বিচারপতি নূরুল ইসলাম
জুলাই কি আগস্ট মাস। একদিন অফিসে বসে আছি ব্যক্তিগত সহকারী বললেন, আপনার এক বাঙালি বন্ধু টেলিফোনে অপর প্রান্তে। ফোন হাতে নিলাম। ‘কে খলিল? আমি নূরুল ইসলাম।’ ভাবতে লাগলাম কোন নূরুল ইসলাম। “আরে কলকাতা বেকার হােস্টেলের নূরুল ইসলাম, যাকে তােমরা… বলে। ডাকতে।’ “ওহ জাস্টিস নূরুল ইসলাম? তুমি কোথেকে? পিণ্ডি কবে এলে? ‘ভাই খলিল, আমি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আছি। তােমার সাথে জরুরি কথা বলা দরকার; কিন্তু তােমার অফিসে আসা তাে মুশকিল, নানা রকমের বাধা। তুমি কি এখনই আসতে পারবে? হাতে কোনাে কাজ ছিল না। বললাম, আসছি। নূরুল ইসলাম ও আমি ছাত্রজীবনে কলকাতার বেকার হােস্টেলে এক ব্লকে থাকতাম। অন্তরঙ্গ বন্ধু । ওকালতি শুরু করে হাইকোর্টে বিচারপতি হয়েছেন বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের রেডক্রসের সভাপতি (নূরুল ইসলাম জেনারেল এরশাদ সরকারের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও পরে উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির টিকিট নিয়ে সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন)। হােটেলে পৌঁছতেই চায়ের হুকুম, তারপর নূরুল ইসলাম জানতে চাইলেন, ‘পাকিস্তানের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে?’ নূরুল ইসলাম ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ । অতএব, কোনাে সঙ্কোচ না করেই উত্তর দিলাম, ‘পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে কী লাভ হবে। পাকিস্তান তাে ভেঙে গেছে সেই পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতে। এখন তাে শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। তবে তুমি এ প্রশ্ন কেন করছাে? আমার কথা শুনে নূরুল ইসলামের ফরসা মুখটা সাদা হয়ে গেল। তবে যে ওরা বলে সব ঠিক হয়ে গেছে। আর তুমি বলছাে পাকিস্তান ভেঙে গেছে? তখন বুঝতে পারলাম নূরুল ইসলামের কোনাে সমস্যা আছে। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী নূরুল ইসলামকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে বলেছেন, রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসেবে জেনেভা ও জাতিসংঘে গিয়ে সবাইকে বলতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে এখন কোনাে সমস্যা নেই। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলাে যা বলে তা মিথ্যে। বিচারপতি হিসেবে নূরুল ইসলামের কথার মূল্য আছে। তাই রাও ফরমান আলীর নির্দেশে নূরুল ইসলাম প্রথমে জেনেভা ও পরে আমেরিকা ইত্যাদি দেশে যাবেন। নূরুল ইসলাম একা নন। তাঁর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীন মুহম্মদও আছেন।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাে, কোন দীন মুহম্মদ? সেই রাজাকারের রাজা দীন মুহম্মদ তাে নয়? ‘হ্যা, সেই দীন মুহম্মদ। তিনি পাশের কামরায় নামাজ পড়ছেন। এখনই এখানে আসবেন।’ বললাম, তবে উনি আসার আগেই আমাদের কথা শেষ হওয়া প্রয়ােজন। ওর সামনে আমি খােলাখুলি কথা বলবাে না। কেননা উনি পাকিস্তানের একজন বেতনভুক চর।’ আমি জিগ্যেস করলাম, নূরুল ইসলাম, তুমি এর মধ্যে জড়িত হতে গেলে কেন? শান্তিতেই তাে ছিলে। বাংলাদেশ তাে স্বাধীন হবেই। তারপর তুমি পরিগণিত হবে রাজাকার হিসেবে। আমি তােমাকে যতােটা জানি তুমি তাে নিছক কিছুটা ভীতু, কর্তৃপক্ষ-ঘেঁষা ও ছা-পােষা গােছের লােক। তুমি তাে রাজাকার নও বরং তুমি নিজে ধার্মিক হলেও অসাম্প্রদায়িক সমূহ বিপদের ঝুঁকি নিয়েও তুমি হিন্দু-মুসলমান রায়টের সময় দেবেশ ভট্টাচার্যের পরিবারকে মাসের পর মাস আশ্রয় দিয়েছে। তােমার শ্রদ্ধেয়া স্ত্রী একজন স্বনামখ্যাত কবি। তা তুমি এই বিতর্কিত ব্যাপারে জড়িত হতে গেলে কেন?’ আমার কথা শুনে নূরুল ইসলাম কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘খলিল, তুমি তাে জানাে না ঢাকায় আমাদের অবস্থা কি? ছেলেপুলে নিয়ে বাস করি । কোনাে নিরাপত্তা নেই। রাও ফরমান আলীর অবাধ্য হবাে? সে সাহস আমি পাবাে কোথায়? আমি পেলেও আমার স্ত্রী ও পরিবারবর্গ পাবে কোথায়? অতএব, যেতেই হবে জেনেভায়। অন্যথায়? না, আমি কল্পনাও করতে পারি না’, বলে নূরুল ইসলাম কাদতে লাগলেন। আমার খুব মায়া লাগলাে এই বিপন্ন লােকটির ওপর; কিন্তু কী-ই-বা করতে পারতাম তাঁর জন্য। কিছুক্ষণ পরে অধ্যাপক ড. দীন মুহম্মদ এলেন ঘরে। নূরুল ইসলামকে কাঁদতে দেখে কিছুটা অস্বস্তি বােধ করলেন; কিন্তু একটু পরেই স্বাভাবিক কণ্ঠে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। চোখে-মুখে দৃঢ়মনস্ক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির ছাপ। আমাকে জিগ্যেস করলেন, পরিস্থিতি কেমন বুঝছেন? উত্তরে বললাম, পরিস্থিতির সরেজমিনে তাে আপনারা। অতএব, আপনিই বলবেন পরিস্থিতি কি। আমরা এতাে দূরে থেকে পরিস্থিতি কি বুঝবাে। তবে শুনেছি সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।’ ‘আমি তাে তাই বলছি। কিন্তু আপনার এই বন্ধুটি আমাদের কথায় আস্থা আনতে পারছেন না। ভয় পাচ্ছেন। অনর্থক।’ বুঝলাম আমার বন্ধু নূরুল ইসলাম শক্তিমান লােকের খপ্পরে এবং তাকে উদ্ধার একটি অসম্ভব কর্ম। তাই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম। তবে নূরুল ইসলাম উপাখ্যান এখানেই শেষ নয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আমাকে অনুরােধ করলেন যে, আমি যেন সাক্ষ্য দিই যে তিনি নিজের ইচ্ছায় জেনেভা যান নি। তা হলেই তিনি তাঁর পূর্বপদে বহাল হতে পারবেন। তিনি এটর্নি জেনারেল অ্যাডভােকেট ফকির শাহাবুদ্দিনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি সুপারিশও করেছিলাম। তবুও কাজ হয় নি। তবে শেখ মুজিব সরকারের পতনের পর নূরুল ইসলাম রাজনীতিতে জড়িত হয়ে স্বাধীনতা-বিরােধী শক্তির সাথেই একাত্ম হয়েছিলেন। তখন মনে সন্দেহ। জাগতাে যে, নূরুল ইসলামকে জেনেভা পাঠানাের জন্য রাও ফরমান আলীকে হয়তাে বেশি বেগ পেতে হয় নি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা