You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৫ মার্চ ও ‘৭১-এর বধ্যভূমি

১৯৯৯ সনে মিরপুরের মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের পর সারা দেশে পাকি বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের দাবিটি জনগণের মধ্যে নতুন করে জেগে উঠে। সেই সাথে দেশের সর্বত্র বধ্যভূমি ও গণহত্যা স্পট শনাক্ত করার একটি প্রক্রিয়াও তখন চালু হয়। এ প্রেক্ষাপটে একাত্তরের নৃশংসতার স্থানগুলাে শনাক্ত করতে এগিয়ে আসে সরকার, জনগণ ও বিন্নি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ঐ সময় থেকে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ দেশব্যাপী হত্যা ও নির্যাতনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে বধ্যভূমি শনাক্ত করার প্রক্রিয়াটির সাথে সম্পৃক্ত হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে বধ্যভূমিগুলােকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি স্বউদ্ভাবিত একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করে বধ্যভূমিগুলােকে দ্রুত শনাক্ত করার জন্য। এই নতুন পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী ও বয়ানগুলাে যাচাই করার জন্য মাটির বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মাটিতে বিদ্যমান মােম, তেল ও নানা এলিমেন্ট বিশ্লেষণ করা হয়। ২০০১ সালের মে মাসে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত দলিল ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ নামক গ্রন্থে ৪২৮টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তারপর এ কাজ থেমে থাকেনি। অদ্যাবধি ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি সারা দেশে ২৮ কম এবং গণহত্যা স্পট শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে চলমান কাজটি শেষ করা গেলে সারা দেশে প্রায় দু’হাজারটি বধ্যভূমি শনাক্ত করা ব হবে। তারও আরাে তিন হাজার বধ্যভূমি হয়ত কোনদিনই চিহ্নিত করা যাবে না। কেননা সেগুলাে ইমারতের তলদেশ, কংক্রিটের ঢালাই, রাস্তাঘাট এবং ক্ষেত খামারের মধ্যে চিদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, স্বাধীনতার পর দেশের যত্রতত্র এমনভাবে হাড়গােড় ছাড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যে, চাষবাস ও জীবনের প্রয়ােজনে এই হাড়গােড়গুলাে সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল আবাদযােগ্য ভূমি উদ্ধারের জন্য। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান ও বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্ত সম্পন্ন করা গেলে দেশের বিন্নি বধ্যভূমি থেকে ৫ থেকে ৮ লক্ষ দেহাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হবে। প্রসঙ্গক্রমে আরাে উল্লেখ্য প্রায় ৭০৮০ ভাগ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় দেশের খাল, বিল ও নদীর পাড়ে। ফলে এদের সংখ্যাটি চিরকাল একটি রহস্যের মধ্যেই থেকে যাবে।

এ কারণে দেশের সকল নদী, জলাশয় ও ব্রিজগুলাের উপর যে গণহত্যা চালানাে হয় তার একটি পরিসংখ্যান উদ্ধার করেছে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’। বধ্যভূমি সংক্রান্ত সর্বশেষ জেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যানটি হল- ঢাকা ৪৯টি, মুন্সীগঞ্জ চারটি, মানিকগঞ্জ তিনটি, নারায়ণগঞ্জ ১৩টি, নরসিংদী পাঁচটি, গাজীপুর আটটি, টাঙ্গাইল নয়টি, ময়মনসিংহ ৩৫টি, নেত্রকোনা নয়টি, জামালপুর ১৫টি, শেরপুর ২০টি, কিশােরগ ২৩টি, ফরিদপুর ১৫টি, মাদারীপুর তিনটি, রাজবাড়ি দুইটি, গােপালগঞ্জ চারটি, শরীয়তপুর সাতটি, চট্টগ্রাম ৩৭টি, রাঙামাটি একটি, কক্সবাজার চারটি, কুমিল্লা ২১টি, চাদপুর ১৮টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪৫টি, নােয়াখালী ১৪টি, লক্ষ্মীপুর চারটি, ফেণী ১৪টি, খুলনা ২৭টি, বাগেরহাট ১৭টি, সাতক্ষীরা ২৪টি, যশাের ২০টি, ঝিনাইদহ সাতটি, মাগুরা ছয়টি, নড়াইল দুইটি, কুষ্টিয়া ১৬টি, চুয়াডাঙ্গা ১১টি, মেহেরপুর আটটি, রাজশাহীর ২৮টি, নওগাঁ ১১টি, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ১৪টি, নীলফামারী সাতটি, গাইবান্ধা ৩০টি, পঞ্চগড় একটি, কুড়িগ্রাম ১১টি, ঠাকুরগাঁও ১৮টি, লালমনিরহাট ছয়টি, দিনাজপুর ২৮টি, রংপুর ২৭টি, নাটোর ১৩টি, কনা ২৯টি, সিরাজগঞ্জ ১০টি, বগুড়া ২৮টি, জয়পুরহাট ১৩টি, বরিশাল ১২টি, পিরোজপুর ১২টি, ঝালকাঠি ৮টি, পটুয়াখালী সাতটি, বরগুনা ১১টি, ভােলা দুইটি, বৃহত্তর সিলেট ৭৪টি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী একাত্তরের নদীতে সংঘটিত গণহত্যার জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হল- ঢাকা ছয়টি, নারায়ণগঞ্জে দুইটি, নরসিংদী একটি, মুন্সীগঞ্জ একটি, মানিকগঞ্জ দুইটি, গাজীপুর একটি, টাঙ্গাইল চারটি, ময়মনসিংহ সাতটি, জামালপুর দুইটি, শেরপুর চারটি, কিশােরগঞ্জ তিনটি, মাদারীপুর একটি, গােপালগঞ্জ দুইটি, চট্টগ্রাম একটি, চাঁদপুর দুইটি, ব্রাক্ষণবাড়িয়া দুইটি, ফেণী একটি, নােয়াখালী একটি, খুলনা পাঁচটি, বাগেরহাট তিনটি, যশোের দুইটি, নড়াইল একটি, ঝিনাইদহ একটি, মাগুরা চারটি, কুষ্টিয়া একটি, চুয়াডাঙ্গা একটি, মেহেরপুর একটি, রাজশাহী একটি, নাটোর একটি, পাবনা একটি, সিরাজগঞ্জ দুইটি, বগুড়া তিনটি, জয়পুরহাট একটি, রংপুর দুইটি, নীলফামারী একটি, দিনাজপুর দুইটি, বরিশাল চারটি, ঝালকাঠি একটি, পিরােজপুর একটি, পটুয়াখালী একটি, বরগুনা দুইটি, সিলেট দুইটি, মৌলভীবাজার একটি। মােট ৮৮টি নদী, শাখা নদী এবং তার কূলে গণহত্যা চালানাে হয়। যে সব ব্রিজ ও সেতুতে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় তার জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলঢাকা তিনটি, মানিকগঞ্জ একটি, নরসিংদী ছয়টি, শেরপুর একটি, ময়মনসিংহ তিনটি, নেত্রকোনা দুইটি, কিশােরগঞ্জ সাতটি, ফরিদপুর দুটি, মাদারীপুর একটি, শেরপুর একটি, নােয়াখালী সাতটি, ফেণী সাতটি, চাদুপর একটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুইটি, ঝিনাইদহ তিনটি, মাগুরা দুইটি, পাবনা একটি, দিনাজপুর একটি, রংপুর চারটি, লালমনিরহাট একটি, নীলফামারী তিনটি, নওগাঁ দুইটি, মৌলভীবাজার চারটি। মােট ৬৫টি ব্রিজ ও সেতুতে গণহত্যা চালানাে হয়। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি” এটা আশা প্রকাশ করে যে, গণকবর ও বধ্যভূমি সংক্র অনুসন্ধান এবং চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটির সাথে জনগণ সম্পৃক্ত হলে জাতি আরাে ইতিহাস সচেতন হয়ে উঠবে। সেই সাথে এই মহতী উদ্যোগ আমাদেরকে গণহত্যার বিচারের দাবি উপস্থাপনের শক্তি ও সাহস জোগাবে। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ আরাে আশা প্রকাশ করে যে, ২৫ মার্চ গণহত্যাকে স্মরণ করে প্রতিবছর এই দিনে আপামর জনসাধারণ সমবেত হয়ে যুদ্ধ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানাবে এবং ঘৃণা প্রকাশ করবে সেই সব অপরাধীদের প্রতি, যারা এই য়ংকর অপরাধ সংঘটিত হতে দিয়েছিল ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নামে। দেশে দেশে এই নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোেধ করবার জন্য এবং মানব সভ্যতাকে অর্থবহ করবার জন্যই আমাদেরকে কাজটি করতে হবে। নিষ্ঠার সাথে। তারিখ-২৪ মার্চ ২০০৫ 

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!