বাংলার বাণী
ঢাকা : ৬ই অক্টোবর, রোববার, ১৯৭৪, ১৯শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
রেলগাড়ী যেন বন্ধ না থাকে
দু’টি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় গতকাল দু’টো গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরের একটি হলো : কয়লার অভাবে আজ রোববার থেকে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব ক’টি ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পূর্বাঞ্চলে চালুকৃত ১৪টি রেল-ইঞ্জিনের মধ্যে ফার্ণেস তেল চালিত ১টি বাদে বাকী ১৩টি ইঞ্জিনই কয়লায় চলে। ঐ তেরোটির জন্য প্রতিদিন ৪১ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। শুক্রবার পর্যন্ত রেলওয়ে গুদামে ৬০ থেকে ৭০ টন কয়লা ছিল। ফার্ণেস তেলের ভান্ডও খালি। সুতরাং জরুরী ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না করলে আজ হতে ঢাকার সাথে বাহাদুরাবাদ, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং নারায়ণগঞ্জের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পশ্চিমাঞ্চলের অবস্থাও প্রায় তাই। তবে সপ্তাহখানেক সেখানে ট্রেন চালু থাকবে। আর তাড়াহুড়ার প্রচলিত নিয়মে কয়লার অভাব পূরণের জন্য এক সপ্তাহ সময়ই যথেষ্ট সেখানে। সুতরাং পশ্চিমাঞ্চলের সমস্যাটা ততটা প্রবল নয় যতটা সৃষ্টি হয়েছে পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে। প্রকাশিত গতকল্যকার অপর খবরটা হলো : চট্টগ্রাম বন্দরে ভারত থেকে আমদানীকৃত ৮১ হাজার ১শ’ ১৫ টন কয়লা গত দুই মাস ধরে পড়ে আছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে স্তূপীকৃত এত কয়লা এক বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কয়লা নিয়ন্ত্রণ পরিদপ্তরের জনৈক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যাদেরকে কয়লা বরাদ্দ করা হয়, কয়লা সরিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা তাদেরিই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে কয়লা মওজুত রয়েছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে যা বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে—রেল বিভাগের কাছে সেই কয়লাই একান্ত অভাবী বস্তু হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু এমনটা হলো বা হচ্ছে কেন? সংবাদপত্রে প্রকাশিত দু’টি রিপোর্ট মনোযোগ দিয়ে পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আন্তঃবিভাগীয় কোন্দলের পরিণতিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হতে চলছে রাজধানীর সাথে গোটা পূর্বাঞ্চলের। কয়লা নিয়ন্ত্রণ পরিদপ্তর এবং রেল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ এ কথা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, দু’টো দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোটা দেশের পরিবহন সমস্যা এবং জনসাধারণের দুর্গতির কথা আপাততঃ বিস্মৃত হয়েছেন। দেশের দু’টো সামুদ্রিক বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের উপরই দেশের আমদানী-রপ্তানী বহুলাংশে নির্ভরশীল। সমগ্র দেশে খাদ্যশস্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চরম সংকট মোকাবেলার জন্য সরকার প্রতিদিন বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মণ জিনিসপত্র আমদানী করছেন এবং সেগুলো দেশের অপরাপর অঞ্চলে প্রেরণের প্রধান মাধ্যম হলো রেলপথ। সেক্ষেত্রে একটা দিনের জন্য কয়লার অভাবে যদি রেল চলাচল বন্ধ থাকে তাহলে অবস্থাটা কতখানি ভয়াবহ ও ব্যাপক হবে তা একবারও কি দুই দপ্তরের কর্মকর্তারা ভেবে দেখেছেন?
রেল দপ্তর বলছেন, কয়লা নিয়ন্ত্রণ পরিদপ্তরের সাথে চুক্তির শর্ত তারা রাখছেন না। হঠাৎ করে কয়লার মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে তারা কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। কয়লা নিয়ন্ত্রণ পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো চুক্তিই তাদের মধ্যে হয়নি। আমরা জনসাধারণ অত সুক্ষ্ম হিসাবের মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু বুঝি দেশের যানবাহন সুষ্ঠুভাবে চলুক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী চলাচলে একদিন অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে এদেশের কালোবাজারী ও মুনাফাখোররা জিনিসের মূল্য দুষ্প্রাপ্যতার অজুহাতে চতুর্গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ তারা যাতে গ্রহণ না করতে পারে। কে কার সাথে চুক্তি করলো বা না করলো, অত শত বুঝবার বা শুনবার মতো সময় দেশবাসীর নেই। দেশবাসী শুধু জানে, চট্টগ্রাম বন্দরে পর্যাপ্ত পরিমাণে কয়লা মওজুত আছে। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারেনা। কয়লা চালিত রেল ইঞ্জিন গতকাল যেমন চলেছিল আজও তেমনি চলবে।
কেরোসিন তেলের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে
কেরোসিন তেলের দাম আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। খবরে প্রকাশ, ডিলারদের কারসাজির দরুণই নাকি দাম বেড়েছে। ডিলাররা অশুভ তৎপরতা শুরু করেছে। এবং দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্র তিন চার দিনের ব্যবধানে সাত টাকা গ্যালন কেরোসিন চৌদ্দ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটিন কেরোসিন তেলের দাম আটাশ টাকা থেকে তিরিশ টাকা ছিল এখন তার দাম বেড়ে আশি থেকে নব্বই টাকা হয়েছে। গতকাল খুচরা বিক্রেতারা নাকি একসের কেরোসিন তেল পাঁচ টাকায় বিক্রি করেছে। কেরোসিন তেলের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা মুশকিল। তবে খবরে বলা হয়েছে তেলের ডিলারদের সংঘবদ্ধ কারসাজির জন্যেই নাকি এমন হয়েছে। দীর্ঘ দু’বছর আড়াই বছর ধরে দেশে কেরোসিনের সংকট লেগেই রয়েছে। কখনও অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে কখনও কমেছে। অথচ কেরোসিন তেল দেশে নেই এমন নয়। সব সময়ই দেশে কিছু তেল ছিল, সংকট মোকাবেলার জন্যে তা অপ্রতুলও ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মাঝে মাঝেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই দেশের প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে তার উপর কেরোসিনের দাম বেড়েছে তার উপর কেরোসিনের দাম মাঝে-মধ্যেই আকাশচুম্বী হয়েছে। সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি এই মূল্য বৃদ্ধির উপর। অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যের ব্যাপারেও যেমন কর্তৃপক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারেননি তেমনি পারেননি কেরোসিনের বেলায়ও। তেলের ডিলাররা যদি এহেন দাম বাড়ানোর কারণ হয় তাহলে তাদের দৌরাত্ম্য অবশ্যই খর্ব করা উচিত। একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের এটা নৈতিক কর্তব্য। দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যারা বাড়িয়ে তোলেন তাদের স্তব্ধ করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আমরা লক্ষ্য করেছি কর্তৃপক্ষ বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ডিলার বা আড়তদারদের ইচ্ছার কাছে সরকার নত হয়ে চলেছেন, তেলের দাম বাড়ার বিষয়টিও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইস্টার্ণ রিফাইনারী বর্তমানে চালু রয়েছে। অতএব তেল সরবরাহের ব্যাপারে কোনো বাধা আছে বলে আমরা জানতে পারিনি। অন্যদিকে ইস্টার্ণ রিফাইনারী যদি বন্ধ থাকতো তাহলে তেলের সংকটের পেছনে একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যেতো। কেন হঠাৎ করে এমনিভাবে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলো তা কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে জানাবেন বলে আমরা মনে করি। যদি ডিলারদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কাছে তারা মাথা নতও করে থাকেন তাহলে তা জনগণকে জানানো আবশ্যক। দেশে বর্তমানে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। প্রত্যেকটি জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। পথে-প্রান্তে নিঃসহায় মানুষগুলো মারা যাচ্ছে। এহেন নিদারুণ পরিস্থিতির মাঝে হঠাৎ করে কেরোসিন তেলের দাম বাড়ায় যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কর্তৃপক্ষ তা বাস্তব দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ করে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক