কার্যস্থলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন
রাওয়ালপিণ্ডিতে আমার প্রাত্যহিক অফিস জীবন দু’পর্বে ভাগ করা যায় ড. সাত্তার ও মেজরত্রয়ী মনযুর-জিয়া-তাহেরের পলায়নের পূর্বে, অর্থাৎ আমিও যে পলায়ন পরিকল্পনায় রত এটা জানার পূর্ব পর্যন্ত এক পর্ব ওই পলায়ন পরিকল্পনা ধরা পড়ার পরে আরেক ভিন্নতর পর্ব আমার পলায়ন পরিকল্পনা ধরা পড়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে। এর আগেও আমাদেরকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পুরােপুরি বিশ্বাস করতাে না। তার প্রধান কারণ পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায় বাঙালি সৈনিক অর্থাৎ পুলিশ, ইপিআর ও সমরবাহিনীর সৈনিকরা সামগ্রিকভাবে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে মার্চ মাসেই, ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে । কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জায়গায় নিয়ােজিত পাঞ্জাবি সৈনিক দলকে এই বিদ্রোহীরা সমূলে ধ্বংস করে। তারপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরােধমূলক যুদ্ধে বিদ্রোহীরা নিজেরা যেমন মৃত্যুবরণ ও আহত হতে থাকে, তেমনি প্রচুর সংখ্যায় পাঞ্জাবি সৈন্যও হতাহত হতে থাকে। এ পরিস্থিতির জন্য পাঞ্জাবিরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। না। তারা মনে করেছিল নৃশংস ও নির্বিচারে কয়েকদিন ধ্বংসযজ্ঞ চালালে গােটা পূর্ব পাকিস্তান ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল বৈ কিছু নয়। জনগণ এই ধ্বংসলীলা দেখলে বাকি জীবনে আর আওয়ামী লীগের নাম এবং বাংলাদেশের তথাকথিত স্বাধিকার আন্দোলনের কথা তাদের মুখেও আনবে না; কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। এই ছােটখাটো ও কৃষ্ণকায় বাঙালিরা রুখে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু রুখে দাঁড়ানাের ব্যাপারটি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে গােপন রাখা হলাে। সামরিক প্রশাসক তাদের পাকিস্তানি নাগরিকদের সফলভাবে বােঝাতে পারলাে, যা ঘটছে তা কোনাে মুসলমান। বাঙালির কাজ নয়। হিন্দু বাঙালি ও ভারতীয় হিন্দুদের যােগসাজশে হচ্ছে এই ‘গণ্ডগােল’। এদেরকে শিগগির উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। চিন্তার কোনাে কারণ নেই অর্থাৎ ভুট্টোর কথাই ঠিক যে, ২৫ মার্চে আমাদের দেশপ্রেমিক ও সাহসী। সৈনিকরা ধ্বংসের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে। এই বক্তব্য পাঞ্জাব তথা পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস করতাে এবং মনে মনে চাইতাে যে, সেনা-অভিযান যেন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কিন্তু সেনাসদর ও সামরিক কর্তৃপক্ষ আসল ব্যাপার টের পেয়েছিল ও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে যে গােটা বাঙালি জাতি আজ চরমভাবে বিক্ষুব্ধ এবং পাকিস্তান তারা আর চায় না।
এ অবস্থায় আমরা যেসব বাঙালি তখন পাকিস্তানে কর্মরত ছিলাম তাদের ওপর পাঞ্জাবিদের আস্থা ছিল না, থাকার কথাও নয়। তদুপরি পশ্চিম পাকিস্তানেও যেখানে সুযােগ পাচ্ছে সেখান থেকে বাঙালি সামরিক অফিসাররা সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করছে। অনেকে প্রাণের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে চলে যাচ্ছে। অতএব, বাঙালি সেনা অফিসারদের বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মনে মনে বিশ্বাস না করলেও বাহ্যিক আচরণে তাে তা দেখানাে যায়। আমাদের দৈনন্দিন কাজ থেকে বিরত রাখলে তাে চলবে না। বিদেশি সাংবাদিকদের নজর তাে আছেই, তাছাড়া পাঞ্জাবি জনগণও জানতে পারবে যে, ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়’। অতএব, বাহ্যিকভাবে আমাদের অফিসে। যাওয়া-আসা, গাড়ি-বাড়ি সব বহাল থাকলাে। অফিস করতে হতাে রুটিনমাফিক মামুলি কাজ। নীতি-নির্ধারণী জাতীয় সিদ্ধান্তগুলাে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে নেয়া হতাে আমাদের কিছুই জানতে দেয়া হতাে না। সেনাসদরে মূলত তিনটি শাখা থাকে। দুটি শাখা প্রধানত আইন-শৃঙ্খলা। এবং রসদ ও পূর্ত বিষয়ক তৃতীয় শাখাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ শাখার কাজ সমর পরিচালনা ও তার জন্য পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক এই শাখাটিতে গােপনীয়তা বেশি প্রয়ােজন; কিন্তু পাকিস্তানিদের জন্য বিশেষ অসুবিধার দিক ছিল এই শাখাটিতে আমরা দু’জন সিনিয়র বাঙালি অফিসার ছিলাম ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হক ও আমি। আমরা দু’জনে ডাইরেক্টর ছিলাম বিধায় প্রতিটি কনফারেন্সে আমাদের উপস্থিতি প্রয়ােজনীয় ছিল। এইসব কনফারেন্সে নীতি-নির্ধারক ও সংবেদনশীল সিদ্ধান্তগুলাে নেয়া হতাে। অথচ সেসব তাে। আমাদের দু’জনকে জানিয়ে নেয়া যায় না। একদিনের কথা মনে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানাের জন্য একশ’ ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান সমরাস্ত্র কারখানায় তৈরি করতে হবে। এছাড়া বর্তমানে যেসব কামান কারখানায় তৈরি অবস্থায় আছে তা অনতিবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত এবং এ সম্বন্ধে প্রয়ােজনীয় আলােচনা আমাদের দু’জনের সামনে হতে পারে না। অতএব, অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচনার পর সভা স্থগিত ঘােষণা করা হলাে। আমরা দুজন ছাড়া বাকি সব ডাইরেক্টরকে আগেই জানানাে হয়েছিল যে, আনুষ্ঠানিকভাবে সভা ভঙ্গ করার পরও যেন তারা থাকেন। তাই আমরা চলে যাওয়ার দু’চার মিনিট পর তারা পুনরায় একত্র হলেন এবং ট্যাংক বিধ্বংসী কামান ও পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের অবস্থা আলােচনা করলেন।
কনফারেন্সটির সভাপতি ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল স্টাফ প্রধান ক্ষমতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পর দ্বিতীয় স্থানে। পূর্ব পাকিস্তানের যাবতীয় যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তদারকি তিনি করতেন। অথচ এই গুল হাসান পরবর্তীকালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে ও ঘটেছে তার কিছু তিনি জানতেন না, সহকারী সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ খান তাকে কিছু জানতে দেন নি। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ কিংবা অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকেও তিনি শেখ মুজিবকে একজন দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি আখ্যা দিতে কুণ্ঠা বােধ করেন নি। পূর্বোক্ত কনফারেন্সগুলােতে আমাদের দু’জনের অবর্তমানে কি কি আলােচনা ও সিদ্ধান্ত হতাে তা জানা আমার পক্ষে কোনাে সমস্যা ছিল না। কারণ এসব ডাইরেক্টরের মধ্যে দু’একজন আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন এবং তারা আমাকে বিশ্বাসের অযােগ্য ভাবতেন না। সেপ্টেম্বরের ঘটনার আগেও আমাদেরকে অনুরূপভাবে অবিশ্বাস করা হতাে। ড. সাত্তারের ধরা পড়া ও মনযুরদের সফল পলায়নের পর আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষ জানতে পারলাে যে, আমি বিশ্বাসের সম্পূর্ণ অযােগ্য। তখন ধীরে ধীরে আমার দফতর থেকে সব অফিসারকে অন্যত্র বদলি করা হলাে। রাখা হলাে কেবল আমার অফিস সেক্রেটারি ও ব্যক্তিগত সহকারীকে। এরা দু’জন যখন খুশি অফিসে আসতেন, কোনাে দিন হয়তাে আসতেনও না।
আমিও কিছু বলতাম না। তবে রােজই অফিসে যেতাম। একদিন এমনিতে ইচ্ছে হলাে যে, পরীক্ষা করে দেখি এরা অন্তত বাহ্যিকভাবে আমার ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় কিনা। সহকারীর মাধ্যমে খবর পাঠালাম যে, আমি দু’দিন পর ওয়াহ্ সামরিক কারখানায় একটি কাজ পরিদর্শন করতে যাবাে। আমি ধরে নিয়েছিলাম কোনাে একটা অজুহাত দেখিয়ে আমার প্রস্তাবিত কার্যক্রম অনুমােদন করা হবে না। কিন্তু না, সময়মতাে লম্বাটে আমেরিকান গাড়ি ব্রিগেডিয়ারের পদবির তারা লাগিয়ে দফতরে এসে হাজির। যেখানে গেলাম সেখানেও দেখি সব প্রস্তুত। একজন ব্রিগেডিয়ার আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। যা যা দেখতে চাইলাম দেখানাে হলাে। এ কথাটা স্বীকার করতে হবে যে, পাঞ্জাবি সেনা কর্তৃপক্ষের এই বাহ্যিক দ্ৰতামূলক আচরণ আমার মনে রেখাপাত করেছিল। ঘটনাটি বিশেষ করে মনে। পড়লাে, ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ত্যাগ করার পর যখন ঘরে বসে থাকতাম, সেই সময়ের নিরিখে তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক একনায়ক, আমার প্রতি সামরিক শাসকের অনুরােধ/আদেশ ছিল যে, আমি যেন দেশের বাইরে যাই রাষ্ট্রদূত হয়ে; কিন্তু আমি রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে দেশের বাইরে যেতে রাজি হই নি। সেই সময় দু’দুটো গােয়েন্দা গাড়ি আমার বাসার দু’দিকে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিযুক্ত থাকতাে আমি যেখানে যেতাম একটি গাড়ি অনুসরণ করতাে এতে আমার আপত্তি ছিল না; কিন্তু তারা আমার কাছে আগত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে প্রশ্ন করা ও ভয়ভীতি দেখাতে আরম্ভ করলাে। মনে পড়ে তখন একদিন আমি একটি গােয়েন্দা গাড়ির ভেতরকার গােয়েন্দাদেরকে অলক্ষ্যে ধরে ফেললাম এবং তীব্রভাবে বকুনি দিতে লাগলাম বকাবকি শুনে গােয়েন্দা হাবিলদারটি বেশ বিনয়ের সঙ্গে উত্তর। দিলেন, ‘স্যার, আমরা হুকুমের দাস চাকরি করে খাই। আপনি যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন তবে আপনার হুকুমও আমরা অনুরূপভাবে তামিল করবাে। আমাদেরকে অযথা আপনি গালাগালি দিচ্ছেন কেন? হঠাৎ আমার হুশ হলাে। আমি হাবিলদারটির কাছে মাফ চাইলাম।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা