You dont have javascript enabled! Please enable it!

জেনারেল শওকত রেজা

শুনলাম অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল শওকত রেজাকে ‘যুদ্ধে অনীহা প্রদর্শনের কারণে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কমান্ড হারিয়ে তিনি হয়েছেন পাকিস্তান সেনাসদরে আমাদের উপরস্থ জেনারেল স্টাফের উপ-প্রধান। যদিও পদ হিসেবে ততােটা খারাপ নয় তবে বােঝা গেছে শওকত রেজার সামরিক ভবিষ্যৎ সমাপ্ত-প্রায়। পূর্বেই বলেছি, দু’একজন অন্তরঙ্গ পাকিস্তানি বন্ধুর মাধ্যমে আমি সব খবরই যােগাড় করতে পারতাম। শওকত রেজা অকৃতদার ও সামরিক পেশায় একান্ত নিবেদিতপ্রাণ। এছাড়া অতীব মেধাসম্পন্ন অফিসার হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। আমরা অনুমান করতাম তিনি ভবিষ্যতে সেনাপ্রধান হবেন। সেনাবাহিনীর অফিসার্স। মেসের একটি সাধারণ কামরায় থাকতেন। নিতান্ত গ্রামীণ ভদ্রলােকের মতাে। তার বাহুল্যবর্জিত জীবনধারা ও আবাস। সেনাবাহিনীর দেয়া বেতের চেয়ারগুলাে ছিল তার সােফা সেট। আমি একদিন মেহমান হয়ে গিয়েছিলাম তাকে সালাম করতে । চা দিলেন আর খেতে দিলেন তার সৈনিক ব্যাটম্যান দ্বারা প্রস্তুত আটার হালুয়া।  আমি যে দফতরের ডাইরেক্টর ছিলাম, শওকত ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ডাইরেক্টর। সেনাবাহিনীর সংগঠন ও রণ-কৌশল বিষয়ে গবেষণা করা ছিল ঐ দফতরের কাজ। এক্ষেত্রে তার মৌলিক অবদান রয়েছে। তিনি শুধু কাজেকর্মেই সৎ ছিলেন তা নয়, জেনারেল ইরশাদের মতাে মনে-প্রাণেও সৎ। একইভাবে সত্য কথাটা সােজা ভাষায় বলা ছিল তার অভ্যাস। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। এছাড়াও বাঙালিরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না সেটা অনুভব করে তিনি সাধারণভাবে বাঙালি অফিসারদেরকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন।  তার সামরিক পেশার হঠাৎ ইতি ঘটার কাহিনী শুনতে পেলাম পরে। ঘটনাটি ছিল এইরূপ। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সকল ডিভিশন কমান্ডারের কনফারেন্স হচ্ছিল। এক সময় কোনাে অফিসার নালিশ করেছিলেন যে, দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৈনিক দ্বারা নারী ধর্ষণের অপরাধ ঘটছে। এর উত্তরে নিয়াজি নাকি বলেছিলেন, “দেখ, বর্তমানে আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিকভাবে ঘটে বলে ধরে নিও।’ তারপর অত্যন্ত উঁচুমানের কৌতুক মনে করে বললেন, ‘ভালােই তাে, এইসব বাঙালি রক্তে পাঞ্জাবি রক্ত মিশিয়ে এদের জাত উন্নত করে দাও।’

এই কথা শুনে নিবেদিতপ্রাণ সৎ সৈনিক শওকত রেজার আর সহ্য হয় নি। তিনি দাড়িয়ে বললেন, ‘আশা করি আপনার এই বক্তব্য কনফারেন্স শেষে যে মিনিটস’ সর্বত্র (পাকিস্তান সেনাসদরসহ) প্রেরণ করা হবে, সেখানেও ঠিক এই ভাষায় লেখা থাকবে।’ নিয়াজি বিরক্ত হয়ে বিষয়টা হালকা করার চেষ্টা করলে শওকত রেজা জোরের সাথে বলেছিলেন, ‘এটা আপনার নির্দেশ বলেই আমরা ধরে নেবাে। অতএব, আপনার এই বক্তব্য লিপিবদ্ধ করাকে আমি সৈনিকসুলভ সততা ও সাহসিকতার পরিচায়ক বলে মনে করি।’  আর যায় কোথায়? নিয়াজি তাকে সেখানে কিছু বলার সাহস না পেলেও শওকত রেজার যুদ্ধ করার মতাে গুরদা’ নেই বলে প্রতিবেদন লিখে তাকে। পাকিস্তানে ফেরত পাঠান। যদিও শওকত রেজা তার উজ্জ্বল পেশাগত ভবিষ্যৎ এভাবে নষ্ট হবে ভাবেন নি, তবুও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেয়ে স্বস্তি অনুভব করেছেন।  নিয়াজির অনুরূপ কেবল একটি বক্তব্য শুনেই শওকত রেজা চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন নি। নিয়াজি প্রায়শ বলতেন, ‘মনে রেখাে, This is a low lying country- people here are low and they lie.’

 

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!