You dont have javascript enabled! Please enable it! ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বন্দিজীবন ও নির্যাতন - সংগ্রামের নোটবুক

ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বন্দিজীবন ও নির্যাতন

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত মামলা সংক্রান্ত খবরাখবর জানতে আমার ঔৎসুক্য ছিল। তাই ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাথে দেখা হওয়ার পর ‘ঘােড়ার মুখ। থেকেই ঘটনাটি শােনার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠলাে; কিন্তু মজুমদার তখনও শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর তার ভগ্ন মন নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিশেষ আনন্দে কাটছে আমাদের সময়। তাহলেও আমি সাক্ষী দেয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপনের মতাে সাহস কিংবা হৃদয়হীনতার কাজটি করে উঠতে পারি নি।  একদিন কর্নেল এমদাদ (ডাক্তার) তার স্ত্রীকে নিয়ে গল্প করতে এসেছেন আমার বাসায় বিকেলের চায়ের সময়। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারও আছেন। এমদাদের স্ত্রী, ডাকনাম কলি, ছেলেবেলা থেকেই আমার শ্বশুরবাড়ির প্রতিবেশী। দুই পরিবার ছিল অত্যন্ত অন্তরঙ্গ। আমি যখন কলিকে দেখি তখন তার বছর দশেক বয়স। আমার স্ত্রীকে আপা ডাকতেন এবং ছিলেন তার অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী  এরা দু’জন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারেরও পূর্ব-পরিচিত। তিনজনই সিলেট অঞ্চলের লােক বলে হয়তাে-বা আত্মীয়ও। কলিই অবতারণা করলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বন্দিজীবনের প্রসঙ্গ। একটু পরে মজুমদার সােজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘কলি, তােমরা যখন শুনতে চাচ্ছ তখন আজ গােটা কাহিনী তােমাদের শােনাবাে। ভাবি, আরাে এক কাপ চা দিন, আর ফায়ার প্লেসে আরাে কয়লা দিতে বলুন।’  ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তিনি ছিলেন চট্টগ্রামস্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল। সেন্টার (ই বি আর সি)-এর কমান্ডান্ট (অধিনায়ক)। আটটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তানের অন্যান্য কোরের জন্য, অর্থাৎ সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য যতাে নবীন বাঙালি সৈনিক ভর্তি করা হতাে তাদের সকলের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এখানেই হতাে। প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল কারাে ছ’ মাস, কারাে ন’ মাস, আবার। কারাে ক্ষেত্রে বছর পর্যন্ত। বছরের সকল সময়ে এই রিক্রুট সংখ্যা কয়েক হাজার থাকতাে।  তখন ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন অর্থাৎ মার্শাল ল চলছে। চট্টগ্রামের মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (এম এল এ) ছিলেন ঢাকার মেজর জেনারেল আনসারী। স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রামে থাকতেন ডেপুটি এম এল এ। জ্যেষ্ঠতা। অনুযায়ী ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ডি এম এল এ হন মার্চের ৪ তারিখে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার। কার্যত শেখ মুজিবের নিজের হাতে তুলে নেয়ার পর দেশ ও রাজনীতি অবর্ণনীয়ভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠলাে। সেই সময় চট্টগ্রামে বিহারি ও বাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা বাধে। সেই দাঙ্গা ঘটে মজুমদারের দায়িত্বভার গ্রহণ করার আগেই ।

কিন্তু মজুমদার স্বয়ং দেখেছেন ও জেনেছেন যে সেই দাঙ্গায় বিহারিদের চাইতে বাঙালিরা বেশি হতাহত হয়েছে। বস্তুত, দাঙ্গা বিহারিরাই শুরু করে।  দায়িত্ব নেয়ার পর মজুমদারকে আদেশ দেয়া হয় এই দাঙ্গা সম্বন্ধে ঢাকায় তার প্রতিবেদন পাঠাতে। মজুমদার ঘটনার সত্য বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদন পাঠান; কিন্তু ঢাকার কর্তৃপক্ষ তাে সত্য শুনতে চায় নি। অতএব, প্রতিবেদনটি তাদের মনােমত হয় নি। তারা লিখে পাঠালাে যে, প্রতিবেদনটি একপেশে। এই সময় কুখ্যাত ‘সােয়াত’ জাহাজ পাকিস্তান থেকে সামরিক সরঞ্জাম বহন করে এনে চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙর করে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সামরিক আঘাত হানা। ব্যতীত বাঙালিদের পাকিস্তানের শাসক হওয়ার মতাে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দমন করা যাবে না— এ সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া হয়েছিল। এই কাহিনীতে অন্যত্র বলা হয়েছে যে, এই সিদ্ধান্ত লারকানা ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৭১-এর ১০ ফেব্রুয়ারি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সামরিক আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট সৈন্যবল ও সামরিক সরঞ্জাম পূর্ব পাকিস্তানে মজুদ ছিল না। তাই স্থির হলাে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রয়ােজনীয় সৈন্য ও সরঞ্জাম ঢাকায় প্রেরণ করা হবে। এই খবরটি জেনারেল ওয়াসি তার ব্যক্তিগত সহকারীকে (বাঙালি) দিয়ে জেনারেল ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে ছিলেন সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরপরই। অতএব, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাকিস্তান সামরিক শাসকের পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকেই জেনেছিলেন। সােয়াত জাহাজ সম্বন্ধে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, নিখুঁতভাবে সামরিক শৃঙ্খলা অনুসরণের ব্যাপারে মজুমদার যে একেবারে ধােয়া তুলসী পাতা ছিলেন তা নয়। বাঙালির প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণে পাঞ্জাবিদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন , এমন কেউ তখন ছিলেন না বললে অত্যুক্তি হবে না। আর এক্ষেত্রে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের মনােভাব নিয়ে তাে প্রশ্নই ওঠে না। তিনি ছিলেন একজন উন্নত চেতনার গর্বিত বাঙালি, প্রবীণ সামরিক কর্মকর্তা। তার পক্ষে এই অত্যাচারী পাঞ্জাবিদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই আসে না। অতএব, তিনি সােয়াত জাহাজ থেকে ওই অস্ত্র নামাতে সাহায্য করবেন, যা তার নিরীহ ও নিরস্ত্র দেশবাসীর বুকে আঘাত করবে, সেটা হতে পারে না। বস্তুত, তিনি নিজে আগ্রহ করে এই সাহায্য পাকিস্তানিদের করেন নি। তবে তার এই অনাগ্রহ যথাসম্ভব বাইরেও প্রকাশ পায় নি। কিন্তু এটাকে তখন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা মজুমদারের অনীহা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কর্নেল সিদ্দিক সালেকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার বইতেও পাকিস্তানিদের এই মনােভাব পরিষ্কারভাবে বিধৃত হয়েছে। 

