You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তান-প্রেমিক বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান

জুন-জুলাই মাসের কথা। একদিন পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলােতে দেখলাম বড় শিরােনামে লেখা হয়েছে, বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মােকাবিলা করে দেশপ্রেমিক বাঙালি কূটনীতিকের দিল্লি ত্যাগ ও করাচিতে আগমন।’ ভেতরে বর্ণিত হয়েছে দিল্লি দূতাবাসে নিযুক্ত বাঙালি দ্বিতীয় সচিব রিয়াজ রহমান কীভাবে সেখানকার বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের পরাস্ত করে। করাচিমুখী প্লেনে আরােহণ করেন। খবরটি পড়ে আমার এক পাঞ্জাবি বন্ধু টেলিফোন করে জানালেন যে, দেখেছ তাে সমস্ত বাঙালিই গাদ্দার (বিশ্বাসঘাতক) নয়। কয়েকদিন পর আমি ও ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হক গিয়েছি ইসলামাবাদে বেড়াতে। উপসচিব হেদায়েত আহমদের (পরে সচিব) বাসায় গেলাম। তিনি ছিলেন আমাদের অন্তরঙ্গ। তার বৈঠকখানায় প্রবেশ করে দেখি সুদর্শন এক যুবক বসে আছেন। হেদায়েত পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সচিব রিয়াজ রহমান।’ আমাদের দু’জনের পরিচয়ও দিলেন। তাঁকে। ওঁকে দেখে তাে আমার রক্ত মাথায় চড়ে গেছে। অতি কষ্টে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার অবস্থা দেখে গৃহকর্তা হিসেবে। হেদায়েতও প্রমাদ গুণলেন। কারণ হেদায়েত আমার মনােভাব সম্যকভাবেই বুঝতে পেরেছেন। আমি সেসব দেখেও দেখলাম না। বললাম, “তা হলে আপনিই সেই রিয়াজ রহমান, যিনি অতি সাহসিকতার সাথে দিল্লিস্থ বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের প্রচেষ্টা প্রতিহত করে নিজের দেশ করাচিতে পৌঁছেছেন সফলভাবে?’ বলাবাহুল্য, রিয়াজ এভাবে তিরস্কৃত হতে অভ্যস্ত ছিলেন না বলে নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তর্কের এক পর্যায়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, পত্রপত্রিকায় লিখেছে ঢাকায় পাকিস্তানিরা ‘জেনােসাইড’ (একটি জাতি নিমূলকরণ) করেছে। এটা কি বিশ্বাসযােগ্য? জেনােসাইডের অর্থ কি এরা জানে? | আমি অনেকটা ধীর কণ্ঠেই উত্তর দিলাম, জেনােসাইডের অর্থ আমিও জানি ।

তবে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী ঢাকায় পঁচিশে মার্চ সেনাবাহিনী কতাে লােক মেরেছে? ‘যা পত্রিকায় বলা হয় তার চাইতে অনেক কম।’ ‘তবুও বলুন সেই সংখ্যা কতাে হবে, দশ হাজার? না এতাে হবে না।’ তবে হাজার দুয়েক?” তা হতে পারে।’ ‘রিয়াজ সাহেব, এই যে দু’হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে তাদের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ও তাদের বেতনভুক সেনাবাহিনী হত্যা করলাে, এই বুলেটগুলাের মূল্যের অর্ধেক তাে বাঙালিরা মিটিয়েছে, তাই না? এ ব্যাপারটি আপনার কাছে অতীব ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। কেননা আপনি একটি ‘খুশি চাকরিতে আছেন। আর যারা মরেছে তাদের দেয় অর্থ থেকে আপনার বেতন আসে। আপনার লজ্জা করে না মাত্র দু’হাজার হত্যা করা হয়েছে এমন কথা বলতে?’ রিয়াজ কি একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে হেদায়েত ও মজিদুল হক দু’জনেই তাঁকে ঠেলেঠুলে অতি কষ্টে বিদায় করে দিলেন। আর আমাকে ওঁরা দু’জন ও আমাদের স্ত্রীদ্বয় তিরস্কার করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারলাম যা করেছি তা অত্যন্ত ছেলেমানুষির পর্যায়ে পড়ে। তবে বােঝা যায় কেমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়তাম এসব বাঙালিদের দেখলে।  ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে দেখি রিয়াজ রহমান আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। এতে আমার ক্ষোভের কিছু থাকত না, যদি মেজর মনযুর, মেজর জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এঁরাও বাংলাদেশের সরকারে মন্ত্রী পর্যায়ের কিছু হয়ে থাকতেন; কিন্তু স্বাধীনতার প্রথম খােরাক হলেন এঁরাই, আর স্বাধীনতার সুফলভােগকারী হচ্ছে রিয়াজ রহমান হয়তাে সেটাই নিয়ম। 

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!