You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তরের নারী নির্যাতন: ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়

গবেষণার উদ্দেশ্য ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠ পর্যায়ের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের বহুমাত্রিক দিক এবং নির্যাতিতার সংখ্যা সংক্রান্ত অনেকগুলাে নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১৯৭২ সনের এক সরকারী হিসাবে বীরাঙ্গনার সংখ্যা দু’লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাৎক্ষণিক অনুমান ভিত্তিক এই হিসাবটি করা হয়েছিল তৎকালীন চারশ’ আশিটি থানা থেকে প্রতিদিন গড়ে দু’জন করে বাঙালি নারীকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেছে-এরকম একটি অনুমানকে ভিত্তি করে। ঐ হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের নমাসের দুশ’ সত্তর দিনে চারশ’ আশিটি থানা থেকে দু’লাখ ঊনষাট হাজার দুশ’ জন (২৭০x৪৮০x২ = ২,৫৯,২০০) নারীকে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বা অপহরণ করেছিল পাকিরা। যে তথ্যের ওপর কিংবা অনুমানের ওপর এই হিসাবটি দাঁড় করানাে হয়েছিল সেটা যে ভুল ও নিছক টেবিলনির্ভর এবং মাঠ পর্যায়ে কোন অনুসন্ধানী পরিসংখ্যানভিত্তিক কাজ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু সেটিই গত ত্রিশ বছর যাবত ত্রিশ লাখ শহীদের মতাে একটি মিথ হিসাবে আমাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। এ ধরনের অনুমাননির্ভর কোন কাজ বিজ্ঞানের অংশ হতে পারে না এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণভিত্তিক ইতিহাসের অঙ্গ হতে পারে না। হত্যা ও নির্যাতনের ব্যাপকতা ও গভীরতা নির্ণয়টি সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ, সােশ্যাল এ্যানথ্রোপলজিস্ট, ফরেনসিক এ্যানথ্রোপলজিস্ট ও দার্শনিকদের গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত সভ্যসমাজ বিনির্মাণকল্পেই। বর্তমানে সমাজের অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবােধের অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতাপ্রসূত আগ্রাসন ও দুর্বলের ওপর নির্যাতন, বিচারহীনতার কারণে মানুষের হতাশা ও আস্থাহীনতা, সর্বোপরি মানবমর্যাদা, সহনশীলতা ও সহানুভূতির অভাবগুলাের অনুপুজ বিশ্লেষণ সম্ভব পেছনে ঘটে যাওয়া এইসব ভয়ঙ্কর মানবতাবিরােধী অপরাধের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এসব আচরণের সংক্রমণ ও গ্রহণপ্রবণতা রােধে পেছনে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলাের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অতি প্রয়ােজন ভবিষ্যতে একটি যুক্তিবাদী ও স্বচ্ছ চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ সভ্য সমাজ বিনির্মাণের জন্যই।

গবেষণার ভিত্তি

দীর্ঘ সময়ব্যাপী আমাদের অনুসন্ধানী গবেষণাকর্মী দল বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যা, বধ্যভূমি, নারী নির্যাতন এবং স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন সমস্যাবলীর উত্থান ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করে আসছে। গত এক দশকে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানী কার্যক্রম এই গবেষণার মূল ভিত্তি। এই কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ১৯৯৯এর জুলাই থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সারা দেশের বিয়াল্লিশটি জেলার পঁচাশিটি থানার প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ, মাঠ-ঘাট, হাট-বাজারসহ নির্যাতিত, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বাড়িতে বাড়িতে আমাদের গবেষণা কর্মীরা দিনের পর দিন কাজ করেছেন। একাজের আওতায় সংগৃহীত অসংখ্য সাক্ষাৎকারের মধ্য থেকে বাছাইকৃত ৫৩০টি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দুই লক্ষ দুই হাজার পাঁচশ’ সাতাশ জন নির্যাতিত নারীর তথ্য উঘাটিত হয়েছে। জেলা ও স্থানভিত্তিক নির্যাতনের হার বিশ্লেষণ করে এবং বিভিন্ন স্পটে পাকিস্তানি আর্মির আগ্রাসন এবং নারী নির্যাতনের ধরন ও সংখ্যা। বিশ্লেষণ করে সমগ্র দেশভিত্তিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে অন্যান্য বিষয়গুলাের সঙ্গে সঙ্গে উদঘাটিত হয়েছে পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনের প্রকৃতি যার মধ্যে নির্যাতিতার সংখ্যা এবং নির্যাতন পরবর্তী সমস্যা সংক্রান্ত অনেক তথ্য লুকিয়ে আছে। আমাদের পরিচালিত সামগ্রিক গবেষণাকর্ম এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি যে, একাত্তর সনে পাকিস্তানি আর্মি ন্যূনপক্ষে চার লাখ আটষয়ি হাজার বাঙালি নারীকে বিস্নি প্রক্রিয়ায় নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। নারী নির্যাতনের এই পরিসংখ্যান সর্বনিম্ন হিসাবে নির্ণয় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের নির্যাতিত নারীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। স্বাধীনতার তিন দশক পরে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই পরিসংখ্যান নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যৌক্তিক কারণেই যেমন শ্রমসাধ্য ও জটিল, তেমনি দুঃসাধ্য। আমরা মনে করি এ বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়ােজন রয়েছে। গবেষণা পদ্ধতি (Methodology): ১. বিভিন্ন বই, পত্র পত্রিকা, সরকারী বেসরকারী নথিপত্র প্রভৃতি থেকে তথ্য সংগ্রহ (১৯৯১ সন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত)। ২. মাঠ পর্যায়ে গবেষণা (১৯৯৯ সনের জুলাই থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলমান)। ৩. দৈবচয়ন পদ্ধতিতে (Random) তৃণমূল পর্যায়ে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, তাদের নিকটজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ। ৪. নির্বাচিত প্রশ্নমালা, কেস স্টাডি ও অন্যান্য গবেষণাভিত্তিক ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান। ৫. নির্বাচিত নির্যাতিতাদের দৈহিক ও মানসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও মনােবিশ্লেষণ।

৬. সমান্তরাল (Parallel) গবেষণা।

৭. আন্তর্জাতিক গবেষণার পর্যালােচনা এবং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গবেষণা ফলাফল মূল্যায়ন। মূল প্রতিবেদন ও পর্যালােচনা : পাকিস্তানি সেনারা গ্রাম বাংলাসহ দেশের সর্বত্র আমাদের মেয়েদেরকে কয়েকভাবে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে :

স্পট ধর্ষণ:

এতে সাধারণত পাকিস্তানি আর্মি পেট্রোল টিমগুলাে কখনও রাজাকার ও বিহারিদের সহায়তায়, আবার কখনও নিজেরাই এককভাবে অংশগ্রহণ করে। এই ধরনের আক্রমণের মূলনীতি ছিল ‘Kill, bum and rape’। এর অংশ হিসাবে তারা ক্ষেতে খামারে, গ্রামেগঞ্জে যেসব বাড়িকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছে কিংবা যেসব মহিলাকে অরক্ষিত পেয়েছে তাদেরকে আক্রমণ করেছে। কখনও অবাঙালি রাজাকার ও স্থানীয় দালালদের কুচক্রে পড়ে, সংসার, সম্পত্তি, চাকুরি ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা সমস্যায় নিরীহ নারীরা এই নারীলােভী দুবৃত্তদের আশ্রয়প্রার্থী হয়ে নিজগৃহে নির্যাতিত হয়েছেন। যাদের স্বামী সন্তান ঘরে উপস্থিত ছিল না তাদের অনেকেও এদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। শহরগুলােতে বিভিন্ন বাড়িতে কখনও স্বামীকে ধরতে গিয়ে, কখনও যুবক ছেলে বা নিকটজনের সন্ধানে উপস্থিত হয়ে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাড়িতে উপস্থিত খ্রী, কন্যাদেরকে তারা অনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। ঢাকার তেজগাঁও, পাজীপুরের জয়দেবপুর ও কামারিয়া, টাঙ্গাইলের ছাব্বিশা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহের ফুলপুর, বাহাদুরপুর, বাখাই, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, পিরােজপুর, পটুয়াখালি, রংপুরসহ সারা দেশে এরকম স্পট ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করেছি। স্পট গণধৰণ পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের আরেকটি জঘন্য প্রক্রিয়া ছিল স্পট গণধর্ষণ। এ প্রক্রিয়ায় তারা কখনও কোন এলাকায় একটি বাড়ি, রেল স্টেশন, ফঁকা গুদামঘর, ট্রেন বাসের মতাে যানবাহন এমনকি তাদের মার্শাল ল’ আদালত, ক্যাম্প প্রভৃতি স্থানকে ব্যবহার করেছে। তারা কখনও উপস্থিত নারীদেরকে একত্রিত করে, আবার কখনও কাউকে এককভাবে নানা চাপের মুখে নির্যাতন ও ধর্ষণ। করেছে। এই ধরনের ধর্ষণযজ্ঞে প্রতিটি স্পটে ভিকটিমের সংখ্যা দিনপ্রতি কখনও দশের অধিক এবং কখনও তা কয়েকশ’তে পৌঁছেছে। এই প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের পর অপরাধী পাকিস্তানি সেনারা আক্রান্ত নারীদেরকে মুক্ত করে দিয়েছে এবং নিজেরা। স্পট ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে। আবার কখনও নির্যাতনের পর ধর্ষিত নারীদেরকে হত্যা করেছে। একাত্তরে লালমনিরহাট রেলওয়ে কলােনি, সৈয়দপুরের গােলাহাট, সিলেটের শমসেরনগর, আদিত্যপুর, শেখেরচক, বরিশালের রাজিহার, বগুড়ার মােকামবাজার, ঝিনাইদহ প্রভৃতি স্থানগুলােতে পাকিস্তানি আর্মির বীভৎস নারী নির্যাতন এই স্পট গণধর্ষণের সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এই স্পট ধর্ষণ এবং স্পট গণধর্ষণেই দেশের প্রায় তিন লাখ সাতাশ হাজার দুশ’ অর্থাৎ সত্তরভাগ নারী নির্যাতিত হয়েছেন।

এঁরা কেউ কেউ এক বা একাধিকবার কয়েকজন পাকি দ্বারা নির্যাতিত হলেও দীর্ঘ দিনব্যাপী এঁরা কেউ নির্যাতিত হননি বা পাকিদের নিকট কোন নির্দিষ্ট স্থানে বন্দীও থাকেননি। ফলে শরীরবৃত্তীয় কারণে এঁদের অধিকাংশই ovulations চক্রের পিক পিরিয়ডে নির্যাতিত হননি বা দিনের পর দিন নির্যাতিত না হবার কারণে এঁদের ডিম্ব অপরাধীদের দ্বারা নিষিক্ত হয়নি। দেশের বিয়াল্লিশটি জেলায় প্রাপ্ত তথ্যভিত্তিক পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয় যে একাত্তরের অবরুদ্ধ ক’মাসে স্পট রেপ ও স্পট গণধর্ষণের আওতায় প্রতিদিন পাকিস্তানি আর্মি দেশের গ্রামগঞ্জ ও শহরতলীর কমপক্ষে তিনশ’টি স্পটে হানা দেয়। এ প্রক্রিয়ায় মার্চের পঁচিশ তারিখ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মােট দুশ’ ছেষট্টি দিনের মধ্যে কমপক্ষে দুশ’ দিন পর্যায়ক্রমে দেশের বিন্নি স্থানে হানা দিয়ে ঐ আর্মি ব্যাপক নারী নির্যাতন ঘটায়। এই হিসাব মতে একেকটি স্পটে একবার আক্রমণের কথা বিবেচনা করলেও কোন কোন স্থানে তারা একাধিকবার হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে। রাজিহারের একটি খ্রিস্টান পরিবারে পাকিস্তানি আর্মি ন’বার হামলা চালিয়েছিল। সিলেট এলাকার চা বাগানগুলােতেও পাকিস্তানি আর্মি এভাবে বার বার হামলা চালিয়েছে। তাদের একাধিকবার হামলার স্পটের সংখ্যা দেশব্যাপী অসংখ্য। প্রতিটি অভিযানকেই এক একটি স্পট ইনসিডেন্স বিবেচনা করা হয়েছে নির্ভুল পরিসংখ্যান নিরূপণের খাতিরেই। কেননা প্রতিটি অভিযানেই আমাদের অসহায় নারীরা আক্রান্ত হয়েছেন। কোন কোন সময় এই হামলাকারী দলের সংখ্যা এক প্লাটুন থেকে এক কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি স্পট ধর্ষণে সর্বনিম্ন একজন থেকে একশ’ এমনকি দুশ’ জন নারী পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনের শিকার হন। গড়ে দৈনিক প্রতি স্পটে সর্বনিম্ন ছ’জন নির্যাতিত হয়েছেন এবং কেউ কেউ অপহৃত হয়েছেন এটা প্রমাণিত হওয়ায় এ ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ষাট হাজার বলে নির্ণীত হয়। একাত্তরে এদেশে নব্বই হাজারের বেশি পাকিস্তানি আর্মি এবং এক লাখের বেশি বিহারি রাজাকারের সাথে ছিল আরও লক্ষাধিক বাঙালি রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পিস কমিটির সদস্য। অর্থাৎ পাকিস্তানি আর্মি এবং রাজাকার ও স্থানীয় দোসরদের আনুপাতিক হার ছিল ১:২। এই হিসাবে গড়ে তিনশ’টি স্পটে সর্বনিম্ন দৈনিক তিন হাজার পাকিস্তানি সেনা স্পট ধর্ষণে অংশ নিয়েছে।

এদেরকে সহায়তা দিয়েছে দৈনিক সর্বনিম্ন ছ’হাজার রাজাকার ও তাদের দোসরগণ। নির্যাতিত বন্দী নারী: ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি কর্তৃক পরিচালিত সারা দেশের বিয়াল্লিশটি জেলার মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানী কার্যক্রম, সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও নিবিড় গবেষণাকর্মের ভিত্তিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত বিন্নি গ্রহণযােগ্য ডকুমেন্ট ও বাহাত্তর-তেয়াত্তর সনের পত্র পত্রিকার দৈনিক রিপাের্টগুলাে পর্যালােচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে, দেশের মােট নির্যাতিত নারীদের শতকরা ত্রিশভাগকে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ক্যাম্পে, বাঙ্কারে, মিলিটারি হেডকোয়ার্টারে এবং জেলখানা, স্কুল কলেজ, পরিত্যক্ত অফিস, কারখানা, গােডাউন প্রভৃতি স্থানে বন্দী রেখে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করেছে। এছাড়া ধর্ষিতাদের মধ্যে অনেকেই নিজ গৃহ, অফিস আদালত, হােটেল, বিন্নি বিনােদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নানাবিধ চাপের মুখে আক্ষরিক অর্থে বন্দী না হয়েও যুদ্ধের পুরাে ন’মাস পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। এইসব নারীদেরকে আমরা নির্যাতিত বন্দী নারী হিসাবে নথিবদ্ধ। করেছি। এঁদের সম্মিলিত সংখ্যা প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’। পাকিরা। এদেরকে একদিন থেকে শুরু করে মাসের পর মাস, এমনকি যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দী করে রেখে গণধর্ষণ ও পৌনঃপুনিক ধর্ষণ করেছে। এদের মধ্যে চল্লিশভাগকে Tয় কোন না কোন সময় হত্যা করা হয়েছে অথবা নির্যাতিতারা নিজেরাই গণহত্যা করেছেন। মরা গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই নির্যাতিত বন্দী প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’ নারীকে তিনটি স্নি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছি। এক. পাকিস্তানি সেনাদের বিন্নি ক্যাম্প, বাঙ্কার, মিলিটারি হেডকোয়ার্টার এবং জেলখানা, স্কুল কলেজ, পরিত্যক্ত অফিস, কারখানা, গােডাউন প্রভৃতি স্থানে অনির্দিষ্ট কাল বন্দী এবং দিনের পর দিন গণধর্ষণের শিকার নারী। এদের সংখ্যা শতকরা প্রায় আঠারভাগ অর্থাৎ চুরাশি হাজার দুশ’ চল্লিশ। দুই. পাকিস্তানি আর্মির ক্যান্টনমেন্ট, বিভিন্ন বাড়িতে স্থাপিত মিনি পতিতালয় এবং ঐ এলাকার বিভিন্ন বাসা বাড়ি ও অন্যান্য স্থানে আটককৃত নির্যাতিত নারী। এঁদের সংখ্যা প্রায় পাঁচভাগ অর্থাৎ তেইশ হাজার চারশ’। তিন, গৃহস্থ বাড়ি, অফিস আদালত, হােটেল প্রভৃতি স্থানে নানাবিধ চাপের মুখে ও ব্ল্যাক মেইলিং-এর শিকার হয়ে ধর্ষিত নারী, যারা নিয়মিত বন্দী না হয়েও যুদ্ধের পুরাে ন’মাস নির্যাতিত হয়েছেন। এদের সংখ্যা মােট নির্যাতিতার প্রায় সাতভাগ অর্থাৎ বত্রিশ হাজার সাতশ’ ষাট। এঁদের মধ্যে ক্যাটাগরি এক ও দুই অর্থাৎ প্রায় এক লাখ আট হাজার (এক লাখ সাত হাজার দুশ’ চল্লিশজন) নারী বন্দী।

অবস্থায় দিনের পর দিন পাকিস্তানি আর্মির গণধর্ষণ ও পৌনঃপুনিক ধর্ষণের শিকার হন। এদের শতকরা আশিভাগ উপর্যুপরি ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। নির্যাতিত অন্তঃসত্ত্বা নারী: আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই তথ্য সম্পর্কে অবগত আছি যে অনিয়মিত মাসিক, ডিহীন মাসিক এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় বিভিন্নতাসহ নানা কারণে সকল ধরনের। যৌন সম্পর্কের পরিণতিই গর্ভধারণ নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় নববিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে শতকরা সত্তরভাগ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিরক্ষাবিহীন স্বাভাবিক মেলামেশার পরেও চটজলদি গর্ভধারণ করেন না। এয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং আমাদের রােগতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরকি’র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কয়েকটি নিবিড় মেডিকেল জরিপে এদেশের সাধারণ মানুষের ফার্টিলিটির সাথে আবহাওয়া, ঋতু, জাতি, গােত্র, বর্ণের সম্পর্ক পর্যালােচনার সাথে সাথে প্রমাণিত হয়েছে যে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ও ঋতুচক্র নিয়েও এদেশের সর্বোচ্চ ত্রিশভাগ নারী বিয়ের প্রথম বছরে গর্ভধারণ করেন। যারা স্বাভাবিক মেলামেশার পরেও গর্ভধারণ করেন না তাদের মধ্যে গর্ভশূন্য Missed Period-এর হার সর্বোচ্চ প্রায় দশভাগ এবং ধর্ষিতাদের মধ্যে ভয়ভীতি, আক্ষেপ প্রভৃতি কারণে ভ্রমাত্মক গর্ভধারণের (False Pregnancy বা Pseudocyesis) সংখ্যা প্রায় দশভাগ। এঁরা স্বাভাবিকভাবেই দু’তিন মাসের মধ্যে স্বাভাবিক রজঃস্রাব দেখে থাকেন। এ কারণে একাত্তরে নির্যাতিতা নারীদের মধ্যে ভয়ঙ্কর ঘৃণা, আক্ষেপ ও ভয়ে অনেকটা Psychosomatic কারণে অনেকের ভ্রমাত্মক গর্ভধারণ হয়েছে। এঁদের মাসিক বন্ধ হয়েছিল, অন্তঃসত্ত্বা হবার বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণও স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এঁরা প্রকৃত অর্থে গর্ভধারণ করেননি। এদের অনেকেই এ অবস্থায় বিভিন্ন ওঝা, বৈদ্য ও হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন, কবিরাজী ওষুধ খেয়েছেন এবং অতঃপর স্বাভাবিক ঋতুস্রাব হলে তারা মনে করেছেন যে তাঁদের গর্ভপাত ঘটেছে। ‘একাত্তরের নির্যাতিতাদের মধ্যে এধরনের অসংখ্য ভ্রমাত্মক গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের ঘটনা আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে।

গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের বিষয়টির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং গর্ভপাতে ব্যবহৃত গাছ গাছড়ার Pharmachological গুণাগুণ বিশ্লেষণ করেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে। এই তত্ত্ব ও তথ্য থেকে যে বিপুল সংখ্যাক নারী একাত্তরে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন না হয়ে বিন্নি ওঝা, বৈদ্য ও হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন তাদের অনেক প্রকৃত সমস্যা ও তার নিঝঞাট সমাধানের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে। এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সংখ্যার সাথে সাথে মূল নির্যাতিতাদের সংখ্যার অনুপাতটিও নির্ধারণের পথ খুলে দিচেছ ওপরে উল্লেখিত তত্ত্ব ও তথ্য। এর সঙ্গে ড. জিওফ্রে ডেভিস প্রদত্ত নির্যাতিতা নারীদের পরিসংখ্যানের গভীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিসের মতে এ ধরনের ধর্ষিতা অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা অন্তত দু’লাখ। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে এইসব ধর্ষিতা মহিলারা যখন কমপক্ষে আঠার সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা তখন ড. ডেভিস তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা এসে পৌছান। বাংলাদেশে অবস্থানের সময় ড, ডেভিস ঢাকাতে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় এক হাজার ডাক্তারের উদ্দেশ্যে গর্ভপাতের। টেকনিক সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনেকগুলাে ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। ড. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মসূচীর শুরু হবার আগেই দেড় লাখ থেকে এক লাখ সত্তর হাজার মহিলা গর্ভপাত করেছেন। এদের সংখ্যাধিক্য অংশ এই গর্ভপাত ঘটিয়েছেন স্থানীয় ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে। এভাবে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অনেকে নিহতও হয়েছেন। অবশিষ্ট ত্রিশ হাজারের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ তাদের শিশুদের নিজেদের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাহাত্তরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত যেসব মহিলা আত্মহত্যা করেন তাদের আত্মীয়স্বজন আত্মহত্যার খবর জানানােকে পরিহার করেছেন। পাছে এই আত্মহত্যার বিষয়গুলাে নিয়ে মামলা হয় এই ভয়ে তারা বিষয়টি গােপন রাখার চেষ্টা করেছেন। ড, ডেভিস তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করবার জন্য হানাদারবাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব তরুণীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হবার লক্ষণ কিংবা রােগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদেরকে পরিত্যাগ করা হয়েছে নয়তাে হত্যা করা হয়েছে। কোন কোন এলাকায় বারাে ও তেরাে বছরের বালিকাদের শাড়ি খুলে নগ্ন অবস্থায় রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে যাতে তারা পালিয়ে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে না পারে।

হতভাগ্য বন্দ নারীদের যখনই শাড়ি পরতে দেয়া হয়েছে তখনই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উদ্ধন্ধনে আত্মহত্যা করেছেন। যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন তেমনি ধরনের হাজার হাজার মহিলা তাঁদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন কারণ, তারা ধর্ষিত অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে দেখতে ‘অপরি’। এ অবস্থায় তাদের অনেকে বুকে পাথর বেঁধে পুলের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ধরনের ঘটন বড়ই মর্মান্তিক। পরিবার ও সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে এইসব ধর্ষিতা নারীদের অনেকে পতিতালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। লােকলজ্জার ভয়ে অনেকে ধর্ষক পাকিস্তানি আর্মিদের হাত ধরে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরকম নির্যাতিত নারীর সংখ্যা আমাদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে সাড়ে সাতশ’র অধিক। এইসব হতভাগ্য নারীদের অধিকাংশই ছিলেন স্কুল কলেজের ছাত্রী এবং কিছু সংখ্যক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক বেসামরিক সদস্যদের নবপরিণীতা শ্রীগণ। এঁদের অনেককে ঢাকা, ফরিদপুর, যশাের, খুলনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঈশ্বরদী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এঁরা দেশত্যাগ করে পরিচিতজনদের থেকে দূরে গিয়ে লজ্জা ঢাকতে চেয়েছেন। এঁরা পাকিস্তানে ভােগের জন্য রক্ষিতা হিসাবে বিভিন্ন বাড়িতে ও পতিতালয়ে বন্দী হিসাবে থেকেছেন এবং অকল্পনীয় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ‘৭২-এর বিশে জুন দৈনিক ইত্তেফাকে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তাদের বর্তমান অবস্থান ও পরিণতি আমাদের কাছে অজ্ঞাত। তবে তাদের কেউ কেউ দেশে ফেরার জন্য চেষ্টা করেছেন। আত্মীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ করবারও চেষ্টা করেছেন। এঁদের একজনের একটি চিঠি ১৯৯০ সনে পাওয়া যায়। এমনিভাবে ঐ সময় যাদেরকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ঝিনাইদহের হাসিনা নামের একটি মেয়ে, বগুড়ার এক পীরের মেয়ে, লালমনিরহাটের হাসান আলীর মেয়ে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মর্জিনা, রােকেয়াসহ আরও অনেকের তথ্য আমাদের হস্তগত হয়েছে। এইসব বাঙালি নারীদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং তাদের বন্দী জীবন সমগ্র জাতির জন্য ভয়ঙ্কর অবমাননাকর ও লজ্জাজনক। একাত্তরের বৃহৎ কয়েকটি গণহত্যা স্পটে নিহতদের সংখ্যা এবং ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত নারী ও পুরুষের অনুপাত মােটামুটিভাবে ১:৬।

গণহত্যার শিকার এবং হারিয়ে যাওয়া এইসব নারীদের মধ্যে অনেকেই নিহত হবার পূর্বে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। বাড়িয়া, ফুলপুর, গােলাহাট, বানিয়াচং, কড়াইকাদিপুর, ময়মনসিংহ, আগৈলঝাড়াসহ দেশব্যাপী পরিচালিত আমাদের গবেষণাকর্ম থেকে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। স্পট ধর্ষিতা, গণধর্ষিতা ও বন্দী ধর্ষিতাদের সম্মিলিত সংখ্যা দাঁড়ায় চার লাখ আটষট্টি হাজার। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ বড় শহরগুলােতে বাঙালি আমলা, সরকারী কর্মকর্তা, কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালি সেনা অফিসার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গসহ সমাজের নানা পর্যায়ের বিপন্ন মানুষের স্ত্রী, কন্যা এবং অন্যান্য নির্যাতিত নারীদের একটা বড় সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নানা অজুহাতে ভীতি প্রদর্শন করে এ ধরনের নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন ও ধর্ষণক্রিয়া ছিল আরেকটি অনুচ্চারিত নির্মম সত্য। জেলা সদরে অবস্থিত মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টারে, বিভিন্ন ক্যাম্প, জেলখানা ও অন্যান্য স্থানে বন্দী বাঙালি পুরুষদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের স্বী ও কন্যারা পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ব্যবহৃত ও ধর্ষিতা হয়েছেন। জনৈক সিনেমা অভিনেতার জীবন উদ্ধার করতে গিয়ে মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে মেজর আসলাম কর্তৃক তার স্ত্রীসহ অনেক নারীর অবমাননার ঘটনা আমরা অবগত হয়েছি। বরগুনা জেলখানায় ব্যাপক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের কথা আমাদের যুদ্ধ ও নারী’ গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নানা গ্রন্থে তার ওপর নির্যাতকদের অত্যাচারের ঘটনাগুলাে বর্ণনা করেছেন। এসব স্থানে বন্দী প্রত্যক্ষদর্শীরাও আমাদেরকে এ ধরনের অনেক ঘটনা জানিয়েছেন। গ্রামগঞ্জ ও শহরগুলােতে পাকিস্তানি আর্মির দোসর, পিস কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের পরিবারের নারীরাও অনেক সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে এধরনের নির্যাতনের বেশকিছু সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি।

ঢাকা নগর ও এর আশপাশে পাকিস্তানি সেনারা তাদের নির্যাতন কেন্দ্রগুলাে এবং বিন্নি বাড়িতে হানা দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে পঞ্চাশ জন বাঙালি নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছিল। হােটেল পূর্বরাগ, ইন্টারকন (শেরাটন), বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ও আরামবাগের একটি হােটেলসহ বেশ ক’টি হােটেলে এরকম ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। প্রতক্ষ্যদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে এসব নির্মম সত্যনির্ভর বাস্তব পরিসংখ্যান। দেশব্যাপী এরকম নিরপরাধ বাঙালি নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করা পাকিস্তানি সেনাদের নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা চরিতার্থ করা এবং সেই সাথে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও ব্ল্যাকমেইলিং করে আমাদের জাতীয় সম্মান ও সম্রমকে দলিত মথিত করা। ঢাকাসহ সারা দেশের বড় শহরগুলােতেই প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে দুশ জন নারী এভাবে পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে আমাদের পরিসংখ্যানে বেরিয়ে এসেছে। চল্লিশ হাজারের অধিক নারী এভাবে পাকিস্তানি সেনাদের যৌন লালসার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে নির্যাতিত নারীদের স্বামী কিংবা পরিবারের অন্যান্যরা এ ঘটনা জানতেও পারেননি। এছাড়াও নাট্য, সঙ্গীত, সিনেমা ও শিল্পকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নারী ও নির্যাতিত সেলিব্রেটির সংখ্যা নগণ্য হলেও তা উল্লেখযােগ্য। এঁদের অনেকেই অনন্যোপায় হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজের ও পরিবারের মানসম্মান ও অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে স্বাভাবিকভাবেই এই অবমাননা গলাধঃকরণ করেছেন। আমাদের গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে স্পট রেপ ও স্পট গণধর্ষণের শিকার সবেচ্চি শতকরা ত্রিশ ভাগ মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। অর্থাৎ নারী নির্যাতনসংক্রান্ত পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পিত আক্রমণে নির্যাতিতা নিহত ও অপহৃতের সংখ্যাসহ স্পট রেপ ও স্পট গণধর্ষণে আক্রান্ত, অথচ বন্দী নয় এমন প্রায় তিন লাখ ষাট হাজার নারীর মধ্যে প্রায় এক লাখ আট হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। অন্য দিকে ক্যাটাগরি এক ও দু’য়ের আওতায় গণধর্ষণ ও পৌনঃপুনিক ধর্ষণের শিকার প্রায় এক লাখ আট হাজার বন্দী নারীর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। আশি ভাগ নারী অর্থাৎ ছিয়াশি হাজার চারশ’ নারী। এঁদের মধ্যে প্রায় চল্লিশভাগ অর্থাৎ চৌত্রিশ হাজার পাঁচশ’ ষাটজন অন্তঃসত্ত্বা নারী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হন অথবা লােক লজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নেন।

এই হিসাবে মােট অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ পঁচানব্বই হাজার। এ প্রেক্ষাপটে ড. ডেভিস যখন উল্লেখ করেন যে ধর্ষণের কারণে শুধু অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যাই দু’লাখের ওপরে, তখন নির্যাতিতা নারীর প্রকৃত সংখ্যাটি বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান ভিত্তিক কোন রহস্য জালে আবদ্ধ থাকে না। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে একাত্তরে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা প্রায় চার লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিডনির শৈল্যচিকিৎসক ও স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিসের মতে কেবল নির্যাতিতা অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যাই দু’লাখ। আর মােট নির্যাতিতার সংখ্যা চার লাখ থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজার। আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের সাথে এই দুটি সূত্রের হিসাবের অদ্ভুত মিল নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের পরিচালিত কাজকে সত্যায়ন করে। পাকিস্তানি আর্মির ধর্ষণ নির্যাতনের এরকম অসংখ্য সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করেছি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বসবাসকারী শহীদ আকবর হােসেনের পুত্র রাউফুল হােসেন সুজা সে সময় পিতার লাশ খোঁজার জন্য বড় দু’ভাইয়ের সাথে ফয়’স লেকের বধ্যভূমিতে যান। সেখানে তারা প্রায় দশ হাজার বাঙালি নরনারীর লাশ দেখতে পান, যাদের অধিকাংশকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। বাবার লাশ খুঁজতে গিয়ে তারা সেখানে চুরাশিজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার লাশও দেখতে পান যাদের সবার পেট ফেড়ে দেয়া ছিল। এরকম ঘটনা বাংলাদেশে সর্বত্রই ঘটেছে। এছাড়াও নির্যাতিতা নারীদের আত্মহত্যা রােধকল্পে জামা-কাপড় ছাড়া উলঙ্গ অবস্থায় নারীদেরকে বন্দী রাখার ঘটনা তাে সর্বজনবিদিত। আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি গর্ভপাত কেন্দ্র ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে শতকরা দশভাগও আনুষ্ঠানিকভাবে এইসব সরকারী বেসরকারী গর্ভপাত কেন্দ্রে আসেননি। স্থানীয়ভাবে যে যার মতাে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন এবং ঘটনাগুলাে যাতে প্রকাশ না পায় তার সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছেন। অধ্যাপক আনােয়ারুল আজিমসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যারা ঐ সময় গর্ভপাত কেন্দ্র ও হাসপাতালগুলাের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারাও এই মত প্রকাশ করেন।

বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যারা সেপ্টেম্বরের পরে নির্যাতিত হয়ে গর্ভধারণ করেছেন অর্থাৎ বাহাত্তরের শুরুতে যারা তিন মাসের নিচে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তাদের তাে এইসব গর্ভপাত কেন্দ্রগুলােতে আসার প্রশ্নই উঠে না। আমাদের হিসাব মতে শুধুমাত্র এই ধরনের নির্যাতিতার সংখ্যাই অষ্টাশি হাজার দুশ’। এছাড়াও ঐ তিন মাসে নির্যাতিত এক লাখ বাষায় হাজার নারী এবং আরও এক লাখ একত্রিশ হাজার নির্যাতিত হিন্দু শরণার্থী নারী একেবারে নীরবে সবার অগােচরে জনসাধারণের মধ্যে মিশে গেছেন। সুতরাং সামগ্রিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে সর্বাধিক দশ হাজার নারী গর্ভপাত করানাের জন্য দেশব্যাপী বিভিন্ন কেন্দ্রগুলােতে আসেন। ঢাকার মেডিকেল কলেজগুলােসহ সকল জেলা হাসপাতাল এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন অস্থায়ী ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বেশকিছু প্রাইভেট ক্লিনিক এবং বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলােতে এই দশ হাজার নারীর গর্ভপাত ও স্বাভাবিক প্রসব করানাে হয়। এ কাজে দেশী বিদেশী বেশ কটি এনজিও সহায়তা করেছে। এরমধ্যে যুদ্ধশিশুদের প্রতিপালন (গর্ভপাত নয়) ও পরিচর্যার জন্য মাদার তেরেসা ঢাকার ইসলামপুরের আমপট্টিতে ‘বেবি হােম’ পরিচালনা করেন। এছাড়াও নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা দেখে যুদ্ধশিশুদের রাখবার জন্য তিনি নাটোরের রাজবাড়িতে দুশ’ পঞ্চাশ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন (সূত্র: Forty Years in Bangladesh; Father Rev. R. Timm)। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান প্যারেন্টহুড ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি গর্ভপাত কেন্দ্র চালু করে। এই কেন্দ্রে যে সমস্ত জীবিত শিশু জন্মায় তাদেরকে ‘বেবি হােমে’ রাখা হয়। ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরও অনেকগুলাে গর্ভপাত কেন্দ্র খােলা হয়। এসব কেন্দ্রের জীবিত শিশুদের অনেককে ধানমন্ডি ও ইন্দিরা রােডের দু’টি শিশু-দত্তক সংস্থার নিকট রাখা হয়। পরবর্তীতে SOS নামক এনজিওটি সাহায্য সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। ঐসময় পরিস্থিতি এত ভয়ঙ্কর ছিল যে সরকারীভাবে আইন প্রণয়ন করে গর্ভপাতকে বৈধতা দান করা হয়। সেই সঙ্গে সরকারীভাবে দেশের এক হাজার ডাক্তারকে গর্ভপাত সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এইসব উদ্যোগের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে এই বিপুল সংখ্যক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব এবং সীমাহীন লজ্জা ও গ্লানি থেকে। রেহাই দেবার চেষ্টা করা হয়। এক হিসাবে একাত্তরের যুদ্ধ শিশুর সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন তিন হাজার।

‘৭৪ সন পর্যন্ত এইসব যুদ্ধশিশুদের অনেকেই বাংলাদেশের ভেতরে ছিল। এদের একটা বড় অংশ কেয়ার, কারিতাস, CORR, ISs Agency New York এবং ইউরােপের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলাের সহায়তায় ইউরােপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসাবে চলে যায় এবং বাকিরা গােপনীয়তার অন্ধকারে দেশের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। দেশের ভেতরের ও বাইরের এরকম বেশকিছু যুদ্ধশিশুর সন্ধানও পাওয়া গেছে। কিছু যুদ্ধশিশুকে ঐসময় বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাচারের তথ্যও উঘাটিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলােতে নির্যাতিত নারীদের নাম, ঠিকানা ও নির্যাতনের ধরন নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অসংখ্য নারীকে এ প্রক্রিয়ায় নিবন্ধিত করা হয়েছিল। বেশকিছু যুদ্ধশিশুকেও তখন নিবন্ধিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে ঐ সময় এ সম্পর্কিত সকল কাগজপত্র ও তথ্য ধ্বংস করে ফেলায় নিবন্ধিত নারীর সংখ্যাটি উদ্ধার করা আর কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।

উপসংহার পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, গণহত্যা সংক্রান্ত মিথটি আমরা ভাঙতে চাইনি। তবে ধর্ষণ নির্যাতনের ব্যাপকতা এবং বর্তমানে সমাজে নারীর অবস্থান ও অবদানকে অনুধাবনের জন্যই আমাদেরকে এই সত্যনিষ্ঠ গবেষণাকর্মটি পরিচালনা করতে হয়েছে। তবে এই গবেষণাকর্ম কেবল একাত্তর সনে ধর্ষণ ও নির্যাতনের কিছু সংখ্যাই তুলে আনেনি, সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে দেশের জন্য, জাতির জন্য যে নারীসমাজ সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, ঝরা পাতা ও মরা পাতার মতাে বিবর্ণ জীবন বেছে নিয়েছেন, তাদের প্রতি আমাদের অন্তহীন উপেক্ষা। নারী নির্যাতন রােধে, নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে, নারীর স্বপ্ন বিনির্মাণে এবং নারীমুক্তি সাধনের লক্ষ্যে একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক সংঘটিত সমগ্ৰ নির্যাতনের বিষয়টির প্রতি গভীর মনোেযােগ, অনুধাবন ও সহানুভূতি প্রয়ােজন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নারী নির্যাতন রােধে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়ে নিমজ্জিত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের সর্ববৃহৎ ঘটনাটি সমাজতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, আইন বিশেষজ্ঞ, নারী সংগঠন ও নারীর স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের জানা থাকা প্রয়ােজন। সেই সাথে এই সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রয়ােজন সমাজের সচেতন অংশ ও মানবতার পক্ষের ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিতভাবে অপরাধীর বিচারের পক্ষে অবস্থান নেয়া। সমাজে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নারীর অধিকার রক্ষাকল্পে, বিচারহীনতার অচলায়তন ভাঙ্গার জন্য এবং পেছনের অপরাধগুলাের পুনরাবৃত্তি রােধের জন্য আমাদের সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সেই সঙ্গে সবাইকে অনুধাবন করতে হবে যে, অপরাধী ও অপরাধীর পক্ষ ছাড়া কেউ এই মহতী উদ্যোগে বাধা দিতে পারে না।

এক নজরে সামগ্রিক পরিসংখ্যান

১. স্পট ধর্ষণ, স্পট গণধর্ষণ ও বন্দী নির্যাতিতার সম্মিলিত সংখ্যা-চার লাখ আটষয়ি হাজার (স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ সাতাশ হাজার ২শ’ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানিদের নিকট বন্দী নির্যাতিত নারী এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’ নারী)।

২. চিহ্নিত স্থানে নির্যাতিতা নিহত ও অপহৃতসহ স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষনের শিকার-তিন লাখ ষাট হাজার। এঁদের মধ্যে শুধুমাত্র স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার প্রায় তিন লাখ সাতাশ হাজার যা মােট নির্যাতিতার সত্তরভাগ। এঁদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রায় ত্রিশভাগ অর্থাৎ এক লাখ আট হাজার নারী।

৩. নির্যাতিত বন্দী নারী প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার (এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’) যা মােট নির্যাতিতার প্রায় ত্রিশভাগ। এরমধ্যে কারাগার, ক্যাম্প, বাঙ্কার, প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিতের সংখ্যা মােট নির্যাতিদের প্রায় আঠারভাগ। এছাড়াও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট, মার্শাল ল’ আদালত এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘর, অফিস আদালত, হােটেল, বিনােদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিত হন বারােভাগ (ক্যাটাগরি দুই-শতকরা পাঁচভাগ এবং ক্যাটাগরি তিন-সাতভাগ)।

৪. বন্দী নির্যাতিত নারীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা আশিভাগ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছিয়াশি হাজার। এঁদের মধ্যে চল্লিশভাগকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তারা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।

৫. মােট নির্যাতিতা অন্তঃসত্ত্বা-এক লাখ পঁচানব্বই হাজার। ড. জিওফ্রে ডেভিসের

মতে এই সংখ্যা দুলাখের ওপরে।

৬. এই অন্তঃসত্ত্বাদের মধ্যে মাত্র দশ হাজার নারী গর্ভপাত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসেছেন যা মােট জীবিত অন্তঃসত্ত্বাদের (একলাখ ছত্রিশ হাজার) দশভাগেরও কম। গর্ভপাত করানাের জন্য সরকারীভাবে এক হাজার ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

৭. যুদ্ধশিশুর সংখ্যা সর্বনিম্ন তিন হাজার।

৮. পাকিস্তানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাড়ে সাতশ’ নির্যাতিত নারীকে।

৯. বৃহৎ গণহত্যা স্পটগুলােতে নিহত নারী ও পুরুষের অনুপাত ১:৬। নিহত হবার

পূর্বে অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন।

১০. ঢাকা নগর ও আশপাশে প্রতিদিন অন্তত পঞ্চাশ জন নারী নির্যাতিত হন। সারাদেশের শহরগুলােতেই দৈনিক গড়ে নির্যাতিত হয়েছিলেন দুশ’জন। এ

প্রক্রিয়ায় কেবল বড় শহরগুলােতেই (মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসের মধ্যে অন্তত দুশ দিনে) নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চল্লিশ হাজারের অধিক।

১১. সারাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের পেট্রোল টিম (প্রতি টিমে দশজন) দৈনিক সর্বনিম্ন তিনশ’ স্পটে হানা দিয়ে নারী নির্যাতন ও গণহত্যা চালায়।

তথ্যসূত্র :

১. জেনােসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টারের গবেষণা তথ্য

২. যুদ্ধ ও নারী ; ডা. এম এ হাসান।

৩. যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ ; ডা. এম এ হাসান

  1. Forty Years in Bangladesh; Father Rev. W. Timm

৫. বাংলার বাণী (বিশেষ সংখ্যা), ১৯৭২

৬. উপসুলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদন। তারিখঃ ৯ মে ২০০২

 

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!