অতএব মজুমদারকে অতি ধূর্ততার সাথে মিথ্যা বলে ২০ মার্চ ঢাকায় এনে গৃহবন্দি করা হয়। উদ্দেশ্য চট্টগ্রামে অবস্থিত বাঙালি সৈনিকদের নির্বিঘ্নে নিরস্ত্র করা, প্রয়ােজনবােধে হত্যা করা যেন সহজ হয়। সিদ্দিক সালেকের বইয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ (পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আঘাত হানার পরিকল্পনার ছদ্মনাম)-এর লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মজুমদারকে ঢাকায় এনে অন্তরীণ করা হবে এবং সেখানকার বাঙালি লে, কর্নেল এম আর চৌধুরীকে প্রথম রাতেই (২৫ মার্চ) বন্দি করা হবে (বস্তুত তাকে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে)। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২৪ মার্চ মজুমদারকে বলা হলাে, ঢাকার জয়দেবপুরে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি অধিনায়কের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে অন্য একজন বাঙালি লে. কর্নেল রকিবকে। অতএব, সিনিয়র হিসেবে মজুমদারের সেখানে থাকা দরকার এই বলে মজুমদারকে এক বস্ত্রে আনা হলাে ঢাকায়। আনার কাজটি করলেন পাঞ্জাবি জেনারেল আনসারী  ঢাকায় এসে মজুমদার বুঝতে পারলেন তিনি বন্দি। তাঁর পরিবারের। সদস্যদের পরে ঢাকায় আনানাে হলাে। এরপর এপ্রিলের প্রথম দিকে তাকে সপরিবারে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে লাহাের। সেখানেই তিনি দেখেন যে লে. কর্নেল মাসুদুল হুসেন খানও ওই বিমানে এসেছেন। এঁদের সবাইকে লাহাের থেকে পিণ্ডির পথে ঝিলাম থেকে প্রায় মাইল বিশেক দূরে ‘বান্নি’ নামক একটি স্থানে সড়ক বিভাগের রেস্ট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। রেস্ট হাউজটি যেমনি পুরনাে, রাত্রিবাসের ব্যবস্থা তেমনি নিম্নমানের। ওপরের কামরা দুটোতে থাকতে দেয়া হলাে মজুমদার ও তাঁর পরিবারকে। সিড়ির নিচে অতি ক্ষুদ্র একটি কামরাতে থাকতে দেয়া হলাে কর্নেল মাসুদকে। মাসুদ একা, তার পরিবার ঢাকা সেনাছাউনিতে। | দু’একদিন পরই মজুমদার বুঝতে পারলেন, কেন তাকে এখানে আনা হয়েছে এবং পাকবাহিনীর উদ্দেশ্য কি এতােদিন পর্যন্ত তাকে মােটামুটি ব্রিগেডিয়ারের না হােক, অফিসারের সম্মান দেয়া হতাে। বান্নিতে এনে তাঁর সাথে সাধারণ অপরাধী কয়েদির মতাে আচরণ করা শুরু হয়। তাকে বলা হয়, হয় তিনি কর্তৃপক্ষের সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবেন, নয়তাে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে সত্য জবাব আদায় করা হবে। এরপর তাঁকে জয়দেবপুর ষড়যন্ত্র (যা ঘটেই নি এবং যার সবটাই কল্পনা) সম্বন্ধে জিগ্যেস করা হলাে। জানি না, উত্তর পেয়ে তাকে নির্যাতনের প্রথম স্তর হিসেবে বান্নি রেস্ট হাউজের সামনের লনে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখা হলাে। এরপর থেকে তাকে ও মাসুদকে আরও পেশাদার গােয়েন্দাদের দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য প্রতিদিন নিয়ে যাওয়া হতাে নিকটবর্তী ঝিলাম সেনাছাউনিতে। সেখানে দৈহিক নির্যাতন না হলেও মানসিক নির্যাতনের অন্ত ছিল না। মজুমদার ও মাসুদকে কিন্তু একসাথে এবং এক জায়গায় নেয়া হতাে না। তারা জানতেনও না যে অন্যকেও প্রশ্ন করা হচ্ছে (আমিও ওদের দু’জনকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করে এ সম্পর্কে জেনেছি)। এই পর্ব চলে প্রায় দু’ মাস। তবে সঠিক দিন-তারিখ মনে রাখার অবস্থা কয়েদিদের কারােরই ছিল না।

মজুমদার তার ওপর অত্যাচারের যেসব বর্ণনা দিলেন, তাতে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছিল যে, ওই পরিস্থিতিতে তখন পর্যন্ত তাঁর দৈহিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক যাতনাই ছিল সমধিক ও অসহ্য। তিনি প্রথম জীবনে চাকরি করতেন পাঞ্জাব রেজিমেন্টে। পাঞ্জাবি সৈনিকরা তাকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করতাে, ভালােবাসা দেখাতাে। আর এরাই আজ তাকে সাধারণ কয়েদির মতাে ‘তুই তুকারি’ করছে অথচ তিনি একজন ব্রিগেডিয়ার। তাঁর সাথে বেয়াদবি তাে কল্পনাতীত, যার উপস্থিতির কথা শুনলে সৈনিকরা সেই তল্লাটও মাড়াতাে না। ঝিলামের নিকট বান্নি রেস্ট হাউজে আনা পর্যন্ত মজুমদারকে ব্রিগেডিয়ারের প্রাপ্য সম্মানটুকু মােটামুটি দেয়া হচ্ছিল। এখানে এসে যেই জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হলাে তখন থেকেই সিপাহি, নায়েক, হাবিলদারদের সুর হঠাৎ করে বদলে গেল। জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল সামরিক অফিসার দ্বারা, কিন্তু শাস্তি পালিত হচ্ছে। কিনা তার তদারকির ভার ছিল সিপাহিদের ওপর। এ তদারকির সময় সেই পাঞ্জাবি সিপাহিদের আচরণ মজুমদারের কল্পনারও অতীত ছিল। বান্নিতে আসার পর তাঁকে যখন রাতের খাবার পরিবেশন করা হতাে তখন এইসব সিপাহি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ‘সাব’ ‘সাব’ করে কথায় কথায় ‘অ্যাটেনশন’ হয়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশন করছিল, সেই সিপাহিদের আচরণে পরদিনই আমূল পরিবর্তন ছিল কল্পনাতীত। ‘খলিল তুমি ভাবতে পারবে না, এই সিপাইগুলাে যাদের আমি বিশেষ স্নেহ করতাম, যারা আমাকে পিতার মতাে মান্য করতাে, তারাই এসে আমাকে কর্কশ কণ্ঠে, দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলাে, ব্রিগেডিয়ার সাব, বাহার নিকলাে। ইস্ জাগা খাড়ে হাে যাও’। আমি তাে অবাক। এরা বলে কি।’ এর মধ্যেই একজন গর্জে উঠলাে, “বিরগেডিয়ার, দেখ কিয়া রাহে হােইধার খাড়ে হাে যাও।’ নিমেষে মনে পড়লাে যেদিন কমিশন্ড অফিসার হিসেবে মনােনয়ন পরীক্ষায় পাস করলাম—সেদিন কি আনন্দ, কি অহঙ্কার। আর যেদিন ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতির কথা শুনলাম সেদিন তাে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খলিল, বিনা দোষে এই অসম্মান। চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলাে। ‘এদিকে আর এক তর্জন, ‘কিয়া সােতে হাে, অ্যাটেনশন হােকে খাড়ে হাে যাও’, বলেই আমার হাত ধরতে গেল। আমি সাত তাড়াতাড়ি ওর কথামতাে দাঁড়ালাম। সারারাত আমাকে বাইরে লনে দাঁড় করিয়ে রাখলাে। সেদিন আমার চোখের পানি ঝরা থামে নি।

আর এ চিন্তাও মন থেকে যায় নি যে কোন্ দোষে আমার এমন চরম অপমান? এর চাইতে ক্ষেতমজুরি ও কুলিগিরি করে খাওয়াও স্বর্গতুল্য মনে হতে লাগলাে। বান্নি রেস্ট হাউজে জিজ্ঞাসাবাদে মজুমদারের কাছ থেকে গােয়েন্দাদের কাক্ষিত জবাব পাওয়া গেল না। পাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না, কারণ ঘটনাটিই ঘটে নি। অতএব, কয়েক সপ্তাহ পর তাকে নেয়া হলাে ঝিলাম ছাউনিতে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ পরিচালনা করে গােয়েন্দা অফিসাররা। এরাও মজুমদারের পরিচিত, কিন্তু অনেক জুনিয়র। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে প্রতি বাক্যে দু’তিনবার করে তারা একসময় স্যার স্যার’ করতাে, অথচ এখন তাদেরই কী ব্যবহার! ঘন্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ চলতাে। এক অফিসার পরিশ্রান্ত হয়ে গেলে। যােগ দিতাে আর একজন। এই দৈহিক ও মানসিক কষ্টে কাটলাে মাস দেড়েক। | তবে জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল একই। এরূপ কোনাে ঘটনা ঘটেই নি, অতএব ওখানে কি কি সিদ্ধান্ত ও ষড়যন্ত্র হয়েছিল তা বলার প্রশ্নই ওঠে না, এই ছিল জবাব। এছাড়া অনেক আজেবাজে প্রশ্নও করা হতাে, যাতে মজুমদার ভেঙে পড়ে। সেগুলাের উত্তর বারবার করে দিতে হতাে। তারপর বলা হতাে বাকি দু’জন বন্দি অর্থাৎ কর্নেল ইয়াসিন ও কর্নেল মাসুদ বলেছে যে, তুমি ওইদিন ওখানে ছিলে, সেখানে ছিলে, এই কথা বলেছাে, ওই কথা বলেছে ইত্যাদি। মজুমদার বললেন, ইয়াসিনকে আন আমার সামনে, আমি তাকে প্রশ্ন করবাে।’ বলা বাহুল্য, তাকে মজুমদারের সামনে আনা হতাে না নানা বাহানা। করে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, সঙ্গী ভাঙানাের এটি একটি উত্তম উপায়—এক সঙ্গীকে অন্য সঙ্গীর দেয়া সাক্ষ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করা। মজুমদারকে বলা হতাে, ইয়াসিন বলেছে তুমি ঐ ঐ দিন ওখানে ওখানে ওঁর ওঁর সাথে এই এই কথা বলেছে। কথাগুলাে ছিল সর্বৈব মিথ্যে। আসলে কথাগুলাে পাক গােয়েন্দাদের বানানাে। উদ্দেশ্য মজুমদারকে রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ করে দেয়া, যাতে তিনি ভেঙে পড়েন।  মনের ওই দুর্বল অবস্থায় মজুমদার সেগুলাে বিশ্বাস করেছেন। প্রয়াত ইয়াসিনের। ওপর মজুমদারের এই প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভ আজ অবধি বিদ্যমান আছে। এদিকে কর্নেল ইয়াসিনের কথা, খলিল, তুমি কি কল্পনা করতে পার যে এই ব্রিগেডিয়ার মজুমদার কতাে বড়াে মিথ্যাবাদী? আমি ভাবতেও পারি নি যে একজন। সিনিয়র অফিসার, আমার সাথে তেমন জানাশুনােও নেই, একজন বাঙালি হয়ে আর একজন বাঙালির বিরুদ্ধে এ রকম ডাহা মিথ্যে কথা বলতে পারে? | আমি যতােই তাকে বােঝানাের চেষ্টা করেছি, দেখুন ইয়াসিন ভাই (ইয়াসিন। আমার চেয়ে বয়সে ও চাকরির দৈর্ঘ্যে প্রবীণ ছিলেন), এসব কথা পাকিস্তানি গােয়েন্দাদের বানানাে—সর্বৈব মিথ্যে।

