You dont have javascript enabled! Please enable it!

সন্ত্রাসের শিকড় ও প্রাসঙ্গিক কথা

বিশ্বব্যাপী চলমান অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক অবিচারের পাশাপাশি ক্ষমতাধরদের লােভ, ক্রোধ, দম্ভ ও স্বার্থান্বেষী ইচ্ছার নিকট পদদলিত হয়ে সমগ্র বিশ্ব এক ভয়ঙ্কর অরাজকতা ও নৈরাজ্যের ঘূর্ণি আবর্তে নিপতিত হয়েছে। মানুষের সম্পদ, স্বপ্ন, ভাগ্য ও অধিকার নিয়ে নিষ্ঠুর রাজনৈতিক খেলা নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থানরত খেলুড়ে নটরাজসহ সকল সাধারণের জন্যই এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধসহ বিগত শত বছরের নানা যুদ্ধ ও বীভৎস সংঘাতের পর ক্ষমতার কেন্দ্রটি একদিকে ঝুলে যাওয়ায় এখন ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীনদের সংঘাতটি চলছে একটি বিকল্প বিকৃত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। এ কারণেই পার্ল হারবারের পতনের পর আমেরিকার ওপর দ্বিতীয় বৃহৎ আঘাতটি নেমে আসে ২০০১ সনের ১১ সেপ্টেম্বর, একটি অভূতপূর্ব সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে। এই হামলার প্রেক্ষাপটে সমগ্র বিশ্ববাসী সন্ত্রাসীদেরকে তীব্র ভাষায় সমালােচনা করলেও তারা দৃঢ়তার সাথে দ্বিতীয় ঈশ্বরতুল্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাপরাক্রমশীল গােয়েন্দা বিভাগ ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্ত সমালােচনা করতে ব্যর্থ হয়। জানা গেছে, ইসরায়েলী গােয়েন্দা সংস্থা মােসাদসহ প্রায় এগারােটি দেশের গােয়েন্দা সংস্থা ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পূর্বে সিআইএ ও এফবিআই’কে সতর্ক করে দিয়েছিল। আসন্ন সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনার ব্যাপারে। এমনকি তারা নাকি সন্দেহভাজনদের একটি বিশাল তালিকাও দিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে। এরপরও আমেরিকা কেন শেষ রক্ষা করতে পারল না কিংবা করল না সেটা গভীর চিন্তার ও গবেষণার বিষয়। চিন্তার বিষয় এটাও যে, কেন আমেরিকানরা এ ঘটনার সাথে আইএসআই এবং মােসাদের একটি অংশসহ কেজিবি’র দলছুটদের ভূমিকা পর্যালােচনা করতে ব্যর্থ হল। অথচ ঘটনার পূর্বে পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, মিশর, সুদান, কেনিয়াসহ আফ্রিকা-ইউরােপের কয়েকটি দেশে এবং খােদ আমেরিকাতে সন্ত্রাসীদের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছিল। আইএসআই’সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গােয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আমেরিকানরা যে সমস্ত ইসলামি জঙ্গি ও মৌলবাদীদের লেলিয়ে দিয়েছিল রাশিয়ানদের আফগান ছাড়া করবার জন্য এবং সােভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙবার জন্য, তারাই আজ আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ছে।

নানা ধরনের অস্ত্র ও কৌশলগত শিক্ষা দিয়ে যাদেরকে একসময় আমেরিকানরা ব্যবহার করেছিল তারাই আজ আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীযুদ্ধে নেমেছে- শক্তিধর দেশটির শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও দ্বৈত ভূমিকার কারণেই। এ প্রেক্ষিতে ভূতপূর্ব ব্রিটিশ পরিবেশমন্ত্রী মাইকেল মিচার সম্প্রতি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, একটি সন্ত্রাসী গােষ্ঠী ১৯৯৬ সন থেকেই ওয়াশিংটনে বিমান হামলার পরিকল্পনা করছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১৯৯৯ সনে আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল রিপাের্টে বলা হয়েছিল যে, আলকায়দার আত্মঘাতি বােমারুরা বিস্ফোরক ভর্তি বিমান নিয়ে পেন্টাগন অথবা হােয়াইট হাউসে ক্র্যাশল্যান্ড করতে পারে। এরপরও যথাযথ প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি ১১ সেপ্টেম্বরের ঐ দু’ঘন্টাব্যাপী হামলার সময় আমেরিকার একটি যুদ্ধজাহাজও উড়তে পারেনি। এ প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি আলােচনায় আসে তাহল- এ সমস্ত ঘটনা কি নেহাতই মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা, নাকি তাদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা? এই অবহেলার পেছনের কারণটিই বুঝতে হবে বিশ্ববাসীকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে যখন কোনভাবেই যুদ্ধে জড়ানাের ব্যাপারে রাজি করানাে যাচ্ছিল না, ঠিক সেই সময় ঘুমন্ত পার্ল হারবারের ওপর জাপানিরা হামলা করে। অসাবধানতায় জাপানিরা নিজেরাই জাগিয়ে তােলে। আমেরিকান জনগণকে। অথচ পার্লহারবারের ঐ আক্রমণের ঘটনার আগে তাদের গােয়েন্দা সংস্থা ঠিকই সতর্কবাণী পেয়েছিল। তবে অজ্ঞাত কারণে তা মার্কিন রাষ্ট্রনায়কের কাছে পৌছাতে পারেনি। পার্লহারবারের পতনের পর আমেরিকার জনগণ যেভাবে যুদ্ধের পক্ষে রায় দিয়েছিল, ঠিক একইভাবে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর তারা তাদের সরকারের পূর্বপরিকল্পিত আগ্রাসনের প্রতি সম্মতি জানিয়েছে, বর্তমান সময়কার প্রেক্ষাপট অনুধাবন না করেই। এতে এই বােঝা যায় যে, আজারবাইজান থেকে পাকিস্তান, কাস্পিয়ান থেকে আরবসাগর এই বিস্তৃত ভৌগলিক সীমার নিকটবর্তী উজবেক, কাজাখসহ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার তেল সম্পদের ওপরে মার্কিনীদের কর্তৃত্বস্থাপন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় দাড়িয়েছিল যে, এ অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদেরকে খুঁজে পেতে হবে সন্ত্রাসের শিকড়টিকে।

এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সন্ত্রাসবিরােধী যুদ্ধের ডামাডােলে সমগ্র বিশ্ব প্রকম্পিত হলেও সত্যিকার অর্থে বিশ্বব্যাপী অসহিষ্ণুতা, সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস দমনে আমরা মােটেই সম্মুখে এগুতে পারিনি। শক্তিধর দেশগুলাের সামরিক ও পুলিশী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কিছু সন্ত্রাসী ধরা পড়লেও সন্ত্রাসের শিকড় ও উৎসগুলাে অক্ষতই রয়ে গেছে।  এইসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীদের ক্ষতিসাধনের পরিবর্তে অধিকতর ক্ষতিসাধন করা হয়েছে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনগণকে। এতে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে। সত্যি কথা বলতে, সন্ত্রাসের বীজগুলাে বােনা হয়েছে বিগত দুশ’ বছরে, নানা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং শােষণের ক্ষেত্রগুলােকে অবারিত রাখবার নষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের অনুচর কর্তৃক ঐসমস্ত এলাকার অদিবাসীদেরকে বঞ্চিত করে তাদের ভূমি ও সম্পদ দখলের মাধ্যমে যে দস্যুতা ও বর্বরতার উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে তা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির একটি বড় কারণ। অস্ট্রেলিয়া ও খােদ আমেরিকার ভূখণ্ডে আদিবাসীদের হত্যা করে সেখানকার মাটিতে শ্বেতসভ্যতার সৌধ বানাবার বিষয়টি মানুষ আজও বিস্মৃত হয়নি। ব্রিটিশ কুটচালে মধ্যপ্রাচ্যে শেখ-শাসিত কয়েকটি ভৃত্য রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের চাকাকে কয়েক হাজার বছর পেছনে ঘুরিয়ে জেরুজালেমের মাটি ও ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে, আরবদের পেটে ইসরায়েল নামক এক গোঁজ ঢুকিয়ে দেয়া সাম্রাজ্যবাদীদের পরসম্পদ লােভী কুটপরিকল্পনার অংশ মাত্র। এসব কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে সংঘাত, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের যে চিরস্থায়ী বীজ বুনে দেয়া হয়েছিল বিগত পঞ্চাশ বছরে, তা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এছাড়া কাশ্মিরী জনগণের স্বাধীন আকাক্ষাকে মুছে তাকে পরিকল্পিতভাবে ভারতপাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করার মাধ্যমে উপমহাদেশের মাটিতে বিবাদ জিইয়ে রাখা হয়েছে। স্বাধীনচেতা সামী কুর্দিদের পিতৃভূমিকে তিনখণ্ড করে ইরাক, ইরান ও তুরস্কের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে এ অঞ্চলসমূহে সন্ত্রাস ও মানব হত্যার তপ্ত চুলাে তৈরি করা হয়েছে। সম্পদ লুটের অভিপ্রায়ে প্রাধান্য বিস্তার ও দালাল সৃষ্টির প্রক্রিয়া আফ্রিকার নানা দেশকে ভয়ঙ্কর জাতিগতদাঙ্গা ও গণহত্যার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। হীরা ও সােনার খনিগুলাের মধ্যে নিজেদের লম্বা হাত ডুবিয়ে ব্রিটিশ রাজরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যে ভয়ঙ্কর লুটপাট চালিয়ে আসছিল বিগত শতাধিক বছর ধরে তার সামান্য অংশই শেষ হয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলার এনসিসি’র বিজয়ের পর।

এখনও আফ্রিকার মাটিতে শ্বেত শাসকের দালালরা দোর্দণ্ড প্রতাপে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আজ কালােদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও তারা সমাজের নিম্নস্তরে বসবাস করছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজপথে নীরব অভিমানে তাদের অনেককেই আজ হাত পাততে হচ্ছে। জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রনায়ক রবার্ট মুগাবে এই প্রক্সি-শাসকদের শােষণ থেকে দেশকে মুক্ত করবার উদ্যোগ নেয়াতেই রােডেশিয়ার প্রাক্তন পশ্চিমা শাসকদের মনে ঘৃণা ও ক্ষোভ জেগে উঠেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট মুগাবের কার্যপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত দিকটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিও বলা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে লাইবেরিয়া, আইভেরিকোষ্ট সিয়েরালিওনসহ আফ্রিকার মাটিতে যেসব সংঘাত চলছে এবং যেখানে পাশ্চাত্য সেনাবাহিনী যাচ্ছে সেখানেই রয়েছে পাশ্চাত্য শক্তির স্বার্থ । রয়েছে তেল, সােনা, হীরাসহ নানা মহার্ঘ বস্তুর প্রতি সীমাহীন লােভের সংঘাত। এটা দিবালােকের মত স্পষ্ট যে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের সম্পদ এবং ঐসব স্থানে পাশ্চাত্য শক্তির স্বার্থই আজ বিশ্বরাজনীতি ও তথাকথিত মানবতার নীতিকে নির্ধারণ করছে। এসব কারণেই ইউরােপের মাটিতে থেকেও আলবেনিয়া উপেক্ষিত থাকে। পশ্চিমাদের স্বার্থের কারণেই যুগােশ্লোভিয়ার মত শক্তিধর দেশ খণ্ডিত-বিখণ্ডিত হয়ে একটা ফেইলর স্টেটে পরিণত হয়। আর এই খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করার প্রক্রিয়াটিকে যৌক্তিকতা দেবার জন্যই সেখানে ঘটানাে হয় ভয়ঙ্কর জাতিগত ও ধর্মগত নিধনযজ্ঞ এবং নারী নির্যাতন। শত বছরের সংগ্রামের পরেও চীনের একপ্রান্তে অবস্থিত উগায়ের (তুর্কেমান), মধ্য এশিয়ার চেচেন ও কুর্দিরা স্বাধীনতা পায় না, অথচ পাশ্চাত্যের স্বার্থে পূর্ব তিমুর ঠিকই স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতার বিষয়টিকে যৌক্তিক মনে করেও বলা যায়, কোন যৌক্তিক বিষয়ই যৌক্তিক নয় যতক্ষণ না তা পাশ্চাত্য বিশ্বের মানােত হচ্ছে বা তা তাদের স্বার্থের অনুকূলে যাচ্ছে। তাদের মতের বিরুদ্ধে অসাধারণ কষ্টের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মত দেশগুলাে স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে অন্তহীন মূল্য দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীদের এসব অনৈতিক আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে জাতিসংঘকে ব্যবহারের নজিরও রয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র মত প্রতিষ্ঠানগুলাে তাে পরাশক্তিদের শােষণেরই নব হাতিয়ার।

গ্লোবালাইজেশন প্রক্রিয়াটি এই শোষণ ব্যবস্থাকে একবিংশ শতাব্দীর উপযােগী করবার একটি ঘােষণাপত্র মাত্র। এসব কারণেই বলতে হয় যে, সন্ত্রাসের পেছনে রাজনৈতিক কারণগুলাের প্রতি আমরা মনােযােগ দিতে ব্যর্থ হয়েছি শক্তিধরদের স্বার্থান্বেষী চিন্তা ও হীন কুটপরিকল্পনার কারণেই। এ কারণেই সন্ত্রাসের মূল কারণ ও হােতাদেরকে চিহ্নিত করে গণবিধ্বংসী অন্ত্র, ইউরেনিয়াম মজুদ, লাদেন কানেকশন ইত্যাদি মিথ্যে অজুহাতে সার্বভৌম ইরাকের জনগণের ওপরে সকল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসর যুক্তরাজ্য।  অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তাতেই একসময় সাদ্দাম মহাশক্তিধর হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে প্রাপ্ত নাপাম বােমা দিয়েই সাদ্দাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল ইরানি ও কুর্দিদেরকে। আর ‘৯১-এ তাদের দ্বৈত ভূমিকার কারণেই সাদ্দাম সাহস পেয়েছিল কুয়েত আক্রমণের। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র পেয়ে ১৯৮০-৮৮ সনের মধ্যে সাদ্দাম হােসেন বেপরােয়া হয়ে উঠেছিল বলেই ব্লেয়ার সরকার ঐ সমস্ত অস্ত্রের উপস্থিতি সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চলেছে। একারণেই জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক রােলফ একিউস ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৩ তারিখে এএফপিকে জানান, বাগদাদ ১৯৯১ সনের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর পর তার রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করে দেয়। তিনি সাংবাদিক জিম লেহরারকে জানান যে, ইরাক ১৯৮০-৮৮ সনের মধ্যে তাদের সংগ্রহে রাখা রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রগুলাে নিজে থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন অস্ত্র তৈরি ও সগ্রহে উদ্যোগী হয়নি। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, প্রাক্তন (বর্তমানে প্রয়াত) ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক বলেছিলেন, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের মাল-মশলার বিরাট অংশ যুক্তরাজ্য থেকেই পাঠানাে হয়েছিল ইরাকের মাটিতে। অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কাজ করছিলেন যে ইরাকি মহিলা বিজ্ঞানী তার মাইক্রোবায়ােলজি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। তবে ইরাকের ল্যাবরেটরিতে অ্যাথ্রাক্স সংক্রান্ত যে গবেষণা চলছিল তা খুব বেশিদূর এগােতে পারেনি। কারণ ইরাকিরা নিজের দেশের মাটিতে অ্যানথ্যাক্স স্পােরগুলােকে হালকা এবং ক্ষুদ্র অণুবিশিষ্ট করবার ব্যাপারে প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। এছাড়া তারা এর কোন ডেলিভারি সিস্টেম উদ্ভাবন করতে না পারায় এই গবেষণাকে অস্ত্র নির্মাণ পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি। যাহােক, ঘটনাক্রমে আজ ইরাকের মাটি সন্ত্রাসীদের নতুন নীড় হয়ে দাঁড়িয়েছে; যেমনটা হয়েছিল কমিউনিস্টবিরােধী যুদ্ধের পর আফগানিস্তান। আমেরিকার দ্বৈতনীতি এবং রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারসহ ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতি তাদের ঐতিহাসিক সমর্থন বর্তমান বিশ্বে একশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে সন্ত্রাসের বীজ বুনে দিয়েছে। ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মাটিতে যে ধর্ম ব্যবসায়ীদেরকে সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছিল আমেরিকা, তারাই সেদিন পাকিস্তানের প্রধান দালাল হিসাবে বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ও নারী নির্যাতনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

তাদেরই একটি অংশ সােভিয়েতবিরােধী যুদ্ধে আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়। আমেরিকান সমর্থন ও বুদ্ধিতেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রগতিশীল আন্দোলন ঠেকানাের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে মাদ্রাসার সংখ্যা পাঁচগুণ করবার  সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকরাও ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে কিছু ধর্মান্ধ আরবদেশের সহায়তায় তথাকথিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তার ঘটায় বাংলাদেশে। প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঠেকাবার জন্য এদেরকে ব্যবহার করা হয়। অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের দ্বারা পরিচালিত এই মাদ্রাসাগুলাের কোন কোনটি মৌলবাদী সন্ত্রাসী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৈরির কারখানা হিসাবে কাজ করেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে যেসমস্ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে এবং এ পর্যন্ত যতগুলাে বােমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলাের পেছনেই এই গােষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বােয়ালমারির বিএনপি নেতা কামরুজ্জামানের বাড়িতে ১৮ জন জঙ্গি নেতা ধরা পড়ার প্রেক্ষাপটে মওলানা আব্দুর রউফ ও মুফতি হান্নানসহ আরও কয়েকজনের ইসলামি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এদেশের জনগণ অবহিত হয়েছে। এই সমস্ত ইসলামি জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড ছাড়াও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা জাতির ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়ােগের পরিবেশও ভয়ঙ্করভাবে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে তার ৯৫ ভাগের পেছনেই রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ এবং প্রায় ৯৯ ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে একটি দেশের সীমারেখার মধ্যে। একভাগেরও কম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। অথচ এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বৈশ্বিক শান্তি, রাজনীতি, জীবনপ্রবাহ ও ব্যবসার মধ্যে মারাত্মক অশুভ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। এসব সন্ত্রাসের পেছনে শক্তিশালী কারণগুলাে হল সামাজিক ও বৈশ্বিক অন্যায়অত্যাচার, কুশিক্ষা, ভ্রান্ত রাজনীতি এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ সন্ত্রাসের হােতাদের ভুল মানসিক অবস্থান বা মাইন্ডসেট। এই মাইন্ডসেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বােঝা যায় ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর, প্রেসিডেন্ট বুশের ক্রুসেড ঘােষণার মধ্য দিয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল কর্তৃক আমেরিকাকে একটি জুডিও-খ্রিস্টান দেশ হিসাবে অভিহিত করার বিষয়টি এই মাইন্ডসেটের অন্তর্গত। এখানেই নিহিত রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং তথাকথিত বিজ্ঞজনদের ধর্মান্ধতার ওপরে উঠার ব্যর্থতার বিষয়টি। কেবল শক্তি প্রয়ােগ করে পৃথিবীকে বিভাজন, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভ এবং সার্বিকভাবে সীমাহীন লােভ বিশ্বের মানুষকে প্রতিনিয়ত একটি অন্যায় সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে তৈরি ক্ষোভকে ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের ভৃত্যদের নিজ হাতে তৈরি ধর্মান্ধ গােষ্ঠী। তাই সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ রুখতে হলে বিশ্ববিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ন্যায়কে। সামাজিক অবিচার, অন্যায়-অত্যাচার, জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন এবং শক্তিমানদের অনৈতিক শাসন ও শােষণ রােধে একটি নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে আমাদেরকে। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে দেশে বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহার করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বৃহৎ শক্তির ক্রীড়ানক ভূমিকা থেকে জাতিসংঘকে সরিয়ে আনবার জন্য বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের কার্যপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়ােজন। শক্তিধরদের ভেটো প্রয়ােগ ক্ষমতা রােধ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে বাস্তবায়নের পথ খুলে দিতে হবে। এ বিষয়ে অনুধাবন করতে হবে যে, জাতিসংঘের গণতায়ন ছাড়া বৈশ্বিক গণতন্ত্রায়ন সম্ভব নয়। এই গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেশে দেশে ধর্মভিত্তিক ও বৈষম্যমূলক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এজন্য অপরাধী দেশগুলাের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা যেতে পারে। সামাজিক ও বৈশ্বিক অবিচারের জট খুলবার জন্য ঐক্যবদ্ধ এক ফর্মুলা তৈরি প্রয়ােজন। সংঘাত নিরসনে আলােচনা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলাে বাস্তবায়ন সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক করা প্রয়ােজন। মাদ্রাসার মত অশিক্ষা-কুশিক্ষা দেবার যেসব স্থানগুলাে অপরের ধর্মকর্ম ও মতের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার বাণী ছড়ায় তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সময়ের প্রয়ােজন। তাদের অর্থায়ন ও শিক্ষাসূচি সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা প্রয়ােজন। তথাকথিত বিভিন্ন মিশনের ধর্ম ব্যবসা আইন করে নিষিদ্ধ করা প্রয়ােজন। মানুষের দারিদ্র ও দুরবস্থার সুযােগ নিয়ে ধর্মান্তরিত করা মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। ধর্মের কারণে কোন দেশের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ বা বৈরীভাব পােষণ করাটিও কোনভাবেই সমর্থনযােগ্য নয়। সমর্থনযােগ্য নয় যেমন ইহুদি, কাদিয়ানিসহ নানা ধর্মমত ও বিশ্বাসের প্রতি বিদ্বেষ পােষণ। ধর্মের কারণে ইসরায়েলকে একঘরে করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনােভাব বজায় রাখতে যে কোন কাজ হয়নি, তা মুসলিম বিশ্বকে বুঝতে হবে।

এই ইস্যুকে ব্যবহার করে শেখ-শাসিত আরব দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কেরা যে নিজেদের জনগণের সাথে ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করে আসছে, একথা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। ইসরায়েলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন যে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারতাে এবং উভয় পক্ষের (আরববিশ্ব ও ইসরায়েল) সন্ত্রাসকে নিয়ন্ত্রণে এনে ঐ অঞ্চলের জনগণের ন্যায্য অধিকার কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারত, তা একদিন সবাই অনুভব করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সংঘাতরত আরব বিশ্ব ও ইসরায়েল- এ দু’পক্ষই আলাদা করে আমেরিকাকে মুরুব্বি মেনেছে নিজেদের নানা স্বার্থে। অথচ তারা নিজেদের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনবার কোন চেষ্টাই করেনি অধিকতর বাস্তবতার আলােকে। এসবের প্রেক্ষাপটে আমাদের সবাইকে সকল ধরনের ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও জাতিগত স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানবতার পাঠশালায় মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মাশ্রয়ী কোন মৌলবাদী এবং তাদের সংকীর্ণ চিন্তার কোন স্থান নেই। সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান ক্ষোভ নিরসনে দারিদ্রমােচন এবং সম্পদ বিতরণে সর্বসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে অতি দ্রুততার সাথে। সর্বোপরি, অসহিষ্ণুতা রােধে সহনশীলতার শিক্ষা, মানবতার চর্চা এবং সকল ধর্মের মূল চেতনার মধ্যে ঐক্যসাধন ছাড়া ধাবমান সন্ত্রাসের ঢেউ থেকে বাচার আর কোন পথ নেই। জাতিসংঘের বাইরে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ শক্তিধর দেশগুলাের গভীর ঐক্য প্রয়ােজন পরিবর্তীত পৃথিবীর বাস্তবতা মােকাবেলার জন্যই। নতুন বিশ্বব্যবস্থা বা গ্লোবাল অর্ডারের জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােকে একযােগে কাজ করতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে অবৈধ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়ােগের বিরুদ্ধে। জাতিগত অহঙ্কার ও হীন স্বার্থে সীমাহীন বর্বরতা ও সকল সামাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বময় ঐক্য ও অহিংস প্রতিরােধ চাই। আমরা চাই, প্রতিটি দেশ ও জাতি নিজেদের গৌরব, অহঙ্কার ও অনন্য স্নিতা নিয়ে টিকে থাকুক স্বাধীনভাবে। আমরা চোখ রাখতে চাই সীমাহীন আকাশ ও বিস্তীর্ণ ভূমির দিকে যা কিনা নিজ গুণে সকল শান্তি, স্থিতি, শৃঙ্খলা এবং শত ঐশ্বর্যময় বিভিন্নতার প্রত্যাশা নিয়ে জেগে আছে। তারিখ: ৪ অক্টোবর ২০০৩

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!