হিন্দুস্তানি কর্নেল
আগস্টের প্রথম দিকে করাচি গিয়েছিলাম, পূর্বেই বলেছি। ফেরার পথে আমার পাশে বসা নৌবাহিনীর উর্দি পরিহিত এক ক্যাপ্টেন অর্থাৎ কর্নেল। আমার পরনে সুট-টাই। আমি আর পরিচয় দিলাম না। বিমান উড়তে লাগলাে। তিনি একটি টাইপ করা প্রতিবেদন বের করে পড়তে লাগলেন। পরে বুঝলাম প্রতিবেদনটি তাঁরই লেখা, তিনি সেটার প্রুফ দেখছেন। তিনি পড়ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আড়চোখে আমিও পড়ছিলাম। প্রতিবেদনটি ছিল ‘অতীব গােপনীয়’ ছাপ। দেয়া। অতএব, আমার আগ্রহ সমধিক। প্রতিবেদনটি বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কার্যক্রম সম্বন্ধে। প্রথম অর্ধেকাংশে সমস্যাটি কীভাবে শুরু হলাে তার বিস্তারিত বিবরণ, অতঃপর আলােচনা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া, সমস্যাটি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং সমাধানও যে রাজনৈতিকভাবে এসব বিষয় অত্যন্ত সঠিকভাবে লেখা। কিন্তু শেষ অধ্যায়ে গিয়ে অনেকটা অসঙ্গতভাবেই উপসংহার, যেহেতু শেখ মুজিব দেশপ্রেমিক নন, বরং তিনি দেশকে দু’ভাগ করতে চেয়েছিলেন, এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আঘাত হানা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না।’ প্রথমার্থে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাদের দ্বারা বিহারিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার কথাও ছিল। তবে বিহারিরা যে বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করছিল সেটাও লেখা আছে। উপসংহারটি ছাড়া বাকি প্রতিবেদন অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ। পড়া শেষ হলে ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকিয়ে আমার সাথে পরিচয় করলেন। আমার সামরিক চাকরি ও পদবি শুনে অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। তিনি তখনও বুঝতে পারেন নি যে আমি বাঙালি। বাঙালি আবার ব্রিগেডিয়ার হয় কী করে? তেমন সন্দেহ চট করে জাগে না। আমি বুঝলাম ক্যাপ্টেন হিন্দুস্তানি, হতে পারে বিহারি এবং সামরিক বাহিনীর গণপ্রচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। হয়তাে প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিংবা জেনারেল হামিদের অফিসের জন্যই তৈরি । মনে হলাে নির্দেশ এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে আর্মি অ্যাকশন, তৎপরবর্তী অবস্থা, জনগণের মনের ওপর প্রতিক্রিয়া, পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়েছে কিনা, না হয়ে থাকলে হতে কতােদিন বাকি ইত্যাদি খবর চেয়ে প্রতিবেদন প্রণয়নের। এ সবগুলাের উত্তর প্রতিবেদনটির উপসংহারে বলা আছে।
পূর্ব পাকিস্তান ধরতে গেলে স্বাভাবিক আছে, কেবল দু’এক জায়গায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা হিন্দুদের (যারা মূলত ভারতীয় চর) নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু গােলমাল করছে। তবে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা (অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর গােলাম আজম গং) ওদেরকে সফলভাবে মােকাবিলা করছে। প্রতিবেদনটি পড়ে (যদি পড়ার সময় হয়) ইয়াহিয়া খান কিংবা হামিদ খান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাঁদের ব্ল্যাক ডগ’ নামক প্রিয় হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেবেন এবং প্রতিবেদকের প্রতি ভবিষ্যতে সুনজর রাখবেন। আমি ক্যাপ্টেনের (সেনাবাহিনীর কর্নেল পদমর্যাদাসম্পন্ন) সাথে গল্প জমাবার জন্যই পরিচয় দিলাম যে, আমি বাঙালি। তাতে ক্যাপ্টেন কিছুটা আশ্চর্য হলেও চিন্তিত হলেন না-বােধহয় এই ভেবে যে, যে অফিসারটি বাঙালি হয়েও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে এতােটা উর্ধ্বপদে উন্নীত হতে পেরেছেন, তিনি নিশ্চয়ই ‘দেশপ্রেমিক’ (অর্থাৎ অখণ্ড পাকিস্তানপ্রেমিক) হবেন। নানা কথার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ উঠলাে। আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলাে যে, অফিসারটি বিহারি। ওঁর সাথে কোনাে আলােচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার আকাক্ষা আমার ছিল না। তবে সময় কাটানাের জন্য অনেকটা কৌতুকভরেই তাকে বললাম যে, বাঙালিরা মুসলমান হলেও হিন্দুদের প্রভাবে দেশপ্রেমিক না হয়ে, হয়ে গেছে পথভ্রষ্ট। এর মধ্যে বাস করে মুষ্টিমেয় বিহারি। অনেকটা যেমন মাছ হয়ে কুমিরের সাথে বসবাস করার মতাে। বাঙালি তাে এবার শায়েস্তা হয়েই গেছে; কিন্তু ভবিষ্যতেও তাে এরা বিহারিদের আপন ভাববে না। বিহারিরাও তাে নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি ভুলে বাঙালিদের সাথে মিশে যাবে না। এমতাবস্থায় এইসব বিহারির জন্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকা একটি সমস্যা হয়ে দাড়াবে না কি? আমার কাছ থেকে এমন উটকো প্রশ্ন ক্যাপ্টেন ঠিক আশা করেন নি। তবে হঠাৎ যেন চিন্তিত হয়ে গেলেন। বললেন, প্রশ্নটি আমার মনেও যে আসে নি। তা নয়।’ আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনার কি মনে হয়? বললাম, “উত্তরটা জানি না বলেই তাে তােমাকে জিগ্যেস করলাম । সবচাইতে বড় মুশকিল এই যে, এরা বাস করে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলাদেশে অথচ মনেপ্রাণে হতে চায় পাঞ্জাবি কিংবা পাঠান। বর্তমানে পাঞ্জাবিরা এদেরকে সাদরে কাছে টেনে নিয়েছে। কিন্তু মূলত তাে পাঞ্জাবিরা এদের গ্রহণ করবে না, উর্দু ভাষাভাষী হলেও। কারণ এরাও তাে বাঙালিদের মতাে, অতাে কালাে না হলেও কালােই এবং ক্ষুদ্রাকৃতিরই।
এদিকে টাকা পয়সা ও শিক্ষাদীক্ষার দিক দিয়েও এরা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিম হিন্দুস্তানের কিছু অংশের লােককে বাস্তুহারা হিসেবে গ্রহণ করেছে; কিন্তু দক্ষিণ ভারত ও পূর্ব-ভারতীয় মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানে ঢুকতে দেয় নি। দেশভাগের পরও। ভবিষ্যতেও ঢুকতে দেবে না বলে আমার বিশ্বাস। এ কথা বলে ক্যাপ্টেনের মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম। ক্যাপ্টেনকে যেন আরও চিন্তিত মনে হলাে। বললেন, আপনার কথাগুলাের মধ্যে সত্যতা আছে। এ সত্যগুলাে কেবল আপনি নন, আমরাও বাস্তব জীবনে দেখেছি। এরা অর্থাৎ পাঞ্জাবি, পাঠানরা তাে আমাদের নিজেদের সমকক্ষ ভাবে না। হ্যা, তাই ভাবছি এই সমস্যাটি সমস্যা হিসেবে থেকে যাবে। তাই না? ততােক্ষণে আমাদের বিমান পিণ্ডির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এদিকে আমার কৌতুক স্পৃহাও শেষ হয়ে গেছে। তাঁকে বললাম, ‘আমি যত দূর জানি পূর্ব পাকিস্তানের বিহারিদের কোনাে প্রজ্ঞাবান নেতা নেই। থাকলে তিনি বােঝাতেন যে, হয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সকলকে উর্দুভাষী, দেশপ্রেমিক মুসলমান করে ফেল। আর তা যদি তােমাদের সাধ্যে না কুলােয় তবে ওদের সাথে মিশে যাও। কারণ ধনী ও শক্তিশালী ব্যক্তি ভাষার দিক দিয়ে তােমার যতাে আত্মীয় হােক না কেন, সে তােমাকে তার ঘরে ঢুকতে দেবে না।’ পিণ্ডি এসে পড়ায় কথা আর এগােয় নি। আমরা বিদায় নিলাম। পরে এই ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা হয়েছে। মনে হয়েছে তিনি আমার সঙ্গে আরাে আলাপ করতে চান; কিন্তু আমি এড়িয়ে গিয়েছি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা