জুনিয়র অফিসারের পলায়ন ও মুক্তিযুদ্ধে যােগদান
মংলায় থাকাকালীন একটি ছােট ঘটনার কথা মনে পড়ে। একদিন বিকেলে আমার পরিচিত ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল) হামিদ দেখা করতে এলেন। হামিদ ছিলেন, যতাে দূর মনে পড়ে, আর্টিলারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার। চা খেতে খেতে একথা-সেকথার পর তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করতে চাই।’ জিগ্যেস করে জানতে পারলাম তার। ইউনিট থেকে মাইল পনের দূরে আজাদ কাশ্মিরের মিরপুরের সীমান্ত। সেখান থেকে ছদ্মবেশে আজাদ কাশ্মিরের পায়ে-হাঁটা পথ পার হলে ভারতের কাশ্মির। ব্যাস্। আমি জিগ্যেস করলাম, তা এ বিষয়ে আমাকে জিগ্যেস করা কেন? প্রশ্ন করে বুঝতে পারলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি, হামিদের জন্য তাতে যােগদান সঠিক হবে কিনা, এই কথাগুলাে আমার মতাে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ অফিসারের কাছ থেকে শুনে নিশ্চিন্ত হতে চান হামিদ। আমার মনে সন্দেহ তাে। প্রথম থেকে ছিল যে অফিসারটি পাকিস্তান গােয়েন্দা বাহিনীর চর নয়তাে। কিন্তু সন্দেহটিকে মুহূর্তে উড়িয়ে দিলাম এই চিন্তা করে যে, আমাদের জন্য তাে ভূত ও ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে গেছে ২৫ মার্চের রাতেই। অতএব, সন্দেহমুক্ত মনে ওঁকে বললাম, “দেখ হামিদ, তােমার জায়গায় আমি (অর্থাৎ অবিবাহিত) হলে কোনাে রকম ইতস্তত না করেই রওনা দিতাম।’ কারণ হিসেবে বললাম, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জয় হবে কি পরাজয় সেটা তাে আমার ভাববার বিষয় নয়। আমার একমাত্র চিন্তা আমার দেশ আজ অন্যায়ভাবে জালেমের কবলে পড়ে কাতরাচ্ছে। আমার মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষার প্রশ্ন উঠেছে। অতএব, সৈনিক হিসেবে আমার একান্ত কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করা।’ আমার কথা শুনে হামিদের শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়ে উঠল।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার সাথে গভীরভাবে করমর্দন করে এই বলে বিদায় নিলেন, ‘দোয়া করবেন স্যার।’ হামিদকে ঈর্ষা হলাে। আমিও যদি তার মতাে পিণ্ডি যাবাে বলে তিন দিনের নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটা দিতে পারতাম! কিন্তু সঙ্গে আমার পরিবার, মা ও যুবতী মেয়ে রয়েছে। পরে প্রায়শ শুনতে পেতাম, আজ অমুক কাল তমুক চলে গেছে। এমনিভাবে কয়েক দিন পরপর আমাদের জুনিয়র, বিশেষ করে যাঁদের পরিবার সঙ্গে ছিল। এবং যাদের পালাবার সুবিধা ছিল, তারা চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করছেন। শুনে বুকটা ভরে উঠতাে তাদের জন্য গর্বে ও প্রশংসায়; কিন্তু একই সময় অতীব লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটতাে। অনেক অফিসারের এইরূপভাবে পালাবার সুযােগ ছিল; কিন্তু তারা পালায় নি হয়তাে সাহস ছিল না কিংবা ইচ্ছে ছিল না। এর চাইতে আরও লজ্জাজনক ঘটনা ছিল। অনেক অফিসার ১৯৭১ সালের মার্চের পর পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ছুটিতে গিয়েছে; কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের পরিবর্তে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে করাচি পৌঁছেছে।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা