You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৭১  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

যুদ্ধ মানেই নিষ্ঠুরতা এবং মানবতার মৃত্যু। তবুও কখনাে যুদ্ধ করতে হয় নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্য, আত্মরক্ষা করবার জন্য, একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখবার জন্য। তাই প্রতিরােধ যুদ্ধের সাথে আগ্রাসী যুদ্ধের রয়েছে যােজন ব্যবধান। প্রতিটি আগ্রাসী যুদ্ধই রাষ্ট্র বা গােষ্ঠী পরিচালিত একটি Organized Crime। একে রাষ্ট্র পরিচালিত সংঘবদ্ধ সর্বোচ্চ পর্যায়ের সন্ত্রাস বলা যেতে পারে। সম্পদ, জীবন, মানব মর্যাদা এবং সভ্যতা বিনাশী এই যুদ্ধের নিষ্ঠুর যাতাকলে সাধারণ জনগণই অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিষ্ট হয়। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ আঘাতে বিশেষভাবে আক্রান্ত হয় নারী ও শিশুরা। কোন কোন যুদ্ধে আহত ও মৃতদের মধ্যে ৯০ ভাগই ছিল সাধারণ জনগণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৫ কোটি মানুষের মধ্যে ২.৬ কোটি ছিল বিন্নি দেশের সেনা সদস্য, ২.৪ কোটি ছিল নারী ও শিশুসহ সাধারণ জনগণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিরীহ জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে এবং ৯ মাস ব্যাপী পাইকারী গণহত্যা এবং নির্যাতনের ফলে প্রায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয় বলে ধারণা করা হয়। এই বিপুল সংখ্যক নর নারীর তুলনায় সকল পক্ষের সেনা সদস্য ও শহীদ মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা অতি নগণ্য। এ প্রেক্ষাপটে সকলকে অনুধাবন করতে হবে- যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে কি ভয়ংকর এক অপরাধ! এ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে কিছুটা শৃঙ্খলাবদ্ধ করবার জন্য ১৯৪৯ সনে এপ্রিলের ২১ তারিখ থেকে আগস্টের ১২ তারিখ পর্যন্ত জেনেভায় চারটি কনভেনশনে নারী, শিশু এবং সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষাকল্পে এবং আহত, বন্দী যােদ্ধাদের জীবন ও সম্মান রক্ষার লক্ষ্যে কিছু আইন প্রণয়ণ করা হয়। ঐ সময়কার চারটি কনভেনশনের মধ্যে ৩য় কনভেনশনটি ছিল যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এবং ৪র্থ কনভেনশনটি ছিল সাধারণ নাগরিকদের রক্ষাকল্পে। এর আগে ১৯৪৮ সনে গণহত্যা সংক্রান্ত কনভেনশনে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরােধে এমন কিছু আইন প্রণীত হয় যাতে অপরাধ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা সংযােজিত হয়। এরপর ১৯৭৭ এ প্রটোকল ১ ও প্রটোকল ২ সংযােজিত হয় স্থানীয় পর্যায়ে সশস্ত্র সংঘর্ষে জনগণের অধিকার রক্ষাকল্পে। যুদ্ধ ও সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা এবং অধিকার রক্ষা করার জন্য আইনের অভাব নেই। তবে আন্তর্জাতিক মােড়লদের স্বার্থ এ বিশরাজনীতির কারণে International Humanitarian Law and International Human Rights Law ACHTICS নানাবিধ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে ঘাতক এবং অপরাধী পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের সহযােগীরা জেনেভা কনভেনশনের অধীনে সকল নিরাপত্তা ও যথাযথ মর্যাদা পেয়েছে। অথচ আমাদের অত্যাচারিত, নিযাতিত এবং নিহত নাগরিকরা এ আইনের অধীনে কোন সুরক্ষাই পায়নি।

‘৭১-এ ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক রেডক্রস কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি। ঐ সময় ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত পরিকল্পিত গণহত্যা এবং মানবতাবিরােধী নিকৃষ্টতম অপরাধগুলাে ঘটে গেলেও তা রােধে পাশ্চাত্য শক্তিগুলাে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। পাশ্চাত্যের সুশীল সমাজের অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়ালেও আমেরিকা ও চীনের মত দেশগুলাে অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেয়। ৮ই এপ্রিল ১৯৭২ এ প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রােধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র” শিরােনামে প্রকাশিত সংবাদে বাসস-এর বরাতে বলা হয়, “গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া এক রিপাের্টে জানা গেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনও তাদের মধ্যে একজন যিনি বাংলাদেশের পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হােক তা দেখতে চান না। শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন আরব দেশগুলােসহ পাকিস্তানের অনেক বন্ধু দেশের রাষ্ট্র নায়কগণ যুদ্ধপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টি করে সদ্য সৃষ্ট বাংলাদেশে সরকারের উপরে সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করে। এ ঘটনা থেকে বুঝতে হবে জেনেভা কনভেনশন এবং মানবতার পক্ষে আইনগুলাে অনেক ক্ষেত্রে বিন্নি শক্তিধর রাষ্ট্রের জন্য ফাকা অঙ্গীকার এবং কাগুজে বাধ্যবাধকতা মাত্র। এ সমস্ত আইন তাদের রাষ্ট্ৰীয় আকাকা এবং স্বপ্নের সাথে একেবারে সম্পৃক্ত হয়নি। সমগ্র বিশ্বের সুশীল সমাজ যে সভ্যতার ও মানবতার স্বপ্ন দেখে তা সম্ভবত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলাের নিকট ইওটোপিয়ান চিন্তা মাত্র। তাই আজও তারা সভ্যতাবিনাশী যুদ্ধকে চুড়ান্ত রাজনৈতিক কৌশল এবং জীবনবিধ্বংসী ভয়ংকর নােংরা অস্ত্রগুলােকে অন্যতম সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে। এ প্রেক্ষাপটে ঐসব রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থানকারী বুদ্ধিজীবীরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও লােকহিতকামী আইনগুলাের সীমারেখাকে Unrealistic বা অবাস্তব বলে দাবী করলেও প্রকৃত পক্ষে সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যুদ্ধাবস্থায় এ আইনগুলাে পাশ কাটাবার কোন পথ নেই। যুদ্ধরত সৈনিকদের স্বার্থ রক্ষায় আইনগুলাে যতটা দৃঢ়তার সাথে প্রয়ােগ করা হয় একইভাবে জনগণের স্বার্থে তা প্রয়ােগ করলেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ অনেকাংশে প্রতিরােধ করা সম্ভব। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে এ আইন প্রয়ােগের বৈষম্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়াও প্রয়ােজন। এ বৈষম্যের কারণ আইনের দুর্বলতা নয় বরং আইন প্রয়ােগে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব। অথচ প্রতিটি যুদ্ধে নারীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধের উত্তাপ তার গায়েই বেশি লাগে।

‘৭১ এ আমরা দেখেছি এ দেশের নারী কতভাবে নির্যাতিত হয়েছে। যাদের সন্তানরা যুদ্ধে গিয়েছে কিংবা যাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে, তারা নির্যাতিত হয়েছে এবং যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না তারাও নির্যাতিত হয়েছে। যারা ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে অথবা পরদেশে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছে তাদের অধিকার ও মর্যাদাও নানাভাবে লজ্জিত হয়েছে। নারী শুধু নারী হবার কারণে নির্যাতিত হয়েছে। ‘৭১ এ যুদ্ধের পর সমাজ যখন শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন খুঁজে নিচ্ছিল তখন অসংখ্য নারী খুঁজছিল তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজন, সন্তান ও স্বামীকে। কেউ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের বিয়ােগ ব্যাথা লােগ করছিল অথবা স্বামী হারা হয়ে ধ্বংসকূপের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষার চেষ্টা করছিল। কেউ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ নির্যাতনের ক্ষতগুলাে নিয়ে কোন ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল। কাউকে বইতে হয়েছে পঙ্গু সন্তান ও স্বামীর ভার। কেউ হারিয়ে যাওয়া সন্তান, ভাই ও স্বামীর জন্য অবিরাম প্রতীক্ষা করেছে। যাদের স্বামী নিখোঁজ হয়েছিল তাদেরকে একটি দুঃসহ ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংকটের মাঝে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। দুঃখের বিষয়, ৭১ এ নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছি। অথচ ৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের অপহরণের কারণে অসংখ্য লােক অদ্যাবধি গুম হয়ে রয়েছে। এটি একটি চলমান অপরাধ। কারাগারে নির্যাতনের বিষয়টি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ যেটি নয় মাস ধরে পাকিস্তানিরা পরিকল্পিতভাবে নিঃসংকোচে চালিয়ে গেছে। ৭১-এ বরগুনার কারাগারে নির্যাতন ও ফরিদপুরের জেলখানায় নির্যাতন এ ধরনের অপরাধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯৭১ সনে ২৫ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর অকস্মাৎ ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যে যুদ্ধ শুরু করে তা কোন অভ্যন্তরীণ সংঘাত, নাগরিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সাধারণ দমন বা দাঙ্গা ছিল না। এটা কোন বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ দমনও ছিল না। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যা এবং একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করবার নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া। বেপােয়ারা হত্যা, গণধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযােগ, অপহরণ এবং অন্যায়ভাবে নিরপরাধ মানুষগুলােকে বন্দী করে পাকিস্তানি শাসকেরা অন্যতম বৃহৎ একটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকর্ম সম্পন্ন করে।

এরপর তারা প্রতারণা মূলকভাবে একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিদ্রোহ এবং দাঙ্গা বলে অভিহিত করে তাদের সীমাহীন অপরাধগুলােকে লঘু করার চেষ্টা করে। ‘৭১-এ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরােধকে পাকিস্তানি বাহিনী অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে দেশরক্ষা বাহিনীর শক্তি প্রয়ােগ হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হল এই যে, প্রাথমিক অবস্থায় জনগণের স্বাভাবিক প্রতিরােধের পর একটি সরকার স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করে যা সকল সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধ হিসাবেই অভিহিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বলে- IHL is applicable in times of armed conflict, whether international or non-international. International conflicts are wars involving two or more states, and wars of liberation, regardless of whether a declaration of war has been made or whether the parties involved recognize that there is a state of war. Non-international armed conflicts are those in which government forces are fighting against armed insurgents, or rebel groups are fighting among themselves. Because IHL deals with an exceptional situation-armed conflict- no derogations whatsoever from its provisions are permitted. In principle. IHRL applies at all times, i.e. both in peacetime and in situations of armed conflict. Certain human rights are never derogated. Among them are the right to life, prohibition of torture or cruel, inhuman or degrading treatment or punishment, prohibition of slavery and servitude and the prohibition of retroactive criminal laws. তখন কোন অবস্থাতেই একাত্তরের যুদ্ধকে একটি অভ্যন্তরীণ সংঘাত হিসেবে অভিহিত করে বিশাল গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের কলঙ্কজনক অধ্যায়কে ইতিহাসের কৃষ্ণগহবরে নিমজ্জিত করা যাবে না। প্রকৃত সত্য হল এই যে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ‘৭১-এর ন’মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালীকে ঘর ছাড়া করে Forced migration -এ বাধ্য করে।

এটাই তাে একটা বড় যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ রয়েছে যে প্রথম ৬ মাসে হত্যা ও ধর্ষণের পর সম্মান ও সম্পদ লুঠ করে ভিটে মাটিতে আগুন দিয়ে ৬৯.৭১ লক্ষ (মার্চ-আগস্ট, সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস পৃষ্ঠা৪৪৬, ভারত সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত) সংখ্যক হিন্দুদেরকে দেশ ছাড়া করে তারা ethnic cleansing- এর কাজটি সমাধা করেছিল। তারা দেশে প্রায় তিন হাজার হিন্দুকেও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার জানান যে একাত্তর সনে যােগীশশা গ্রামে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী বিয়াল্লিশ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা গ্রামের কয়েকজনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিল। তার এক জ্যাঠাত দাদাকে আমি ও তাদের দোসররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। এ সময় কর্মকার শ্রেণীর কয়েক ঘর হিন্দু যারা সেসময় গ্রামে ছিলেন, তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে পাকি সেনারা তাদেরকে অবশ্যই হত্যা করত। ইতিহাসের অধ্যাপক রতন লাল জানিয়েছেন যে তাকে এবং তার কয়েকজন আত্মীয়কে জোরপূর্বক মুসলমান বানিয়ে ছাড়ে পাকিদের দোসরগণ। তবে তা ছিল সাময়িক। অনেক হিন্দু মেয়েদের সিথির সিদ্র মুছে, হাতের শাখা ভেঙে তাদেরকে যৌনদাসী হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। এমন ক’জন যৌনদাসীদের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে যু ও নারী’ গ্রন্থে। এদের মধ্যে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কামিনী মােহন দেবের জীর কষ্টের কথা ভুলবার মতাে নয়। সিলেটের অন্যান্য জেলাগুলাের মতাে হবিগঞ্জেও পাকিবাহিনী ব্যাপক নারী নির্যাতন চালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন তারা চুনারুঘাট থানার হাতুত্তা গ্রামে হানা দেয়। ঢাকা-সিলেট সড়কের পাশেই ছােট গ্রাম হাতুন্তা। আমি গ্রামের কামিনীমােহন দেবের বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রীকে নিয়ে পাশবিক উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। তারপর সে বাড়িটাকে তারা মিনি পতিতালয়ে পরিণত করে। প্রতিরাতে তারা পালাক্রমে কামিনী মােহনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। আশেপাশের আরও অনেক মেয়েকেও ধরে এনে তারা নির্যাতন করে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ইউসুফ ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা এই নির্যাতনে নেতৃত্ব দেয়। স্বাধীনতার পর লজ্জায় ঘৃণায় কামিনী মােহন তার স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে চলে যান। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চলতি গবেষণা অনুযায়ী পাকি হানাদার ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালে দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায় তাতে প্রায় সাড়ে বারাে লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি গবেষণায় (সূত্র: ওয়ার ক্রাইস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গবেষণা)। এর বাইরে আরাে হিসাব রয়েছে।

এ যাবৎ গণকবর ও গণহত্যা স্পট আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় ৯২০টি। ৮৮টি নদী ৬৫টি ব্রিজের উপরে হত্যা নির্যাতনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। চার লাখ ষাট হাজার নির্যাতিত নারীর পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে পাকি দোসররা সহায়তা করলেও পাকিস্তানি বাহিনীই নিজেরাই এই সমস্ত ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও গণহত্যায় অংশ নেয়। ধর্ষিতা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের নাম উল্লেখ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ২৮৭জন সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীকে শনাক্ত করেছে। এরমধ্যে ১৯১ জন বড় মাপের যুদ্ধাপরাধী। ৩০ থেকে ৪০ জন রয়েছে শীর্ষ অপরাধী। বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিদের আগ্রাসন ও গণহত্যাযজ্ঞ কতটা পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঐ সময়ে চট্টগ্রামের রেজিমেন্ট কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম, আর, মজুমদারের বক্তব্যে। তিনি গত ১৬ জুন ২০০৩ তারিখে ওয়ার ক্রাইস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকাবে বলেন যে ৭০ এর ডিসেম্বরের শেষে বা ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। ঐ চিঠিতে কর্তৃপক্ষ জানান যে, শেখ মুজিবের ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান আর্মিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য ক্ষুন্ন হবে এবং তাদের সামরিক স্বার্থ ব্যাপকভাবে লজ্জিত হবে। চিঠির শেষ অংশে লেখা ছিল- ‘Therefore the Army cannot allow Sheikh Mujib to become the Prime Minister of Pakistan a fofoco 7840 Director Military Operations (DMO) Director Military Intelligence -এর স্বাক্ষর ছিল।

সেই চিঠিটার প্রসঙ্গ সিদ্দিক সালিকের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্দিক সালিক সেখানে বলেছেন যে, ঐ সময় একজন জেনারেল এখানে এসেছিল এবং সে গভর্নর হাউসে বলেছিল, “Don’t worry, we will not allow these black bustards to rule over us.” পাকিস্তানি শ্বেতপত্রে বাঙালি কর্তৃক বিহারি নির্যাতনের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, মার্চে শুরুতে রেলওয়ে কলােনীতে একটি দাঙ্গা হয়েছিল। ঐ দাঙ্গাটি পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের কমান্ডাে দ্বারা সৃষ্ট ছিল। ঐ দাঙ্গায় রেলওয়ে কলােনি এলাকায় নিহতদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই ছিল বেশি এবং তাদের ঘরবাড়িই বেশি পােড়ানাে হয়েছিল। ঐ সময়ে রেলওয়ে কলােনিতে কর্মরত ক্যান্টেনটি ফাতেমির অধীনে একজন পাঞ্জাবি অফিসার ছিল। ১৯৭২ সনে ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত একটি জাতির জন্ম” শীর্ষক রচনায় প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান উল্লেখ করেন-“ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণােন্মুখ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডাে ব্যাটেলিয়ানের সৈনিক চট্টগ্রামে শহরের বিন্নি এলাকায় ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস কতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরও জানলাম, কমান্ডােরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে বিহারি বাড়িগুলােতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারিদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। “ঐ সময়ে আমার ব্যাটেলিয়ানের নিরাপত্তা এনসিওরা আমাকে জানালাে প্রতিদিন। সন্ধ্যায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পােষাক পরে বেসামরিক ট্রাকে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লােক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতিরাতেই তারা যায়। কতগুলি নির্দিষ্ট বাঙ্গালী পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙ্গালীদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙ্গালীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে শােনা যায়।” এই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লে.ক. জানজুয়া আমার গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখার জন্য লােক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লােকেরা যেয়ে আমার সম্পর্কে খােজ খবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশংকা করছিলাম- আমাদের হয়তাে নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনােভাব দমন করে কাজ করে যাই, নিরস্ত্র করার। উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বাঙ্গালী হত্যা ও বাঙ্গালী দোকান পাটে অগ্নিসংযােগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সেনা শাসক কর্তৃক বাঙালির বিরুদ্ধে অবাঙালিদের ব্যবহারের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

স্বাধীনতা পরপর মিরপুরের চেয়ারম্যান ফকির সফিউদ্দীন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মিরপুরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে “মুক্তিযুদ্ধকালীন মিরপুরের কথা বলতে গেলে একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলাদেশকে কজা করার উদ্দেশ্যে তাদের দোসর উগ্র বিহারিদেরকে মিরপুর, মােহাম্মদপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এনে বসতি স্থাপন করায়। ফলে এলাকাগুলাে এক পর্যায়ে তাদের কলােনিতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সনের অনেক আগ থেকেই মিরপুরে বসতি গেড়ে বসা এই বিহারিরা স্থানীয় বাঙালিদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। কখনও কখনও লুটপাট চালাত ও বাঙালিদের সঙ্গে অনর্থক ঝগড়া বাঁধানাের পায়তারা করত। “৭১-এর ২৫ মার্চের কয়েকদিন আগ থেকেই মিরপুরে বাঙালিদের সাথে বিহারিরা দাঙ্গা বাঁধানাের চেষ্টা করে। এ সময় তাদের নির্বিচার বাঙালি হত্যা ও লুটতরাজ থেকে আমরা বুঝতে পারি বাড়িতে থাকা আমাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। তাই ২৪ মার্চ সকালে আমার পরিবার পরিজনকে নদীর ওপারে গ্রামে পাঠিয়ে দিই। “২৫ মার্চ দুপুর ১২ টার দিকে বিহারিরা আমার মিরপুরের বাড়ি আক্রমণ করে। ব্যাপক লুটপাটের পর তারা আমার বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। তখন আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। তাই ভেতর বাড়িতে দুটো বিশাল ধানের গােলা ও অনেক চাল মজুদ ছিল। ধান ভর্তি গােলা দুটিতে আগুন দিয়ে চাল, অন্যান্য মূল্যবান আসবাব পত্র ও টাকা পয়সা বিহারিরা লুট করে নিয়ে যায়। বিহারিদের এই লুটপাট ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কাছে আমরা খুবই অসহায় ছিলাম। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমি ও বাড়িতে অবস্থানরত আমার অন্য দু’ভাই কৌশলে বিহারিদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। ২৭ মার্চ বিহারিরা মিরপুরে হত্যা করে ইত্তেফাক’-এর সাংবাদিক আবু তালেবকে। তাকে নিজ ঘরের মধ্যে জবাই করা হয়। বি ব্লকের দুই নং রােডে অবস্থিত তার বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এ ব্লকের এভিনিউ ১-এর বাড়িটি ছিল অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমানের। বিহারিরা তার। বাড়িটিও লুট করে। তিনি তাদের হাতে মারাত্মক জখম হন। ২৬ তারিখে হত্যা করা হয় ডা. জয়নুদ্দিন, আব্দুল হাকিম, আসিরুদ্দিনের ছেলে বরকত প্রমুখকে। বরকত আলীকে তার স্ত্রী সন্তানসহ নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে জবাই করা হয়। তিনি আরাে জানান যে ‘৭০ নির্বাচনের পরও মিরপুরের অবাঙালিরা নানাভাবে বাঙালিদের উপর নির্যাতন করছিল। ‘৬৯ এর আন্দোলনের সময় পাকিস্তানিরা বিহারিদের হাতে কিছু অস্ত্র দিয়েছিল এমন তথ্যও রয়েছে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহায়তায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিহারিদের ব্যবহারের আরাে একটি উদাহরণ রয়েছে সৈয়দপুরের ঘটনায়। এ সময় তৎকালীন কায়েদ-ই আজম কলেজ বর্তমানে সৈয়দপুর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মােঃ হারিকুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ডিগ্রি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার হিসাবে কর্মরত ছিলাম এবং শহরের নতুন বাৰু পাড়ায় বসবাস করতাম। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ মধ্যরাতে লােকজনের করুণ আর্তনাদে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন দেখলাম যে সৈয়দপুর শহরের গােলাহাট বাঙালিপুরসহ অনেক মহল্লায় (এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না) দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং মানুষের করুণ আর্তনাদ শােনা যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে বিহারি অধ্যুষিত শহরের মতিন হাশমি (সৈয়দপুর কলেজের অধ্যাপক), এজহারুল হক (বিহারিদের নেতা) এবং অন্যান্য কয়েকজন বিহারির নেতৃত্বে তারা বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাচ্ছে এবং এর মধ্যে তারা কিছু বাঙালিকে হত্যাও করেছে। ভাের হলে দেখা গেল হাজার হাজার বিহারি বন্দুক, তলােয়ার, শরকী, দা ইত্যাদি মারণাস্ত্র নিয়ে দলবদ্ধভাবে উত্তেজক শ্লোগানসহ শহরের, বিশেষভাবে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ঘােরাফেরা করছে এবং নিরীহ বাঙালিদের উপর অত্যাচার করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্য ২৪ মার্চ সকাল বেলা সৈয়দপুর থানা আফিসে সর্বদলীয় (বাঙালি ও বিহারি সমম্বয়ে) একটি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু বিহারিদের অসহযােগিতার জন্য উক্ত সভায় কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য যে উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল র্যাংকের একজন কমানডিং অফিসার। উক্ত অফিসারের নির্দেশে বাঙালি নেতৃবৃন্দ ডা. জিকরুল হক (তখন কার এমপিএ), জনাব আবুল গফার (আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি), ডা. শামসুল হক (আওয়ামী লীগের সহসভাপতি) সহ বেশ কয়েকজন বাঙালি নেতৃবৃন্দকে থানায় আটক রাখে এবং পরে ডা. জিকরুল হক (এমপিএ), ডা. শামসুল হক এবং আর কয়েকজনকে নির্মমভাবে হত্যা জেনারেল টিক্কা ও তার সহকর্মীদের এই বীভৎস গণহত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র ২৫ মার্চের মধ্যরাতেই ঢাকা নগরীতে ঘুমন্ত ও হঠাৎ ঘুমভাঙা প্রায় সাত হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হন। ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত মাত্র আড়াই দিনেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তেরাে হাজার। ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা জেলায় নিহতদের সংখ্যা ত্রিশ হাজার পেরিয়ে যায় এবং যুদ্ধের ন’মাসে এই গণহত্যা কখনও থেমে থাকেনি।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ দেশের সেরা সব বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি আর্মি। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা ঘৃণ্য ভূমিকা রাখে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী অফিসার ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ব্রিগেডিয়ার বশির, ব্রিগেডিয়ার শরীফ, ব্রিগেডিয়ার শফি, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, ভিসি সাজ্জাদ হােসাইন, এবিএম খালেক মজুমদার, ডা, মােহর আলী, কমান্ডার আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। এদের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এ কাজে তাদের সহযােগিতা করে জেনারেল জাহানজেব আরবাব । এভাবে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়টি Crime Against Humanity of Murder এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে আচরণকে Crime Against Humanity of Inhumane Acts and Degradation-47 আওতায় পড়ে। এরপরে রয়েছে অসংখ্য মানুষের গুম ও Enforced Disappearance হবার তথ্য। একাত্তরে বাঙালি জাতিকে ঝাড়ে-মূলে চিরতরে নির্মূলের লক্ষ্যে উর্ধ্বতন পাকিস্তানি সমরনায়করা এবং তাদের অধস্তন সেনারা মানবতাবিরােধী যে অপরাধগুলাে করে তা হল –

১. ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র

নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, লুট ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা সাধন।

২. সামরিক পদক্ষেপ শুরুর পর গ্রামাঞ্চলগুলােতে তথাকথিত দুষ্কৃতকারী

দমনের নামে নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযােগ ও সাধারণের সম্পত্তির ধ্বংস

সাধন;

৩. শুধু সামরিক অভিযানের প্রথম দিকেই নয়, একাত্তরের ডিসেম্বরে যুদ্ধের

চূড়ান্ত পর্যায়ে বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীদেরকে

পরিকল্পিতভাবে হত্যা;

৪. ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যদের এবং ইস্ট পাকিস্তান

রাইফেলস ও পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করার সময় বা বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে তাঁদেরকে শঠতামূলকভাবে হত্যা করা এবং তাদেরকে Fair Trial এর সুযােগ না দেয়া;

৫. পাকিস্তানি আর্মি অফিসার ও সৈন্যদের দ্বারা প্রতিশােধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবং জাতির অহংকারকে ধ্বংস করবার জন্য সাড়ে চার লাখের বেশি বাঙালি নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং বহুসংখ্যক নারীকে হত্যা করা;

৬. যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধ শেষে অন্তত সাড়ে সাতশ’ বাঙালি নারীকে ভােগের | জন্য বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং বেশ্যালয়ে আটকে রাখা;

৭. নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং ব্যাপক গণহত্যা;

৮. অনেক নিরপরাধ নারী পুরুষকে আইন বহির্ভূতভাবে বন্দী করে নির্যাতন ও গুম করে ফেলা;

৯, সংখ্যালঘু হিন্দুদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন, জাতিগত নিধন ও

শুদ্ধি অভিযান। উল্লিখিত মানবতাবিরােধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও নারী নির্যাতন সংঘটনের দায়িত্ব। একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনারা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না। এ প্রেক্ষাপটে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্ট ছাড়াও পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি জেনারেল তাজাম্মল হােসেন মালিক বক্তব্য উল্লেখযােগ্য। তার দেয়া সাক্ষকারে পাকিস্তানি বাহিনীর অপরাধের প্রমাণ মেলে। তিনি বলেন”I took over the command of 205 Brigade on 17th of November 1971 and about 4 days later the Indians had started the attack on our position. During the period of my command, on one occasion, it was reported to me that one of my units 8 Baluch had captured about 8 civilians. The brigade headquarter was informed for their disposal. I was told that as a routine all such persons who were captured were to be shot without any investigation. I passed orders that in future no such shooting would take place unless I had seen them myself. When I visited the unit, they produced them before me. As I was meeting them, one of them fainted. The CO of that unit said, he is malingering. On further inquiry I found out that they were not in fact ‘mukris’ but were the local people working in the fields, grazing cattle. I ordered that they be released. I learnt through many other officers that during the earlier operations against the Mukti Bahinis thousands of innocent people were killed. In one of my defensive position at Santahar, large numbers of people were massacred. General Tikka Khan & Lieutenant General Jahanzeb Arbab had earned their reputation of being Butchers of East Pakistan. So were many other Brigadiers and Generals. Mukti Bahinis too, may also have done so in retaliation but it was very negligible as compared to the atrocities committed by the West Pakistani troops against the East Pakistanis.’

Maj Gen (Retd) Tajammal Hussain Malik Remembering Our Warriors; Defence Journal – August 2007 একাত্তরের গণহত্যাযজ্ঞ যে কতটা ব্যাপক, ভয়ঙ্কর ও পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ। পাওয়া যাবে পাকিবাহিনীর অসংখ্য গণহত্যা স্পটের কয়েকটি চিত্র দেখলেই। বাড়িয়া গণহত্যায় একই দিনে পাকি আর্মি হত্যা করে দুশ’জন নিরীহ গ্রামবাসীকে যাদের মধ্যে পঁয়তাল্লিশজন ছিলেন নারী। একইভাবে তারা ছাব্বিশাতে সাতজন নারীসহ চল্লিশজন, গােলাহাটে একশ’ জন নারীসহ চারশ’ তেরজন, বানিয়াচং থানার জিলুয়া-মাকালকান্দিতে ছাব্বিশজন নারীসহ একশ’জন, কড়াইকাদিপুরে ষাটজন নারীসহ তিনশ’ একষণিজন, হাতিয়া-দাগারকুঠিতে চল্লিশজন নারীসহ তিনশ’জন, সিলেটের বুরুঙ্গাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একশ’জন, শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে পঞ্চাশজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া খুলনার চুকনগর, বরিশালের আগৈলঝাড়া, মাদারিপুরের হাওলাদার জুট মিল, বরগুনা জেলখানা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ানসহ দেশব্যাপী অসংখ্য গণহত্যা স্পটের বিবরণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অম্বেষণ’ এবং ‘যুদ্ধ ও নারী। গ্রন্থে। ১৯৭১ সনে কিশােরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যার নৃশংসতার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে। বর্বরােচিত এই হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকারে পরিণত হন ৩৬৬ জন গ্রামবাসী, মারাত্মক আহত হন আরও ১৩৪ জন। এক সকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সহযােগী দালালরা প্রায় পনেরাে’শ পুরুষকে বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে জড়ো করে মিটিংয়ের নাম করে। তারপর এই লােকদের প্রায় অর্ধেককে উপস্থিত দালালরা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত ইত্যাদি বলে পাকিস্তানি আর্মির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট লোেকদের একজনের বাহু অন্যের সঙ্গে বেঁধে রেল লাইনের ওপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাতে একে একে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হয় প্রত্যেকের মাথা। এরপর মৃতদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এত কিছুর পরও যাদের দেহ একটু আধটু নড়াচড়া করছিল তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়। রাজশাহীর গুরুপ্রসাদ দাস জানিয়েছেন পাকি আর্মির নারী নির্যাতনের এক বর্বর ঘটনা। একাত্তর সনের একুশে এপ্রিল বুধবার দুপুর বারােটায় পাকিবাহিনী তেরােটি আর্মি। কনভয়যােগে পুঠিয়ার পাঁচআনী রাজবাড়ি মাঠে গিয়ে অবস্থান নেয়। ঐ গাড়ি বহরে মেজর শেরওয়ানীর গাড়িও ছিল। সে গাড়ি থেকে নেমে চারআনী রাজবাড়ির কমর বেগমের কাছে যায়। সেখান থেকে সে নিজে একটি গাড়ি চালিয়ে পুঠিয়ার পূর্বদিকে রামজীবনপুর মৌজার বাবু শ্রী অনিলেন্দ্র নাথ চৌধুরীর বাড়িতে যায়। চৌধুরী বাবুর তিন মেয়ে ও তিন ছেলে ছিল।

তার বড় দু’মেয়ের নাম ছিল রাধা ও নূপুর এবং ছােট মেয়েটির নাম ছিল স্বপ্ন। শেরওয়ানী বেলা আড়াইটার দিকে চৌধুরী বাবুর অনিন্দ্য সুন্দরী বড় দু’মেয়ে ও বড় ছেলে শঙ্কুকে জোরপূর্বক রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায়। সন্ধ্যা নাগাদ কে তারা ফেরত দিলেও দু’মেয়েকে ফেরত দেয়নি। মেজর শেরওয়ানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মেয়ে দুটিকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাঁদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ভয়ঙ্কর ধর্ষণের ফলে তারা হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলেন না। সেই রাতেই চৌধুরী বাবু ধর্ষিত দু’মেয়েকে নিয়ে ভারতের যাবার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা সবচেয়ে বর্বরােচিত এবং ল ণত্যা চালায় সৈয়দপুর শহরের কাছে গােলাহাটে। ১৩ জুন পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুরের ১৫০ জন লােককে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাদেরকে ভারতে পৌছে দেয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে নেয়া হয়। কৌশলে বন্দীদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও স্টেশনে আনা হয়। এই ফাঁকে চালানাে হয় নির্বিচার লুটপাট। ট্রনের চারটি বগির পেছনের দুটোতে উঠানাে হয় নারী ও শিশুদের এবং বাকি দুটোতে পুরুষদের। দু’কিলােমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। তারপরই রু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। একজন একজন করে নামানাে হয় আর খােলা তলােয়ারের কোপে দু’ধও করে ফেলা হয় তাদের দেহ। জানালা ভেঙে যাঁরা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। গােলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিন তেইশজন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের কেউ পালাতে পারেনি। উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে নারীদেরকে হত্যা করা হয়। ঐদিন গােলাহাটে পাকিবাহিনী ৪১৩ জনকে হত্যা করে। ছাব্বিশে মে বালাগঞ্জের বুরুঙ্গাতে সংঘটিত হয় আরেক নারকীয় গণহত্যা। শেরপুর থেকে ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে পাকি আমি এখানে আসে। তারা মিটিংয়ের নাম করে প্রায় একহাজার গ্রামবাসীকে স্থানীয় স্কুলমাঠে জড়াে করে। তাদের মধ্যে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, তাঁর ছােট ভাই ও বাবাও ছিলেন। শ্রীনিবাস চক্রবর্তী জানান, এদের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায়। একশ’জন নিরীহ লােককে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে ব্রাশ ফায়ার করে পাকিসেনারা। চোখের পলকেই মানুষের মাথা, দেহ, হাত-পা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর হাতে গুলি লাগে। এ সময় একটা একটা করে গুলি করছিল আর্মি। এর মধ্যে মরার মতাে পড়ে থেকে শ্রীনিবাস চক্রবর্তী অলৌকিকভাবে রক্ষা। পান। এরপর কেরােসিন ঢেলে মৃতবৎ সবার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলে যারা তখনও বেঁচে ছিল তারা আগুনের তাপে চিৎকার করে ওঠে। আর্মিরা তখনও মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে পারেনি। চিৎকারের শব্দ শুনে তারা ফিরে আসে এবং গুলি চালায়। এত সব কিছুর পর আমি কিছুদূর চলে গেলে মানুষ পানি পানি বলে চিৎকার করে ওঠে। তাতে আমি ফিরে এসে আবার গুলি চালায়। এ সময় একটা গুলি এসে লাগে শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর পিঠে। তারপরও ঈশ্বরের ইচ্ছায় শ্রীনিবাস গণহত্যা স্পট থেকে সরে যেতে সক্ষম হন।

ক্যাম্পে আটক নিরীহ নারীদের ওপর পাকিদের বর্বরতার বিবরণ পাওয়া যায় ঝিনাইদহের নাজিয়া খাতুনের জবানবন্দী থেকে। যুদ্ধের শুরুতে পাকিবাহিনীর আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়েন নাজিয়া খাতুন। শৈলকুপার রাণীনগরের কাছে পাকিদের এক ক্যাম্পে তিনি বন্দী হন। দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর ছিল সেই বন্দী জীবন। আলােবাতাসহীন ছােট একটা কক্ষের মধ্যে আরও মেয়েদের সঙ্গে তাকে থাকতে হত। কিল, ঘুষি, লাথি এসব ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এর পাশাপাশি চলত পাকিদের উন্মুক্ত পাশবিক নির্যাতন। এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নাজিয়াসহ অনেককেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গলায় দেবার দড়ি তাে দূরে থাক কাপড়টুকু পর্যন্ত তিনি পাননি। পাকিরা তাদেরকে কাপড় পরতে দিত না। ব্লাউজ, কামিজ এসব পরে থাকতে হত। ক্যাম্পে এভাবে নির্যাতনে নির্যাতনে তিনি একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। কিন্তু পাকিরা ওষুধ প্রয়ােগ করে। তার গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে দেয়। পাকিদের বীভৎস পাশবিক লালসা থেকে ন’বছরের শিশু সন্ধ্যাও রেহাই পায়নি। একাত্তরের জুন মাসে ঝালকাঠির কুড়িয়ানা আক্রমণ করে পাকিরা। সন্ধ্যা তার মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ছুটে পালাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁরা সবাই ধরা পড়ে আটক হন কুড়িয়ানা স্কুলে পাকিদের ক্যাম্পে। তারা চারদিন ঐ ক্যাম্পে আটক ছিলেন। কিন্তু পাকিদের নির্মম নির্যাতন থেকে কেউই রক্ষা পাননি। ঐ জানােয়াররা শিশু সন্ধ্যার ওপর এমন বীভৎস নির্যাতন চালিয়েছিল যে, কষ্ট, যন্ত্রণা আর বিরামহীন রক্তপাতে সে নির্জীব ও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। এর ক’দিন পরে সে মারা যায়। একাত্তরে বরগুনা জেলখানায় পাকিদের নির্যাতনে পিষ্ট এক নারী মালতি রাণী রায়। সেসময় তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। তিনি জানান, বর্বর পাকিরা কারাগারের অভ্যন্তরে আটক সকল মহিলাকে পালাক্রমে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করেছে। প্রতিরাতে আটক মহিলাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে কয়েকজনকে বের করে পাকিদের প্রমােদ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলােতে নিয়ে যেত। সারারাত ধর্ষণ নির্যাতন শেষে পরদিন সকালে তাদেরকে জেলখানাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। মালতি রাণী যেদিন পাকিদের হাতে ধরা পড়েন ঐদিনই মধ্যরাতে তারা তাকেসহ চারজন মহিলাকে পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলােতে নিয়ে যায়। সেখানে চারজন পাকি আর্মি তাদের। চারজনের ওপর সারারাত পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাকিরা ধর্ষণের আগে তাদেরকে ভয় দেখিয়েছে, বুকের ওপর বন্দুক তাক করে ধরেছে। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। এই চারজনের একজন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা।

নির্যাতনের তিন চারদিন পরে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। এ নির্যাতনের নেতৃত্ব দেয় মেজর নাদের পারভেজ। যুদ্ধের ন’মাস পাকিরা যে কতভাবে আমাদের নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তা ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলাে বিশ্লেষণ না করলে বােঝা যাবে না। শহর ও গ্রামের যুবতী নারীদেরকে এরা কখনও বন্দী করে নিয়ে গেছে নিজেদের ক্যাম্পে ও বাঙ্কারে। দিনের পর দিন সেখানে তাদেরকে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে, ইচ্ছে মতাে সম্ভোগ করেছে। তাদের ঘাঁটি ও ক্যাম্পের আশপাশের অনেককে বাধ্য করেছে দিনের পর দিন তাদের কাছে হাজিরা দিতে। কখনও স্বামীহারা মেয়েদেরকে তারা নির্দেশ দিয়েছে নিজ ঘরে থাকবার জন্য, পাহারার ব্যবস্থা করেছে যাতে তারা পালিয়ে যেতে পারে অন্য কোথাও। এরপর এসব মেয়েদের কাউকে কাউকে পাকিদের সম্মিলিত সম্ভোগের জন্য যৌনকর্মীর মতাে ব্যবহার করেছে। এইসব নারীদেরকে অসংখ্য পাকি আর্মি সম্লোগ করেছে, ইচ্ছে মতাে তাদেরকে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে গেছে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরিয়েছে। ক্যাম্পের পরিবর্তন হলে তাদেরকে সাথে নিয়ে গেছে পরবর্তী গন্তব্যে। গণহত্যা ও নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধসহ প্রায় পনেরাে রকম মানবতাবিরােধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মাটিতে। নারী, শিশু ও সাধারণ জনগণের উপর ঘটে যাওয়া ঐসব ঘৃণ্য অপরাধের একটিও জাতিসংঘ, মানবাধিকার হাইকমিশন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলাে কর্তৃক সত্যিকার অর্থে বিশ্লেষিত হয়নি। ‘৭১ এ যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময় নির্যাতিত জনগণ তাদের জীবনের অধিকার প্রসঙ্গে কোন প্রতিকার পায়নি। এরপরও বিচারহীনতার নীরবতা একদিন ভাঙবেই এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলাে বিচারের আলােতে আসবে এমন স্বপ্ন দেখছি। সেই সাথে আশা প্রকাশ করছি যে, সময়ােচিত সিদ্ধান্তের অভাবে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রয়ােগে ব্যর্থতার কারণে কোন জাতি বা গােষ্ঠীর জীবনের অধিকার ও মর্যাদার অধিকারসহ সামগ্রিক মানবাধিকার যেন পৃথিবীর কোন দেশে লজ্জিত না হয়। যুদ্ধ, সংঘাত এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থায় সকল দেশ, জাতি, গােষ্ঠী, বর্ণের জন্য। মানবাধিকার আইনগুলি অর্থবহ হােক এটা আমাদের প্রত্যাশা। মানবাধিকার আইনগুলাে ঘােষণা, প্রতিশ্রুতি এবং বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি পর্ব থেকে যথাযথ প্রয়ােগ পর্যায়ে নেমে আসুক এমন প্রার্থনা করে সর্বজনীন মানবাধিকারের বিজয় ঘােষণা করছি। জয় হােক মানব সভ্যতার এবং শুভ স্বপ্নের। তারিখ: ১০ ডিসেম্বর ২০০৫.

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!