You dont have javascript enabled! Please enable it!

জামায়াতের দৃষ্টিতে পীর-মুরিদী

ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে শরীয়তভিত্তিক আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা বা পীর-মুরিদীর ধারা যুগ যুগ থেকে চলে আসছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়েও নির্দ্বিধায় বলা চলে, এ হচ্ছে বাস্তব ইতিহাস একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীতে অস্ত্রবলে ইসলাম বিস্তার লাভ করেনি। সূফী-সাধক, আওলিয়া-দরবেশ ও পীর-মাশায়েখদের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচারপ্রসার হয়েছে। বিশেষ করে, উপমহাদেশে তারাই এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। এক্ষেত্রে কোনাে মুসলিম রাজা-বাদশাহ কিংবা তথাকথিত স্বঘােষিত ইসলামিক ভাষ্যকারের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা বা অবদান নেই বললেই চলে। পীর-ফকির নামধারী দু’চারজনের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কথা থাকলেও সবার বিরুদ্ধে এবং সুফিবাদ সম্পর্কে ঢালাও সমালােচনা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। কিন্তু মওদুদী সাহেব আধ্যাত্মিক শিক্ষা-দীক্ষার এই ঐতিহাসিক ধারার বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “অনৈসলামিক বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার আক্রমণ থেকে ওলামা, মাশায়েখ, পীর-দরবেশ এবং মােত্তাকী-পরহেজগার কারাে রেহাই মেলেনি। পরিণামে এই হয়েছে যে, তাদের মধ্যে বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার ব্যাধি সংক্রামক আকারে বিস্তার লাভ করেছে।” “বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “এর ভিত্তিতে এক বিশেষ ধরনের জীবন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এর বিভিন্ন রূপজ্জবৈদিক মত, মানবতাবাদ, সম্মােহন, যােগ, তাসাউফ, খৃষ্টীয় সন্ন্যাসবাদ এবং বৌদ্ধ মত প্রভৃতি নামে খ্যাত।” (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দীন, ২৩ পৃঃ-মওদুদী) একই গ্রন্থের অপর এক স্থানে তিনি বলেছেন, “তরীকতের মাধ্যমে মুসলমানদের আফিম খাওয়ানাে হয়। তাতে তাদেরকে অচেতন, অকেজো ও অকর্মণ্য করে দেয়া হয়।” (পূর্ববৎ, ৪২ পৃঃ)। তিনি আরাে বলেছেন, “বায়য়াত বা মুরীদ হওয়ার পর তরীকতের পীর ও মুশরিক বা অংশীবাদীদের দেবতার মধ্যে কোনাে পার্থক্য থাকে। ।”(ঐ, ১৩২ পৃঃ)

এভাবে মওদুদী সাহেব তার তাসাওফ সম্পর্কিত লেখায় পীর-মুরীদ ও অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে বহু আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। আমরা পূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করেছি, পবিত্র ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে মওদুদী অসংখ্য স্ববিরােধী উক্তি করেছেন। একই বিষয়কে পবিত্র ইসলামের নামে একবার জায়েজ আবার নাজায়েজ বলেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রমটি করেননি। পীর-মুরিদী ও তাসাওফ সম্পর্কে উপরে উল্লিখিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গুলাে মওদুদী সাহেবের পরিণত জীবনের। কিন্তু তার আগে তিনি এ সম্পর্কে অনেকটা প্রচলিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। প্রথম জীবনে, বিশেষ করে তিরিশের দশকে মওদুদী সাহেব তাসাওফের ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইসলামী তাসাওফ শরীয়ত থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়, বরং শরীয়তের বিধানগুলােকে সর্বাধিক আন্তরিকতা ও সৎ সংকল্প সহকারে পালন করা এবং আনুগত্যের ভিতরে আল্লাহর প্রেম ও ভীতির মনােভাব সঞ্চয় করার নামই হচ্ছে তাসাওফ।” (রাসায়েলে দ্বীনিয়াত, বাংলা সংস্করণ, ইসলাম পরিচিতি, ১৬৭ পৃঃ) পাঠকদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, পরবর্তী জীবনে মওদুদী সাহেব পীর-মুরিদীর উপর এরূপ ক্ষেপে গেলেন কেন? পীর-মুরিদীকে কেন তিনি দেব-দেবীর পূজার সাথে মিলিয়ে দিলেন? এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা মওদুদী সাহেবের অনুসারী জামায়াতিরা কি দেবেন জানি না। তবে আমাদের নিকট এর জবাব অত্যন্ত সহজ। প্রথম জীবনে মওদুদী সাহেব পীর-মুরিদীকে তার চলার পথে, উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে কোনােরূপ বাধা মনে করেননি। তাই তিনি তাসাওফ সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে দেখেন, উপমহাদেশের প্রায় সব মুসলমানই কোনাে না কোনাে পীর-মাশায়েখের। মুরীদ বা অনুসারী। আর মুসলমানদের এই সামাজিক পরিবেশ পবিত্র ইসলামের নামে তার তথাকথিত জামায়াতের প্রচার-প্রসারের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। জামায়াতের প্রচার-প্রসারের পথের এই বাধা সরানাের লক্ষ্যে তিনি তাসাওফ ও পীর-মাশায়েখদের বিরুদ্ধে কলমা জেহাদ ঘােষণা করেন। তাদেরকে তিনি দেব-দেবীর কাতারে নিয়ে দাড় করান। এজন্যই আমরা বলে আসছি, পবিত্র ইসলাম হচ্ছে মওদুদী সাহেব ও তার অনুসারী জামায়াতিদের একটা হাতিয়ার, একটা মুখােশমাত্র। এই হাতিয়ার তারা যখন যেভাবে প্রয়ােজন প্রয়ােগ করছেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে বহু পীর-মাশায়েখ রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কারাে কারাে ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা কয়েক লাখ রয়েছে। কিন্তু একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তাদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া কেউই ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ জামায়াত সম্পর্কে কোনাে কথা বলছেন না। আমরা এদেশের পীর-মাশায়েখদের অনুরােধ করবাে, আপনারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকান। আমাদের সাথে একমত হবেন, প্রকাশ্য শত্রু বা বিরােধীরা মুসলমানদের যতাে না ক্ষতি করেছে, পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী বাতিল ফেরকাগুলাে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি করেছে। এজন্যই আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে। মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করেছেন। পীরমাশায়েখদের প্রতি আবেদন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালার কঠোর শাস্তি ঘােষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। বাতিল ফেরকা জামায়াত সম্পর্কে মুখ খুলুন। এদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের নিকট, বিশেষ করে আপনাদের নিজ নিজ ভক্ত ও মুরীদদের সামনে জামায়াতের আসল চেহারা তুলে ধরুন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই দায়িত্ব আপনারা এড়াতে পারেন না। এটা আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। 

সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!