কিন্তু তারও মনের আঘাত এমনি ছিল যে তিনি আমার কথা পুরাে না শুনেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘খলিল, তুমি ওই মজুমদার লােকটিকে চেন না।’ আমি একান্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, কেমন অসহায় অবস্থা হলে, ভূত-ভবিষ্যৎ কতােটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলে জন্ম-মৃত্যু-জীবন অর্থহীন মনে হয় এবং মানুষের এই সব সাধারণ সত্যগুলাে উপলব্ধির শক্তি লােপ পায়। চরম অমানবিক নির্যাতনের ফলে এই দু’জন পরিপক্ক, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ অফিসারের মনের অবস্থা এরকমই দাঁড়ায়। জুলাইয়ের শেষে কিংবা আগস্টের গােড়ায় মজুমদারকে নিয়ে যাওয়া হলাে লাহাের ফোর্টে অবস্থিত পুলিশের বিশেষ নির্যাতন সেলে। এই পুলিশ সেলটি বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার ও পীড়নমূলক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত।  পরিবার থেকে আলাদা করে মজুমদারকে আনা হলাে লাহাের ফোটের নির্যাতন সেলে। জেরা শুরু হলাে। জয়দেবপুরের ষড়যন্ত্র । প্রশ্নকারী প্রায় ছ’ফুট লম্বা, পেশিবহুল এক পুলিশ কর্মকর্তা। প্রথমে সে মজুমদারকে ‘সাব, আপনি বলুন ওখানে কে কে ছিলেন, কে কি বক্তব্য দিলেন ও কি কি পরিকল্পনা নেয়া হলাে’, এই ভাষাতেই প্রশ্ন করতে লাগলাে। মজুমদার তাকে বােঝানাের চেষ্টা করলেন যে, প্রথমত, তার জানামতে এ ধরনের কোনাে বৈঠক জয়দেবপুরে হয় নি। দ্বিতীয়ত, যদি হয়েও থাকে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। প্রশ্নকারী বিশ্বাস করলাে না। পুনরায় প্রশ্ন করলাে, “আমরা জানি, আমাদের নিকট রেকর্ড আছে যে ওই বৈঠক জয়দেবপুরে অমুক মাসে হয়েছে। আর এও জানি যে আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অতএব, কি পরিকল্পনা হয়েছে বলুন। আপনার কোনাে ক্ষতি হবে না। আপনি কেবল সত্যি কথাগুলাে বলে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন। এরপর সসম্মানে আপনাকে সেনাবাহিনীতে পূর্বপদে বহাল করা হবে।’ মজুমদারের বিনীত উত্তর একই, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। ঠিক তখনই প্রশ্নকারী মজুমদারের গালে এমন প্রচণ্ড চড় কষালাে যে তিনি কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এ রকম একতরফা শারীরিক আঘাত? তাও আবার এই বয়সে, এমন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার হিসেবে? মজুমদার প্রথমে স্তব্ধ ও পরে জ্ঞানশূন্য। পরে যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন তখন অপমানে ও ক্ষোভে চোখ ফেটে পানি। খােদা, এও কি সম্ভব?

পরদিন দ্বিতীয় রকম শাস্তি। প্রশ্ন একই। তাদের বক্তব্য হলাে এটা নির্যাতনের মাত্রায় ক্রমিক নং দুই। এই রকম একুশটি মাত্রার নির্যাতন রয়েছে। দিনে দিনে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকবে। যতাে ইস্পাতদৃঢ় মনের অধিকারী কয়েদিই হােক না কেন, নয়/দশ নম্বরের পরে আর কেউ টেকে , ভেঙে পড়বেই। তাই তারা মজুমদারকে উপদেশ দিলাে যে, এই পর্যায়েই সত্য কথা বলে দিলে ভবিষ্যৎ কঠোর শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে। যখন বলতেই হবে তখন অযথা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে লাভ কি? সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে চলতে হবে। এই নির্যাতনগুলাে ঠিক ক্রমিক নম্বর হিসেবে মজুমদার আমাদেরকে বলেন নি বা বলতে পারেন নি। আমাদেরও মনের অবস্থা এমন ছিল যে বিস্তারিত জিগ্যেস করতে পারি নি। তবে পরে কর্নেল মাসুদের কথা থেকে বিস্তারিত শুনেছি—মাসুদের নির্যাতন কাহিনীর সাথে পরে তা বর্ণিত হয়েছে। কয়েকদিন পরে দেয়া হলাে বৈদ্যুতিক শক’। মজুমদার বললেন, ‘সব বন্দিই বলে যে তাদেরকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। আমি একথা মানতে নারাজ। তারা কি বলতে পারবেন এই ‘শক’ কিভাবে দেয়া হয়। পারবেন না। ভাবী, আমি বলছি আপনাদেরকে। আমাকে নেয়া হলাে উঠোনে, একটি খাটিয়ার ওপর শােয়ানাে হলাে। উঠোনটি দোতলায় আমাদের ক্ষুদ্রাকার সেলগুলাের সামনে। দোতলার ছাদে ছিল উঁচু প্রাচীর ঘেরা উঠোন। নির্যাতন ওখানেই হতাে।’ | ‘খাটিয়ার ওপর আমাকে শুইয়ে হাত-পা চারটি পায়ার সাথে টান টান করে। বাধা হলাে। এর আগে আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করা হয়েছে। হাতের ও পায়ের কবজিতে প্রথমে রাবারের পাত দিয়ে মােড়া হলাে, তার ওপর রশি দিয়ে বাঁধা হলাে, যাতে হাতে-পায়ে আঘাতের ক্ষত না হয়। তারপর মাথায় ক্লিপ সটা তিনটি তার আনা হলাে। ক্লিপগুলাের দুটো আটকানাে হলাে আমার বুকের বোটায় । আর তৃতীয়টি আটকানাে হলাে (কিছুক্ষণ ইতস্তত করে), বলেই ফেলি, আমার যৌনাঙ্গে। তিনটি তারের অপর মাথাগুলাে এক সাথে বাঁধা হলাে একটা বৈদ্যুতিক সুইচের সাথে । অতঃপর সুইচটি লাগানাে হলাে একটি প্লাগে। প্লগটি আবার লাগানাে ছিল একটি কাঠের ছােট চাকার সাথে। চাকাটির ব্যাস হবে ইঞ্চি দশেক। তার সাথে লাগানাে একটি ছােট হাতল। হাতলটি চাকাটিকে ঘােরানাের জন্য।

ইফতারের সময় কিংবা যুদ্ধের সময় বিমান আক্রমণ ঘােষণা করার জন্য যে সাইরেন বাজানাে হয় জিনিসটা অনেকটা সেই রকম। ওই হাতলটি হাতে ঘােরানো হয়। ঘােরানাে হলেই বিদ্যুৎ প্রস্তুত হয় এবং তিনটি তারের মাধ্যমে তা শরীরের অসংখ্য স্নায়ুকে আঘাত করে।’ ‘ভাবী, কি বলবাে। যখন ঘােরানাে হয় ও আস্তে আস্তে তার গতি বাড়ানাে হয়, তখন মনে হয় যেন লক্ষ লক্ষ ব্লেড দিয়ে আমার শরীরের প্রতিটি অংশকে মােরব্বা বানানাের মতাে করে ঘনঘন ফালি ফালি করে কাটা হচ্ছে। মিনিট খানেকও জ্ঞান থাকে না। বেহুশ হয়ে গেলে চাকা ঘােরানাে বন্ধ করা হয় ও জ্ঞান ফেরানাে হয়। জ্ঞান ফিরলে পুনরায় চলে একই পদ্ধতি। দু’তিন বার আমার জ্ঞান ফিরেছিল। তারপর জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে।’ এই পর্যায়ে আমি বললাম, ‘মজুমদার, ভাই তুমি যখন জানই যে এদের মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই, আর যে শেখ মুজিবের জন্য সাক্ষ্য তাকে তারা যেভাবেই হােক হত্যা করবেই, তখন তুমি বললে না কেন যে আমাকে যা বলতে বল আমি বলবাে। সেগুলাে সব একটি কাগজে লিখে আন, আমি বলবাে,’ এ কথা কেন বলাে নি?’  মজুমদার বলল, ‘খলিল, কি বলছাে? কতােবার বলেছি এ কথা। বলেছি। তােমরা আমাকে দিয়ে কি বলতে চাও বলাে। ওদের উত্তর একটাই, বিরগেডিয়ার সাব, আমরা তাে সব কিছু জানি-ই। লেকেন ও সব হাম তুমহারা সােনেরি মু’ সে সুননা চাহতে হয় অতএব যে পর্যন্ত তুমি তা না বলবে ততােক্ষণ পর্যন্ত এ নির্যাতন চলবেই।’ শুনে কেবলি ভাবতাম, কি গুনাহ করেছি আমি? ওদের পায়েও ধরেছি কিন্তু বুঝলাম ‘ওপরের অর্থাৎ সেনাবাহিনীর হুকুম  আমার কাছ থেকে কথা আদায় করতেই হবে।’ এ পর্যায়ে আমাদের এই নৃশংস কাহিনী শােনার ইচ্ছে লোেপ পেল। আমাদের আর সহ্য হচ্ছিল না। মজুমদারকে থামতে বললাম। মজুমদার থামলেন না। ইশারায় চুপ করতে বলে বললেন, ‘ভাবি, আরও শুনুন। নির্যাতনের ক্রমিক নম্বর নয়, দশ, এগারাে ছাড়িয়ে গিয়ে পৌছল চৌদ্দতে। চৌদ্দ নম্বর নির্যাতনের ব্যবস্থা হলাে।’  ‘দোতলার খােলা উঠোন। আগস্ট মাস প্রচণ্ড গরম উত্তাপ ১১৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সূর্যতাপে মনে হচ্ছে যেন মগজ গলে যাবে দুটি টেবিল রাখা হলাে পাশাপাশি। মাঝে ৫/৬ ফুট ফাক। আমাকে শােয়ানাে হলাে ছাদে। আমার হাত-পা এক সাথে বাধা হলাে একটা মােটা রশি দিয়ে কবজিগুলাের ওপর দেয়া হলাে রাবারের আচ্ছাদন রশির অভ্যন্তরে। তারপর আমার বুকের কাছ দিয়ে একটি মােটা বাশ দু হাত ও দু’পায়ের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলাে। এক পাশে আমার শরীর, অন্য পাশে আমার চার হাত-পা একসাথে গিট দিয়ে বাঁধা।

এরপর বাঁশটির দু’মাথা দু’জনে ধরে ওপরে তুললাে। জবাই করা শেষে চার পা বাঁধা গরু/খাসিকে যেমনভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া হয় ঠিক সেভাবে আমাকে তােলা হলাে এবং বাঁশের দুই মাথা টেবিলে রাখা হলাে। আমি জবাই করা পশুর মতাে ঝুলে থাকলাম। তখন বেলা দশটা। কিছুক্ষণ পর আমার মাথা ঝুলে পড়লাে। আরও কিছুক্ষণ পর আমি বেহুশ হয়ে পড়লাম। আবার কি করে জানি না হুশ ফিরে এলাে। হয়তাে ওরাই পানি। ছিটিয়ে থাকবে। আবার বেহুশ, আবার হুঁশ। এইভাবে বেলা দু’টা (সময়টা অবশ্য পরে জেনেছিলাম)। তখন আমাকে নামানাে হলাে একটি খাটিয়ার ওপর। ওদের একজন বিদ্রুপের স্বরে প্রশ্ন করলাে, বিরগেডিয়ার সাব, আভি কিয়া মাঙ্গতে হাে? মুখ থেকে কথা বেরুলাে না। অতি ক্ষীণ স্বরে বললাম, একটু পানি। তখন পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। এক ফোটা পানির বিনিময়ে আমি সর্বস্ব দিতে রাজি। ওদের একজন হাে-হাে করে হেসে উঠলাে। বললাে, ‘সাব পানি মাঙ্গতা হ্যায়। উসকো পানি পিলাও।’ আমি উৎসুক হয়ে তাকালাম। পুলিশটি বললাে, “ঠিক হ্যায়, মু খােলাে।’ এই বলে আমার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে সে তার প্যান্টের বােতাম খুলতে লাগলাে। ভাবি হ্যা, প্যান্টের বােতাম।’ এই কথাটুকু বলতে বলতেই মজুমদার সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে গেলেন। তিনি ভেঙে পড়লেন। হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে উপুড় হয়ে পড়লেন। মুখটি দু’হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা। কান্না থামে না। বরং বাড়তে লাগলো। মনে হলাে বাধ হঠাৎ ভেঙে পড়েছে। সমস্ত অন্তর গুমরে গুমরে উঠছে অসহনীয় যন্ত্রণায়। মানবতার অপমানবােধে ও ভাগ্যের বিবর্তনে। আমরা থ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। কান্না থামে না। একটু পরে শরীরের কাঁপুনি কমে এলাে। এই ফাঁকে আমি বললাম, মজুমদার, তুমি থাম। আমরা আর শুনতে চাই না।’ কলি ও আমার স্ত্রী তাে মজুমদারকে জাপটে ধরলেন, ‘ভাই আপনি থামুন। আপনার দুটি পায়ে পড়ছি, আপনি থামুন।’ কথাগুলাে বলার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। এমনিতেই মজুমদারের আর শক্তি ছিল না কিছু বলার। সবাই চুপ—অনেকক্ষণ কাটলাে। তারপর মহিলারা বললেন, ‘ভাই, এক কাপ চা খান।’ মজুমদার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা