বাঙালিদের সম্বন্ধে পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিদের মনােভাব
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কঠোরভাবে কেবল পাকিস্তানি জনগণকে নয়, পাকিস্তানের শিক্ষিত ও অবগত শ্ৰেণীকেও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি এবং সেখানকার জনগণের মনােভাব সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ রাখতে সমর্থ হয়েছিল। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে জানবার কোনাে আগ্রহও পাকিস্তানিদের ছিল না। তারা কেবল একটি কথা জানতাে এবং খুশিমনেই। জানতাে যে, শেখ মুজিব নামক একজন দেশদ্রোহীর চেলা-চামুণ্ডারা কিছু গােলমাল করেছে পূর্ব পাকিস্তানে। তবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী তাদেরকে ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। বর্তমানে সবকিছু স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবি, যারা কখনাে পূর্ব পাকিস্তানে যায়। নি, তাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান ছিল ‘দূরান্তের’ এক স্থান। সেখানকার অধিবাসীরা নামে মুসলমান হলেও হতদরিদ্র ও নিচু শ্রেণীর আর যারা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছে এবং থেকেছে তারাও সেখানে গিয়েছে পূর্বে-গড়া মানসিকতা নিয়ে তাদের মনের ছবিটি মােটামুটি এই যে, ওখানকার ‘ছােটে ছােটে কালে কালে মানুষরা নামেমাত্র মুসলমান এবং সংস্কৃতিতে হিন্দুভাবাপন্ন। অতএব, পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিদের একটি গুরুদায়িত্ব এদেরকে সাচ্চা মুসলমানে পরিণত করা ও শাসন করা। এ সত্য প্রমাণের জন্য অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। তবে দু’একটি দিলেই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি।
ব্রিগেডিয়ার সওয়ার খান ও লে. কর্নেল সায়গল
১৯৭০ সালের শেষের দিক। আমি তখন একদিন মংলার অফিসে বসে কাজ করছি। পরদিন শবেবরাত। হঠাৎ আমার উপরস্থ ব্রিগেডিয়ার সওয়ার খান টেলিফোনে তার অফিসে চা খেতে ডাকলেন। গেলাম। সেখানে ক্যাডেট জীবনে। আমার সতীর্থ, বর্তমানে পদোন্নতি না হওয়ায় আমার নিচের পদবিতে অধিষ্ঠিত লে, কর্নেল সায়গল রয়েছেন। ওর সাথে উষ্ণভাবে করমর্দন করে বসার পর। সওয়ার খানের প্রশ্ন, আচ্ছা খলিল, জানাে তাে কাল শবেবরাত, তাই না।’ আমি হ্যা বলার পর তিনি জানতে চাইলেন শবেবরাত রাতটির তাৎপর্য কি এবং এর গুরুত্ব কোথায়। প্রথমে আমি বুঝি নি ওঁরা দু’জন আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। তাদের সামনে সেদিনকার খবরের কাগজ পড়ে ছিল, শবেবরাতের তাৎপর্য ইত্যাদি সম্বন্ধে লেখা একটি প্রবন্ধ ওপরের পৃষ্ঠাতেই ছাপা হয়েছে। আমি স্বাভাবিক মনে শবেবরাতের ব্যাখ্যা দিলাম এবং এও বললাম যে প্রচলিত বিশ্বাস আছে ওইদিন আমাদের ভাগ্য লেখা হয়, তবে এর কোনাে প্রমাণ নেই। ওঁদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম যখন সওয়ার খান প্রশ্ন করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের লােকেরা এসব জানে কি না এবং দিনটি পালন করে কি না। হাসতে হাসতে এও বললেন যে, আমি হয়তাে এসব জ্ঞান পশ্চিম পাকিস্তানে এসেই লাভ করেছি। বলাবাহুল্য, ওদের সাথে কোনাে আলােচনা অর্থহীন। সেদিনকার পত্রিকা না পড়লে এরা শবেবরাত সম্বন্ধে নিজেরাও জানতেন। পত্রিকা পড়েই তারা আমাকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পদবিতে। তফাত হলেও এরা বন্ধু। কারণ, হয়তাে-বা এঁরা দু’জনই ঝিলাম কিংবা পিণ্ডি জেলার একই প্রত্যন্ত অনুর্বর এলাকার অধিবাসী, সেনাবাহিনীর চাকরি ব্যতীত এঁদের অন্য জীবিকা দুর্লভ। বলাবাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তান ও বাঙালিকে জড়িয়ে এঁরা আমাকে যে প্রশ্ন করেছেন তাতে একদিকে যেমন নিজেদের ব্যক্তিগত মূর্খতা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রকাশ পেয়েছে বাঙালি মুসলমান তথা বাঙালিদের সম্বন্ধে তাদের প্রকট অবজ্ঞা। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ পাকিস্তানি অফিসার অনুরূপ অবজ্ঞার ভাব পােষণ করতেন বাংলাদেশ ও বাঙালি সম্বন্ধে। তেমনি পর্বত প্রমাণ ছিল তাদের অজ্ঞতা। আমরা বাঙালিরা এও জানতাম, এঁদের এ চরম মূর্খতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে গণতন্ত্র আসতে পারে না।
হয়তাে মার্শাল ল’র অবসানও সম্ভবপর নয়। ইতােপূর্বেকার এরকম আরাে অনেক ঘটনার মতাে সেদিনও নতুন করে অনুভব করেছিলাম যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই পৃথক দু’অংশকে নিয়ে একটি একক দেশ গঠন ছিল অবাস্তব। আমি উত্তর না দিয়ে উঠে পড়লাম দেখে সওয়ার খান বললেন, ‘খলিল, তুমি। আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও নি। এছাড়া আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে।’ প্রচণ্ড রাগ দমন করে হাসিমুখে বললাম, ‘স্যার, শবেবরাত সম্বন্ধে আমি কবে জ্ঞান লাভ করেছি মনে নেই। বাঙালি মুসলমানরা শবেবরাত সম্বন্ধে জানে কি তাও আমার জানা নেই। তবে আমি আপনাদের একটি প্রশ্ন করবাে। কথা দিন ‘সত্য’ উত্তর দেবেন। কারণ মিথ্যে বললে আমি বুঝতে পারবাে এবং এ সম্বন্ধে আরও প্রশ্ন করবাে। উভয়ে হা-সূচক ভাব প্রকাশ করে মাথা নাড়ার পর জিগ্যেস করলাম, “আপনারা দু’জনে কি আজ আপনাদের সামনে পড়ে থাকা পত্রিকাটি পড়ার পূর্বে জানতেন শবেবরাত বাস্তবপক্ষে কি? কিংবা এই দফতরে যতাে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার আছেন তাদের কেউ কি শবেবরাতের সত্যিকার অর্থ জানেন? আপনাদের উত্তর কিন্তু সত্যি হতে হবে। বলাবাহুল্য, দু’জনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। উত্তর দিলেন না কেউই। সওয়ার খান অনেকটা লজ্জার সাথে বললেন, ‘খলিল, দু’মিনিটের জন্য বসাে।’ বসলাম। তিনি বললেন, আমি দুঃখিত যে প্রশ্নটা করা আমার ঠিক হয় নি। সত্যি বলতে কি, আমি শবেবরাতের সঠিক ইতিহাস ও তাৎপর্য জানতাম । তুমি কিছু মনে করাে না। তবে আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে। এই কর্নেল সায়গল পূর্ব পাকিস্তানে বরিশাল জেলায় মার্শাল ল’র সময় কাজ করেছে। সে বলছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মশিক্ষা অর্থাৎ দ্বীনিয়াত শিক্ষা দেয়ার জন্য মুসলমান শিক্ষকের অভাব। তাই সেখানে বেশিরভাগ স্কুলে হিন্দু শিক্ষকরাই ইসলাম ও দীনিয়াত পড়ায়। ও নাকি নিজে দেখেছে। তাই না সায়গল?’ সায়গল সায় দিলেন, “আমি দু’একটা স্কুলে তাই দেখেছি।’ আমার রাগের মাত্রা আর এক ধাপ চড়ে গেল। তবে শান্ত সুরেই বললাম, ‘সায়গল, তুমি সেনাবাহিনীতে আমার সতীর্থ। সেনা শিক্ষা স্কুলে যেটুকু তােমাকে যা দেখেছি তাতে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তুমি সেনাবাহিনীতে মনােনীত হলে কি করে। তােমার মধ্যে প্রয়ােজনীয় নিম্নতম যােগ্যতাও দেখি নি। আজ আবার আশ্চর্য হচ্ছি, তুমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ পর্যন্ত উঠতে পেরেছাে দেখে। সে যাই হােক, তুমি কি করে বুঝলে যে শিক্ষকটি হিন্দু না মুসলমান? আর এটা কি করে বুঝলে যে তিনি ধর্ম পড়াচ্ছিলেন নাকি ইতিহাস? এতােটা বােঝার মতাে বাংলা জ্ঞান তাে তােমার নেই?’ সওয়ার খানের দিকে তাকিয়ে বললাম, এই আমার উত্তর। এবার অনুমতি করুন আমি যাই।’ বলে চলে এলাম।
তবে আসার পূর্বে এই কথাটা বলতে বলতে এলাম যে, সায়গলের মতাে অফিসার যে সেনাবাহিনীতে আছে, সেই সেনাবাহিনী দেশ শাসন করছে। তাই আমার সংশয় এ দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়। উপরে বর্ণিত ঘটনা থেকে পরিস্ফুট হবে যে, পাকিস্তানি মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা, যতাে মূর্খ বা জ্ঞানী হােক না কেন, বাঙালিদের সম্বন্ধে কতােগুলাে পূর্ব ধারণার ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সমমনা ছিল। প্রথমত, বাঙালি যেমন মুসলমান হােক না কেন, কোনােভাবে তারা পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবি মুসলমানদের সমকক্ষ নয় দ্বিতীয়ত, জাতিগতভাবে তারা নিচু শ্রেণী থেকে আগত। তৃতীয়ত, তারা দরিদ্র। অতএব, স্বাভাবিক চিন্তা ও ন্যায়শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী বাঙালিরা পাঞ্জাবি সামরিকতন্ত্রের পােষ্য। সামরিকতন্ত্রের অন্যতম দায়িত্ব বাঙালি মুসলমানদেরকে ভারতীয় হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ থেকে সার্বক্ষণিক প্রতিরক্ষা প্রদান করা। পাঞ্জাবিদের দ্বারা কাঁধে তুলে নেয়া এই অসামান্য দায়িত্ববােধের বিনিময়ে বাঙালি মুসলমানদের কর্তব্য একদিকে যেমন সাচ্চা মুসলমান হওয়া, অন্যদিকে তেমনি পাঞ্জাবি মুসলমানদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও চির অনুগত থাকা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঠিক এই মনােভাবের বিরুদ্ধেই বাঙালি সােচ্চার হয়েছে বারবার এবং পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। সােচ্চার হয়েছে ১৯৪৮ সালে, মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সেই ঘােষণার প্রতিবাদে যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৫৪ সালে ভােটের মাধ্যমে প্রতিবাদ করলাে মুসলিম লীগ সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে। বাঙালির অধিকার আদায়ে সমগ্র বাঙালি জাতি রুখে দাঁড়িয়েছে ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে বিভাগ-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অর্থাৎ পাকিস্তান অর্জনের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কেও এই মধ্যবিত্ত ও অর্ধশিক্ষিত সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রের তেমন কিছু জানা ছিল না। অন্যদিকে এ সম্বন্ধে ভাসা ভাসা কিছু জ্ঞান থাকলেও এই সংগ্রামে বাঙালির ভূমিকার চাইতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিজেদের ভূমিকা বেশি উজ্জ্বল ভাবার প্রবণতা প্রকট ছিল এদেরকে মনে করিয়ে দিতে হতাে যে, নেহায়েত অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান চেয়েছিল এবং এজন্য সংগ্রামও করেছে, এর পক্ষে সামগ্রিকভাবে ভােট দিয়েছে পাকিস্তানে একমাত্র সিন্ধু প্রদেশের জনগণ ও সরকার ব্যতীত পাকিস্তানের পক্ষে প্রাথমিক স্তরে কোনাে মুসলমান-প্রধান প্রদেশ ছিল না। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে শােচনীয় পরাজয় এবং ইতিহাসের পরম কাপুরুষােচিত আত্মসমর্পণ করার পর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেউ কেউ স্বীকার করতে শুরু করেছে যে তারা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পশুসুলভ অত্যাচার চালিয়েছিল।
ব্রিগেডিয়ার তােজাম্মেলের মন্তব্য
এ ক্ষেত্রে জলজ্যান্ত এক উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭১ সালে হিলি সেক্টরের ব্রিগেড। কমান্ডার (পরে মেজর জেনারেল) তােজাম্মেল হুসেনের মন্তব্য। পূর্বেই বলা হয়েছে এই ব্যক্তি আমার বন্ধু। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে যুদ্ধের জন্য যাওয়ার পূর্বে আমি তাকে উপদেশ দিয়েছিলাম, তুমি ওখানে যেও না। কারণ ওখানে সব শেষ হয়ে গেছে।’ কিন্তু তিনি জবাবে বলেছিলেন, না সব শেষ হয় নি। আমি বাঙালিদের জানি। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ইমানদার মুসলমান। তারা পাকিস্তানি কমান্ডারদের কাছ থেকে সুনেতৃত্ব পেলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাধ্য নেই আমাদেরকে পরাজিত করে। আমি সেই নেতৃত্বই সেখানে দিতে চাই। আমি আর ওকে বলতে পারি নি যে ভারতীয় বাহিনী তােমার শত্রু ঠিকই; কিন্তু তাদের চাইতেও ভয়ঙ্কর শক্র বাঙালি এবং মুসলমানরা। এমন ঘৃণ্য কাজ তােমরা করেছ ওখানে যে গােটা বাঙালি জাতি তােমাদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ স্পৃহায় প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। এই তােজাম্মেলই যুদ্ধের পর তার রচিত বইয়ে খােলাখুলি অনেক কথা লিখেছেন। সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমর্থিত ডিফেন্স জার্নাল মাসিক পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০০১ সংখ্যায় লিখেছেন, ‘ওখানে (বাংলাদেশে) বর্বর পাকিস্তান। সেনাবাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে এনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে ও তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতাে।
তিনি আরও লিখেছেন, “মােটামুটি সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নজিরবিহীন কাপুরুষতার সাথে আত্মসমর্পণ করেছে—উদ্দেশ্য একটিই, নিজের পৈতৃক জানটি বাঁচানাে।’ তােজাম্মেল আরও বলেছেন যে, তারা ছিল মার্সিনারি অর্থাৎ ভাড়াটে সৈনিক। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। এখানে তার বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘তখন (১৯৭১ সালের পূর্বে) প্রায় সব সিনিয়র ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেলদের আসল পেশা হয়ে উঠেছিল, অর্থের ও স্বার্থের বিনিময়ে যুদ্ধ অর্থাৎ মার্সিনারি ঐতিহ্যে যুদ্ধ অতএব তারা (পূর্ব পাকিস্তানে) যুদ্ধ করেছিলেন তাদের ইহজাগতিক স্বার্থের জন্য। ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১-এ যখন এই আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে তখন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিল চারজন জেনারেল, একজন নৌবাহিনীর এডমিরাল এবং প্রায় ৩০ জন ব্রিগেডিয়ার এরা সবাই মিলে নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে বাধা দিতে পারতাে; কিন্তু তাদের সেই নৈতিক সাহস ছিল না।’ পাকিস্তানি ও পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের প্রতি মুক্তিবাহিনীর বর্বরােচিত কার্যক্রম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তােজাম্মেল বলেন, “জেনারেল টিক্কা খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (তখন ব্রিগেডিয়ার) আরবাব নিজেদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কসাই হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ঠিক এদের মতাে অনেক জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারও অনুরূপ বর্বরােচিত কার্যে লিপ্ত ছিল। এই কার্যক্রমের প্রতিশােধ হিসেবে মুক্তিবাহিনীও হয়তাে অনুরূপ বর্বরােচিত প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারে; কিন্তু পাকিস্তানিদের বর্বরতার অনুপাতে তা ছিল নিতান্তই নগণ্য। উপরােক্ত বক্তব্যগুলাে থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, তােজাম্মেল আন্তরিকভাবে একজন সাহসী ও সৎ সৈনিক ছিলেন এবং বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন। কিন্তু ওই প্রবন্ধে তার আরেকটি মন্তব্য বাঙালি সম্বন্ধে সাধারণ পাঞ্জাবি মধ্যবিত্ত মানসিকতার অপর একটি দিকও অত্যন্ত প্রােজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে। তিনি যখন ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ােগপ্রাপ্তির জন্য অনুরােধ করেন তখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কোনাে অফিসার রাজি হতেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বদলি করলে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হতেন। সেক্ষেত্রে তিনি এই অসময়ে যাওয়ার জন্য এতাে উদগ্রীব ছিলেন কেন? এ সম্বন্ধে জিগ্যেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, (ভারতীয় আগ্রাসনের ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে তাে মুসলিম ইতিহাসের স্পেন হতে দিতে পারি না।’ সকল পাকিস্তানি বাঙালিকে ঘৃণা করতাে তা ঠিক নয়। কিংবা তাদেরকে তারা অপছন্দ করতাে তাও ঠিক নয়। তাদের বেশিরভাগেরই একটা বন্ধুসুলভ মনােভাব ছিল বাঙালি সম্বন্ধে।
কিন্তু জটিলতা সৃষ্টি হতাে অন্য এক জায়গায়। পাকিস্তানিরা জাতিগত, গােষ্ঠীগত ও কৃষ্টিগতভাবে বাঙালিকে কিছুতেই তার সমকক্ষ ভাবতে পারতাে না। বাঙালির যে নিজস্ব একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সত্তা আছে সেটা তারা ভেবেও দেখতাে না, জানতেও চেষ্টা করতাে না। এমনি মনােভাব স্বয়ংসিদ্ধভাবে গড়ে উঠেছিল তাদের মনে। তাই সৎ, সাহসী ও সহানুভূতিশীল হয়েও তােজাম্মেল ধরে নিয়েছিলেন যে, বাঙালি নিরাশ্রয়, অসহায়। অতএব, তাদেরকে রক্ষা করা একজন মুসলিম হিসেবে তার ইমানের অঙ্গ। এই সহানুভূতিশীল তােজাম্মেল সংশ্লিষ্ট আরও দুটি ছােট ঘটনার উল্লেখ করলে তার ও তার মতাে অন্য পাকিস্তানির মনমানসিকতা আরও পরিষ্কারভাবে বােঝা যাবে। ১৯৬৩ সালে আমরা একসাথে তুরস্কে তুর্কি ভাষা শিখি ও দু’জনে এক সময় একই বাসা ভাড়া করে অন্য চারজন ছাত্র থেকে আলাদা থাকি। সেই সময়কার একটি ঘটনা। আমরা সবাই ক্লাসে একত্র হয়েছি। দু’ক্লাসের মাঝখানে চায়ের বিরতি। কে একজন জানালাে যে আজকের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে চারটি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল স্থাপন করার জন্য পাকিস্তান বহির্দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েছে। আমাদের মধ্যে আমি একাই বাঙালি এবং সবাই মেজর পদবির। একজন বললেন, এই চারটি হােটেলের দুটি নিশ্চয়ই পশ্চিম পাকিস্তানে হবে আর দুটি হবে পূর্ব পাকিস্তানে। খলিল, তােমার কি মনে হয়? আমার তাে মনে হয় একটি ডাকায় অন্যটি চাটগায় হবে। কি বলাে।’ আমি। উত্তর দিলাম না। বাঙালির প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিবাদী কণ্ঠ, তােজাম্মেল হেসে হেসেই বললেন, ‘খলিল কি বলবে? সরকারের ইচ্ছে হবে চারটেই পশ্চিম পাকিস্তানে, করাচি, লাহাের, পিণ্ডি ও পেশাওয়ারে হােক। কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে মনে করে হয়তাে একটা ঢাকায় হতেও পারে। পেশাওয়ার বাদ যাবে? খলিল কি বলাে?’ বাংলাদেশের ওপর যে অবিচার হচ্ছে এটা তােজাম্মেলের কথায় বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেত। কিন্তু এই তােজাম্মেলও মনেপ্রাণে বাংলা ও পাঞ্জাবির সমকক্ষতা মেনে নিতে পারতেন না। একদিন কথায় কথায় বললেন, হ্যা, বাংলা ভাষা আমাদের শেখা উচিত।’ তারপর একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ঠাট্টার সুরে বললেন, “তবে খলিল আমি এ জীবনে ওই হিন্দুর ভাষা, বাম থেকে ডান দিকে লেখা অক্ষর আমার কলমে লিখতে পারবাে না।’ কথাগুলাে তিনি আমাকে ইংরেজিতেই বলছিলেন এবং কথাগুলাে যদি লিখতেন তবে বাম থেকে ডান দিকেই লিখে যেতেন। এখানে হয়তাে আইয়ুব খানের লেখা ও সমগ্র পাকিস্তানে জোর করে সবাইকে পড়ানাে, ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স বইটির কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। সেখানে আইয়ুব খান অত্যন্ত পরিষ্কার করে লিখেছেন যে, বাঙালি একটি ভিন্ন জাত ও নিচু জাত।
লে. জেনারেল হামিদ গুল
বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি মনােভাব সম্বন্ধে লে. জেনারেল হামিদ গুলের মন্তব্যও আমাদের উক্ত ধারণার পক্ষে আর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল হামিদ গুল (পাঠান) ২০০১ সালের ১৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক জং-এর সাময়িকী বিভাগে নিজস্ব মতাদর্শ প্রকাশ করে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। উর্দু ভাষার সাক্ষাৎকারটির কিয়দংশ বাংলা অনুবাদ করে জাফর আলম দৈনিক জনকণ্ঠ ৯ এপ্রিল ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশ করেছেন। গুল তার প্রশ্নোত্তরে এক জায়গায় বলেছেন, “পূর্ব পাকিস্তানে যখন বন্যা হলাে, লােক মারা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধারণা সেখানে কিছু পােকামাকড় মারা গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কারও সহানুভূতি ছিল না।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘আমি সে সময়ও (১৯৭১) বলেছি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমাদের যে অনুভূতি ও সহানুভূতি থাকা উচিত ছিল তা সমগ্র জাতিতে ছিল না। আমরা তাদেরকে পৃথক জাতি মনে করতাম।’
পাঞ্জাবি মেজর আতাউল্লাহ
এবার পুনরায় আমার মেহমান পাঞ্জাবি মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহর প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১-এর বিজয় দিবসের ঘটনার কয়েক দিন আগে তিনি। এসে হাজির। আমার বাসায় বেশ কয়েকজন বাঙালি আসতেন, আড্ডা দিতে ও যুদ্ধের খোঁজখবর নিয়ে আনন্দ করতে। মাহমুদ আতাউল্লাহর আগমনের পর সে আড্ডাটিই বন্ধ হয়ে গেল। অনেকটা নিম্নগ্রামে হলেও বিজয় উপলক্ষে আনন্দউল্লাস করবাে, ভালাে খাওয়া-দাওয়া করবাে—সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে চাকরিতে বদলি হয়েছে- সেই স্থানান্তরের নিয়ােগপত্র নিয়ে বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল জলিল ওই সময়ই এসে হাজির। শহরে ব্ল্যাকআউট অর্থাৎ সব অন্ধকার। পথে বেরুনাে নিরাপদ নয়। বাসায় বসেই আড্ডা জমতাে। আগেই বলেছি, যুদ্ধ কেমন চলছে সে সম্বন্ধে মেজর মাহমুদের কোনাে ধারণা ছিল না, জানার ইচ্ছেও তেমন ছিল না। কিন্তু হঠাৎ ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের অজেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চরম পরাজয় ও পূর্ব পাকিস্তানে নব্বই হাজার দেশপ্রেমিক সাহসী সৈনিকের আত্মসমর্পণ মেজর মাহমুদকে হতভম্ব করে দিলাে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খলিল, ইয়ে কেয়া হাে গেয়া?’ চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত। এই দেখে আমরা কোথায় আনন্দ-উল্লাস করবাে, তার পরিবর্তে মেজর মাহমুদকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মুখে বিষন্নতার ভাব এনে বসে রইলাম।
অতি কষ্ট করে হলেও আমি মাহমুদের মনে আঘাত দেয়া থেকে বিরত থাকতাম; কিন্তু বিকেলে চা পর্ব থেকে শুরু করে রাতের খাওয়া পর্যন্ত লম্বা আলােচনায় যখন যুদ্ধ সম্বন্ধে কথা উঠতাে, তখন অনেক সময় জলিল ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। ফেটে পড়ার কারণও ছিল। সেই সময়ে তাঁকেও একেবারে বিনাদোষে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হয়েছিল। তিনি বলতে চাইতেন পূর্ব পাকিস্তানে কি কি ঘটেছে। কিন্তু মাহমুদ অনেকটা আশ্চর্যান্বিত মুখভাব নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতেন যে, ওখানে তাে শুনেছি আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা বিহারিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং তাই থামাতে গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে কিছুটা অ্যাকশন নিতে হয়েছে। তারপর তাে শুনেছি সব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জলিল যখন তাকে উত্তপ্ত স্বরে বােঝানাের চেষ্টা করতেন যে ওখানে পাকবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। মাহমুদ চরম অবিশ্বাস নিয়ে উত্তপ্ত স্বরে বলতেন যে, কই এসব তাে তিনি শােনেন নি। এসব নিশ্চয়ই ভারতীয়রা প্রােপাগাণ্ডার উদ্দেশ্যে প্রচার করেছে এবং প্রবাসী বাঙালিরা সব ভুল তথ্য পেয়েছে। এই ছিল পাকিস্তানিদের মাইন্ড-সেট।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা