You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১২ই অক্টোবর, শনিবার, ১৯৭৪, ২৫শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

পাওয়ার পাম্পের খবর কি সত্যি?

চলতি মওসুমে সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যত কি তা নিয়ে ইতিমধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে তথ্যাভিজ্ঞ মহলে। প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান বছরের খাদ্য সংকটের প্রেক্ষিতে দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনে সক্ষম জমিগুলোকে পুরোপুরিভাবে কোনো উপায়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। দু’মাস আগেকার বন্যার ফলে উদ্ভূত কৃষি সংকট মোকাবেলায় সরকারের তরফ থেকে আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও বীজ ধান আর হালের বলদের অভাবে বহু আমন ধানের জমি এবার অনাবাদী থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরপর সাম্প্রতিককালে খবর পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল পোকার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে এবং সবাই ধারণা করছেন বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতির আলোকে ফসলের পোকা নিধন অভিযান হয়তো বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ইতিমধ্যেই জরুরী ভিত্তিতে শুরু করেছেন।
এখন প্রশ্ন উঠেছে দেশের সামগ্রিক সেচ প্রকল্পের অবস্থাটা বর্তমানে কেমন? নির্ভরযোগ্য মহলের বরাত দিয়ে গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি পড়ে দেশের যে কোনো লোকেরই বিচলিত হবার কথা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের ১৯টি জেলায় সরবরাহের জন্য বর্তমানে ১৫ হাজার পাওয়ার পাম্প প্রস্তুত রয়েছে। ১৬ হাজার ৩শ’ ৬৯টি পাওয়ার পাম্প বর্তমানে বিকল হয়ে পড়ে আছে। গত বছরের সরবরাহকৃত পাম্পের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৩ হাজার ৯শ’ ৭৯টি পাওয়ার পাম্প কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের হাতে আসেনি। এগুলো সচল কি বিকল তা কর্পোরেশনের কর্তারা অদ্যাবধি জানেন না বলে উক্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছর দেশের কৃষকদের চাহিদা পূরণ করবার জন্য বহুভাবে আবেদন-নিবেদন জানানোর পর ঊনিশটি জেলায় কিঞ্চিৎ অধিক মোট ৩৫ হাজার পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করা হয়েছিল এবং এ কথাও ঠিক যে, ঐ ৩৫ হাজার পাওয়ার পাম্প সারাদেশের চাষীদের চাহিদা মেটাতে পারেনি অর্থাৎ আরো অতিরিক্ত পরিমাণে পাম্প সরবরাহ করতে পারলে চাষীদের উপকার হতো। এই অবস্থায় প্রায় সাড়ে ষোল হাজার পাওয়ার পাম্প বিকল হবার খবর শুনবার মতো মানসিক অবস্থা দেশবাসীর যে নেই—তা কি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তারা জানেন না? দেশে রীতিমতোভাবে দুর্ভিক্ষ চলছে। অনাহারে এই রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন লোকের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সেই অনুপাতে সারাদেশের বর্তমান অবস্থাটা ভাবতেও ভয় হয়। অথচ এই দুর্ভিক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোথায় ভাববো যে আগামী মওসুমে পর্যাপ্ত ফসল উঠাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তার বদলে শুনতে হচ্ছে মোট পঁয়ত্রিশ হাজার পাম্পের মধ্যে সাড়ে ষোল হাজারই বিকল হয়ে গেছে যন্ত্রাংশের অভাবে। জানিনা, প্রকাশিত রিপোর্টটি সর্বাংশে সত্যি কিনা—অসত্য হলে দেশবাসীর কাছে তা মঙ্গল। কিন্তু যদি সত্যি হয়? আর দশটা খবরের মতো এই সাড়ে ষোল হাজার পাওয়ার পাম্প বিকল হবার সংবাদের কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতিবাদ জানাতে না পারেন তাহলে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের বড় সাহেবরা কি কৈফিয়ত দেবেন দেশবাসীর কাছে?
খবরে বলা হয়েছে, সচল ১৫ হাজার পাওয়ার পাম্পের একটিও এখনও পর্যন্ত কারো কাছে বরাদ্দ করা হয়নি। আমরা জানতে চাই যেগুলো চালু আছে সেগুলো আপনারা বরাদ্দ করলেন না কেন বা এখনও করছেন না কেন? আপনারা কি জানেন না জমিতে ধান গাছ লাগানোর পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির দরকার হয় সেখানে। অথচ ফসলের মওসুমের শুরুতে যা করার ছিল অদ্যাবধি তা করেননি। অর্থাৎ একটি চাষীও পাওয়ার পাম্প পায়নি। খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব—আজ এ কথা বললে আমরা শুনবো কেন? এতদিন ধরে তাহলে আপনারা কি করছিলেন? বিদেশ থেকে জরুরী ভিত্তিতে খুচরা যন্ত্রাংশ আনানোর ব্যবস্থা করলেন না কেন? গত বছর ৩৫ হাজার পাওয়ার পাম্প চালু রেখে দেশের খাদ্য পরিস্থিতির এই দশা। সেক্ষেত্রে অর্ধেক পাওয়ার পাম্প বিকল হয়ে গেছে, সচলগুলো কাউকে দেয়া হয়নি এখনও। এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের কথা বাদ দিন, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্ণধাররা একটু নিশ্চিন্ত মনে ভাবুন তো, যদি খবর আসে চাষীদের কাছে সময় মতো পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করতে না পারায় আগামী মওসুমে সারাদেশ নতুন করে ব্যাপক হারে খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
গতকাল এরই পাশাপাশি দেখেছি সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রীর সাথে কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের বৈঠকের খবর। যত ইচ্ছে খুশী আপনারা বৈঠক করুন। কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াবার কথা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন। আমরা দেশবাসী শুধু শুনতে চাই পাওয়ার পাম্পের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছে।

মেয়েদের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা

সমগ্র দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। এই বিপুল শ্রমশক্তিকে বৃথা বয়ে যেতে দেয়া সম্ভব নয়। যদিও শিক্ষাঙ্গন এবং কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা আজ এগিয়ে আসছেন—কিন্তু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জগত আজো তাদের কাছে রয়েছে প্রায় অজ্ঞাত। সেদিকে ইঙ্গিত রেখে মিরপুর টেকনিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে নারী সমাজের জন্য কারিগরি শিক্ষার দ্বিতীয় কোর্স উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বলেছেন যে, নারী সমাজের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, কারিগরি শিক্ষার অভাবে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। তাই পুরুষরা তো বটেই—নারী সমাজকেও ব্যাপকভাবে আগ্রহ নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে হবে। এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজ বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নমূলক ও অর্থনৈতিক কাজে অংশ নিতে পারেন।
মিরপুর টেকনিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে সভাপতির ভাষণে নারী পুনর্বাসন বোর্ডের মাননীয় চেয়ারম্যান বলেন যে, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা নারী সমাজকে আত্মনির্ভরশীল, স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এ কথা সত্য যে, কর্ম মানুষকে উন্নতি ও স্বাবলম্বীতার সোপানে নিয়ে যায়। হাতে-কলমে যে কাজ শেখা যায় এবং বাস্তব জীবনে যার প্রয়োজন হরহামেশাই দেখা দেয়—এমন কাজ মেয়েদের শেখা খুবই দরকার।
তবে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সুফল সম্বন্ধে এখনও সাধারণ নারী সমাজ বিশেষ কিছুই জানেনা। এই অজ্ঞতাই তাদেরকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণে অনেক সময় বিমুখ রাখে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্যের ভুয়া মূল্যবোধ এবং সংস্কারও তাদের পথরোধ করে। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত বোনদেরই অগ্রণী হয়ে আসতে হবে এগিয়ে এবং বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তরসূরী সৃষ্টি করতে হবে।
এ কথা সত্য যে, কারিগরি শিক্ষা বলতে শুধু যে রেডিও, ইঞ্জিন মেরামত বোঝায় তা নয়, সেগুলো তৈরী করাও হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। হয়তো সেখানে পুরুষ কর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাতেই বা কি? কাজকে কাজ বলেই গ্রহণ করতে হবে এবং যে কোনো প্রকারের কাজ শিখে পেশা গ্রহণের জন্য তৈরী করতে হবে প্রসন্ন মানসিকতা। এই প্রসন্ন মানসিকতা অর্জন করতে পারলে আর পেশা নির্বাচন নয়—পেশা গ্রহণের প্রার্থী হতে পারবে নারী সমাজ। তদুপরি এই উদারতাই দূর করে দেবে সংস্কারের কালো ছায়াকে।
সংশ্লিষ্ট মহল সূত্রে জানা গেছে যে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কাজে তুলনামূলকভাবে মেয়েরা নাকি ছেলেদের চেয়ে অধিক নৈপুণ্যের পরিচয় দিচ্ছেন। এ কথা সত্য যে, নিপুণ কাজে এবং ধৈর্য ও নিষ্ঠার কাজে মেয়েরাই প্রকৃতিগতভাবে স্থিতিশীল বেশী। হয়তো সে কারণেই এই প্রশংসা তাদের ভাগ্যে জুটছে। এবং এভাবে যদি মেয়েরা ক্রমশঃ তাদের যোগ্যতা, ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে যেতে পারেন তাহলে সংস্কার তো পরাজিত হবেই উপরন্তু তারা অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার হাত থেকেও পাবেন মুক্তি। তখন অনেক বেশী সংখ্যক মহিলা এই দিকে আকৃষ্ট হবেন এবং ব্যাপক হারে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের, পরিবারের, সমাজের ও দেশের উপকার করতে পারবেন।
যদিও দেখা যায়, আজকাল মেয়েরা ডাক্তারী বা প্রকৌশলী বিদ্যার প্রতিও ঝুঁকেছেন তবু তা সংখ্যায় নগণ্য এবং পুরুষদের তুলনায় আনুপাতিক কোনো হারই হয়তো দাঁড়ায় না। অথচ উন্নত দেশের দিকে চাইলে দেখা যায়, সেখানে সমগ্র জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য হারে মেয়েরা নানা প্রকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করছে। এবং তারা নিরলসভাবে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করতে পারছেন।
এমন পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ব্যাপক সরকারী উদ্যোগেরও প্রয়োজন রয়েছে বৈকি! শুধু রাজধানী নগরী নয়, প্রতি শহর, মহকুমা এমনকি সম্ভব হলে গ্রামেও নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা উচিত। বাঙালী মেয়েরা কাজ করতে বা শিখতে পারে না এ কথার মধ্যে না গিয়ে প্রথমেই তাদেরকে কাজের জগতে টেনে আনা হোক। মূল্যায়ন হবে তারপর। সুখের কথা যে সব স্বল্প ক্ষেত্রে এই মূল্যায়নের সুযোগ হয়েছে—সেখানে বাঙালী নারী সমাজ গৌরবের চিহ্ন রেখেছে। অতএব আমরাও চাই দেশের অর্ধেক নারী সমাজকে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ এবং উৎসাহ দানের মধ্য দিয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বাস্তব ক্ষেত্রে কাজ করবার ও শিখবার সুযোগ দেয়া হোক। দেশ গঠনের কাজে নারী সমাজও সমান অংশ নিক। কারণ তারা অবলা ভাব কাটিয়ে উঠে আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরশীলতার প্রতিশ্রুতিতে বলিষ্ঠ হতে শিখলে জাতিরই কল্যাণ!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!