একাত্তরের মার্চ-পূর্ববর্তী ঘটনাবলি
আজাদ কাশ্মিরের পাদদেশে অবস্থিত মংলা একটি ছােট্ট গ্রাম। ঝিলাম নদীর বিখ্যাত বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছিল এই ক্ষুদ্র মংলা গ্রামটিতে তখন আমেরিকানরা প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীদের বাসস্থান হিসেবে গড়ে তােলে এক নাতিবৃহৎ কলােনি। গল্ফ কোর্স থেকে আরম্ভ করে প্রায় সকল আধুনিক সুবিধাদি ছিল এই কলােনিতে। বাড়িগুলাে নিচু কিন্তু সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমেরিকানরা চলে যাওয়ার পর এই কলােনিতে স্থাপিত হয় সামরিক কোর সদর দফতর। আমেরিকা-প্রদত্ত আধুনিক যুদ্ধ-সরঞ্জাম দ্বারা সজ্জিত চারটি ডিভিশন নিয়ে গঠিত হয়েছিল এক নম্বর কোর এবং এর সদর দফতর স্থাপিত হয় বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণশেষে পরিত্যক্ত মংলা কলােনিতে। স্থানটি পিণ্ডি-লাহাের মহাসড়কে, পিণ্ডি থেকে মাইল ষাটেক দূরে। ১৯৭০-এর নির্বাচন পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল এই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় সকল আসনে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্তত অর্ধেক আসনে আইয়ুব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কনভেনশন মুসলিম লীগ নামক দলটি জিতবে এই দল ছিল একান্তভাবে সামরিকতন্ত্রপন্থী অর্থাৎ ‘দেশপ্রেমিক’। অতএব, ইয়াহিয়া খানের সরকারের জন্য এই নির্বাচন কোনাে মাথাব্যথার কারণ হবে না। এছাড়া একমাত্র দেশপ্রেমহীন’ অর্থাৎ পাকিস্তান ভাঙার পক্ষের রাজনৈতিক দল তাে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ তারা পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৩০/৩৫টির বেশি আসন পাবে না। এ সম্বন্ধে একটি কৌতুকপূর্ণ ঘটনা এখানে না বললেই নয়। পাকিস্তানের গােয়েন্দা বিভাগকে সর্বোচ্চ বলা যায় এবং সর্বশক্তিমান’ সংগঠন হলাে আই এস আই (ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স), বাংলাদেশে যেমন ডি জি এফ আই গড়ে উঠেছিল দুই সামরিকতন্ত্র, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে। এই আই এস আই’র একটি সুদৃশ্য ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বের হয় অনেকটা ম্যাগাজিন’ আকারে।
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনটি ছাপা হয়ে বিভিন্ন দফতরে পৌঁছাতে প্রায় মাস দুই পার হয়ে যায়। অর্থাৎ আজকের ভবিষ্যদ্বাণী বিভিন্ন অফিসে পৌঁছাবে দু’মাস পরে নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে গােয়েন্দা বিভাগের ভবিষ্যদ্বাণীটিও পৌছেছিল ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের পরে অথচ এর আগেই নির্বাচন ও তার একান্তভাবে নৈরাশ্যজনক এবং পরম উদ্বিগ্নকারী ফলাফল প্রকাশ হয়ে পড়েছে। মনে আছে, প্রতিবেদনটি কোর সদর দফতরে আমার হাতে প্রথম পৌঁছায় আমি পরে সেটি নিয়ে গিয়েছিলাম কোর কমান্ডার জেনারেল ইরশাদকে দেখাতে প্রতিবেদনটির ওপর চোখ বুলিয়ে ইরশাদ যে উক্তিটি করেছিলেন তা যেমনি অশ্রাব্য তেমনি অমুদ্ৰণীয়। আমি চলে আসছি দেখে বললেন, বসাে।’ আমি তবুও ইতস্তত করছি দেখে শান্তস্বরে বললেন, ‘খানিক বােস।’ ইরশাদ কমান্ডার হিসেবে ছিলেন যেমনি কঠোর তেমনি ভীতিপ্রদ। কথা বলতেন খুব কম কিন্তু ক্রটি দেখিয়ে দিতেন অত্যন্ত কঠোর ভাষায়—যদিও উচ্চস্বরে নয়। যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অগাধ, তাই অধস্তন কর্মকর্তা কোনাে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে কিছুটা বিপদাপন্ন বােধ করতেন। অন্যদিকে অর্থ ও লােভ-লালসার ব্যাপারে ইরশাদের মতাে সৎ ব্যক্তি আমি আর দেখেছি কিনা সন্দেহ একটি উদাহরণ-একবার ব্যক্তিগতভাবে করা দূরপাল্লার টেলিফোন কলের বিল তার অপারেটর সরকারি কাজের খাতে লিখে। দিয়েছিল আর যায় কোথায়-সে কি লঙ্কা কাণ্ড! আমার অভিজ্ঞতায় তিনি কেবল বাহ্যিকভাবে সৎ ছিলেন না, নৈতিকভাবেও সৎ ছিলেন। এমনি সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে না। ইরশাদের আরও একটি বৈশিষ্ট্য আমার কাছে খুব অদ্ভুত ঠেকতাে। তিনি বক্তৃতার সময় কখনও বলতেন না, তােমরা সৎ হও’, কিংবা ‘সততা একটি উত্তম গুণ।’ একথাও বলতেন না, তােমরা পরিশ্রম কর’, পরিশ্রম কর’ ইত্যাদি। তবে পরিশ্রম না করে তার অধীনে চাকরি বােধহয় সম্ভব ছিল না। মিথ্যা বললে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল সমধিক। অথচ আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারা বক্তৃতায় সদা বলেন, “তােমরা সৎ হও’, তাঁদের বেশির ভাগই ব্যক্তিগতভাবে সৎ নন। আমি বছরখানেক তার অধীনে চাকরি করেছি-তার বন্ধু বলে কাউকেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমরা যারা অধস্তন কর্মকর্তা, তারা তার অফিসে গেলে কোনােদিন বসতে বলতেন না। দাড়িয়ে দাড়িয়ে ২/৪ মিনিট কথা বলেই বিদায়। নেহায়েত দীর্ঘ আলােচনার বিষয় হলে অন্য কথা; কিন্তু সে রকম প্রয়ােজন মাসে দু’মাসে এক-আধবার হতাে কিনা সন্দেহ। অতএব, বসতে আমার ইতস্ততভাব। অবশেষে বসলাম। ইরশাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখের চশমা খুললেন, কাচ পরিষ্কার করে টেবিলে রাখলেন, চোখ দুটো দু’হাত দিয়ে মৃদুভাবে ঘষলেন। বুঝলাম মনে মনে পরিশ্রান্ত কিংবা উদ্বিগ্ন।
শেষে বললেন, বলতে পারাে ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতি কোন্ দিকে মােড় নেবে? যদিও সেই মুহূর্তে প্রশ্নটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তবে এমনি প্রশ্ন নিয়ে যে ভাবি নি তা নয়; কিন্তু যা ভেবেছি তা তাে তাকে বলা যাবে না। তাকে কী করে বলবাে যে, আমার ধারণা রাষ্ট্রক্ষমতা পাঞ্জাবিরা বাঙালির হাতে ছেড়ে দিয়ে কোনােদিনও দ্বিতীয় সারিতে বসবে না। অতএব, সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। তবে মনে মনে আশা ছিল এই রাজনৈতিক সংঘাতের সমাধানও রাজনৈতিকভাবে হবে। দু’পক্ষ সহ-অবস্থানের একটি ফর্মুলা রাজনৈতিকভাবে উদ্ভাবন করবে।উত্তরে বললাম, আপনি কি মনে করেন না যে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে? কারণ জাতি তাে নীতিগতভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে আমারও ইচ্ছা তাঁর মতটি জানা। প্রশ্নটি শুনে ইরশাদ পুনরায় চেয়ারে হেলান দিলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, হ্যা, তাই তাে হওয়া উচিত। কিন্তু মুশকিল হয়েছে মুজিবের ছয় দফা নিয়ে। ছয় দফা বাস্তবায়ন করা আর পাকিস্তান ভেঙে ফেলা তাে একই কথা, তাই না?’ উত্তরে আমি বললাম, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। তবে চাপ দিলে মুজিব হয়তাে ছয় দফা কিছুটা পরিবর্তন করে পশ্চিম পাকিস্তানের ভীতিটা দূর করতে পারে। যদিও আমি জানতাম মুজিব তা করতে পারবে না। তারপর প্রশ্ন করে জানতে চাইলাম তেমন হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালির হাতে আসার কোনাে সম্ভাবনা আছে কিনা। ‘তা যদি হয়ও তবু একটি কথা থেকে যায়। জান তাে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে সমর সরঞ্জাম ছিল। অপ্রতুল। এর কারণও তুমি জান। ভারতের শক্তির তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক শক্তি কম। এই শক্তি দিয়ে পাকিস্তানের দু’অংশেরই সম্যক প্রতিরক্ষা বিধান সম্ভব নয়। অতএব, আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত এই যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার ওপর। এছাড়া উপায়ও নেই।’ একথা বলে ইরশাদ থামলেন। আমিও জানতাম বলে তিনি সবিস্তারে বললেন না যে, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করে ফেলে তবে আমরাও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দিল্লি পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে যাব ইতােমধ্যে যুদ্ধের জন্য আমাদের যেটা প্রধান উদ্দেশ্য অর্থাৎ কাশ্মির দখল সেটাও করা হয়ে যাবে। যুদ্ধশেষে যখন জাতিসংঘের অধীনে অস্ত্রবিরতি ঘােষিত হবে তখন বিজিত অঞ্চল বিনিময় করে আমরা পূর্ব পাকিস্তান ফিরে পাবাে। এদিকে কাশ্মির ব্যতীত বাকি বিজিত অংশ ভারতকে ফেরত দেব। এই ছিল পাকিস্তানের পাক-ভারত যুদ্ধ পরিকল্পনার মূল ভিত্তি।
তবে ইরশাদ যে কথা বলতে পারলেন না তা হলাে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ফলাফল, পাঞ্জাবিদের মতে কোনাে অজ্ঞাত কারণে, আর সমগ্র পৃথিবী জানে অবশ্যম্ভাবীরূপে, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আশানুরূপভাবে হয় নি। বরং তাদের ঘটেছে চরম পরাজয়; কিন্তু অজানা কারণে ভারত তখন পূর্ব। পাকিস্তান আক্রমণ করে নি। হয়তাে অহেতুক রক্তপাতের প্রয়ােজন ছিল না। যুদ্ধবাজ আইয়ুবের নাক থেকে যথেষ্ট রক্ত পাঞ্জাবে ঝরেছে এবং ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি লাহােরের দরজার কাছ পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বে থামে নি। এসব তিক্ত কথার মধ্যে না গিয়ে ইরশাদ যে সমস্যাটির প্রতি ইঙ্গিত করলেন তা হলাে এই যে, যুদ্ধশেষে শেখ মুজিব প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে আকাশ ফাটাতে শুরু করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। তাহলে আমরা বাঙালিরা কেন এই সামরিক বাহিনীর খরচ যােগাব? অতএব, ছয় দফার এক দফা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থাকবে পূর্ব পাকিস্তানি মিলিশিয়ার ওপর। আরও ইঙ্গিত, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ব্যয়ভার পশ্চিম পাকিস্তানিরাই বহন করবে, পূর্ব পাকিস্তানিরা নয়। | অতএব, আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বাঙালিরা যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে তবে তাদের একটি প্রধান কাজই হবে পাকিস্তানের অর্থাৎ পাঞ্জাবি সামরিক বাহিনীকে কাটছাট করে সাইজমতাে করে দেয়া। এর অর্থ হলাে কাশ্মির সমস্যা চিরদিনের জন্য সিকেয় তােলা। তারপর আছে আওয়ামী লীগের ছয় দফা। ছয় দফা তাে প্রায় স্বাধীনতার সমান দাবি। পাকিস্তান (অর্থাৎ পাঞ্জাবি) তাে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে পারে না। হ্যা, এক ব্যক্তি এক ভােট। কিন্তু তাই বলে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া (অর্থাৎ পাঞ্জাবের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া)? এটা তাে পাঞ্জাবের জনগণ মেনে নেবে না। অর্থাৎ পাঞ্জাবের সামরিক বাহিনী, পাঞ্জাবের আমলাতন্ত্র যারা পাঞ্জাবের সামন্ত প্রভুদের সন্তান, তারা তাে। মেনে নেবে না। নানাভাবে নানা ভাষায় এ কথাগুলাে বললেন ইরশাদ। আমি চুপ করে থাকলাম। হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরশাদ ঘড়ি দেখে বললেন, দুটো বেজে গেছে। চল যাওয়া যাক। | যে কথাটা আমি খুব পরিষ্কারভাবে জানতাম, সেটা আজকে আরও ভালােভাবে শুনলাম, যে-কোনাে অবস্থায় কাশির সমস্যার সমাধান হওয়ার পূর্বে পাঞ্জাবিরা বাঙালির কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেবে না—নির্বাচনের ফলাফল যাই। হােক না কেন।
তবে ইরশাদ যদিও বলেন নি, আমরা এটাও জানতাম যে, কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়ার পরও পাঞ্জাব তার সামরিক শক্তির জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালি কেন পাকিস্তানি অন্য কোনাে জাতির কাছেও ছেড়ে দেবে। অনেকে বিশ্বাস করতেন এবং এখনও করেন যে, ঠিক এই কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কেবল দু’ভাগে নয়, কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। হয়তাে। ঠিক এই কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্র কখনও শিকড় গাড়তে পারবে না। বর্তমান পাকিস্তান, তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে, গণতন্ত্র শেকড় না গাড়ার আরও একটি প্রধান কারণ, যেমন পূর্বে আভাস দিয়েছি, সেখানে চার চারটি প্রদেশেই সামন্ততন্ত্র। এই সামন্ততন্ত্র স্বভাবগতভাবে গণবিরােধী। সহায়হীন প্রজার এক ভােট, আর সর্বক্ষমতার অধিকারী সামন্ত প্রভুরও একটি মাত্র ভােট, এটা অভাবনীয়। আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ বাদ দিলে বাকি পাকিস্তানের ৫৭% লােক পাঞ্জাবি। আর সামন্ত শ্রেণীর আশীর্বাদপুষ্ট পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর শতকরা নব্বই ভাগ পাঞ্জাবি। এদিকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অধিনায়কগণের প্রায় ৮০ ভাগ এই সামন্ত শ্রেণীর সন্তান। সিভিল প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদেরও প্রায় ৮০ শতাংশ সামন্ত পরিবার থেকে আগত। অতএব সিন্ধু, বেলুচ ও পাঠান প্রদেশের পক্ষে পাঞ্জাবি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গঠন একেবারে অসম্ভব। গণতন্ত্রের তাে প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে বাস্তব পরিস্থিতি এই দাড়িয়েছে যে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে গােটা বাঙালি জাতি এক হয়ে একটি অতি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করেছে যে, তারা পাকিস্তানে তাদের ন্যায্য অধিকার চায় । এতােদিন এই চাওয়াটা ছিল অনেকটা অনুমানের ব্যাপার। এবার সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই বাস্তবতা। অতএব, আমরা যারা জানতাম যে পাঞ্জাবি কোনাে অবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা বলে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া (অর্থাৎ পাঞ্জাবের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া)? এটা তাে পাঞ্জাবের জনগণ মেনে নেবে না। অর্থাৎ পাঞ্জাবের সামরিক বাহিনী, পাঞ্জাবের আমলাতন্ত্র যারা পাঞ্জাবের সামন্ত প্রভুদের সন্তান, তারা তাে। মেনে নেবে না। নানাভাবে নানা ভাষায় এ কথাগুলাে বললেন ইরশাদ। আমি চুপ করে থাকলাম।
হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরশাদ ঘড়ি দেখে বললেন, দুটো বেজে গেছে চল যাওয়া যাক। যে কথাটা আমি খুব পরিষ্কারভাবে জানতাম, সেটা আজকে আরও ভালােভাবে শুনলাম, যে-কোনাে অবস্থায় কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়ার পূর্বে পাঞ্জাবিরা বাঙালির কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেবে না—নির্বাচনের ফলাফল যাই। হােক না কেন। তবে ইরশাদ যদিও বলেন নি, আমরা এটাও জানতাম যে, কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়ার পরও পাঞ্জাব তার সামরিক শক্তির জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালি কেন পাকিস্তানি অন্য কোনাে জাতির কাছেও ছেড়ে দেবে অনেকে বিশ্বাস করতেন এবং এখনও করেন যে, ঠিক এই কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কেবল দু’ভাগে নয়, কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে হয়তাে। ঠিক এই কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্র কখনও শিকড় গাড়তে পারবে না। বর্তমান পাকিস্তান, তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে, গণতন্ত্র শেকড় না গাড়ার আরও একটি প্রধান কারণ, যেমন পূর্বে আভাস দিয়েছি, সেখানে চার চারটি প্রদেশেই সামন্ততন্ত্র। এই সামন্ততন্ত্র স্বভাবগতভাবে গণবিরােধী সহায়হীন প্রজার এক ভােট, আর সর্বক্ষমতার অধিকারী সামন্ত প্রভুরও একটি মাত্র ভােট, এটা অভাবনীয়। আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ বাদ দিলে বাকি পাকিস্তানের ৫৭% লােক পাঞ্জাবি। আর সামন্ত শ্রেণীর আশীর্বাদপুষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শতকরা নব্বই ভাগ পাঞ্জাবি এদিকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অধিনায়কগণের প্রায় ৮০ ভাগ এই সামন্ত শ্রেণীর সন্তান সিভিল প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদেরও প্রায় ৮০ শতাংশ সামন্ত পরিবার থেকে আগত। অতএব সিন্ধু, বেলুচ ও পাঠান প্রদেশের পক্ষে পাঞ্জাবি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গঠন একেবারে অসম্ভব। গণতন্ত্রের তাে প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে বাস্তব পরিস্থিতি এই দাড়িয়েছে যে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে গােটা বাঙালি জাতি এক হয়ে একটি অতি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করেছে যে, তারা পাকিস্তানে তাদের ন্যায্য অধিকার চায়। এতােদিন এই চাওয়াটা ছিল অনেকটা অনুমানের ব্যাপার। এবার সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই বাস্তবতা। অতএব, আমরা যারা জানতাম যে পাঞ্জাবি কোনাে অবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালির হাতে তুলে দেবে না, আমরা উদ্বিগ্ন হলাম, প্রমাদ গুণলাম। এ বিষয়টি নিয়ে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর জেনারেল ইরশাদ ও আমার মধ্যে প্রায়শ আলােচনা হতাে মনে হতাে তিনিও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে আমি যে কথাটা ইরশাদকে বলি নি, বলতে পারি নি, কিন্তু সবসময় মনে খেলা করতাে, তা হলাে ভুট্টোর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা