পারভেজ মােশাররফের বাংলাদেশ সফর – বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে ফিরে দেখা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মােশাররফের আসন্ন সফরটি ‘৭১-এর নির্যাতিত ও নিহতদের নিকটজনের জন্য একটি অপ্রীতিকর বিষয় এবং তাকে প্রতিশ্রুত লাল গালিচা সম্বর্ধনা বাঙালি জাতির জন্য অসম্মানজনক ও অনাকাক্ষিত হলেও এটিই বাস্তবতা। যেমন বাস্তব তথা নির্মম ছিল ‘৭৪ সনে লক্ষ শহীদের রক্তভেজা মাটিতে একাত্তরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের অন্যতম খলনায়ক, তথাকথিত গণতন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর দাম্ভিক পদচারণা এবং তাকে প্রদত্ত সম্বর্ধনা। নানা কারণে ১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পারভেজ মােশাররফের এই আগমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে আমেরিকার মদদে ‘৭১ সনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশের মাটিতে গণহত্যা চালিয়েছিল, যাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য, সহযােগিতা ও উৎসাহে মানবতার শত্রু তালেবান তৈরী করেছিল আফগানিস্তানে, নিজ দেশে ও অবিভক্ত পাকিস্তানের এ অঞ্চলে মাদ্রাসার প্রসার ঘটিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের বিস্তার ঘটিয়েছিল, সেই আমেরিকার অঙ্গুলি হেলনেই আজ মাদ্রাসাভিত্তিক সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সংকোচনে এগিয়ে এসেছেন পারভেজ মােশাররফ। আমরা আশা করব, পাকিস্তান তাদের সন্ত্রাসীদেরকে এ অঞ্চলে পাচার না করে বরং নিজ দেশের মত ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী দলগুলাে নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে সহযােগিতা দেবে এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ থেকে সরে আসবার জন্য বাংলাদেশ থেকে আইএসআই-এর কর্মকান্ড গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল কায়দার বিন্নি সদস্য, মােরা ওমর, লাদেন গ্রুপ, সাংবাদিক পার্ল হক শেখ ওমর, ড্রাগ ও আর্মস মাফিয়া, মােসাদ ও প্রাক্তন কেজিবিসহ বিভিন্ন দেশের গােয়েন্দা চক্রের সঙ্গে আইএসআই-এর জটিল যােগাযােগ এবং তাদের সর্বগ্রাসী অপতৎপরতা আমাদের মত সন্ত্রাসপ্রবণ দেশের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। আমরা বাংলাদেশের মাটিতে এদের কাউকেই দেখতে চাই না। সেই সাথে এ উপলক্ষে আমরা চাই পাকিস্তান ‘৭১-এ তাদের কৃত যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং নারী নির্যাতনের দায় স্বীকার করবে এবং মূখ্য অপরাধীদের ঘৃণ্য ও মানবতাবিরােধী অপরাধগুলাের ক্ষেত্রেযৌথ তদন্তে ও বিচারে সম্মত হয়ে ন্যায়ের পক্ষে ও সভ্যতার পক্ষে অবস্থান নেবার চেষ্টা করবে।
আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের বেশ কটি দেশ এবং সৌদি আরব, ইরান, জর্দান, লিবিয়া, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি আরব দেশের সামরিক ও আর্থিক সহযােগিতায় ১৯৭১ সনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশের মাটিতে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত করে এবং ৪ লাখ ৬৮ হাজারের অধিক বাঙালি নারীকে যৌন নির্যাতনে ল্লিগ্নি করে। এদেশের মাটি থেকে এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে শত শত বাঙালি কিশােরী, তরুণী ও গৃহবধূকে পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে নিয়ে বন্দী করে তারা দিনের পর দিন বিকারগ্রস্ত ও ভয়ঙ্কর কুৎসিতভাবে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু তাদেরকে পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে, ব্যক্তিগত বন্দিশালায় নিক্ষেপ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিস্নি স্থানে পাচার করে তাদেরকে চিরতরে উধাও করে ফেলেছে। এরকম নির্যাতিত নিখোঁজ ৭৫৫ জন নারীর তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। শুধুমাত্র স্যান্ডেলিনা দূর্গেই ৭১০ জন বাঙালি নারী আটক ছিলেন। লালমনিরহাটের হাসান আলীর মেয়ে, বগুড়ার এক পীরের মেয়ে, ঝিনাইদহের হাসিনা, শাহজাদপুরের মর্জিনা, রােকেয়া প্রমুখ এদের মধ্যে ক’জন মাত্র। এসব নারী ছাড়াও স্যান্ডেলিনাসহ পাকিস্তানের বিল্পি দূর্গে আটক ও নিখোঁজ আড়াই হাজারের অধিক বাঙালি ‘৭১-এর নিখোঁজদের মধ্যে কেবল একটি সংখ্যা হয়ে বেঁচে আছেন, সে সংক্রান্ত ব্যাপারে যৌথ তদন্ত দাবি করছি। নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করবার জন্যই পারভেজ মােশাররফের উচিত Human Rights Watch, Amnesty International-সহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনকে এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত চালাবার সুযােগ করে দেয়া। নিজেদেরকে সভ্য সমাজের অংশ হিসাবে প্রমাণ করবার জন্য এবং সামরিকবাহিনীর দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হবার জন্যই অতীতের অনেক ঘটনার ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তে সম্মত হওয়া প্রয়ােজন তাদের। ‘৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও নিখোঁজ বিপুল সংখ্যক নিরপরাধ মানুষের অবস্থান জানবার জন্য একাত্তরে ৩৩ জন উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিখোঁজ ও নিহত হবার বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। ১৯৭২ সনের ২৩ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এদের স্ত্রীরা পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক তাদের স্বামীদেরকে সুপরিকল্পিত হত্যা ও গুমের জন্য দোষী আর্মিদের বিচারের দাবি করেন। যারা বিচারের দাবি করেন তারা ছিলেন: (১) আমিনা চৌধুরী, পিআইএ’র ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফজলুল হক চৌধুরীর স্ত্রী। জনাব হককে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়; (২) মােসফেকা মাহমুদ, রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ ডিআইজি মামুন মাহমুদের স্ত্রী।
জনাব মাহমুদকে ২৬ মার্চ হানাদার বাহিনী নিয়ে যায়; (৩) নাজমা মজিদ, রাজশাহীর এসপি শাহ আবদুল মজিদের স্ত্রী। ৩১ মে মার্চ হানাদার বাহিনী জনাব মজিদকে গ্রেফতার করে; (৪) মাহমুদা হক; চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হকের স্ত্রী। ১৭ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জনাব হককে ধরে নিয়ে যায়; (৫) মিসেস নাজমুল হক, চট্টগ্রামের দুর্নীতি দমন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নামজুল হকের স্ত্রী। ৪ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জনাব হককে ধরে নিয়ে যায়। (৬) হুমাইরা আমিন খান, সিএসপি নূরুল আমিন খানের স্ত্রী। ২৩ এপ্রিল জনাব খানকে ঢাকা সেনানিবাসে ধরে নিয়েও ছেড়ে দেয়া হয়, পরে ২০ মে পুনরায় ধরে নিয়ে যায়; (৭) আয়েশা ইসলাম, বরিশালের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার কাজী আজিজুল ইসলামের স্ত্রী; (৮) মিসেস শামসুল হক খান, কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার শামসুল হক খানের স্ত্রী; (৯) মিসেস মুন্সী কবীর উদ্দীন, কুমিল্লার এসপি মুন্সী কবীর উদ্দীনের স্ত্রী; (১০) ফেরদৌসী চৌধুরী, সিলেট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল চৌধুরীর স্ত্রী; (১১) হাসনা হেনা কাদির, লে. কর্নেল এ কাদিরের স্ত্রী। জনাব কাদিরকে তাঁর বাসভবন থেকে ১৭ এপ্রিল ধরে নিয়ে যাওয়া হয়; (১২) মিসেস কাজী, চট্টগ্রাম পাের্ট কনজারভেটর জনাব কাজীর স্ত্রী। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ এপ্রিল তাকে ধরে নিয়ে যায়; (১৩) মিসেস শামসুজ্জামান, চট্টগ্রামের পাের্ট ট্রাস্টের চীফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব শামসুজ্জামানের স্ত্রী। ২১ এপ্রিল তাকে অফিস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়; (১৪) মিসেস হােসেন, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হােসেনের স্ত্রী; (১৫) মিসেস শফি আহমেদ, চট্টগ্রাম রেলওয়ের চীফ প্লানিং অফিসার শফি আহমদের স্ত্রী; (১৬) মিসেস জালাল, রেলওয়ের কমার্শিয়াল অফিসার জনাব জালালের স্ত্রী; (১৭) মিসেস নাসিরুদ্দীন, রেলওয়ের ট্রাফিক ম্যানেজার জনাব নাসিরুদ্দীনের স্ত্রী; (১৮)। মিসেস শামসুজ্জামান, এসডিও (টেলিগ্রাফ) জনাব শামসুজ্জামানের স্ত্রী; (১৯) মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর, ৪০ ফিল্ড এম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের স্ত্রী; (২০) মিসেস আলম, ক্যাপ্টেন বদরুল আলমের স্ত্রী; (২১) মিসেস ফারুকী, লে, ফারুকের স্ত্রী; (২২) মিসেস হুদা, ৪০ ফিন্ড এ্যাম্বুলেন্সের ক্যাপ্টেন হুদার স্ত্রী; (২৩) মিসেস আনােয়ারুল ইসলাম, মেজর আনােয়ারুল ইসলামের স্ত্রী; (২৪) মিসেস মুহিদুজ্জামান, মেজর মুহিদুজ্জামানের স্ত্রী; (২৫) মিসেস খালেক, মেজর খালেকের স্ত্রী; (২৬) মিসেস আইউব আলী, ক্যাপ্টেন আইউব আলীর স্ত্রী; (২৭) মিসেস আতিকুর রহমান, ক্যাপ্টেন আতিকুর রহমানের স্ত্রী; (২৮) মিসেস হাসিব, মেজর হাসিবের স্ত্রী; (২৯) মিসেস চৌধুরী, লে. কর্নেল বি এ চৌধুরীর স্ত্রী; (৩০) মিসেস চৌধুরী, লে. কর্নেল তাহের চৌধুরীর স্ত্রী; (৩১) মিসেস হােসনে আরা মােহসিন, রাজশাহীর সিনিয়র রেডিয়াে ইঞ্জিনিয়ার মােহসীন আলীর স্ত্রী; (৩২) মিসেস রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমানের স্ত্রী; (৩৩) সৈয়দা জাকিয়া বানু, বরিশালের এডিশনাল এসপি গােলাম হােসেনের স্ত্রী।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়ের করা হয়েছিল তারা হল : (১) লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, (২) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, (৩) ব্রিগেডিয়ার বশীর, (৪) ব্রিগেডিয়ার কাদের, (৫) মেজর সরফরাজ, (৬) মেজর সেলিম, (৭) মেজর শাম্মি, (৮) ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ, (৯) মেজর ফারুকী- এরা ঢাকাতে আত্মসমর্পণ করে এবং ঢাকা ও দেশের সর্বত্র হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। (১০) ব্রিগেডিয়ার হাসান, (১১) মেজর আনিস চৌধুরী, (১২) কর্নেল ফাতেমী, (১৩) এফআইইউ ক্যাপ্টেন কায়ানি, (১৪) এফআইও ক্যাপ্টেন মাহবুব, (১৫) কর্নেল হামিদ হােসেন শিকরী, (১৬) কর্নেল ওসমানী, (১৭) ক্যাপ্টেন জিয়াদ, (১৮) ক্যাপ্টেন শাহেদ রশীদ- এরা চট্টগ্রামে হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। (১৯) ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, (২০) লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক, (২১) মেজর আগা বােখারী, (২২) মেজর সুলতান (বর্তমানে লে. কর্নেল), (২৩) সুবেদার মেজর ফয়েজ, (২৪) লে. কর্নেল সাফায়াত, (২৫) ব্রিগেডিয়ার আতিক-এরা কুমিল্লায় বর্বর কার্যকলাপের জন্য দায়ী। ব্রিগেডিয়ার আতিক কর্নেল থাকাকালে বরিশালেও হত্যাকান্ড চালায়। (২৬) ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আহমেদ রানা (২৭) লে. কর্নেল মালিক সরফরাজ, (২৮) লে. কর্নেল রিয়াজ, (২৯) ব্রিগেডিয়ার সফি, (৩০) লে. কর্নেল সেকেন্দার, (৩১) মেজর পারভেজ, (৩২) ব্রিগেডিয়ার রহীম আহমদ, (৩৩) কর্নেল এস এম আলী- এরা সিলেটে হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। (৩৪) মেজর সালমান মাহমুদ এবং (৩৫) মেজর ইকবাল রংপুরে আত্মসমর্পণ করে। এরা রাজশাহীতে বাঙালি হত্যার জন্য দায়ী। এরা সকলেই নৃশংস হত্যাকারী। এফআইইউ’এর কর্নেল তাজও এসব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। কর্নেল তাজ পরিকল্পিতভাবে প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের হত্যা করার ব্যবস্থা করে। এছাড়া যুদ্ধ ও নারী’ এবং যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ শীর্ষক আমাদের প্রকাশিত দুটি প্রমাণ্য দলিল গ্রন্থে সাড়ে তিনশ’র অধিক পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরােধী অপরাধীর নাম দাখিল করা হয়েছে।
এর মধ্যে ৬৩ জনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগ পেশ করে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। এদের মধ্যে যারা গুরুতরভাবে নারী নির্যাতনে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ক’জন হল: মেজর নাদের পারভেজ, মেজর নিসার আহমেদ খান শেরওয়ানী, মেজর জুবলী, লে. আতাউল্লাহ, মেজর আজিজ খটক, মেজর আশফাক আহমেদ চীমা, ক্যাপ্টেন আজমত, ক্যাপ্টেন শাফায়েত, মেজর শাকিল খান, মেজর রাজ্জাক প্রমুখ। এদের বিরুদ্ধে যৌথ তদন্ত ‘৭১-এর নির্মম নির্যাতনের কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ভেতরে সৃষ্ট ঘূণী মােচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যুদ্ধাপরাধী এইসব পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধর্ষিত ২৬ জন নারীর ফরিয়াদ ও Voice আমাদের রেকর্ডভূক্ত হয়ে আছে। তারা সুস্পষ্টভাবে চিনিয়ে দিয়েছেন সেই সমস্ত নরপশুদের যারা তাদেরকে আটকিয়ে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন করেছে এবং যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করছে। এছাড়া পর্যায়েক্রমে অপেক্ষাকৃত জটিল অভিযােগের সাথে সম্পৃক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়ােজন। এ ধরনের অভিযােগের আওতায় যারা পড়ে তারা হল: লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠা খান, জেনারেল এসজিএম পীরজাদা, জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, জেনারেল টিক্কা খান (মৃত), ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ খান, জেনারেল ওমর, ব্রিগেডিয়ার দুররানী, ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, জেনারেল নজর হােসেন শাহ্, জেনারেল মােহাম্মদ হােসেন আনসারী, মেজর জেনারেল জামশেদ, ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির খান-সহ আরও কয়েকজন। নির্যাতিত ৪ লাখ ৬৮ হাজারের অধিক নির্যাতিত নারীর মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছিলেন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের স্ত্রী ও কন্যাগণ।
এদের সকলের ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিষয়টি কখনােই বিস্মৃত হবার নয়। যারা দেশপ্রেমিক, যারা দেশের ভূমির জন্য, পতাকার জন্য, গৌরবের জন্য, গর্বের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন এবং যাঁদের বিন্দুমাত্র মর্যাদাবােধ রয়েছে, নিজের অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে তারা কোনদিনও এই অপমান বিস্মৃত হতে পারে না- এটা আমাদের বিশ্বাস। ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য, বিচারের জন্য, গর্বের জন্য, গৌরবের জন্য, আত্মপরিচয়ের জন্য ‘৭১-এর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের বিষয়টির প্রতি মনােযােগী ও সচেতন হওয়া প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের কর্তব্য। গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের তদন্তের সাথে সাথে এদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সীমিত সংখ্যক ক্ষেত্রে হলেও ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি (WCFFC) যৌথ তদন্ত সহ আন্তর্জাতিক তদন্তের জোর দাবি জানাচ্ছে। WCFFC মনে করে ইউরােপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস হাইকমিশনসহ সভ্য বিশ্বের সমর্থন রয়েছে এ কাজে। Political Persecution এবং Stigmatization আমাদের লক্ষ্য নয়। শান্তির। অন্বেষণে সত্য উদঘাটন, সত্য স্বীকার ও Reconciliation আমাদের লক্ষ্য। একটি সভ্য, স্থিতিশীল ও অসহিষ্ণুতামুক্ত সমাজ গঠনে সত্যের অধিকার ও ন্যায়ের অধিকার। প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক সমঝােতা সৃষ্টিকল্পে আলােচনা (dialogue) এবং Reconciliation একটি অপরিহার্য শর্ত। Reconciliation-এর মূলভিত্তি অন্যায় ও অপরাধের অনুভব, গ্লানিবােধ, সত্য স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষমার যােগ্য। অপরাধগুলাের অনুপুক্ষ মূল্যায়ন। সংশ্লিষ্ট সকলের মনে রাখা প্রয়ােজন, মিথ্যা ও অন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে কোন সমাজ স্থিতিশীল হতে পারে না। ন্যায়, সত্য ও সভ্যতার দিকে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে। জেনারেল পারভেজ মােশাররফের কাছে পাকিস্তানের নিকট আমাদের পাওনা আদায়ের দাবি এবং ‘৭১-এর সম্পদনাশের ক্ষতিপূরণের বিষয়গুলাে শক্তভাবে তুলে ধরা এবং এসব ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়ার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক Law Group নিখরচায় এই ক্ষতিপুরণ আদায়ে সহায়তাদানের ব্যাপারে আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষতিপূরণ এবং পাকিস্তানে আটককৃত সরকারী-বেসরকারী পাওনা সম্পদ ছাড়াই প্রাথমিক হিসাবে ‘৭১ সনে এদেশের ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ ছিল মার্কিন ডলারের হিসাবে প্রায় ২০.২২ বিলিয়ন ডলার। পাওনা ফেরৎ প্রদানে কালক্ষেপণের জন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও আলােচনায় আসা উচিত।
‘৭১-এর পাকিস্তানি সামরিক শাসকদেরকে যারা আর্থিক সহায়তা ও সামরিকভাবে মদদ দিয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন ও মানবতাবিরােধী অপরাধে ইন্ধন যুগিয়েছে সেইসব দেশকে বাংলাদেশের জাতীয় ক্ষতিপূরণ ও Reparation-এ সম্পৃক্ত করে জরুরী ভিত্তিতে পাওনা আদায় করতে হবে। অনুগ্রহের দান নয়, সমঝােতার ভিত্তিতে হিসাবের পাওনা ও ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। আন্তর্জাতিক লবিস্ট ও ল’ গ্রুপগুলাের সহায়তায় চাপ প্রয়ােগ করে একবিংশ শতাব্দীর উপযােগী টেকসই উন্নয়ন ও মানব সম্পদ তৈরীতে আদায়কৃত এসব অর্থ কাজে লাগাতে হবে। এই অর্থ আদায় আমাদের বাঁচা-মরার লড়াইয়ের অংশ। এছাড়া অবাঙালি প্রত্যাবাসনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বাংলাদেশকে যে আর্থিক দণ্ডি ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে তা রাবেতা সংগৃহীত ফান্ড থেকে কর্তন করে বাংলাদেশ সরকারকে প্রদান অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত দাবি। যে সমস্ত নারী পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও তাদের অন্যান্য সদস্য দ্বারা পরিকল্পিতভাবে দিনের পর দিন নির্যাতিত হয়েছেন এবং যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন ভয়ঙ্কর দৈন্যদশায় জীবন যাপন করছেন। পরাজিত রাষ্ট্রকর্তৃক ক্ষতিপুরণ বা Reparation-এর বিষয়টি আজ একটি অতি বাস্তব প্রয়ােজনীয়তা। যৌন নির্যাতিত এবং যৌনদাসীদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তাদের সমের বিনিময়ে কোন দান নয়, এটা তাদের জীবনের মূল্যের প্রতি সামান্য সম্মান প্রদর্শন মাত্র। পাশ্চাত্য বিশের দু’একটি দেশ এ বিষয়ে আমাদেরকে সহযােগিতা প্রদানে রাজি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পাকিস্তানের অপরাধ স্বীকারের প্রেক্ষাপটে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এ বিষয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষতিপূরণ বা Reparation-এর দাবিদার ক’জন নারীর ফরিয়াদ (যুদ্ধ ও নারী’ গ্রন্থে উল্লেখিত), তাদের প্রতি পাকিস্তানি আর্মির অপরাধের সুনির্দিষ্ট বিবরণ এবং যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি বাহিনীর ক’জন সদস্যের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পাকিস্তান সরকারের নিকট প্রেরণ করছে। দেখার বিষয় পাকিস্তান সরকার কীভাবে সত্যের মুখােমুখি হয় এবং কতটা সভ্য আচরণ করে মানবতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এটা তাদের অন্যতম শুভাকাক্ষী আমেরিকারও বিবেচনার বিষয় বলে আমরা মনে করি। আমরা আশা করব পাকিস্তান সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচারের বিষয়টিতে যথাযথ মনােযােগ দিয়ে ন্যায় ও সভ্যতার পক্ষে অবস্থান নেবে। তারিখঃ ২৫ জুলাই ২০০২ ইং
সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান