রাজাকার-আলবদর বাহিনী
শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্য একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীও গড়ে তােলে। ৯৬ জন জামায়াত কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার খান জাহান আলী রােডের আনসার ক্যাম্পে ‘৭১ সালের মে মাসে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি গঠন করেন জামায়াত নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর এই সশস্ত্র বাহিনী হত্যা, নির্যাতন এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পাক হানাদার বাহিনীর কেবল তল্পীবাহক হিসেবেই কাজ করেনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অত্যাচার হানাদার বাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ ঘটিয়েছিলাে। শক্রকবলিত বাংলাদেশের একটি পরিবারও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা এই রাজাকারদের হত্যা, লুণ্ঠন এবং নির্যাতনের শিকার হননি। জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার অল্পদিনের মধ্যেই আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত করে। পাক সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে কার্যকর সহযােগিতা প্রদানে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তােলার জন্য এদের এক থেকে তিন-চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণের সরকারী ব্যবস্থা করা হতাে। সাধারণত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তাদের সশস্ত্র করা হতাে। রাজাকাররাও তাদের দেশপ্রেমের সরকারী স্বীকৃতি পেতে থাকে। সিলেট সফরকালে ৮ জুলাই জেনারেল নিয়াজী ‘দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাজাকারদের প্রশংসা করেন। ১১ আগস্ট রংপুরে গভর্নর টিক্কা খান একই সুরে বলেন, “রাজাকাররাও দুষ্কৃতকারীদের হামলার মুখে নিজ নিজ এলাকা রক্ষা এবং সেতু ও কালভার্ট পাহারা দিয়ে বিশেষ দরকারী ভূমিকা পালন করছে।’ ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ট্রেনিং গ্রহণরত রাজাকারদের পরিদর্শনকালে জেনারেল নিয়াজী তাদের মনােবল ও উৎসাহের প্রশংসা করেন। জামায়াতে ইসলামী রাজাকার বাহিনীর প্রশ্নেও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে। ১ সেপ্টেম্বর করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােলাম আযম ‘পাকিস্তান রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাক সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
গােলাম আযম বলে ‘কোনাে ভাল মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিছিন্নতাবাদীদের নির্মল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। নিহত রাজাকার রশীদ মিনহাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গােলাম আযম বলেন, এই আত্মত্যাগের নিদর্শন থেকে তরুণরা উপকৃত হতে পারবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর, ’৭১) ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার হােটেল এম্পায়ার’-এ এক জামায়াতী সমাবেশে গােলাম আযম শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার কথা উল্লেখ করে বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।” গােলাম আযম বলেন, জামায়াতের কর্মীরা। শাহাদাত বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করতে রাজী নয়।’ গােলাম আযম আরাে বলেন, “সারা দেশ সামরিক বাহিনীর পূর্ণ। নিয়ন্ত্রণে আসার পরও যে কয়েক হাজার লােক শহীদ হয়েছেন, তাদের। অধিকাংশই জামায়াতের কর্মী।” (ঐ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ৭১)। রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওলানা ইউসুফ ১১ অক্টোবর খুলনার জেলা স্কুল মিলনায়তনে এক রাজাকার সমাবেশে ‘দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের কার্যকলাপ দমনের জন্য রাজাকারদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। (ঐ, ১২ অক্টোবর, ‘৭১) স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযােগ্য অপর এক প্রচেষ্টা ছিলাে আলবদর নামের সশস্ত্র খুনী বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। বদর বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে। প্রথম দিকে নেতৃত্বে ছিল তকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম। পাক দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশে জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে।
বদর বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন গােলাম আযম এর প্রকাশ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে। ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিযামী (সারা পাকিস্তান প্রধান), বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ (প্রাদেশিক প্রধান), মীর কাশেম আলী (তৃতীয় নেতা) এবং জামায়াত নেতা মােহাম্মদ কামরুজ্জামান (প্রধান সংগঠক)। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম’ও সে সময় বদর বাহিনীকে উত্তেজিত করা শুরু করেছিলাে। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘আলবদর শিরােনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘সংগ্রাম’ লিখেছ, “আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুস্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুস্কৃতকারীদের কাছে। আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।” ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসাস্থ বদর বাহিনী ক্যাম্পের এক সমাবেশে বদর বাহিনী প্রধান মতিউর রহমান নিযামী ২৩ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন, “যারা ইসলামকে ভালােবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালােবাসে। এবারে উদ্ঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।” বদর দিবসের সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে বদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মতিউর রহমান নিযামী ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে লেখেন, “….বদর যােদ্ধাদের যেসব গুণাবলীর কথা আমরা আলােচনা করেছি, আলবদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ্ সেসব গুণাবলী আমরা। দেখতে পাবাে। …সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পযুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উডডীন করবে।” স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত শত শত প্রতিবেদনে বদর বাহিনীর নৃশংসতার এক ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। এই চিত্র হিটলারের। গেস্টাপাে, ভিয়েতনামের মাইলাই কিংবা লেবাননে প্যালেস্টাইনীদের সাবরা শাতিলা শিবিরের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও হাজার গুণ ভয়াবহ।
সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত