১৯৭১ সালের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা
খানে ১৯৭১ সালের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ দেয়া হলাে। সব ঘটনা গুলাের কোনাে কোনােটির সাথে তৎকালীন ইতিহাসের সম্পর্ক আছে। আবার কোনাে কোনােটিতে মানব চরিত্রের ক্ষুদ্রতা ও উদারতার অদ্ভুত বৈচিত্র্যও প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে যদি একটি বিপ্লবের সাথে তুলনা করা যায় তবে এটাও প্রকাশ পাবে যে, বিপ্লবের চিরাচরিত নীতি অনুযায়ী বিপ্লব-পরবর্তী ইতিহাসের অধ্যায়ে বিপ্লবের সন্তানরাই প্রথম কোরবানি হয় এবং যারা বিপ্লবের বিরােধিতা করে কিংবা যারা বিপ্লব থেকে নিজেদের সযত্নে দূরে রাখে তারাই বিপ্লবের ফল ভােগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। আবার কোনাে কোনাে ঘটনায় পাঞ্জাবিদের মনােভাবও পরিস্ফুট হবে। ঘটনাগুলাে যথাসম্ভব সময়ানুক্রমিকভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে ‘বিদ্রোহী অফিসারদের পরিবারবর্গের নিরাপত্তা
ঘটনাটা বােধ করি একাত্তর সালের এপ্রিল মাসের, আমি তখন মংলায়। একদিন রাওয়ালপিণ্ডি থেকে খবর জানতে পারলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানে যেসব বাঙালি অফিসার বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেছেন তাঁদের মধ্যে দু’একজনের পরিবার সেখানকার সেনাছাউনিতে আটকা পড়েছেন। মেজর জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়াও ছিলেন এঁদের একজন। তারা স্বাভাবিকভাবেই চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অথচ তাদেরকে আত্মীয়-পরিজনের কাছে যেতে দেয়া হচ্ছে না। খবরদানকারীরা আমাকে অনুরােধ করলেন যেন আমি চেষ্টা করি এ বিষয়ে একটা কিছু করতে। ভাবছি দুর্ভাগা বােনদের জন্য কী করতে পারি। শেষে কোর কমান্ডার জেনারেল ইরশাদকে কথাটা বললাম। বলার পূর্বে এটাও চিন্তা করলাম তিনি হয়তাে সাধারণ পাকিস্তানিদের মতােই বলবেন যে, যাদের স্বামী বিদ্রোহী তাদের তাে এটাই প্রাপ্য। সঙ্গে সঙ্গে এমন ভাবলাম যে, তিনি হয়তাে দয়াপরবশও হতে পারেন। অতএব, বলতে তাে আপত্তি থাকা উচিত নয়। সেই ভাবনা থেকে কথা পাড়লাম এভাবে যে, এই মহিলাদের স্বামীরা হয়তাে বিদ্রোহী, কিন্তু আমাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী। এঁরা আমাদের আশ্রিতা। এদের অসম্মান তাে আমাদের ধর্মেও গ্রহণযােগ্য নয়। ভয়ে ভয়েই বললাম কথাগুলাে। শােনা মাত্র ইরশাদ বলে উঠলেন, বলাে কি হে? ওঁরা তাে তােমার আমার বােন ও মেয়ে। ওঁদের অসম্মান? তাও আমাদের সৈনিকদের হাতে-যে সেনাবাহিনীকে আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ। সেনাবাহিনী বলে বিশ্বাস করি। বলাে কি? আমি এখনি আমার মা-বােনদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করছি। আর তুমি যাদের বিদ্রোহী বলছাে আমি বলবাে তারা ‘গুমরাহ’ (পথভ্রষ্ট)। ওরাও একদিন পথে ফিরে আসবে।’ বলেই তিনি টেলিফোন করলেন সেনাসদরে। একদিন পরে আমাকে ডেকে বললেন, ‘খলিল, আমি বন্দোবস্ত করেছি। ওঁরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে সেনানিবাসে থাকতে পারবেন।’ আমি আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, জেনারেল ইরশাদ ঢাকায় সেনাহামলা পুরােপুরি সমর্থন করেন, তবে তিনি ব্যক্তিগত ও মানসিকভাবে উঁচুমানের। নৈতিকতায় বিশ্বাসী। ঠিক এই ধরনের পাঞ্জাবি অফিসার আমি পরেও কয়েকজন দেখেছি। প্রত্যেক সমাজে বােধহয় এমনি ধরনের উচ্চ মনের ব্যক্তি আছেন। এঁদের সংখ্যা অধিক হলে পৃথিবী ও জীবন আরও উপভােগ্য হতাে।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা