You dont have javascript enabled! Please enable it!

উপ-সেনাপ্রধান আবদুল হামিদ খানের সাথে সাক্ষাৎ

আগস্ট মাসে একটি বিজ্ঞপ্তি পেলাম যে, উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান সেনাসদরের সব ডাইরেক্টরের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। উদ্দেশ্য তাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে আলােচনা ও নিজ নিজ বিভাগীয় দক্ষতার উন্নয়নের দিকনির্দেশনা প্রদান। আমার জন্য একটি দিন-তারিখ ধার্য করা আছে। আমার তাে বিশেষ কোনাে কার্যক্রম নেই । অতএব, ভেবেই নিলাম যে, আমার সাথে আলােচনা পেশাগত দিকে বিশেষ ঘেঁষবে না, মােড় নেবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির দিকে। নির্ধারিত দিন ও সময়ে উপস্থিত হলাম। অনেকক্ষণ বিভিন্ন কথাবার্তার পর উঠলাে পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে আলােচনা। আমি মনে মনে অনেকটা প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। ইয়াহিয়া খান ছিলেন প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মেধাবী অফিসার হিসেবে খ্যাত ছিলেন; কিন্তু ১৯৬৯ সালে সামরিক শাসক হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রক্ষমতা তার হাত থেকে চলে যেতে থাকে। যে গ্রুপটি এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে থাকে তাদেরকে সবাই বলতাে পাঞ্জাবি গ্রুপ। এই গ্রুপের নেতা ছিলেন জেনারেল হামিদ খান। তবে এর সদস্যরা সবাই পাঞ্জাবি ছিলেন না। এই দলে ছিলেন সর্ব-জেনারেল পীরজাদা, আবু বকর মিঠুঠা, খুদাদাদ, ওমর প্রমুখ। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা পছন্দ করতেন কিন্তু সেই সাথে শরাব ও মেয়েমানুষও কম পছন্দ করতেন না। এই সুযােগ নিয়ে হামিদ গ্রুপ আসল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ও প্রয়ােগ করতে থাকেন। যখন হামিদ খানের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে তখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অনেকটার অধিকারী। অতএব, আমি স্থির করলাম যে, এমনি শেষ মুহূর্তেও যদি এই ক্ষমতাধর জেনারেলকে বােঝাতে পারি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি রাজনৈতিক, সামরিক নয়, তাহলে হয়তাে রক্তপাত বন্ধ হলেও হতে পারে। আলােচনার গতি-প্রকৃতি নিয়ে আমার অনুমান ঠিক প্রমাণিত হলাে। তিনি মিনিটখানেক আমার বিভাগ সম্বন্ধে আলাপ করার পরই চলে গেলেন পূর্ব। পাকিস্তানের সমস্যায়। যা বললেন তার সারাংশ হলাে নিম্নরূপ : পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি সৃষ্টি করেছে ভারত। ভারতের উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা, সেই লক্ষ্যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে বিরােধ বাধিয়ে রেখেছে। তবে বর্তমানে সব আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে; কিন্তু মনে হয় ভারত অতাে সহজে ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই বাধবে। যুদ্ধ যদি হয় তবে এবার ভারতকে আমরা উচিত শিক্ষা দেবাে। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতের এতাে বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেবাে যেন ভারত শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় আমাদের সাথে সন্ধি করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।

এই কথাগুলাে সবিস্তারে বলতে হামিদ খানের মিনিট বিশেক লাগলাে। আমিও চুপ করে শুনে গেলাম। অপেক্ষা করছিলাম তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তিনি আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চান কি না। তার কথা শেষ হলাে। তখন তিনি প্রশ্ন করলেন, “তােমার কি মনে হয়।’ বললাম, ‘স্যার, এতােক্ষণ আপনি ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ, তার প্রকৃতি ও আকৃতি, অন্তিম ফলাফল কেমন হবে এসব নিয়ে বললেন। এসব বিষয়ে আমি আপনার সাথে একমত। আপনার অভিজ্ঞতার সাথে আমার অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না। তাই আমি আপনার সব কথা মনােযােগ দিয়ে শুনছিলাম। সর্বক্ষণই আপনি দুটি প্রতিপক্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ দিয়েছেন; কিন্তু এতে যে আরও একটি পক্ষ অর্থাৎ ফ্যাক্টর আছে তা একবারও বলেন নি। সে পক্ষটি পূর্ব পাকিস্তান এবং তার অধিবাসীবৃন্দ, বাঙালি। আপনার এই যুদ্ধ পরিস্থিতির আলােচনাতে সেই ফ্যাক্টরটি কি ধর্তব্যের মধ্যে নেই। পাকিস্তান এবং ভারত এই দুটিই কেবল ফ্যাক্টর। বাঙালির মনােভাব কি এর মধ্যে কোনাে ফ্যাক্টর নয়? মনে হলাে হামিদ খান এই প্রশ্নটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, অথচ আমি তার সাথে সাক্ষাতের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে রেখেছি পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা ও তার বাস্তবসম্মত সমাধান খোজার প্রচেষ্টা। হামিদ খান আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন যে, আমি এ সম্বন্ধে কি বলতে চাই। আমি জানতে চাইলাম, পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যেসব খবর পান তা যে সঠিক এ কথাটা তারা কীভাবে যাচাই করেন। আমার তাে মনে হয় সব খবরই একতরফা। কর্তৃপক্ষ যা শুনতে চান তাই তাদেরকে শােনানাে হয়। হয়তাে সত্য তা থেকে বহু দূরে। স্বাভাবিকভাবেই হামিদ প্রশ্ন করলেন, আমি কীভাবে জানি যে কর্তৃপক্ষের প্রাপ্ত সব খবর সঠিক নয়। তখন আমি একটি উদাহরণ দিয়ে কথাটা বােঝাতে। চেষ্টা করলাম। প্রথমেই বললাম যে, কর্তৃপক্ষকে দেয়া খবরগুলােতে কোনাে বাঙালির পক্ষ থেকে দেয়া খবর নেই। বাঙালির আসল মনােভাব ও অনুভূতি তাে বাঙালি ছাড়া কারও পক্ষে সম্যকভাবে জানা ও অনুধাবন করা সম্ভব নয়। 

অথচ খবর প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে কোনাে বাঙালি নেই। এই বলেই উদাহরণটি দিলাম।  বললাম, ‘ধরুন একজন বাঙালি ও একজন পাঞ্জাবি কিংবা বিহারি অফিসার এক হেলিকপ্টারে করে উড়ে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলের ওপর দিয়ে। বেশ নিচু দিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা দেখল নিচে এক নির্জন এলাকায় একজন লােক একটি মেয়েকে ধর্ষণ করছে। তারা উভয়ে স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখলাে। তারা ফিরে এসে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি সম্বন্ধে প্রতিবেদন পেশ করবে। সেখানে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পাঞ্জাবি কিংবা বিহারি অফিসারটি জানাবে যে, একজন বিহারি মহিলাকে একজন বাঙালি কর্তৃক ধর্ষিত হতে আমি নিজ চোখে দেখে এলাম। এদিকে বাঙালি অফিসারটি তার প্রতিবেদনে লিখবে যে, সে নিজ চোখে দেখেছে যে একজন বাঙালি মহিলাকে একজন বিহারি কিংবা পাঞ্জাবি ধর্ষণ করছে। তাই না?’ মনে হলাে হামিদ খান কিছুটা ব্ৰিতবােধ করলেন। হয়তাে-বা ঠিক এভাবে আগে চিন্তা করেন নি। অতএব, সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও কিছুটা বিচলিত হলেন; কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ পূর্বনির্ধারিত। বিশ্বাসে অনড় থাকেন। তাদের বিশ্বাস যুক্তিতর্ক দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। এক্ষেত্রেও সেই সত্যের ব্যতিক্রম হলাে না। হামিদ খান যা বললেন তার মর্মার্থ এই যে, মুশকিল তাে এখানেই, বিশ্বাসযােগ্য ও প্রবীণ কোনাে বাঙালি অফিসার এ কাজের জন্য পাওয়া যাচ্ছে। তবুও আমি যখন বলছি তখন তিনি চেষ্টা করবেন এমন কোনাে বাঙালি অফিসার পাওয়া যায় কি না; কিন্তু সেই বাঙালি অফিসারকেও তাে দেশপ্রেমিক ও চরিত্রবান হতে হবে। বুঝতে বাকি রইলাে না এর অর্থ কর্তৃপক্ষের হা-এর সাথে সুর মেলাবার মতাে হতে হবে। এ কথা শােনার পর আমার আর সন্দেহ রইলাে না যে, বাংলাদেশের ওপর। নির্মম সামরিক আঘাত পাঞ্জাবি সামরিক কর্তৃপক্ষের পূর্ব পরিকল্পিত, তা বদলাবার নয়। সবচাইতে বড় কথা, আমার পুনরায় মনে পড়লাে, লারকানা ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার তাে এই হামিদও ছিলেন। অতএব, আমাদের দেশের প্রস্ফুটোনুখ নবীন গােলাপগুলাের অকালে দলিত হওয়া ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। জানতাম বিজয় ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনাে পথ খােলা নেই। তবে তার জন্য যে বিপুল মূল্য দিতে হবে সেটা কোনােভাবে যদি কমানাে যেতাে! এছাড়া আরও মনে পড়লাে, ১৭ জানুয়ারির লারকানা ষড়যন্ত্রে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিলেন হামিদ খান। তিনি তাে মনস্থির করে আছেন যে, বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। হামিদের অফিস থেকে কুশল বিনিময় করে বিদায় নিলাম। ততােক্ষণে আমি ভালােভাবে বুঝতে পারলাম শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে নেমেছে এই পরিকল্পনা করেই যে আঘাত এমন হবে যেন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক কি দুই প্রজন্মের বাঙালি মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং মিশেই থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তারা যেন কখনাে কোনাে মাথাব্যথার কারণ না হয়। সেই প্রধান পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে হামিদও একজন। অতএব, তার পক্ষে অন্য কথায় কান দেয়া সম্ভব নয়।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!