You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তানের ফোর্সেস ডিফেন্স

সেপ্টেম্বর মাসের দিকে, মংলার ১ নং কোরের অধিনায়ক আমার পুরােনাে। কমান্ডারের টেলিফোন পাই। আমি অমুক মেসের ভি আই পি কামরায় আছি। পিণ্ডি এসেছি কাজে। আজকের রাতই থাকবাে। এসাে না গল্প করা যাক। তখনও আমার পলায়ন তৎপরতা ধরা পড়ে নি। ঠিক হলাে রাতে খাওয়ার পর যাবাে। গেলাম গল্প শুরু হলাে। যা অনুমান করেছিলাম—তাই । আলােচনার বিষয় দাঁড়ালাে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা। এবার মনে হলাে ২৯ মার্চের তুলনায় ইরশাদ সাহেবের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই কম।  অসমসাহসী পাকিস্তানি সামরিক যােদ্ধারা ঠিক ভাবতে পারে নি যে, আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার কর্তব্য করতে গিয়ে, শক্তিতে দ্বিগুণ ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে পড়তে হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে সেই আশঙ্কাই অবশ্যম্ভাবী রূপ নিয়ে সত্য হয়ে উঠছে প্রতিদিন। কেবল জেনারেল ইরশাদ কেন, আরাম-আয়েশের জীবনে অভ্যস্ত সব জেনারেলই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম যুদ্ধ লাগলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর জন্য কতােটা ক্ষতিকর হবে কিংবা হওয়ার ক্ষমতা রাখে, সে সম্বন্ধে আমার মতামত এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনায় আমার মন্তব্য ও পরামর্শ গ্রহণই এই আলাপের উদ্দেশ্য পূর্বেই বলেছি, আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বাইরেও আমাদের দু’জনের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইরশাদ আমাকে স্নেহ করতেন। সেটা বুঝে আমিও তার মনে আঘাত দেয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতাম। সত্য কথা। যে বলতাম না তা নয়, কিন্তু সত্যটিকে তিক্ত করে বলতাম না। তবে আজ বিপদ গুণলাম। কারণ আমার কথা তাে একটাই এবং তা অত্যন্ত সহজ ও সরল। পাকিস্তানকে দুভাগ করে, ভারতের নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই হােক, আর এক কোটি না হােক অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ বাস্তুহারাকে বছর ধরে পালনের ক্ষমতা ভারত কেন, বিত্তশালী দেশের পক্ষেও অসম্ভব বলেই হােক, ভারতকে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়তে হবে। আর যুদ্ধ হলে ফল অনিবার্য। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম সাহসী পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের মাতৃভূমিকে হারাতে বসবে। আর পূর্ব পাকিস্তান? ভারত দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে। ঢাকার পতন কেবল সময়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। দিনে ভারতীয় বিমানবাহিনী আর রাতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও নড়তে দেবে না। আর নড়াচড়ার অক্ষমতা মানেই তাে মৃত্যু।

কিন্তু এ কথাটি জেনারেল ইরশাদকে তাে বলা যায় না। তিনি মনে আঘাত। পাবেন। অতএব, নানা রকম ধানাই-পানাই গল্প চলতে লাগলাে পূর্ব পাকিস্তান। ও মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে, যেসব কথা সবাই জানে, সেগুলাে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে লাগলাম। হঠাৎ ইরশাদ একবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, সিদ্দিকী না কি নামের যে একটি সন্ত্রাসী দল আছে, তারা কোথায় তাদের কার্যক্রম চালায়? বললাম, টাঙ্গাইলে মধুপুর নামক একটি জঙ্গল আছে, সেইখানে।’ ‘আচ্ছা মধুপুর জঙ্গলটি কি উত্তরে গারাে পাহাড়ের জঙ্গলের সাথে গিয়ে মিশেছে।’  না স্যার, জঙ্গলটি একটি দ্বীপের মতাে। চারদিকে বিস্তীর্ণ লােকালয়।’ ‘আল্লাহকে শুকুর, ভারতীয় দুষ্কৃতকারী এখানে ঢুকতে পারবে না, আর এরাও ভারত থেকে গােলা-বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না। আমি ভেবে অবাক হলাম যে, এতাে উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল অফিসারও পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে কতােটা অজ্ঞ। তিনি জানেন না যে, এই ভাদ্র মাসে সেখানে নৌকায় করে যথাখুশি যাওয়া যায়। আর গ্রামের প্রতিটি মানুষ সপক্ষে বলে মুক্তিযােদ্ধারা পানির ভেতর মাছের মতাে সর্বত্রই নিরাপদ। তাই ভারত থেকে রসদ আসার পথ অসংখ্য ও সর্বত্রই। তখন রাত এগারােটা বেজে গেছে। টেলিফোন এলাে। এরশাদই ধরলেন। না বহিন, আপনার স্বামী বহালতবিয়তে এখানে আছেন। অনেকদিন পরে দেখা। তাই কিছু গল্পসল্প করছি। না বেশি দেরি হবে না। তবে আরও আধ। ঘণ্টা। ঘণ্টাখানেক দেরি হলেও চিন্তিত হবেন না। ঘণ্টাখানেক পরে আসবেন। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। এই নিন কথা বলুন ওর সাথে।’ এই বলে টেলিফোন আমার হাতে দিলেন ইরশাদ। পূর্বেই বুঝেছি, টেলিফোনটি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমাকে আটকে জেলে পুরে দিলাে না তাে? তখন দিনকালও এমনি ছিল যে, ভয়ে মন সর্বদাই সঙ্কুচিত থাকতাে তবে আমার স্ত্রীও ইরশাদ দ্বারা আমার কোনাে বিপদ হবে এ আশঙ্কা কমই করতেন।

তাই সংক্ষেপে বললেন, ‘যতাে তাড়াতাড়ি পারাে এসে যাও। এতাে রাত পর্যন্ত। কিসের গল্প?’ সেদিন ফিরতে ফিরতে রাত একটা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আমার স্ত্রী আর টেলিফোন করেন নি। ‘আচ্ছা খলিল, এবার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে তােমাকে দু’একটা প্রশ্ন করবাে। হ্যা ভালাে কথা। তােমার জন্য একটি সুখবর আছে। জানাে তাে। আমাদের সেনাসদর (জিএইচকিউ) লাহাের সীমান্তের অমুক চরের (নামটি এখন আর মনে নেই) আক্রমণ সম্বন্ধে তােমার সংশােধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। এবং আমাদের কোর’-কে ‘শাবাশ’ জানিয়েছে। আমাকেও ব্যক্তিগতভাবে। ‘শাবাশ’ জানিয়েছে।’ ঘটনাটি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, তবে পাঠকের কৌতূহল মেটাতে ব্যাপারটি অতি সংক্ষেপে বলি। ১৯৭০ সালের ঘটনা। আমাদের কোরের দায়িত্ব ছিল। একমাত্র সিন্ধু প্রদেশ ব্যতীত উত্তরের সমগ্র পাক-ভারত সীমান্তের প্রতিরক্ষা। আমার দফতরের দায়িত্ব ছিল এই প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হালনাগাদ করে সংরক্ষণ করা। ঐ হালনাগাদ করতে গিয়ে নজরে পড়লাে যে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে লাহােরের কাছে ইরাবতী নদীর একটি বিস্তীর্ণ চরভূমি ভারত কর্তৃক সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। এই খবরটি জেনে পাকবাহিনী তখন তাদের প্রথম আক্রমণে ঐ এলাকাটি দখল করে নেয় এবং এই প্রাথমিক বিজয়কে অত্যন্ত ফলাও করে। প্রচার করে। ওখানকার রেলস্টেশনে হিন্দিতে লেখা নাম, গ্রামগুলাের নাম। টেলিভিশনে দেখিয়ে একদিকে যেমন নিজের দেশবাসীর কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ভারতীয় নাগরিকদের কাছে ভারতীয় সৈনিকদের। কিছুটা হলেও, মাথা হেট করিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। অতএব, এই বাহাদুরি। আগামী যুদ্ধের প্রথম রাতেও করা হবে। এই অনুযায়ী যুদ্ধ পরিকল্পনাতে লাহাের পদাতিক ডিভিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  পরিকল্পনাটি পড়ে আমার মনে হলাে গতবার ভারত যেখানে মার খেয়েছে এবার সেখানে তার প্রতিরক্ষাটি বিশেষভাবে দৃঢ় করার কথা। এটা সাধারণ অনুমানের ব্যাপার। অতএব, আমার মনে হলাে যে, সম্ভাব্য মজবুত ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংবলিত স্থানটিতে প্রথম রাতেই আমাদের একটি মূল্যবান ব্রিগেডকে আক্রমণ করতে বলা মানে তাে ব্রিগেডটির আত্মহত্যা করার শামিল। হ্যা, হতে। পারে স্থানটি ১৯৬৫ সালের মতাে অরক্ষিত এবং আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত। 

কিন্তু তা হলেও তাে গতবারের মতাে আমাদের বিজয় প্রচার হবে মাত্র দু’চার দিনের জন্য তারপর তাে যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে ‘বিজয় প্রচার’ ইত্যাদি। অথচ যদি ভারতীয় প্রতিরক্ষা সুসংহত হয় তবে পাকিস্তানি ব্রিগেডটির জন্য সেটা হবে অনেকটা আত্মঘাতী। আর এই প্রাথমিক যুদ্ধ বিপর্যয় আমাদের জাতীয় ও সামরিক মনােবলের ওপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলবে। অতএব, সম্ভাব্য লাভের চেয়ে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। তাই যদি হয় তবে এতাে বড় ঝুঁকি নেয়ার প্রয়ােজনীয়তা তাে নেই। তাই আমি তীব্রভাবে এই ঝুঁকি নেয়ার বিরােধী ছিলাম। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং আমার সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি নিজে গেলাম জায়গাটা দেখতে। ওখানকার মাইলখানেক দূরে পাকিস্তানের ভেতরে দেড়শাে-দুশাে ফুট উঁচু একটি সীমান্ত পর্যবেক্ষণ পােস্ট ছিল। সেই পােস্টের ওপরে উঠলাম। মনে পড়ে বিদ্যুতের পাইলনের মতাে করে তৈরি পােস্টটি। উচুতে উঠলে দু’তিন ফুট এদিক-ওদিক করে দোলে–বেশ ভয়ই লাগে। যা হােক শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলাে। ফিরে এসে পরবর্তী পরিকল্পনা কনফারেন্সে আমি কথাটা তুললাম। জেনারেল ইরশাদ হেসে বললেন, খলিল, এটা পূর্বেই কয়েকবার আলােচিত হয়েছে। একবার উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ নিজেও সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং অত্যন্ত জোরের সাথে এই কার্যক্রমটি অবশ্যগ্ৰহণীয় বলে চূড়ান্ত করে গেছেন। অতএব, দ্বিতীয়বার আমার পক্ষে সংশােধনীটি উত্থাপন। করা সম্ভব নয়। | আমি বহুরকমভাবে জে. ইরশাদকে বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে এটা। দেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপার। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়। এও বললাম যে, আমাদের সামরিক পুঁথিতেও আছে বয়স্ক জেনারেলগণের একটি প্রধান দুর্বলতা এই যে তারা পূর্ববর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা দিয়েই নতুন যুদ্ধ পরিচালনা করতে চান।’ এতাে করেও জে, ইরশাদকে রাজি করাতে পারলাম । তখন তাকে জিগ্যেস করলাম, আপনি নিজে আমার মতটি অনুমােদন করেন কি না? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর কনফারেন্সে উপস্থিত অন্য সদস্যদের জিগ্যেস করলেন তাঁদের মতাে।

সবাই বললেন যে, আমার মতের পক্ষে যুক্তি আছে, হয়তাে যথেষ্টই আছে, কিন্তু আর্মির উপপ্রধানের মতের বিরুদ্ধে তর্ক করা কিছুতেই সমীচীন নয়। বুঝলাম উপস্থিত সবাই প্রবীণ অফিসার এবং বর্তমানে আর্মির ভাষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। এঁদের সবারই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। জাতীয়ভাবে যতাে গুরুত্বপূর্ণই হােক এই ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে উপ-প্রধানের সম্ভাব্য বিরক্তির উদ্রেক করার ঝুঁকি নিতে এঁরা কেউ রাজি নন (আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে পূর্বেই বলেছিলেন যে, আমিও যেন এই ঝুঁকি নিই)। তখন আমি জে, ইরশাদের দিকে তাকিয়ে তাকে বললাম, ‘স্যার, এখন আমি যা বলবাে তা সাধারণভাবে রীতিবিরুদ্ধ; তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি জে, হামিদকে সরাসরি বলতে চাই যে মতটি একান্ত আমারই, এই কোরের নয়। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে আমাকে অনুমতি দিন জে, হামিদ যেদিন এই পরিকল্পনাটি অনুমােদন করতে আসবেন সেদিন আমি সভাকক্ষে অনুপস্থিত থাকব।’ | পূর্বেই বলেছি জে. ইরশাদের সততা মানসিকভাবেও ছিল। কিছুক্ষণ ভেবে। তিনি রাজি হলেন এবং বললেন যে জে, হামিদকে তিনিই বলবেন, আর্মির এই পরিকল্পনার একটি ক্ষুদ্র পয়েন্টে খলিলের নিজস্ব ও একার একটি মন্তব্য আছে। ওর সনির্বন্ধ অনুরােধ আপনার অনুমতি পেলে মতটি প্রকাশ করতে চায়। মতটিতে কিছু যুক্তি আছে বলেই মনে হয়।  যা হােক উপ-প্রধানের সামনে আমি প্রস্তাবের পক্ষে আমার যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলাম । হয়তাে তিনি নিজেই ১৯৬৫ সালের পূর্বেকার এই পরিকল্পনাটির প্রবক্তা ছিলেন বলে বেশ অনেকক্ষণ ধরে যুক্তিতর্ক চলেছিল। শেষে উপ-প্রধান জে, হামিদ জে, ইরশাদকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন যে, সংশােধনী প্রস্তাবটি যেন সেনাসদরে পাঠিয়ে দেয়া হয়; তিনি বিবেচনা করে দেখবেন। এর পরপরই আমি মংলা ত্যাগ করে এসেছিলাম বলে সেই সংশােধনী প্রস্তাবের কি হয়েছে তার কিছুই জানতাম না। জে. ইরশাদের বক্তব্য সেই প্রসঙ্গ নিয়েই। বললাম, না স্যার শুনি নি। তবে ভালাে খবর স্যার।’ 

কিন্তু বুঝলাম না খবরটি ওঁর তখনি হঠাৎ করে মনে পড়লাে, নাকি এই মুহূর্তে বলার পেছনে অন্য কোনাে উদ্দেশ্য আছে। পরে বুঝেছিলাম যে, খবরটি ইচ্ছে করেই বলা। কারণ এরপর তিনি আমাকে যে প্রশ্ন করলেন তার উত্তর আমি এই বলে যেন পাশ কাটিয়ে না যাই যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার আমি কি বুঝবাে। ইরশাদ মানুষটি, পূর্বেই বলেছি, বাহ্যত কঠোর হলেও সৎ ও সরল। মানুষকে বিশ্বাস করতে তিনি অভ্যস্ত, কারণ তিনি নিজেও মানুষকে ঠকাতেন না। ইরশাদ জানালেন যে, নিয়াজি প্রস্তাব করেছেন যে প্রচলিত যুদ্ধনীতি পূর্ব পাকিস্তানে চলবে না। প্রচলিত নীতি হলাে শক্রর সম্ভাব্য আক্রমণ পথগুলােতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে যুদ্ধ আরম্ভ করা। যদি সুবিধামতাে পরিস্থিতি আসে তবে শক্রর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে আক্রমণ চালানাে ও শক্রর বুকের ওপর আঘাত হানা। যদি পরিস্থিতি বিপরীত হয় তবে যুদ্ধ করতে করতেই পশ্চাদপসারণ ও পেছনের কোনাে সুবিধাজনক স্থানে নতুন প্রতিরক্ষা গড়ে তােলা। শত্রুকে আক্রমণ ও তার দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অবাস্তব। কারণ যে সৈন্য সরঞ্জাম পূর্ব পাকিস্তানে আছে তা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অসম্ভব। অতএব, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হবে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অব্যাহত রাখা, যে পর্যন্ত তাদের শেষ রক্ষাকারী, এক্ষেত্রে চীন ও আমেরিকা, এগিয়ে না আসে এবং ভারতের অগ্রগতিকে নিরস্ত না করে।  যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের যাতায়াত পথ ভালাে নয় এবং আমাদের যান্ত্রিক পরিবহন ক্ষমতা নিতান্ত অপ্রতুল সেই হেতু এই প্রচলিত যুদ্ধপদ্ধতি ত্যাগ করে ‘দুর্গ প্রতিরক্ষা’ অর্থাৎ ফোট্রেস ডিফেন্স পদ্ধতি অনুসরণ করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনী কতােগুলাে ফোট্রেসে (দুর্গে) প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করবে। যেমন যশাের, কুষ্টিয়া, হিলি, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ইত্যাদি। এইসব ফোর্সেস যেকোনাে মূল্যে হােক সংরক্ষিত রাখতে হবে। শত্রু যদি এর ফাক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তবে তাকে সাঁড়াশি আক্রমণ দ্বারা ধ্বংস করতে হবে ও তার অগ্রগতি রােধ করতে হবে। জেনারেল।

ইরশাদ এই যুদ্ধ-কৌশল সম্বন্ধে আমার মতামত জিগ্যেস করলেন। আগে থেকেই তার ধারণা ছিল, বেশি উচ্চপদস্থ না হলেও এই রণকৌশল সম্বন্ধে আমার ধারণা আছে। আমার মনে পড়লাে ইতােপূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়াজির রণকৌশল ও সম্ভাব্য যুদ্ধ-পরিকল্পনা নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনের সাথে আমার প্রায়শ দীর্ঘ আলােচনা হতাে। বলাবাহুল্য, নিয়াজি ভুল রণকৌশল অবলম্বন করুক আমরা মনেপ্রাণে তাই চাইতাম। আমরা জানতাম যে, নিয়াজি যদি শেষ মুহূর্তে তার ষাট সত্তর হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে পারে তবে সেটা হবে আমাদের মিত্রবাহিনীর জন্য সবচাইতে মারাত্মক। কারণ ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তাদের সবদিক দিয়ে বেশি শক্তি নিয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গুটিয়ে ঢাকার কাছে পৌছতে সপ্তাহ কিংবা সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। কিন্তু তারপরই প্রায় চার-পাঁচশ’ বর্গমাইল ঘিরে একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখীন হতে হবে। এই প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে তাদের সামনে দুটি বিকল্প থাকবে। একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমান বাহিনী কিংবা গােলন্দাজ বাহিনীর কামান ব্যবহার করতে হবে। এই কার্যক্রমের ফলে যে সংখ্যায় বেসামরিক লােক হতাহত হবে তা হবে অগ্রহণযােগ্য। আর দ্বিতীয় বিকল্প হলাে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকার চারদিকে অবরােধ বেষ্টনী স্থাপন করা। এর অর্থ হবে ঢাকায় কোনাে সরবরাহ আসবে না। বেসামরিক লােকের জন্যও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।

অথচ এই সরবরাহ লাইন খুলে দিলেও বেসামরিক জনগণ উপকৃত হবে না, উপকৃত হবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে দ্রুত অগ্রগতি কঠিন হয়ে পড়বে, যুদ্ধ হয়ে যাবে স্থবির ও দীর্ঘ। এদিকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্ত্রবিরতির বিভিন্ন প্রস্তাব আনবে। বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র মিত্র দেশ সােভিয়েত রাশিয়াই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। অতএব, একমাত্র তারাই আমেরিকার অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়ােগ করতে পারে; কিন্তু। অনির্দিষ্টকালের জন্য তা করে যাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই ভারতকে প্রায় প্রতিদিনই রাশিয়ার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, শিগগিরই যুদ্ধ শেষ হয়ে। যাবে। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার একটি কি দুটো ভেটো প্রয়ােগ করার পরই জয়। নিশ্চিত হওয়া চাই। এমতাবস্থায় যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে পারলে পাকিস্তানের অত্যন্ত বড় লাভ। আর এটাই হবে মিত্রপক্ষের জন্য বড় সমস্যা। এদিকে নিয়াজি যদি সীমান্তে দশ-বারােটি দুর্গ-সম প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে। এবং ‘শেষ সৈনিক শেষ গুলি’ শপথ নিয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা করে তবে ভারতীয় বাহিনীর জন্য ঢাকা প্রবেশ সহজ হবে। ফোট্রেস অর্থাৎ দুর্গ-প্ৰায় জায়গাগুলােকে একদিকে যেমন শক্তিশালী বাহিনী দ্বারা আক্রমণ করে যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখতে হবে, অন্যদিকে তেমনি দুই দুর্গের ফাক দিয়ে কয়েকটি শক্তিশালী কলাম ভেতরে ঢুকবে। এদিকে ভারতের প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত ছত্রীসেনা ঢাকার কাছাকাছি অবতরণ করে নিয়াজির সৈন্যদলের জন্য পিছিয়ে ঢাকায় প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেবে। ভারতের সৈন্য সংখ্যার কোনাে অভাব নেই। তাদের শক্তিশালী বিমানবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের দুর্বল ও অপ্রতুল বিমানগুলােকে যুদ্ধ। আরম্ভ হওয়ার দু’চারদিনের মধ্যে ধ্বংস করে দেবে, যাতে নিয়াজি দিনের বেলায় তার দুর্গতেই অচল হয়ে আটকে থাকে। কারণ বেরুলেই বিমান থেকে গােলাবৃষ্টি আর রাতে তাে মুক্তিবাহিনী আছেই। পরে বিবৃত হয়েছে, যুদ্ধে পরাজয়ের পর ২০ ডিসেম্বর জেনারেল হামিদ খান আমাদেরকে উদ্দেশ করে তার বক্তৃতায় এই কথাটি বিশেষভাবে বলেছেন যে, ১০ ডিসেম্বর আমরা নিয়াজিকে আদেশ দিলাম যেন তিনি পশ্চাদপসারণ করেন এবং ঢাকায় ফিরে নতুন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন; কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন, ‘তা সম্ভব নয়।

কারণ দিনের আলােতে সৈন্যদের পথচলা সম্ভব নয়—ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য এবং রাত্রিতে সৈন্যদের চলা সম্ভব নয় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের জন্য।’ অতএব, অনতিবিলম্বে ঢাকার পতন হলাে, যদিও আমাদের বেশ কয়েকটি ফোর্সেস তখনও অক্ষত ছিল।  জেনারেল ইরশাদের প্রশ্নে আবার আসা যাক। এক মিনিট ভাবলাম। ইরশাদ মানুষ ভালাে বটে, কিন্তু তিনি কট্টর মনােভাবাপন্ন একজন পাঞ্জাবিও। বাঙালির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবির যে লড়াই চলছে সেখানে পাঞ্জাবির প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সহায়ক কোনাে ধরনের সঠিক বক্তব্য প্রদানের প্রশ্ন ওঠে না। বরং মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম যে, ছােটভাবে হলেও একটা সুযােগ এসেছে। প্রতিপক্ষকে বিপথে নেয়ার চেষ্টা করার। | অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থা, ভূমি বৈশিষ্ট্য, নদীনালা ইত্যাদির বিশ্লেষণ করলাম। এসব ব্যাপারে জেনারেল ইরশাদ যে বিশেষ কিছুই জানেন না, সেটা জানতাম। কারণ যে পাকিস্তানিরা ওখানে চাকরি করেছেন তারাও বিশেষ জানেন না যে, প্রত্যেক মৌসুমে পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি প্রকৃতির কিরূপ পরিবর্তন হয়। জুলাই-আগস্টে যেখানে ট্যাঙ্ক একশ’ গজ এগুলেই মাটিতে দেবে অচল হয়ে যাবে, সেই ভূমিতে আবার ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যােজন বিস্তৃত ট্যাঙ্ক দৌড় কোনাে সমস্যাই নয়। গ্রামের ঘরবাড়িগুলাে গাছপালা দ্বারা আবৃত ও ছড়ানাে-ছিটানাে। পাকিস্তানের বিরান ভূমিতে গুচ্ছ গুচ্ছ করে গড়ে ওঠা গ্রামের সাথে কোনাে তুলনাই হয় না।

অতএব, এইসব অবান্তর গােছের অনেক কথা অনেকটা বিকৃতভাবে বিশ্লেষণ। করে জেনারেল ইরশাদকে বােঝাতে সক্ষম হলাম যে, নিয়াজির প্রস্তাবিত ফোট্রেস ডিফেন্স ব্যতীত অন্য কোনাে প্রতিরক্ষা কৌশল পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর হবে না। ইরশাদ এই যুক্তির বিরুদ্ধে অনেক যুক্তিই তুলে ধরলেন। তবে। বাঁচোয়া এই যে, একদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতির শক্তি যে কতাে প্রবল এবং অন্যদিকে সর্বস্তরের জনগণ সেখানে কতােটা পাঞ্জাব-বিদ্বেষী তা পাকিস্তানিরা জানতাে না। অতএব, সেখানে যুদ্ধ করা কোনাে পাঞ্জাবি সৈন্যের পক্ষে যে কতাে কঠিন, সেটা পাকিস্তানিরা বুঝতাে না। তাদের বােঝার কোনাে উপায়ও ছিল না। কারণ তাদের খবর সরবরাহকারীরা সবাই হুকুম বরদার। মুষ্টিমেয় বাঙালি খবর সরবরাহকারীরা ছিল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ জাতীয় রাজনৈতিক এতিমরা। কর্তা যা জেনে খুশি হবেন সেসব বলেই তারা। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতেন।  আর ছিল বিহারিরা যারা বাঙালিদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাে। তারা বাঙালিদের প্রতিরােধ ক্ষমতা খাটো করে দেখিয়ে পাঞ্জাবিদের উৎসাহ যােগাত। কারণ ঐ একই, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা।  অতএব, ইরশাদ যদিও প্রচলিত রণকৌশলের পক্ষপাতী ছিলেন, তবুও ফোট্রেস ডিফেন্স নীতির কার্যকারিতা সম্বন্ধে অনেকটা প্রভাবান্বিত হলেন বলে। মনে হলাে। তখন রাত প্রায় একটা। আমি ঘড়ি দেখছি। আবার দেখা হবে, আজ এই পর্যন্ত থাকুক বলে ইরশাদ আমাকে বিদায় দিলেন। জেনারেল ইরশাদের সঙ্গে পরে আর দেখা হয় নি। 

 

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!