You dont have javascript enabled! Please enable it!

কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী

এর কয়েকদিন আগে মেজর মান্নান সিদ্দিকী (পরে মেজর জেনারেল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) আমাকে বলেছিলেন যে, ‘স্যার, গতকালের পাকিস্তান রেডিও শুনেছেন? না শুনি নি তাে। কেন? ‘স্যার, অবাক কাণ্ড! মেজর কাইয়ুম চৌধুরী (মুনীর চৌধুরীর ভাই) বার্লিনে গেছেন একটা প্রশিক্ষণ কোর্সে। সেখানে এতাে সুযােগ ছিল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার অথচ তা না করে মুনীর চৌধুরীর মতাে লােকের ভাই যে ভাষণ দিয়েছে রেডিও পাকিস্তানে তা শুনে কতােটা ঘেন্না ধরে গেছে তা বলার ভাষা আমার জানা নেই। শেখ মুজিবকে তাে গাদ্দার বলেছেই, তাছাড়া বলেছে, মুজিব তুমি জানাে না তােমার মতাে কুলাঙ্গার এই সােনার দেশটির কি ক্ষতি করেছে ও করছে।’ কাইয়ুম ছিলেন অত্যন্ত কৃতী ব্যক্তি, তার ভাষা, শব্দ চয়ন ও বলার ভঙ্গি সব মিলে এই ইংরেজি বক্তৃতা যেমনি আকর্ষণীয় তেমনি ঘৃণা উদ্রেককারী’ বলে মান্নান জানালেন। মেধাবী হিসেবে কাইয়ুম আমাদের অহঙ্কার ও স্নেহের পাত্র ছিলেন। মনটা নিতান্তই খারাপ হয়ে গেল। তবে ঘটনাটা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম; কিন্তু এর দু’এক মাস পরে কাইয়ুম আমার বাসায় এসে হাজির। অক্টোবরের শেষ কিংবা নভেম্বরের প্রথম দিকের কথা। বাসায় বসে আছি। মুনীর চৌধুরীর ছােট ভাই মেজর কাইয়ুম চৌধুরী এলেন। যদিও জার্মানিতে প্রশিক্ষণ অবস্থায় তার রেকর্ডকৃত বক্তব্য পাকিস্তানে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল, প্রচারের বিষয়বস্তু আমি মােটামুটি পুরােপুরিভাবে জেনেছি, তবুও এ কথা বলতে পারবাে না যে ওকে দেখে খুশি হই নি। এর প্রধান কারণ ওঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্নেহ করতাম। ১৯৬৭ সালে একবার সেনাবাহিনীতে বাঙালি ক্যাডেটে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করার জন্য দুটো টিম গঠিত হয়েছিল। কাইয়ুম আমার টিমে ছিলেন। তখন ওঁর কথাবার্তা বিশেষ করে বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ইতােপূর্বে কাইয়ুম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কোর্স সমাপনকালে ‘সম্মানীয় তরবারি’ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করাতেও আমরা ছিলাম গর্বিত; কিন্তু যখনি বেতারে ওঁর বক্তব্যের কথা মনে পড়লাে—মনটা বিরূপ হয়ে গেল। তাই ওঁর সাথে গল্প বিশেষ জমলাে না। ওঁ বারবার প্রশ্ন করলেন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কি? এই প্রশ্নের উত্তর ওঁকে দিতে আমার মনে এক প্রকার ঘৃণার উদ্রেক হলাে। সংক্ষেপে বললাম, অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে, এখন কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া বাকি।

আমার কথা শুনে বুদ্ধিমান কাইয়ুম এতােটা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন বুঝতে পারি নি। তিনি কটুকণ্ঠে আমার কথার প্রতিবাদ করে বললেন, ‘ওখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে আপনার চিন্তা একান্তই ভুল। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর আমি আলােচনা বন্ধ করে দিয়ে বললাম, কাইয়ুম, তুমি কোথায় উঠেছ?” এই মাত্র দেশে ফিরেছে এবং কোথাও এখনও ওঠে নি শুনে বললাম যে, আমার অতিথি কামরা খালি আছে। ইচ্ছে করলে আমার অতিথি হতে পারাে। কাইয়ুম তাতে রাজি হলেন না। বরং আবার প্রশ্ন করলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্বন্ধে নিজেকে এতােটা সঠিক মনে করি কেন? এতােক্ষণে আমারও ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল। বললাম, “দেখ কাইয়ুম, তুমি বিদেশ থেকে পালিয়ে দেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের পরিবর্তে পাকিস্তানে ফিরে এসেছ। তােমার তাে দেশের খবর জানার কথাও নয়। কারণ তুমি যে পরিস্থিতিতে বসবাস করাে (কাইয়ুম ওর চাইতে অনেক অধিক বয়সী এক পাঞ্জাবি গৃহবধূর সাথে বিবাহে আবদ্ধ হয়ে তার সাথেই বসবাস করতাে) তাতে তুমি বাঙালি সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এবং তােমার মনও বাঙালির। ব্যাপারে অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। আমি কথাটা ইংরেজিতে বলেছিলাম, Qayyum, you are isolated from our society and your mind is insulated.’ কথাটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই কাইয়ুম অত্যন্ত রেগে গেলেন এবং কিছুটা অপমানিতও বােধ করলেন। কিন্তু আমি তাকে কথা বলার সুযােগ না দিয়ে। দরজা দেখিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালাম। বুদ্ধিমান কাইয়ুম আর প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন নি। পরে শুনেছিলাম কাইয়ুম পাঞ্জাবি জেনারেল শওকত রেজার মেহমান হয়েছেন। শুনে মনে হলাে ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নতির জন্য বাঙালি ব্রিগেডিয়ারের চাইতে পাঞ্জাবি জেনারেলের আতিথ্য গ্রহণ হয়তাে শ্রেয় বলে মনে হয়েছে। কাইয়ুমের। কিন্তু তিনি হয়তাে জানতেন না যে, মেজর জেনারেল শওকত রেজার ভবিষ্যৎও ফিকে হয়ে পড়েছে। প্রত্যাখ্যাত ও নিরুৎসাহ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফেরত এসে তিনি সেনাসদরে ডিসিজিএস পদে বহাল হয়েছেন। ডিসেম্বরের কোনাে এক সকালবেলা।

কি কাজে শওকত রেজার পাশের অফিসে গিয়েছি। দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম—সালাম দিলাম ও চলে যেতে লাগলাম। শওকত রেজা ডাকলেন, খলিল, এসাে না, চা খাবে। বুঝলাম গল্প করবেন। ভেতরে গেলাম। গিয়ে দেখি মেজর কাইয়ুম বসে আছেন। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্বন্ধে শুনেছি এর পূর্বেই। আর এও জেনেছি। যে, কাইয়ুমের ভাই মুনীর চৌধুরীও ঐসব শহীদদের মধ্যে একজন। অতএব, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাইয়ুমকে সমবেদনা জানালাম। শওকত রেজা এই সঙ্গে বললেন যে, কাইয়ুম, আমিও অত্যন্ত দুঃখিত এই চরম পাশবিক কাহিনী শুনে।’ কিন্তু কাইয়ুম হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দাড়িয়ে পড়লেন ও চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “আপনি বলেছেন যে আমি সমাজ থেকে isolated এবং আমার মন insulated। এখন তাে বুঝতে পেরেছেন যে বাঙালি চরিত্র সম্বন্ধে আমি জার্মানির মতাে দূরে থেকে যা বুঝতে পেরেছি এবং সঠিক অনুধাবন করেছি, আপনারা এখান থেকেও তা বুঝতে পারেন নি। দেখলেন তাে আপনাদের পরম গর্বের মুক্তিযােদ্ধারা কি করেছে—আমার ভাই বাঙালির গৌরব মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করেছে। আপনারা যতাে বড়ই হােন বাঙালিই থেকে যাবেন।’ কাইয়ুম কথাগুলাে সবই ইংরেজিতে বলছিলেন বলে জেনারেল শওকত রেজাও শুনছিলেন ও কাইয়ুমকে উত্তেজিত দেখে তাকে কীভাবে থামাবেন এবং আসল কথাটি কী করে বােঝাবেন, বুঝতে পারছিলেন না। বললেন, কাইয়ুম তুমি থাম।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খলিল, আমি দুঃখিত যে কাইয়ুম সঠিক খবরটি জানে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবাে। তবে বুঝতে পারছাে সে এখন অত্যন্ত শােকাহত। ওকে আমি সত্যি ঘটনা বুঝিয়ে বলবাে। আমার মনে হয় তােমার এখন যাওয়াই ভালাে। তােমার সঙ্গে পরে কথা হবে।’ আমিও অনুরূপ একটি পরিত্রাণ চাইছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তবে কাইয়ুমের অগ্নিদৃষ্টি আমাকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিল বলেই আমার অনুমান।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!