You dont have javascript enabled! Please enable it!

সন্ত্রাস, একাত্তর এবং আমাদের জয় পরাজয়

একাত্তরের স্বপ্ন ও আমাদের জয় পরাজয় নিয়ে যখন নানা কথা ভাবছিলাম তখন দেশে কতগুলাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনা ঘটল তাহল জেএমবির জঙ্গী হামলায় ঝালকাঠিতে বিচারক সােহেল আহমেদ ও জগন্নাথ পাড়ের মৃত্যু। এই দুই বিচারকের মৃত্যুতে তাদের স্বজনদের কষ্ট, কান্না এবং সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচলিত মন আমাদের হৃদয়কে শুধু ছোঁয়নি, সেই সাথে সমগ্র সত্ত্বাকে ঝাকি দিয়েছে। আমাদের অস্তিত্বই আজ অলক্ষ্য সংকটে। যে দেশের জন্য হাজার ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও সুন্দর ভবিষ্যতকে নিজ হাতে ভেঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং পরবর্তীতে বিদেশের সম্ভাবনাময় জীবন ত্যাগ করে দেশে ফিরেছি সেই দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি শঙ্কিত হচ্ছি। এ দেশের মাটিকে আমি ন্নি চোখে দেখি। এর প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে আমার ভাইয়ের রক্ত। এ মাটির পরতে পরতে সাজানাে রয়েছে লাখাে শহীদদের অস্থিকরােটি। প্রিয়জনদের এই সব অস্থি ও ধুলামিশ্রিত রক্তকণা অপেক্ষা করছিল। এমন একটি জ্যোৎস্নাময় রাত ও আলােকোজ্জ্বল দিনের জন্য যা কিনা মুক্ত করবে সকল শহীদদের সম্মিলিত আত্মাকে। যা পূরণ করবে তাদের অন্তিম ইচ্ছাকে। কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আর বুঝি এলােনা। বিগত ৩৪ বছরে নানা সরকার এসেছে কিন্তু এদেশের মানুষের জীবনে উল্লেখযােগ্য কোন পরিবর্তন আসেনি। এখনও এদেশের ৪০ ভাগ লােক দারিদ্র সীমার নীচে জীবনযাপন করছে। ৫০ ভাগ লােক পুষ্টির অধিকার থেকে বঞ্চিত। সমসংখ্যক লােক বিশুদ্ধ পানির অধিকার থেকেও বঞ্চিত। দেশের জনগণ নয়, স্বাধীনতার সুফল ভােগ করেছে দেশের লুটেরা শ্রেণী, নষ্ট রাজনীতিবিদ এবং সামরিক-বেসামরিক আমলারা। এই হতাশ পরিস্থিতিকে আরাে অন্ধকারময় করে তুলেছে জোট সরকারের সাথে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের সখ্যতা এবং তাদের ফ্যাসিষ্ট আচরণ। যে দুনীর্তি ও সন্ত্রাস হটাবার নাম করে তারা ক্ষমতায় এসেছে, সেই দূনীর্তি এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সন্ত্রাসের শিকড় মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে প্রশাসন পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তৃত। দেশের মাথা ও লেজ সব যেন পচে গেছে। এর মধ্যে পায়তারা চলছে আইন করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ ও সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। আইনের বাইরে সাংবাদিক নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণ যথারীতি চলছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা মােটেই ভাবতে পারছে না।

গণতান্ত্রিক অধিকারের কথাও ভাবতে পারছেনা। যে দেশের সরকার নিজেরা বাস ও নৌকা আটকিয়ে ভিন্ন দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেয় এবং নিরাপত্তাকর্মীরা সমাবেশ ঠেকাতে সাধারণ জনগণকে স্থানে স্থানে গাছের সাথে বেঁধে রাখে এবং কখনাে কখনাে হাজতে পুরে রাখে, সেখানে গণতন্ত্রের কোন ভবিষ্যত আমি দেখতে পাচ্ছিনা। লাখাে শহীদের স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনাও কম। সেদিন বেশি দূরে নয় যে দিন একাত্তরের ঘাতক আল-বদর, আল-শামস ও জামাত চক্র নিজেদেরকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসাবে দাবী করবে। স্থানে স্থানে মুক্তিযােদ্ধা ও সেনাবাহিনীদের নানা অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধী চক্র হাজির হয়ে তাদের গ্রহণযােগ্যতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়েই গেছে। এরপর তাদের সহায়ক শক্তি জেএমবিকে দিয়ে স্থানে স্থানে বােমা ফাটিয়ে তারা পশ্চাত্য শক্তির কাছে গণতন্ত্রের ত্রাতা হিসাবে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে। নিজেদেরকে প্রমাণ করতে চাচ্ছে বিষনাশী মােক্ষম বিষ হিসাবে। ‘৭১-এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাতকদের সাথে সম্মিলিতভাবে তাবেদার পাকিস্তানকে রক্ষাকল্পে নানা ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত ছিল এবং আমাদের স্বপ্ন নষ্ট করবার নােংরা খেলায় মত্ত ছিল ১৯৭৫ পর্যন্ত। এখন নতুন করে এই তথাকথিত মডারেটদের সাথে গাঁটছাড়া বাধলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কেননা এই আমেরিকার সমর্থনের অভাবে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। এদের পরােক্ষ সমর্থনের কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের ৭৫ ভাগ ইউনিয়ন কাউন্সিলের। চেয়ারম্যান এবং ৮০ ভাগ মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম নারায়ে তাকবীর বলে, পাকিদের সাথে হাত মিলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও নারী নির্যাতনে লিপ্ত হয়েছিল। মানবতাবিরােধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ঠ ইতর ও হিংস্র দানবগুলাে আজ বুক ফুলিয়ে চলছে। আজও তারা অনুতাপহীন। বিগত সামরিক সরকারগুলাে বিভিন্নভাবে এদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরা বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন পরিচয়ে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে শক্ত আসন করে নিয়েছে। সিংহভাগ ব্যবসা ও বাণিজ্য এদের করায়ত্বে।

নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে লুটের টাকা ও পেশী শক্তির অভাব নেই। এরপর ইউনিফর্ম পরিহিতদের সন্ত্রাস তাে রয়েছেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে মৌলবাদীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। তারা ‘৭১-৭৪ পর্যন্ত পরাজয় এবং নানা অবমাননার প্রতিশােধ চায়। একাত্তরের নিহত ও নির্যাতিতদের দেহের উপর দাঁড়িয়ে তারা বিজয় পতাকা উড়াতে চায়। দেশ কি প্রস্তুত এদেরকে রুখবার জন্য? জনগণের আন্দোলনই হঠাতে পারবে এদেরকে। তবে তা যেমন তেমন আন্দোলন নয়। ‘৬৯ এর মত ব্যাপক আন্দোলন, যা আইয়ুবের পতন ঘটিয়ে দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে নাকচ করেছিল তেমন আন্দোলন চাই। এই অপশক্তিকে মরা হাঁসের পালকের মতাে একটি একটি করে উপড়িয়ে ফেলতে চাই। দেশের প্রতি কোনায় সার্বিক শুদ্ধি অভিযান চাই। পরাক্রমশীল জনগণ অংশগ্রহণ করলে হিমালয়ও সরে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রতিটি সৈনিকের দৃঢ় সংকল্প এবং ফেলে আসা দিনের স্বপ্ন হয়ত অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারৱে। আসুন বিজয়ের স্বপ্ন দেখি এবং পরাজয়কে মেনে নেবার আগে আবার যুদ্ধ করি, প্রয়ােজনে মৃত্যুকে বরণ করি। জয় হােক আমাদের অহংকারের। তারিখঃ ২৭ নভেম্বর ২০০৫

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!