You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানিদের সীমাহীন- ব্রিগেডিয়ার তােজাম্মেল -মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহর অজ্ঞতা - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানিদের সীমাহীন অজ্ঞতা

মর্বেই আলােচনা করা হয়েছে, লারকানা ষড়যন্ত্রের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের  ওপর সশস্ত্র তৎপরতা চালালে বাঙালিরা বিদ্রোহ করতে পারে এবং Wভারতও এ বিদ্রোহ সমর্থন করে প্রয়ােজন হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে এমন সম্ভাবনা পাকিস্তানের সামরিক জান্তা চিন্তাও করে নি। তাই ১৯৭১ সালের মার্চের পরবর্তী সমস্ত ঘটনা অর্থাৎ তাদের ব্যর্থতা, সামরিক জান্তা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে গােপন রাখতাে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তখন বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা। (ভােয়া) ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র না শুনে রাতে ঘুমাতে যেত না বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদি বিদেশি খবর মাধ্যমগুলাে শােনা দেশপ্রেমের অভাব বলে বিবেচনা করতাে। তাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সরকারের ভাষ্য ব্যতীত অন্য কোনাে ভাষ্য শুনতে তারা মানসিকভাবে অভ্যস্ত ছিল না। এজন্যই যখন হঠাৎ তারা শুনতে পেল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, সবাই। আমাকে প্রশ্ন করেছে, সাব ইয়ে কিয়া হাে গিয়া? পূর্ব পাকিস্তানে যা দু’চারজন বেসামরিক পাঞ্জাবি ছিলেন তারাও বাস্তব পরিস্থিতি থেকে বহু দূরে অবস্থান করতেন। সেখানে তাদের আশপাশে কি ঘটছে তার কোনাে খবরই রাখতেন না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও বেশির ভাগ অনুরূপভাবে অজ্ঞ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্বন্ধে। এই রকম দু’একটি ঘটনা এখানে বর্ণনা করলে আমার বক্তব্য। আরও পরিষ্কার হবে।

ব্রিগেডিয়ার তােজাম্মেলের অজ্ঞতা

অক্টোবর মাসের শেষ দিক। ব্রিগেডিয়ার তােজাম্মেল হুসেন আমার অফিসে এসে হাজির। বললেন, বাঙালি, চায়ে পিলাও। তুমি জান যে আমি পূর্ব পাকিস্তানে চাকরির জন্য ভলান্টিয়ার করেছি। শিগগিরই আমার পােস্টিং এসে যাবে। এখন তুমি কি বলাে?’ তােজাম্মেল আমার বহুদিনের পুরনাে বন্ধু। শুধু ঘনিষ্ঠতাই নয়, আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালােবাসা মিশ্রিত একটি সম্পর্ক ছিল। আমরা তুর্কি ভাষা শিখতে গিয়ে একসাথে তুরস্কে ছিলাম। তােজাম্মেল ১৯৪৮ সালে ঢাকায় একমাত্র পদাতিক রেজিমেন্ট ৩/৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মুখেই শােনা যে, তিনি নাকি কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট আলী রেজা সাহেবের এক কন্যার সাথে প্রায় বিবাহবদ্ধ হতে যাচ্ছিলেন। আলী রেজা ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এসে পুরানা পল্টনে বাসা নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্মৃতি তােজাম্মেলের কাছে অত্যন্ত আনন্দের। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের সর্বদাই সমালােচনা করতেন তােজাম্মেল। পরবর্তীকালে তিনি একটি আত্মজীবনী লিখেছেন। সেখানে বাঙালিদের সম্বন্ধে পাঞ্জাবিদের মনােভাব বিষয়ে অতীব তিক্ত সমালােচনা করেছেন। সে প্রসঙ্গ আরও পরে। তােজাম্মেল জি এইচ কিউতে আমার সহকর্মী ছিলেন, অর্থাৎ তিনিও একজন বিভাগীয় প্রধান, পরিচালক। তােজাম্মেল তার স্বভাবসুলভ উচ্চ হাসি ও আনন্দের সঙ্গে আমাকে খবরটি দিলেন; কিন্তু আমার মুখ কালাে হয়ে গেল। বুঝলাম তােজাম্মেলের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা রয়েছে। ওঁর অমঙ্গল। আমার হৃদয়ে বাজে। সহাস্য তােজাম্মেল আমার বিরূপ অনুভূতি লক্ষ্য করলেন ও জিগ্যেস করলেন, ব্যাপার কি? “তুমি কি ইচ্ছে করলে তােমার এই পােস্টিং পরিবর্তন করতে পারাে না?’ ‘পারি, কিন্তু কেন? তুমি কি খুশি হও নি যে আমি আমাদের মাতৃভূমি, বিশেষ করে তােমার জন্মভূমি উদ্ধারের সম্রামে যাচ্ছি।’  তােজাম্মেলকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম যে অত্যন্ত দেরি হয়ে গেছে। একসময় হয়তাে সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব ছিল; কিন্তু এখন তাও নেই। এখন যুদ্ধ অনিবার্য এবং যুদ্ধে পাকিস্তান নিশ্চিতভাবেই পরাজিত হবে। তােমার ভবিষ্যৎ কি হবে কেউ জানে না। আমি খুশি হবাে তুমি জীবিত থাকলে ও বন্দি হলে। এমতাবস্থায় আমার সনির্বন্ধ অনুরােধ, তুমি পূর্ব পাকিস্তানে যেও না। ওখানে যেসব পাকিস্তানি আছে তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। বরং আশা করবাে তারা সবাই ধ্বংস হােক; কিন্তু তুমি কেন? তুমি তাে কোনাে অপরাধ করাে নি। তুমি তাে মনেপ্রাণে একজন সৎ লােক।

আমার পক্ষে যতােটা সম্ভব চেষ্টা করলাম তােজাম্মেলকে বােঝাতে। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়। উলটো তিনি আমাকে বােঝাতে লাগলেন, “খলিল, তুমি তাে জানাে বাঙালিরা কেমন সাচ্চা মুসলমান। আমাদের এই গােমূখ পাঞ্জাবিরা ওদেরকে পাকিস্তানের প্রতি বীতস্পৃহ করে ফেলেছে। আমি । গিয়ে বােঝাবাে যে আসল পাঞ্জাবির কাছে বাঙালিরা কেমন প্রিয়। আমরা ভাই ভাই । খলিল, আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে আমি ওঁদেরকে বােঝাতে সক্ষম হবাে। এবং আমরা দু’ভাই মিলে ভারতীয়দের মােকাবিলা করবাে। তুমি আমাকে বাধা দিও না।’ এরপর আমি আর ওঁর সাথে তর্ক করি নি। তিনি আমাকে গভীরভাবে। আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন। আমি ওঁর যাওয়ার পথের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকলাম।  পরদিন কিংবা হয়তাে আর দু-একদিন পর তােজাম্মেল তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির। প্রথমে বুঝতে পারলাম না কেন।পরে মনে হলাে হয়তাে আমার সঙ্গে আলাপের কথা তিনি তার স্ত্রীকে বলেছেন। তার স্ত্রীকে বােধহয় আমার সাথে কথা বলাতে চেয়েছেন। তার স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরেও আমি বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে, এই জটিল সময়ে তােজাম্মেলের স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া কোনােমতেই ঠিক হবে  বলতে গেলে শেষ রক্ষার সময় ফুরিয়ে গেছে। বেগম তােজাম্মেলও জানতে চাইলেন যে বাঙালিরা পাঞ্জাবিদের ওপর এতােটা বিরূপ কেন? এই কথায় আমার স্ত্রী কিছুটা আপত্তি উত্থাপন করাতে আমাদের আলােচনায় তিক্ততা সৃষ্টি হবে ভেবে আমি দ্রুত সেই প্রসঙ্গের ইতি টেনে দিয়ে বললাম, “জানাে তাে আমি। ব্যক্তিগতভাবে এই লােকটাকে ভালােবাসি। আমি চাই না উনি পূর্ব পাকিস্তানে যান এই সময়ে। তােমরা ওখানকার পরিস্থিতি জানাে না। তােমাদেরকে পরিস্থিতি বলে বােঝানাে সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি কেবল অনুরােধ করতে পারি যে তােজাম্মেলের এই পরিস্থিতিতে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না।’  শেষ পর্যন্ত মনে হলাে তারা কেউই আমাদের কথায় পুরােপুরি আস্থা রাখতে পারলেন না। বরং হতে পারে ধরে নিলেন, আমরাও কিছুটা বিপরীত চিন্তার লােক  যাহােক কুশল বিনিময় করে ওঁদেরকে বিদায় দিলাম; কিন্তু মনটা অত্যন্ত ভারি হয়ে উঠল। তবে তােজাম্মেলের ঘটনা, এই শেষ নয় শেষ ইতিহাস পরে। 

ক্যাপ্টেন জিলানির অবিশ্বাস্য ধারণা

বিভাগ-পূর্ব ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে কর্নেল জিলানি ছিলেন একজন তথাকথিত ইঙ্গ-ভারতীয় ব্যক্তি। তিনি বিলেতে ইংরেজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। সেখানে তাদের দু’ছেলের জন্ম হয়। উভয়েই ব্রিটিশ ভারতীয় এবং দু’জনকেই কর্নেল জিলানি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে ভর্তি করান। প্রথমজন বিমান বাহিনীতে ও দ্বিতীয়জন ক্যাপ্টেন আসগর। আলী জিলানি আমাদের সতীর্থ, সেনাবাহিনীতে। ঘটনাক্রমে দু’ভাইয়ের কারােরই চরিত্র বৈশিষ্ট্য সৈনিকসুলভ ছিল না বলে ক্যাপ্টেন পদবির ওপরে ওঠার আগেই তারা পেশা পরিবর্তন করেন। | ক্যাপ্টেন জিলানির চরিত্রে আরও একটি বৈপরীত্য ছিল। তিনি পাঞ্জাবি। হয়েও পাঞ্জাব ও পাঞ্জাবিদের পছন্দ করতেন না। বাঙালিদের সাথে বেশি সমমনস্কতা অনুভব করতেন। সেই কারণে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান, যদিও পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরে তাঁর বিপুল পৈতৃক ভূসম্পত্তি ছিল। উপরন্তু তিনি ঢাকা বা চাটগাঁর অভিজাত শ্রেণীর সদস্য হিসেবে এখানে থাকেন নি। থেকেছেন চাটগাঁ জেলার সাতকানিয়া থানার বাণীগ্রাম নামে এক অজ পাড়াগাঁয়ে অবস্থিত মুমিন সাংগাে’ চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে। নাম চা বাগান হলেও চায়ের কোনাে অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। ছিল অরণ্য আর গাছপালা। গাছ কেটে বিক্রি করে তাই দিয়ে তার জন্য বরাদ্দ পাঁচশ’ টাকা ও পাহারাদার ইত্যাদির জন্য যৎসামান্য বেতন-ভাতাদির বন্দোবস্ত তিনি করতেন। তিনি, তাঁর একমাত্র কেরানি ও গােটা দুই পাহারাদার মিলে একটি মেস করেছিলেন সবাই এক সাথে বসে খেতেন আমি একবার জিগ্যেস করেছিলাম, ওরা সবাই কি খায় সেটা আমি অনুমান করতে পারি; কিন্তু দু’বেলা তুমি কি খাও? দুপুরবেলা খাই রাইস আর ডাল রাতে খাই পটাটো আর ডাল।’ সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে আমি আমার ঝিলাম রােডের বাসার বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ গেটের পাশে কুকুরের ঘেউ ঘেউ । তাকে শান্ত হওয়ার জন্য ডাক দিলাম। দেখি কুকুরের পেছনে পেছনে আসছেন খাকি জলপাই রঙের প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত শীর্ণদেহ এক ভদ্রলােক। ভালাে করে তাকিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন আসগর আলী জিলানি। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হ্যা ঠিকই জিলানি। উষ্ণ অভিনন্দন সমাধা করে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম তিনি ছুটিতে এসেছেন। কয়েকদিন আমার বাসাতেই। থাকবেন। চা-পর্ব ও গল্পসল্প শেষ হওয়ার পর আমি জিলানিকে জিগ্যেস করলাম, পূর্ব পাকিস্তানের কি অবস্থা? জিলানির উত্তর, কেন? স্বাভাবিক অবস্থা ।  ‘কোনাে রকম গােলমালের খবর তুমি পাও নি?’ “হ্যা, মার্চ মাসের দিকে ঢাকায় কিছু গােলমাল হয়েছিল। সেসব তাে এখন। ঠিক হয়ে গেছে। কোনােরূপ আইন বিঘ্নিত হওয়ার মতাে ঘটনা তাে ঘটে নি। তবে শােনা যায় কিছু দুষ্কৃতকারী নাকি সরকারের বিরুদ্ধে হামলা করে মাঝে মাঝে। সে রকম তাে হয়েই থাকে।

 ওর উত্তর শুনে আমি থ মেরে গেলাম। এও কি সম্ভব যে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে কিছুই জানে না এমন লােকও আছে। পরে দেখেছি এমন লােক পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবাই, দু’চারজন বুদ্ধিজীবী ধরনের ব্যক্তি ছাড়া। | যাহােক আমি ক্যাপ্টেন জিলানিকে পছন্দ করতাম। তাকে বললাম, “তুমি আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেও না। সেখানে বাঙালি ও পাকিস্তানিদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই সংঘাত শেষের পর্যায়ে উপনীত হলে তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন হবে।’ কিন্তু জিলানি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। বারবার বলতে লাগলেন যে, ওখানে শান্তি-শৃঙ্খলা পুরােপুরিভাবে অটুট। তখন আমি তাকে অনুরােধ করলাম যে আর কয়েকটা মাস দেরি করে যেন ওখানে যায়। ততােদিনে দেখতে পাবে কিছু একটা ঘটে গেছে। দশ বারােদিন পরে বিদায়কালে তাঁকে এই অনুরােধটিই বারবার জানালাম। কিন্তু পরে শুনলাম জিলানি চাটগাঁর সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে ফিরে গেছেন। বােধহয় তার প্রবল বিশ্বাস ছিল যে তিনি তাে বাঙালিই হয়ে গেছেন, বাঙালিদের দিক থেকে তার কিসের ভয়। জিলানি সম্বন্ধে পরবর্তী ঘটনা আমাদের বিষয়বস্তুতে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক; কিন্তু কিছুটা কৌতুক মিশ্রিত বলে সংক্ষেপে এখানে তা বলে রাখি। | জিলানি ফিরে যাওয়ার পর আমি ধরে নিয়েছিলাম সে আর ফিরবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে—আমরা সবাই বন্দিশিবিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এমন সময় মার্চ মাসে গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি—জিলানি। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করলাম, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ, তা হলে তুমি জীবিত?’ ‘ও ইয়েস কলী-ল (খলিল), আই অ্যাম এলাইভ।’ ‘ফিরলে কি করে? ওখানে যারা জীবিত তারা সবাইতাে ভারতের বন্দি-শিবিরে।’ ওঁর কথায় জানতে পারলাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ বিপদেই পড়েছিল। স্থানীয় বাঙালিরা ওঁকে চিনতাে। তারাই তাঁকে বাঁচিয়েছে। নচেৎ অস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা তাকে হত্যা করতাে। অবশেষে তিনি  ঢাকায় এসে জেনারেল ওসমানীর কাছে হাজির হলেন। ওসমানী পড়লেন। বিপদে। এই অদ্ভুত লােককে নিয়ে কী করা যায়? এখানে থাকলে তাে ও বাঁচতে  পারবে না। পরে কোনাে কূটনৈতিক ব্যক্তির সাহায্যে তাঁকে করাচি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ভাবলাম, “রাখে খােদা মারে কে।’

কথা শেষ করে জিলানি প্রশ্ন করলেন, এখন বল খলিল, তুমি এখানে পিণ্ডিতে বসে কি করে জানতে যে ওখানে গােলমাল হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এবং আমি ওখানে বাঁচতে পারবাে না?’ | আমার হাসি পেল। কথা আর বেশি বাড়ালাম না। উত্তর এড়িয়ে গিয়ে যা বললাম তা তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। তবে খানদানি ইংরেজ ভদ্রলােকের মতাে আর প্রশ্ন করলেন না। জিলানি এখন বাহাওয়ালপুরে পিতার সম্পত্তি দেখাশােনা করছেন। বিয়ে করেছেন সেখানকার গ্রামের এক স্বল্পপড়ুয়া মেয়েকে। চিঠিপত্র লেনদেনের সূত্রে অনুমান করি সুখেই আছেন- পড়াশােনা, লেখা আর গ্রামের পথে ঘুরে বেড়ানাে- এই নিয়ে আছেন। পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে সাধারণভাবে এবং সেখানকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে জানার ইচ্ছা, আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি পশ্চিম পাকিস্তানের লােকদের কেমন ছিল তার একটি চিত্র তুলে ধরা এই গ্রন্থের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই লক্ষ্যেই কতক উদাহরণ এখানে দেয়া হয়েছে। তবে বলে রাখি, এখানে মােটামুটি দুই শ্রেণীর মানুষের মনােভাব তুলে ধরা। হয়েছে। একদিকে উচ্চতম পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের মনােভাব, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অজ্ঞতা, অনীহা ও তাচ্ছিল্য ইত্যাদি। পাকিস্তানের সমাজে আরও দুটো শ্রেণী ছিল। প্রথমটি ছিল কিছু উদারমনা, উচ্চ শিক্ষিত ও পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যারা পূর্বাঞ্চলে পশ্চিমের শােষণ-শাসন সম্বন্ধে তাদের লেখা ও কথায় প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের প্রসঙ্গ এখানে উথাপিত হয় নি। কারণ তারা একেবারে মুষ্টিমেয়সংখ্যক ছিলেন এবং তাদের অনেকে আমাদের এখানেও পরিচিত আর দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগণ যারা পুরাে জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ, তাদের কথাও বলা হয় নি। তার প্রধান কারণ এই বিরাটসংখ্যক মানুষ পাকিস্তানি সমাজের ভাগ্য নির্ধারণে কোনাে ভূমিকা। রাখতে সক্ষম নয়। কারণ হিসেবে মনে রাখতে হবে যে, এই উপমহাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্র বিদ্যমান ও তা অত্যন্ত দৃঢ় এবং কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই সামন্ততন্ত্রে জমির মালিকানা ক্ষেত্রে প্রজাদের কোনাে অধিকার নেই। এরা যখন-তখন মালিকের খেয়ালখুশিমতাে উচ্ছেদ হতে পারে বিধায় মালিকের খামখেয়ালির ওপর সর্বতােভাবে নির্ভরশীল। সামন্ত প্রভু তাদের যা জানাবে তাই তারা জানবে, যা শেখাবে তাই তারা শিখবে, যাকে  ভােট দিতে বলবে তাকেই তারা ভােট দেবে। এই দরিদ্র অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত পাকিস্তানিদের মতামতও আমাদের আলােচনার বিষয়বস্তু নয়- নিতান্ত অপ্রয়ােজনীয় বলেই পুনরায় আমাদের মূল বিষয়ে ফেরা যাক।

মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহর অজ্ঞতা

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। শুরু করেছিল পাকিস্তানই, অনেকটা মরিয়া হয়ে। এই যুদ্ধারম্ভের পূর্বে নিয়মমাফিক পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের ‘রিজার্ভ সৈনিকদের নিয়মিত চাকরিতে যােগদান করার জন্য ডাকলাে। একটি নির্ধারিত বয়স পুরাে হওয়ার পূর্বে সমস্ত অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকই জাতীয় যুদ্ধের প্রয়ােজনে চাকরিতে ফেরত আসতে বাধ্য। তাদেরকেই বলা হয় সশস্ত্র বাহিনীর রিজার্ভ এই রীতি অনুযায়ী আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের পূর্বতন অফিসার, আমার চাইতেও পাঁচ বছরের সিনিয়র, মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহ ডাক পেয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে হাজির হলেন। তবে তাকে কোনাে দায়িত্ব দেয়া হলাে না। যুদ্ধের কয়েকদিন কোনাে অফিসার মেসে কাটিয়ে শেষের দিকে এসে উঠলেন আমার বাসায়। আগে থেকে কোনাে খবর দেয়া নেই-একদিন বাক্স-প্যাটরা নিয়ে হাজির হলেন। ইতােপূর্বে আমরা একসাথে চাকরি করেছি। শিয়ালকোটে চাকরির সময় আমরা একটি বড় বাংলােকে দু’ভাগ করে বাস করেছি। ওঁর স্ত্রী বােম্বাইয়ের বােরা মুসলমান সম্প্রদায়ের পাঞ্জাবিদের কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু সামাজিক প্রথার চাইতে তিনি বাঙালির উদার সমাজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করতেন। অতএব, আমাদের সাথে তার আন্তরিকতা তখন পুরােপুরি যুদ্ধ চলছিল, তাই একজন প্রবীণ পাঞ্জাবি অফিসারের বাসায় অবস্থান আমাদের একেবারে অভিপ্রেত ছিল না। কারণ যুদ্ধের অবস্থা দিন দিনই। আমাদের পক্ষে যাচ্ছিল। অতএব সারাক্ষণ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকে সুখবর শুনে কোথায় চেঁচিয়ে আনন্দ করবাে ছেলে-পুলে ও আগত বাঙালি বন্ধু-বান্ধবসহ, সেখানে কিনা হঠাৎ করে এই পাঞ্জাবির আবির্ভাব। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলাম পঞ্চাশাের্ধ্ব এই প্রাক্তন সামরিক অফিসার যুদ্ধের কোনাে খবরই রাখতেন না। মাঝে মাঝে আমাকে জিগ্যেস করতেন, “কি হে খলিল, কি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে? তােমরা মনে হচ্ছে বেশ খুশি। তবে বােধহয় ভারত খুব মার খাচ্ছে ওখানে, তাই না? অবাক বিস্ময়ে মেজর সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর কিছু বলা বা করার না পেয়ে চায়ের অর্ডার দিতাম।

প্রাক্তন সুবেদার মেজর/অনারারি ক্যাপ্টেনের অজ্ঞতা

ডিসেম্বরের ১০/১২ তারিখ । আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন সুবেদার মেজর এবং অনারারি ক্যাপ্টেন সৈয়দ আসকার হুসেন এসে হাজির। তিনি ছিলেন হিন্দুস্তানি, বর্তমানে পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা। মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল বিদ্রোহ করে তখন সৈয়দ সাহেবের নাতি, একজন ক্যাপ্টেন নিহত হন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাঁর পরিবারবর্গকে পুরােপুরি জানায় নি, অথচ ক্যাপ্টেনটি নিশ্চিতভাবে নিহত। অতএব, অনারারি ক্যাপ্টেন সাহেব ও পরিবারবর্গ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয়ের পর ক্যাপ্টেনের ফেরত আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। এদিকে কানে আসছে যুদ্ধের অবস্থা ভালাে যাচ্ছে না। তাই নিজের লােক হিসেবে সঠিক খবর পাওয়ার জন্য আমার কাছে ছুটে এসেছেন।  খুব মায়া লাগল এই বৃদ্ধ সৈনিকটির আশাভরা চোখমুখ দেখে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তিনি যে মেজর সাহেবের তুলনায় যুদ্ধাবস্থা সম্বন্ধে অনেক বেশি জানেন তাতে অবাক হই নি। ওঁর নাতিএই যুদ্ধে জড়িত, মেজর সাহেবের কেউ জড়িত নয়। আর পূর্ব পাকিস্তান? তার কি হবে? এসব ব্যাপারে দু’জনের কারােরই তেমন আগ্রহ ছিল না। অনারারি ক্যাপ্টেন সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে যথাসাধ্য আশাপ্রদ ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম তিনিও খুশি হলেন। শেষে বললেন, ‘ধরুন খুদা-না-খাওস্তা যদি। এমন কিছু হয়ও তবে তাে আমাদের বন্ধু দেশ উত্তর থেকে অর্থাৎ চীন ও আমাদের বন্ধু দেশ দক্ষিণ সমুদ্রে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র তাে প্রস্তুতই, তাই না?’ যদিও ভালাে করে জানতাম যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মুখে এবং বক্তৃতায় যতাে পাকিস্তান সমর্থক ও ভারত তথা বাংলাদেশবিরােধী হােক না কেন, পাকিস্তানের (তাদের তরফ থেকে) সামান্য সমস্যার জন্য রাশিয়ার বিরােধিতা ও একটি সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাময় পদক্ষেপ নিশ্চয় নেবে না। বস্তুত তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে ইতােপূর্বে অনেকবার পরামর্শ দিয়েছে যে এই রাজনৈতিক সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধা করে ফেলতে, যুদ্ধ অবধি এটাকে গড়াতে না দেয়ার। জন্য। অতএব, তারা দু’একটি মৌখিক বাণী ও দূর থেকে কিঞ্চিৎ সচলতা দেখানাে ছাড়া অন্য কোনাে সাহায্য পাকিস্তানকে দেবে না। তবে স্বজন হারানাে বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তরে জোর দিয়েই বললাম, “নিশ্চয় তারা আসবে। হয়তাে ইতােমধ্যে পৌঁছেও গেছে।’ বৃদ্ধ খুশি মনে বিদায় নিলেন। একটি কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই প্রকাশ পেল। মেজর সাহেব ও এই অনারারি ক্যাপ্টেন সাহেব মােটেই জানতেন না যে বাঙালির ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কি অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে, জানার কৌতূহলও তাঁদের ছিল না।

কর্নেল শিগরির অজ্ঞতা

পূর্বেকার অনুরূপ একটি ঘটনা। অক্টোবর, নভেম্বর মাস হবে। হঠাৎ কর্নেল শিগরি এসে হাজির। তিনি কাশ্মিরের উত্তরের গিলগিট অঞ্চলের শিগার উপত্যকার বাসিন্দা; কিন্তু রাওয়ালপিণ্ডিতেই মানুষ। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন জনপ্রিয় অফিসার। বহুদিন রেজিমেন্টে চাকরি করেছেন এবং বিশেষ করে তিনি একজন কৃতী ফুটবল খেলােয়াড়। একসময় পাকিস্তান ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। প্রথম বেঙ্গল ফুটবল টিম যে গােটা পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেজন্য শিগরির অবদান সমধিক। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক চাটগাঁয় প্রশিক্ষণরত প্রায় সহস্রাধিক নবীন সৈনিককে নিরস্ত্র অবস্থায় অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়, একজন কর্নেলসহ বাঙালি অফিসারদেরও হত্যা করা হয়, তখন কর্নেল শিগরি ওখানে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনায় তার সম্পৃক্তি সম্বন্ধে যে দুর্নাম আছে তা উপেক্ষা করলেও এ কথা মানতেই হবে যে তিনি এই হত্যাযজ্ঞে বাধা না দিয়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এইসব খবর আমার ভালােভাবে জানা ছিল। অতএব, কর্নেল শিগরিকে ওই সময় আমার বাসায় অভ্যর্থনা জানানাে দূরের কথা, ওর সাথে কোনাে কথা বলারও প্রবৃত্তি আমার ছিল না। কর্নেল শিগরি আমার বাসায় আসার কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, “তুমি যদি আমাকে আমাদের বন্ধুত্বের খাতিরে একটু সাহায্য করাে তবে আমি কর্নেল। থেকে পদোন্নতি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার হতে পারি।’ কথাটা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারি না। | শিগরি চাকরিতে আমার চেয়ে প্রবীণ হলেও পদোন্নতি পান নি বলে কর্নেলই। রয়ে গেছেন। সেনাবাহিনীর নিয়মানুযায়ী তার আর পদোন্নতি হওয়ার কথা নয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন শিগরি যা ভেবেছেন, পদোন্নতি হতেও পারে; কথাটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকলাে না। শিগরি বললেন, “দেখ বর্তমানে চাটগাঁর বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে কোনাে ব্রিগেডিয়ার নেই। তুমি যদি জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বলাে তবে তিনি সুপারিশ করে আমাকে ওখানে পদোন্নতি দিয়ে নিয়ােগ দিতে পারেন। কারণ হিসেবে শিগরি বললেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে তাঁর দাবি অগ্রগণ্য। 

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে—অনুরূপ প্রচেষ্টা সফল হলেও হতে পারে। নবীন বাঙালি সৈনিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রবীণ বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসারেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সেই হিসেবে ইতােপূর্বে পদোন্নতির ব্যাপারে অতিক্রান্ত হলেও, শিগরির ব্যাপারটা বিবেচিত হতে পারতাে হয়তাে; কিন্তু আমি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ওঁর প্রস্তাব শুনে স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। ২৫ মার্চ উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে যে একান্ত কাপুরুষােচিত ও বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালানাে হয়েছিল তার হােতা যদি শিগরি না হয়ে থাকেন, তবে সহায়তাকারী নিশ্চয় ছিলেন। ওই দিনই কিংবা তার দু’একদিন পরে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত বাকি পাঁচটি বেঙ্গল ব্যাটালিয়নকে প্রয়ােজনবােধে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সমর বাহিনীর সেই প্রচেষ্টা সফল হয় নি, এ একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। পাঁচটি ব্যাটালিয়নই সফলভাবে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেছিল। যে তিনটি বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হয় নি। তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল ও তিনজন বাঙালি লে. কর্নেলই এদের অধিনায়ক ছিলেন। কিন্তু চাটগাঁয়ে বাঙালি নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আর তাে কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। হত্যাযজ্ঞের পরপরই শিগরিসহ সব অফিসারকে এদিক-ওদিক স্থানান্তরিত করে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমি ভেবে পেলাম না, শিগ্‌রির মতাে একজন প্রবীণ অফিসারও এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি রাখতেন না। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ হচ্ছে, পাকিস্তান সমর বাহিনী চরম পরাজয়ের মুখােমুখি, এ কথাটি কর্নেল পদবির সিনিয়র অফিসার শিগরির মতাে পাকিস্তানিদের জানা উচিত; কিন্তু তারা কথাটা কল্পনাও করতে পারতেন না। এই কর্নেল শিগরি-গণ’ জানতেন না, তাদের জানার আগ্রহও ছিল না, পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ তাদেরই দেশের অর্ধেক অংশে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর পশু সুলভ বর্বরতায় লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে, অসংখ্য নারী ধর্ষণ করেছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করেছে।  এই শিগরি-গণ ও পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এও জানতাে না (সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাস্তবে হয়তাে আরও বেশি) ‘৭১ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কেবল মুক্তিযােদ্ধাদের হাতেই নিহত হয়েছে (আহত অগুণতি) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর : কর্নেল পদবিসহ অফিসার – ২৩৭ জন। জুনিয়র কমিশন্ড় অফিসার – ১৩৬ জন অন্যান্য সৈনিক – ৩৫৫৯ জন। (মেজর জেনারেল শওকত রেজার লিখিত পুস্তক, পাকিস্তান আর্মি ১৯৬৪-৭১, ১০৯ পৃষ্ঠা)

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা