাসুদকে নেয়া হলাে বিমানবন্দরে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের দেখা। তাঁরা একসাথে লাহাের গেলেন। লাহাের থেকে তাদের নেয়া হলাে ঝিলাম শহর থেকে প্রায় মাইল বিশেষ দূরে এক জায়গায় খারিয়ান নামের ছাউনির কাছে, বান্নি হাইওয়েজের এক ভাঙাচোরা রেস্ট হাউজে। মাসুদকে রাখা হলাে সিড়ির নিচে ভৃত্যদের জন্য তৈরি একটি কামরায় আর পরিবারসহ মজুমদারকে রাখা হলাে ওপরের তলায় দু’কামরাতে। তবে তাদের কাউকেও বলা হয় নি যে, অপরজনও এখানে আছেন। কিন্তু তারা জানতে পেরেছিলেন কথাটা। ওখানে তাদেরকে কোনাে পত্রিকা দেয়া হতাে না, রেডিওর তাে প্রশ্নই ওঠে না। জুন-জুলাই মাসে মাসুদকে নিয়ে যাওয়া হলাে ঝিলাম সেনাছাউনিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। প্রশ্নের ধরন একই। মাসুদ নিজের নাম করে জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসের কোনাে একদিন সিনিয়র বাঙালি অফিসারদের, যেমন (অব.) মেজর জেনারেল মজিদ, (অব.) কর্নেল ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার প্রমুখকে জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে তার রেজিমেন্টাল মেসে দাওয়াত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা পেশ করেন। পরিকল্পনাটি কি তা মাসুদের মুখে শুনতে হবে। মজুমদারের মতাে, মাসুদও চেষ্টা করতেন এটা বােঝাতে যে এই পিকনিক’ ব্যাপারটিই বাস্তব নয়, কখনাে ঘটে নি, সম্পূর্ণ কাল্পনিক, তাই কোনাে পরিকল্পনার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রশ্নকারীরাও নাছােড়বান্দা ওপর থেকে আদেশ, এই পরিকল্পনাটির বিস্তারিত বিবরণ মাসুদের মুখ থেকে শুনতে হবে।  মজুমদারের তুলনায় মাসুদ আর একটি ব্যাপারে অভাগা ছিলেন। তার পরিবার ছিল ঢাকায় তাকে পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছে একা। তাছাড়া তিনি পদেও ব্রিগেডিয়ারের চেয়ে নিচে। যদিও পৃথিবীর সমস্ত দেশেই লে. কর্নেলকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি/সম্রাট নিজ দস্তখতে চিঠি লিখে তার হাতে স্বাধীনভাবে একটি রেজিমেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। অতএব, কয়েদি হিসেবেও তার প্রাপ্য সম্মান ছিল অনেক উর্ধ্বে। দুনিয়ার সমস্ত দেশ মিলে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে যে জেনেভা চুক্তি’ প্রণয়ন করেছে, সেই অনুযায়ী তাকে কিছুতেই সিপাহিদের সাথে কোয়ার্টার গার্ডে রাখা যায় না।

কিন্তু এই কর্মগুলাে সাধিত হয়েছে পাকিস্তান নামক দেশের ‘অপরাজেয়’ সামরিক বাহিনী দ্বারা। এই সেনাবাহিনী ইতােপূর্বে আর একজন বাঙালি লে, কর্নেল মুশতাককে ১৪ ডিভিশন সদর দফতরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। মুশতাকের দোষ ছিল যে, তিনি নিজে না হলেও তাঁর জাতিভাই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক গুণ্ডারা পাকিস্তানের ‘আপন ভাই’ বিহারিদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। অতএব, শাস্তি ভােগ করতে হবে মুশতাককে। হাতকড়া পরে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কলম্বাে হয়ে করাচি আসা একজন। লে. কর্নেল রাতে শােয়ার জন্য জায়গা পেলেন করাচির একটি রেজিমেন্টের কোয়াটার গার্ডের মেঝেতে। তার খাওয়ার পানীয় জল ও শৌচকর্মের জন্য একমাত্র সম্বল একটি এলুমিনিয়ামের মগ। অতএব মজুমদারের মতে, তারও মনে প্রশ্ন ওঠার কথা, কোন গুনাহার জন্য তিনি পাকিস্তান নামক দেশটির প্রতিরক্ষায় নিজের প্রাণ বাজি রেখে পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় সেনাবাহিনীতে যােগদান করেছিলেন। রাজনীতি তাে তিনি কখনাে করেন নি। রাজনীতি তিনি বুঝতেনও না। রাজনীতি তাে বাস্তব পক্ষে করেছেন সেই জেনারেল, যিনি ইয়াহিয়ার একান্তজন, ছিলেন এবং যিনি ‘৭১ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গভবনে এক ভূরিভােজের পরে প্রশ্নোত্তরকালে বলেছিলেন, “তােমরা চিন্তা করাে না। আমরা কিছুতেই এই কৃষ্ণচর্ম হারামিদের (বাঙালিদের) হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেবাে না (কর্নেল সিদ্দিক সালেক, উইটনেস টু সারেন্ডার’, ২৭ পৃষ্ঠা)।  কোনাে অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই এমন অমানবিক শাস্তি ভােগকালে কর্নেল মাসুদের চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত হওয়ারই কথা। এমন সময় মাসুদ দেখলেন যে, ঝিলাম ছাউনিতে তার প্রশ্নকর্তা তার বন্ধু/পূর্বপরিচিত কর্নেল আনজুম নামক এক পাঞ্জাবি অফিসার। মাসুদের বিধ্বস্ত মনেও আশার সঞ্চার হলাে যে, হয়তাে এই পুরনাে বন্ধু তার কথা ও তার অবস্থা বুঝতে পারবে; কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। আনজুম মাসুদের স্বগােত্রীয় নয়। গায়ের রঙ আনজুমের চাইতে ফর্সা হলেও মাসুদ কৃষ্ণচর্ম বাঙালি হারামিদের একজন বৈ তাে নয়। তাছাড়া আনজুমের ওপর পরিষ্কার আদেশ, রাষ্ট্রদ্রোহী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কয়েকজন সিনিয়র। বাঙালি অফিসারের সাক্ষ্য সগ্রহ করতে হবে। অতএব বন্ধুত্ব পরে, চাকরি ও জাতিগত আনুগত্য তার আগে । তাই আনজুমের জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব, অন্য পাঞ্জাবি। অফিসারের জেরার চাইতে কোনাে ব্যতিক্রমধর্মী হয় নি।

বেচারা মাসুদ! অবশেষে আগস্ট মাসে হুকুম এলাে, সেই অনুযায়ী মাসুদকেও লাহাের কোর্টের স্পেশাল ইন্টারােগেশন সেল অর্থাৎ জিজ্ঞাসাবাদের পশুসুলভ সেলে নিয়ে যাওয়া হলাে। মজুমদার তাে ক্রমিক নম্বর অনুসারে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যেভাবে যা মনে আসে বলে যাচ্ছিলেন। মাসুদ অনেকটা নিখুঁতভাবেই ক্রমিক নম্বরগুলাে মনে রেখেছিলেন।  প্রথম দিন স্বাভাবিক ব্যবহারের পরে যখন মাসুদ ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে কিছু জানেন না বললেন তখন ইন্সপেক্টর দুররানি, ইন্সপেক্টর সরওয়ার ও ইন্সপেক্টর ইসলাম নামে তিন পশুর একজন তাকে প্রচণ্ড জোরে থাবা মারলাে। মাসুদ কেবল ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলেন না, জ্ঞানও হারালেন। মজুমদার ছিলেন খেলাধুলাে করা পেশিবান শক্তসামর্থ্য লােক তার সহ্যশক্তি ছিল গড়পড়তা বাঙালির চাইতে অধিক; কিন্তু মাসুদের শারীরিক গঠন ছিল অনেকটা নাজুক দ্বিতীয় দিনের নির্যাতন ভিন্নরূপ : মাসুদের পা দুটো একটি দড়ির সাথে বেঁধে ‘পুলির সাহায্যে ওপর দিকে টেনে তােলা হলাে। পা রইলাে ওপরে, মাথা নিচে। ঝুলবার জন্য নির্মিত লােহার বারের সাথে যুক্ত পুলি’ দিয়ে তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হলাে কতােক্ষণ তা মাসুদ জানেন না; কারণ তিনি কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তৃতীয় দিনের নির্যাতন। একটি বরফের চাঁই (Slab) মাটিতে রাখা হলাে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ছ’ফুট এবং প্রস্থ ফুট তিনেক। তিনজন পুলিশ অফিসার মাসুদকে ধরে ওই বরফের ওপর শুইয়ে দিয়ে চেপে ধরে রাখলাে। অতঃপর পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রশ্ন, “কিয়া কর্নেল সাহাব, কুছ ঠাণ্ডা লাগ রাহা হ্যায়?’ মাসুদ উত্তর দেয়ার প্রয়ােজন বােধ করেন নি। একই কৌতুকের সুরে উপদেশ, ‘ফের কর্নেল সাহাব উস্ দিন যাে যাে বাতে হুয়ি, ও সাচ বাতা দো।’ মাসুদের অনুরােধ, আপনারা আমাকে যা বলতে বলবেন আমি তাই বলবাে। আপনারা একটি কাগজে লিখে দিন। আমার একটাই অনুরােধ, আমাকে আর নির্যাতন করার প্রয়ােজন নেই।’ ওদেরও একই উত্তর, “জি না। তােমার সােনা মুখ থেকে কথাগুলাে আমরা শুনতে চাই।’ এখানেই ট্রাজেডি, ঘটনাটি ঘটেই নি অথচ সেখানে কি হয়েছিল তাই বলতে হবে সবিস্তারে। মাসুদের কাকুতি-মিনতি খুব লম্বা সময় ধরে চলে নি। বিধাতা হয়তাে একেবারে নির্দয় নন মাসুদের শরীর পেশিবহুল ছিল না, তাই জ্ঞান হারাতেও তাঁর খুব বেশি সময় লাগে নি। যখন জ্ঞান ফিরলাে ততােক্ষণে তিনি তাঁর খাটিয়ার বিছানায় । 

চতুর্থ দিন। প্রশ্ন একই। জেরাকালে প্রশ্নকারীরা তাদের জ্বলন্ত সিগারেট মাসুদের শরীরে চেপে ধরে। নিবু নিবু অবস্থায় সিগারেটে আবার দু’চার টান। এরপর আবার মাসুদের গায়ে সিগারেট নিভানাে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন। ওই একই প্রশ্ন। আর মাসুদেরও একই অনুরােধ। পঞ্চম দিন। মাসুদকে উলঙ্গ করা হলাে। একটি তপ্ত লােহার ডাণ্ডা তার পশ্চাদ্দেশে প্রবেশ করানাের চেষ্টা চললাে মাসুদের চিৎকার, কিন্তু পুলিশদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের একই প্রশ্ন। মাসুদের একই অনুরােধ। প্রথম লৌহ ডাণ্ডাটি কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দ্বিতীয় তপ্তডাণ্ডা আনা হলাে। মাসুদের পশ্চাদ্দেশ জ্বলে গেল। পরে তা দগদগে ঘায়ে পরিণত হয়। জ্ঞান হারানাের পরই মাসুদ সেদিনের মতাে নিষ্কৃতি পায় পরের দিন এবং তার পরের দিন পুনরায় চলে জিজ্ঞাসাবাদ। প্রশ্ন একই; কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বেশি নির্যাতনের রূপ পশুসুলভ বললে কম বলা হয় এবার আসে বৈদ্যুতিক শক। এই বৈদ্যুতিক শক মজুমদারকে যে পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছিল তারই অনুরূপ। তবে মাসুদকে একাধিকবার দেয়া। হয়েছিল। হয়তাে মজুমদারকেও একাধিকবার; কিন্তু তিনি বিস্তারিত বলেন নি। তার হৃদয়বিদারক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মজুমদার ভেঙে পড়েছিলেন তবে মাসুদ যেহেতু ঘটনার অনেক দিন পরে বর্ণনাগুলাে যতােদূর মনে করতে পেরেছেন বলেছেন, তাই অনেকটা আবেগবিহীনভাবে দিতে পেরেছিলেন মাসুদকে দেয়া বৈদ্যুতিক শকের তারগুলাের একটি ছিল তার পশ্চাদ্দেশে।

পূর্বেই সেখানটায় ঘা হয়ে গিয়েছিল। শকের ফলে এখন ঘা এতােটা পেকে যায় যে তাকে ডাক্তারি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয়। জেরাকারীরা। কিন্তু নাজুক পেশিহীন শরীরের অধিকারী মাসুদের জন্য এই শকগুলাে সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ইতােপূর্বে তাকে পরপর আর একটি অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। প্রশ্নকারী তাঁকে একটি বেঞ্চে বসালাে। তার এক হাতে একটি ধারালাে সুচ, অন্য হাত দিয়ে সে মাসুদের একটি হাত ধরলাে। সুচটির অগ্রভাগ মাসুদের আঙুলের নখের নিচে ধরে বললাে, কর্নেল সাহাব, বলবে কি জয়দেবপুরের ষড়যন্ত্রে কি পরিকল্পনা। করেছিলে, না কি সুচটি বসিয়ে দেব নখের নিচে?’ মাসুদের একই উত্তর, যে। ঘটনা ঘটেই নি, সেটা সম্বন্ধে কী বলবেন? তার চাইতে আপনারা যা লিখে দেবেন আমি তাই বলবাে।’ | মাসুদের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুচের অনেকটা ঢুকে গেছে তার নখের ঠিক পেছনের মাংসে, প্রচণ্ড চিৎকার করে মাসুদ বাঁকা হয়ে গেলেন অবর্ণনীয় যন্ত্রণায়। ব্যথা যে এমন প্রচণ্ড হতে পারে মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না মাসুদ চেষ্টা করলেন আঙুল সরিয়ে নিতে, কিন্তু শক্ত করে ধরা তার হাত, কিছুই। করার উপায় নেই। পুনরায় একই প্রশ্ন, কি পরিকল্পনা করা হয়েছিল উত্তর দেয়া দূরের কথা, মাসুদের চিন্তাশক্তিও লােপ পাচ্ছিল। অতএব, সুচ বেঁধাবার পরের কথাটি পুরােপুরি কার্যকর হওয়ার আগেই মাসুদ জ্ঞানহীন, বিছানায় শুয়ে। জ্ঞান ফেরার পর মাসুদের মনে পড়লাে ১৯৪৮ সালের সেই দিনটির। কথা- যেদিন সামরিক বাহিনীর নির্বাচনী বাের্ড তাঁকে কমিশন্ড অফিসার হওয়ার যােগ্য ঘােষণা করে সম্মানিত করে সাফল্যের গর্বে মাসুদের বুক উচু হয়েছিল সেদিন। আনন্দে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। বিধাতার অশেষ রহমত। যে, মাসুদকে ভবিষ্যৎ জানবার শক্তি তিনি দেন নি। দিলে মাসুদ সেদিন ওই গর্বিত ও আনন্দিত মুহুর্তটি উপভােগ করা থেকে বঞ্চিত হতেন বলা হয়ে থাকে দুর্ভাগ্য একা আসে না। অন্তত মাসুদের বেলায় আসে নি। যখন মাসুদের পশ্চাদ্দেশে দগদগে ঘা, হাতের আঙুল দিয়ে কিছু ছুঁতে পারেন। , তখন খবর এলাে যে, ঢাকায় তার ছােট ছেলে নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত এবং সে বর্তমানে (DI List-ভুক্ত বিপজ্জনক রােগী) অর্থাৎ যেকোনাে দিন জীবনাবসান হতে পারে। সামরিক বাহিনীর বিধান অনুসারে কেউ DI List-এ থাকলে তার Next of Kin-কে জানাতেই হবে। অতএব, ছেলের পিতা। মাসুদকে জানাতে হলাে। মাসুদ প্রথম শােনেন তার পুত্রের অসুস্থতার কথা, পরে খবর পেলেন যে তার পুত্র বেশ আগে থেকেই নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিএমএইচে নেয়া হয়েছিল। পাঞ্জাবি ডাক্তার বলেছেন, কী? গাদ্দারের (বিশ্বাসঘাতকের) বাচ্চার চিকিৎসা?

আমার দ্বারা কিংবা সি এম এইচ দ্বারা হবে না। যদিও ডাক্তার ভালাে করেই জানতাে যে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আহত বন্দিকেও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা অপরাধ। মাসুদের মনের অবস্থা অকল্পনীয়। ছেলের অবস্থা যখন এতােটাই খারাপ যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি, কেবল তখনই অন্য একজন পাকিস্তানি ডাক্তার তাকে ভর্তি করলাে সি এম এইচে এবং মাসুদকে আনুষ্ঠানিকভাবে খবর দিলাে।  মাসুদের এই অবস্থায় লাহাের ফোর্টের বিশেষ জেরাকারীরা তাঁকে তৃতীয় বাঙালি সাথি লে. কর্নেল এ, বি, এম, ইয়াসিনের লিখিত স্বীকৃতিমূলক জবানবন্দি এনে পড়ে শােনান। মাসুদের কথায়, তিনি তা শােনেন নি, শােনার ইচ্ছেও ছিল না, শােনার দরকারও মনে হয় নি। অবাধ, মুক্ত ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের ফলে সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী দলের নেতা শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে বাংলাদেশে পাঞ্জাবের ক্ষমতা দখল বেশি রকম বেখাপ্পা দেখাবে, অতএব মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী কিংবা অন্য অপরাধে, কিংবা কোনাে দুর্ঘটনায় হত্যা করতেই হবে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, লে. কর্নেল। ইয়াসিন ও লে. কর্নেল মাসুদ- এই তিনজন বাঙালি অফিসার পরিস্থিতির বলির পাঠা বৈ তাে আর কিছু নয়। অতএব মাসুদ সেদিন অযথা নির্যাতন থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে দস্তখত করেছিলেন।  এরপর মাসুদকে লায়ালপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় ও পুত্রের অসুস্থতা। সম্বন্ধে খবর দিয়ে বলা হয় যে, ছেলের অবস্থা উন্নতির দিকে। হয়তাে এ যাত্রা বেঁচেই যাবে। অতএব তাকে আদেশ করা হলাে, ওই কয়েক পৃষ্ঠা টাইপ করা জবানবন্দি অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করতে। মাসুদ তাই করতে লাগলেন।  সেপ্টেম্বরের ৩ কি ৪ তারিখে শেখ সাহেবের ক্যাঙারু বিচার শুরু হলাে লায়ালপুর জেলে। আদালতটি একটি সামরিক আদালত। ব্রিগেডিয়ার রহিম (প্রাক্তন বালুচ রেজিমেন্টের) আদালতের প্রেসিডেন্ট আর রয়েছে চারজন সদস্য। এই চার সদস্যের তিনজন সামরিক অফিসার এবং একজন বেসামরিক। মাসুদ আদেশমতাে বিচারকক্ষে উপস্থিত হলেন সামরিক উর্দি পরে। তিনি সেখানে দেখলেন শেখ মুজিবকে পাইপ মুখে, নির্বিকার, বরং কিঞ্চিৎ হাসি হাসি মুখ । মাসুদকে তিনি চিনতে পারলেন। সেই ১৯৪৪ সালের কলকাতা বেকার হােস্টেলের মাসুদ। শেখ সাহেবকে দেখে মাসুদের মাথাও নত হয়ে এলাে। শেখ সাহেবও তাঁর দিকে তাকিয়ে, মুখে মৃদু হাসি।

বিচার শুরু হলাে। মাসুদের সবচাইতে বড় ভয় ছিল ব্যারিস্টার ব্রোহির জেরা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দেয়া লিখিত জবানবন্দি তার মুখস্থই ছিল; কিন্তু তিনি তাে অনেক কিছুই জানতেন না। যেমন শেখ সাহেবের ধানমণ্ডির বাড়ি ইত্যাদি সম্বন্ধে এসব ব্যাপারে বিবাদি পক্ষের আইনজীবীর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে মাসুদ বেসামাল হয়ে পড়তেন ও মিথ্যাবাদী সাক্ষী প্রমাণিত হতেন। অতএব, ব্রোহির ভয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। কিন্তু ভাগ্য ভালাে, ব্রোহি কোনাে জেরাই করলেন না।  মাসুদের জান বাঁচলাে। তবে মাসুদ ভেবে পেলেন না, ব্রোহি শেখ সাহেবের ডিফেন্স ল ইয়ার হয়েও বাদিপক্ষের সাক্ষী কর্নেল মাসুদকে কোনাে প্রশ্নই করলেন —জেরা করা তাে দূরে থাক। মাসুদ অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। এমন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, তিনি জেরা করলে তাে উপায় থাকতাে না! বরং প্রিসাইডিং বিচারক ব্রিগেডিয়ার রহিমই কয়েকটা প্রশ্ন করলেন মাসুদকে শেখ সাহেবের বাড়ির কোন কামরায় শেখ সাহেবের সঙ্গে মাসুদের দেখা, একদা একটি মিছিলে মতিয়া চৌধুরী (তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা, পরে আওয়ামী লীগের কৃষিমন্ত্রী) কি একটা আপত্তিকর বক্তৃতা দিয়েছেন সেই সব সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন। মাসুদ দেখি নাই, জানি না বলে উত্তর দিলেন। রহিম আর প্রশ্ন করেন নি।  মাসুদ এই বিচারকক্ষে আনুমানিক আধ ঘণ্টা ছিলেন। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার বন্দি সেলে। এর কয়েক দিন পরে তাকে শােনানাে হয় যে তার অসুস্থ ছেলেকে দেখার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানাে হবে। মাসুদের মনে ভয় ছেলে বেঁচে আছে তাে? যা হােক মাসুদকে ঢাকায় পাঠানাে হলাে ৭ অক্টোবর, ১৯৭১।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা