You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.04 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শনির প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে | ক্ষমতার দর্প চূর্ণ হয়ে যাবেই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৪ঠা এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, ২১শে চৈত্র, ১৩৮০

শনির প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে

চলতি বিশ্বাসে যে কোনো অশুভ পরিস্থিতির জন্য সাধারণত শনি গ্রহের প্রভাবের কথা বলা হয়। ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হচ্ছে সারা বাংলাদেশে এখন শনির ব্যাদান মুখে ধড় ফড় করছে।
সবাই ভেবে নিয়েছে স্বাধীনতা মানেই যা ইচ্ছা তাই করার অবাধ ক্ষমতা। তাতে আইন লঙ্ঘন হোক, সামাজিক দুর্নীতি হোক কিংবা ঠাকুরদাদা বেজারই হোক-কুছ পরোয়া নেই। তাই প্রায়ই দেখা যাচ্ছে যে, কথায় কথায় মিল কারখানা বন্ধ, ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত, লুটতরাজ, ছিনতাই, বস্রহীন দ্রব্যমূল্যের দৌরাত্ম্য সব মিলিয়ে সারা দেশ এখন উম্মত্ত।
কিন্তু সত্যি কি স্বাধীনতার অর্থ তাই? একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সত্তিকারের স্বাধীন রূপ প্রকাশ করতে কয়েকটি নির্দিষ্ট কর্তব্যভার ও দায়িত্ব পালন আছে। যে লোক সেসব কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করে একমাত্র সেই প্রকৃত স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দাবি করতে পারে। আর যে সে সব দায়িত্ব অবহেলা করে অন্য কিছু করে, সেই নিজে ও দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করে। তাকে প্রকৃত স্বাধীন নাগরিক বলা চলে না। কিছু প্রতিশ্রুতি, কিছু অঙ্গীকার ও কিছু জাতীয় করের বিনিময় পৃথিবীর সব খানেই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুখ ও নিরাপত্তার ভার বহন করে। তবে এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েই অপরাধীর শাস্তি বিধান করে। এই অঙ্গীকার আর কিছু নয়, রাষ্ট্রে প্রচলিত আইন-শৃঙ্খলা আচার-পদ্ধতি ইত্যাদি পালন করে জাতীয় কল্যাণের সুনাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করার অঙ্গীকার।
কিন্তু মনে হচ্ছে, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে দেশে এ বালাই যেন উঠেই গেছে। কারো প্রতি কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, কারও প্রতি কারো ন্যূনতম মানবিক বোধটুকু নেই, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, আর কত নেই। ‘নেই’-এর দৌরাত্ম্যে সারাদেশ নাভিশ্বাস। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, বাড়লে কমার কথা নেই, মিলে উৎপাদন নেই। জীবনের নিশ্চয়তা নেই, হরতাল-ধর্মঘট এর কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যা কিছু মনে আসে তার একটা করলেই যেন বাহাদুরি ভাব।
তা’না হলে কি করে সামান্য সামান্য ঘটনায় কথায় কথায় সারাদেশে এত নৈরাজ্য চলছে?
কিছুদিন আগে শোনা গেছিল, কার সঙ্গে কার জানি একটা সামান্য সংঘর্ষের দরুন একদিন কমলাপুর স্টেশনের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। আবার সংবাদ এসেছে চট্টগ্রাম স্টেশনে অরাজকতা। গত কয়েকদিন ধরেই নাকি এর জের চলছে আর দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দেশের সাধারণ দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি, তাতে বিবদমান কোন পক্ষই সম্পূর্ণ নির্দোষিতা দাবি করতে পারে না অহম শক্তির প্রতিযোগিতা আর পারস্পারিক অসহনশীলতা থেকেই এ বিবাদের শুরু।
সবারই যখন আলাদা আলাদা বিভাগ, ক্ষমতা, দায়িত্ব ইত্যাদি আছে তখন এ বিবাদ হবে কেন? নিশ্চয়ই কেউ কারো মাঝে নাক গলিয়ে ছিল। নিশ্চয়ই কেউ আইনকে অশ্রদ্ধা করেছিল। তা না হলে এসব বিবাদ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
আর বিবাদই যদি হলো তখন বেয়াইর উপর গোসসা করে থাল রেখে কলা পাতায় খাওয়া কেন? আইনের মাধ্যমে বা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি কি একেবারেই সম্ভব ছিল না? আবার সামান্য একটা দলীয় কোন্দলের জন্য দেশের সব মানুষ কিভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হবে কেন?
আমরা স্বীকার করি, রেল কর্মীদের হয়তো সত্যিই দোষ কম ছিল কিংবা পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের অনেক অভিযোগও ছিল। কিন্তু সে খোদ মেটানোর অনেক রাস্তাও ছিল। পুলিশের ওপর প্রতিশোধ নিতে সাধারণ মানুষকে এত দুর্ভোগ দেয়া কেন? রেল কর্মীদের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের অপরাপর বিভাগীয় যদি এমন ‘বাংলা বাদ’ পদ্ধতি চালু হয় তবে দেশের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?
তাই, আমরা এধরণের বাড়াবাড়িকে কিছুতেই সমস্যা সমাধানের পথে উপযুক্ত ব্যবস্থা বলে মনে করতে পারছিনা।
দেশে যখন আইন আছে, তখন আইনের মাধ্যমে এসব বিরোধ মিটিয়ে ফেলার সবচেয়ে সমীচীন। নানান সমস্যাগ্রস্থ অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কাছে হরতাল-ধর্মঘট আর বনদি পদ্ধতি একান্তই আত্মহত্যা মূলক। কারণ, একমাত্র এসব গোলেমেলে সুযোগের হাতিয়ার কে পুঁজি করেই দেশের শত্রু ও সমাজবিরোধীরা দেশের উপর মৃত্যু আঘাত হানছে। তাদের তৎপরতা শুধু দেশের সর্বত্রই নয়, রীতিমতো ব্যাপক আকার নিয়েছে। এসব সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতেই হবে। তা না হলে কারোরই রেহাই নেই।

ক্ষমতার দর্প চূর্ণ হয়ে যাবেই

বিশ্ব শান্তি পরিষদের আহবানে গত পরশুদিন সারাবিশ্বে ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের জন্য প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়েছে। গত পরশুদিন বায়তুল মোকাররমে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় বিভিন্ন বক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এহেন যুদ্ধংদেহী তৎপরতাকে তীব্রভাবে নিন্দা করেছেন। তারা মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব তথা সারা এশিয়ায় উত্তেজনা জিইয়ে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র দিয়াগো গার্সিয়া ঘাঁটি নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। ঘাঁটি নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো শান্তি বিঘ্নিত করা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করা। এই উত্তেজনার ফলে এতদঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত হবে এবং শান্তি ও প্রগতির পথে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এহেন ঘৃণ্য ঘাঁটি স্থাপনের পেছনে চীনের সমর্থন রয়েছে বলে বিভিন্ন বক্তা অভিমত পোষণ করেছেন। অনুন্নত দেশের উন্নতির জন্য শান্তি হলো অপরিহার্য পূর্ব শর্ত। কিন্তু মার্কিনী নীতি বিশ্বের উন্নয়নমুখী দেশ গুলোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপ এর মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের পেছনে শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য নয়-সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা সমাবেশ করাই তার লক্ষ্য। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়ন এশীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শান্তি, মৈত্রী ও প্রগতির সম্পর্ক রয়েছে; তার মধ্যে যুদ্ধের কোনো বিষয় নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের দেশগুলোতে তাবেদারে পরিণত করতে চায়-আর তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তারই, যারা এ অঞ্চলে প্রতিক্রিয়া ও হঠকারীতার কায়েমি স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে। প্রতিবাদ সভায় বক্তাগণ এই মার্কিন আগ্রাসন ও তাবেদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারত মহাসাগরে দিয়াগো গার্সিয়া একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। একে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তা যেমন ভয়াবহ, তেমনি উদ্বেগজনক ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত উপমহাদেশে তার শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় এবং সোভিয়েত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করেছে। গার্সিয়া দ্বীপ এ কারণে পেন্টাগন রানওয়ে সম্প্রসারণ রিফুয়েলিং ব্যবস্থা করার নামে গড়ে তুলছে ভয়াবহ সাবমেরিন ঘাঁটি। এই কারণে প্রতিবাদ এসেছে সর্বপ্রথম ভারত, বাংলাদেশ, সিংহল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালদ্বীপ, মাদাগাস্কার, মরিসাস এবং মালয়েশিয়া থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ এ ব্যাপারে প্রতিবাদ মুখর। গত পরশুদিন বিশ্বব্যাপী শান্তি পরিষদের ডাকে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এতদঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ন্যক্কারজনক তৎপরতা শুরু করেছে তার শান্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে পেন্টাগন পিছপা হতে হয়েছে। সর্বশেষে ভিয়েতনাম থেকে মার খাওয়ায় আজ তারা ভারত মহাসাগরের ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে উঠেছে। প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রসারণবাদী চিনা নেতৃত্বেও এ ব্যাপারে মার্কিন সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা করি। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে আকুল আহ্বান জানাব এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠার জন্য। জাতিসংঘের এ ব্যাপারে কিছু করণীয় আছে বলে আমরা মনে করি। সর্বোপরি আমরা বিশ্বাস করে ক্ষমতার দর্প যারা করে তাদের পতন অনিবার্য, বাংলাদেশের মানুষ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে তা উপলব্ধি করে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন