You dont have javascript enabled! Please enable it! পূর্ব-পশ্চিমে সন্ত্রাস- কারণ ও প্রতিকার - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব-পশ্চিমে সন্ত্রাস– কারণ ও প্রতিকার

গত ৭ জুলাই ২০০৫ তারিখে লন্ডনে বােমা হামলার পর ১৭ আগস্ট ২০০৫-এ বাংলাদেশের প্রায় সব কটি জেলায় ইসলামী জঙ্গী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বােমা হামলাটি সমগ্র বিশ্ব তথা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অশনিসংকেত। দু’মহাদেশের দু’প্রান্তে দু’ধরণের বােমা হামলার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও এর মধ্যে আদর্শগত ঐক্য রয়েছে। দুটি হামলার পিছনে রয়েছে ইসলামী জঙ্গীগােষ্ঠী; উভয় হামলার পিছনে রয়েছে অশুভ পাকিস্তান কানেকশন এবং সম্ভবত পর্দার পেছনে আল-কায়দার কালাে হাত। উভয় গােষ্ঠীর চিন্তা চেতনার ঐক্যটি হল এক ধরনের অসহিষ্ণুতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রয়ী স্বপ্ন। দারিদ্র, হতাশা, সামাজিক অবিচার, বৈষম্য, সম্পদের অপ্রতুলতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাব যখন বাংলাদেশে এক শ্রেণীর লােককে ধর্মান্ধ গােষ্ঠীর কবলে ঠেলে দিচ্ছে তখন যুক্তরাজ্যে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ বিশেষ নিজেদের দেশ ও সমাজের সাথে একাত্ম অনুভব না করে বিভ্রান্ত চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজেদের আইডেনটিটি (Identity) খুঁজে নিচ্ছে মধ্যযুগীয় ইসলামী জাতিসত্তার মধ্যে। এদেরকে ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদ ও ধ্বংসাত্মক কাজে প্ররােচিত করছে কতিপয় মৌলবাদী গােষ্ঠী। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলাে ব্যবহার করে এদেরকে ইসলামী জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এই ঘৃণ্য অপশক্তি। ভ্রান্ত পথে চলবার জন্য এবং অসুস্থ চিন্তায় আচ্ছন্ন হবার পিছনে তাদের ব্যক্তিসত্তার সাথে সমাজের যে মিথক্রিয়াগুলাে কাজ করছে তার মধ্যে অন্যতম হল-তাদের আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক একীভবনের (Identity ও Cultural Integration) অভাব। প্রকৃত শিক্ষার অভাবের সাথে সাথে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের কারণে বিদেশের মাটিতে কয়েক পুরুষ ধরে থাকলেও তারা রয়ে গেছে বিচিছন্ন দ্বীপ। হিসেবে। সে দেশের মানুষ, সমাজ কখনই তাদের কাছে আপন হয়ে উঠেনি; সে দেশের মাটিতে তারা খুঁজে পায়নি শিকড়। জাতিগত ও বর্ণগত বিদ্বেষের সাথে সাথে নানাবিধ ব্যাথা, বেদনা, হিউমিলিয়েশন তাদের মধ্যে তৈরি করেছে হীনমন্যতা, অস্থিরতাও নিরাপত্তার অভাব।

এরপর কোন কোন পাশ্চাত্য শক্তির পররাজ্য আগ্রাসন, নৰউপনিবেশবাদ, তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠন এবং সামগ্রিকভাবে Arrogance of power বা ক্ষমতার দম্ভ তাদের মধ্যে তৈরি করেছে ভয়ংঙ্কর ক্রোধ, ক্ষোভ, স্বপ্নভঙ্গ এবং প্রতিহিংসা প্রবণতা। আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতে চেয়েছে এমন পরিবারের সন্তানরাও এ প্রেক্ষাপটে মৌলবাদীগােষ্ঠী কর্তৃক প্ররােচিত হয়ে ধর্মান্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন হচ্ছে। এই ধর্মান্ধ চিন্তাগুলােই তাদের মধ্যে উস্কে দিয়েছে এক ধরণের হতাশা ও অহমবােধ থেকে সৃষ্ট আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ ও প্রতিহিংসা। এই অসুস্থ মানসিক অবস্থাটিকে প্যারােনিয়া (Paronia) বললে ভুল বলা হবে না। এরা অনেকেই ধর্মভিত্তিক ডেব্যুশন (Delusion) এ ভুগছে। তাদের এই অসুস্থ চিন্তাকে আরও উস্কে দিচ্ছে বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের বেশ। কিছু দেশের ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি ও মৌলবাদ। ঐসব দেশে প্রচারিত হয় না অথচ অনুভব করা যায় এমন জাতিগত বা ধর্মগত বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতমুলক (Discrimination) আচরণ সে দেশের মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে দেশের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এরপরও যখন জানতে পারি সেখানকার কোন অভিবাসী টুইন টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞ বা ৭ জুলাই-এর বােমা হামলার পর খুশী হয়েছে তখন বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ঘৃণা প্রকাশ না করে পারি না। এসবের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য পাশ্চাত্য শক্তিকে নিজেদের অপকর্ম, ব্যর্থতা ও সমস্যার দিকে তাকাতে হবে। বুঝতে হবে বিভ্রান্ত মুসলিম জনগােষ্ঠীর ক্ষোভ এবং দুঃখগুলােকে। নিশ্চিত করতে হবে সম্পদের বন্টন এবং বৈশ্বিক সুবিচারকে। বন্ধ করতে হবে হীন স্বার্থে বেপরােয়াভাবে দূর্বল দেশগুলাের সম্পদ লুণ্ঠন এবং চাপিয়ে দেয়া সংঘাতগুলােকে। জাতিসংঘসহ বিশ্বসংস্থাগুলােকে ব্যাপক সংস্কার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সার্বিক সাহায্য ও সহযােগিতার শর্ত হবে সুশাসন ও মানবধিকার। আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে রুখতে হবে জাতিগত ও ধর্মগত বৈষম্য। স্বৈরশাসন, একনায়কতন্ত্র, মৌলবাদদের উত্থান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গণ্য করা যাবে না।

সর্বসম্মতক্রমে এসব ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বকে ঢাল হিসাবে ব্যবহারের বিষয়টিকে নাকচ করতে হবে। সকল দেশের পক্ষ থেকে বন্ধ করতে হবে মৌলবাদী সরকার ও অগনতান্ত্রিক দেশগুলাের সাথে দ্বৈত সম্পর্ক। পাকিস্তান, সৌদিআরব ও মিশরের মত দেশগুলাের শিক্ষালয় ও মাদ্রাসাগুলাের সাথে সম্পৃক্ত সকল অভিবাসী তথা ধর্মীয় নেতাদের উপর কঠোর নজরদারি করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী জঙ্গীদের অন্যতম পৃষ্ঠপােষক সংগঠন আইএসআই এবং তালেবানদের সাথে সম্পর্কযুক্ত সকলের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন এবং তাদের চলাচলে বাধা প্রদান সন্ত্রাস দমনের স্বার্থেই করতে হবে। পৃথিবীর যে কোন দেশে যারা সন্ত্রাস এবং জিহাদের পথে গান গায়, যারা মানুষের হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করে তাদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পৃথিবীকে শান্তিময় করবার জন্য। এই সমস্ত অপশক্তিকে সৌদিআরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলি আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তাদের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করতে হবে। পৃথিবীর দেশে দেশে যারা হত্যা, ও ধ্বংসের বানী শােনায় তাদের ভিসা ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষিদ্ধ করতে হবে। সকল মৌলবাদী জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের পাসপাের্ট বাতিল করতে হবে। এ সমস্ত মৌলবাদী জঙ্গীদের নাম আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এদের অর্থের যােগানদাতা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলােকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যে সমস্ত মসজিদ ও মাদ্রাসায় ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাণী প্রচার করা হচ্ছে বা জিহাদের ঝান্ডা। তােলা হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে যে সমস্ত ধর্মভিত্তিক এনজিওগুলাে কাজ করছে তাদের কার্যক্রমগুলােকে কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে এবং এদের আর্থিক লেনদেনগুলােকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের আমল থেকে ঘৃণ্য মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপােষকতা শুরু হওয়ায় ঐ সময় থেকে সরকারী আনুকুল্য পাওয়া সকল ধর্মভিত্তিক এনজিও ও মৌলবাদী গােষ্ঠীর কার্যক্রমকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নজরদারি করতে হবে।

এই সমস্ত এনজিও এবং ধর্ম ভিত্তিক গােষ্ঠীগুলাে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের সময় থেকে বিকশিত হওয়ায় এদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। মৌলবাদীরা প্রশ্রয় প্রদানকারী সকল রাজনৈতিক সংগঠনগুলােকে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা দেখেছি ‘৭১-এর বহু যুদ্ধাপরাধী ও ঘৃণ্য মৌলবাদী চক্র ব্যাপকভাবে আশ্রয় নিয়েছে সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক দলগুলােতে। রাজনৈতিক পরিচয় ও পরিকল্পনা গােপন করে তারা স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে। এমন কি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও এদের শক্ত শিকড় রয়েছে। নীরব ঘাতক হিসাবে এরা কৌশলে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে দেশের ক্ষমতা কজা করার জন্য। নানামুখী আশ্রয় প্রতিষ্ঠান তৈরী করে আপন শক্তি বৃদ্ধির জন্য মৌলবাদী। গােষ্ঠী তাদের অর্থনৈতিক ঘাঁটিগুলােকে মজবুত ও শক্তিশালী করেছে। করায়ত্ব করেছে মিডিয়াকেও। এ প্রেক্ষাপটে জঙ্গীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতা সংগঠন গুলােকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়ােজন এদেরকে রুখবার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাস দমনের জন্য মসজিদ মাদ্রাসাগুলাের উপর কঠোর নজরদারি করা প্রয়ােজন। ধর্মের নামে ব্যাংক ও বীমা জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরী করে ধর্ম ভিত্তিক বাণিজ্য নিষিদ্ধ করতে হবে। সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে এ ব্যাপারে অতি প্রয়ােজন হল সরকারের সদিচ্ছা। মাদ্রাসাগুলাে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যা প্রয়ােজন তাহল –

১.সরকারী রেজিষ্ট্রেশন

২.সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত স্বচ্ছ পাঠ্যসূচী প্রণয়ন

৩.মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে কম্পিউটার ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংশ্লিষ্ঠ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ।

৪.বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিষয়ক শিক্ষকদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োেগ দান।

৫.মাদ্রাসা গ্রাজুয়েটদেরকে সামাজিক পুনর্বাসন। ৬.মাদ্রাসা শিক্ষার শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করণ এবং তাদের সুযােগ সুবিধার প্রতি দৃষ্টি জ্ঞাপন।

৭.মসজিদ ও মাদ্রাসার অর্থ যােগানাদাতাদের নিয়ন্ত্রণ ৮.সামগ্রিকভাবে মাদ্রাসার সংখ্যা কমিয়ে আনা। সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাস দমন করতে হলে দেশের মানুষের দারিদ্র বিমােচন ও শিক্ষা উন্নয়নের উপর জোড় দিতে হবে। আশার আলাে দেখবার জন্য প্রকৃত অর্থে ন্যায়ের অধিকার ও সত্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সমাজের অভ্যন্তরে অবস্থিত গভীর হতাশা, ভারসাম্যহীনতা ও বিক্তের বৈষম্য কমাতে হবে। গ্লোবালাইজশন তথা বিশ্বব্যাংকের ফাদ থেকে বেরিয়ে এমনভাবে দারিদ্র বিমােচন করতে হবে যাতে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। মানুষের সাধ্যের সাথে স্বপ্নের দূরত্বকে কমিয়ে আনতে হবে। বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাবের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একদিকে যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বিচারহীনতার নীরবতা ভাঙ্গতে হবে অন্যদিকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহমর্মিতা উপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে ধর্মভিত্তিক সকল রাজনীতি। বন্ধ করতে হবে নষ্ট পথে বিত্তের উদ্ভব ও লুটেরাদের ক্ষমতায়ণ এবং রাজনীতিতে এদের আত্মীকরণ। সন্ত্রাসে নির্মূল করতে হলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ দূনীতি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কালাে টাকার অবাধ গতি এবং লুটেরা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তনসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সন্ত্রাসের সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে নির্বাচনে মনােনয়ন দানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরােপ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা শুধু নির্বাচন কমিশনকে দিলেই হবে না, সেই সাথে এ বিষয়টি স্বাধীন বিচার বিভাগের এখতিয়ারভূক্ত হতে হবে। গণতান্ত্রিক শক্তি, সুশীল সমাজ এবং জনগণের ঐক্যই কখতে পারে সন্ত্রাস। তারিখ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৫ 

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান