You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য নগ্নভাবে উন্মােচিত হয়ে পড়ে - সংগ্রামের নোটবুক

জামায়াতের স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী নিধন অভিযান শুরু করলে জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য নগ্নভাবে উন্মােচিত হয়ে পড়ে। নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ৪ এপ্রিল প্রথম সুযােগেই খুনী জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গােলাম আযম ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। দু’দিন পর ৬ এপ্রিল গােলাম আযম পৃথকভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে আবার দেখা করেন। এই বৈঠকে অন্য দালালদের মতাে গােলাম আযম স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।” (দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ‘৭১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অংকুরেই ধ্বংস করার পাশবিক প্রক্রিয়ায় সহযােগিতা দানের উদ্দেশ্যে ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটিতে জামায়াতে ইসলামী প্রধান ভূমিকা রাখে। এরপর ১৫ এপ্রিল গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির তিন নম্বর সদস্য মনােনীত হন গােলাম আযম। আহ্বায়ক ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দিন। (দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ এপ্রিল,৭১) এপ্রিলেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি তার স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে। জামায়াতে ইসলামী এর নেতৃত্ব দখল করে। জামায়াতের দালালরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে গ্রামে গ্রামে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাে। মানুষের গরু-খাসিসহ অর্থ-সম্পদ লুট করতাে, মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতাে, নারী নির্যাতনেও সহায়তা করতাে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলােতে খুনী জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে জামায়াতে ইসলামী। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এক সিম্পােজিয়ামে গােলাম আযম বলেন, “কিন্তু এবার পাকিস্তানের ভেতরে হাজারাে দুশমন সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবারের সংকট কঠিন। কারণ বাইরের দুশমনের চেয়ে ঘরে ঘরে যেসব দুশমন রয়েছে তারা অনেক বেশি বিপজ্জনক।”

এর চারদিন পরের বিবৃতিতে বােঝা যায়, গােলাম আযম মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর কি পরিমাণ রুষ্ট ছিলেন। ১৮ আগস্ট লাহােরে তিনি বলেন, “ভারত দুষ্কৃতকারীদের (‘৭১ সালে পাকিস্তানের ভাষায় মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন দুস্কৃতকারী) সাহায্য করছে। তাই পাকিস্তানের উচিত কালবিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।” স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ২৩ আগস্ট গােলাম আযম লাহােরে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারে।” ৩১ আগস্ট গােলাম আযম হায়দরাবাদের এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে গােলাম আযম বলেন, ‘বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত ও সরকার কর্তৃক বহাল ঘােষিত ৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই পাকিস্তানে নেই। তিনি বলেন, ‘বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়ােজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক ও ইসলামপ্রিয় লােকজনের হাত শক্তিশালী করা। এসব লােক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। এবং ‘দুষ্কৃতকারীদের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ ও ‘বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে পূর্ণ সহযােগিতা দান করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম দেশকে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্যে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’ পরদিন গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষণা করা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়ার দাবি জানান। তিনি এ প্রসঙ্গে ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, ওয়ালী খান ন্যাপের পূর্ব পাকিস্ত নি শাখার নাম উল্লেখ করেন। তাঁর মতে এসব দলের সদস্যরা এখনাে পূর্ব পাকিস্তানে গােপন তৎপরতা চালাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশার ভাব সৃষ্টি করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম বলেন, ” কোনাে ভাল মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে

তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ২২ নভেম্বর গােলাম আযম পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। গােলাম আযম দীর্ঘ সাত বছর পর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন ‘৭৮ সালের ১১ জুলাই। ২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে এবং তা পবিত্র মাতৃভূমির এক ইঞ্চি জমিও ভারতকে দখল করে নিতে দেবে না।  ‘ ২ ও ৩ ডিসেম্বর গােলাম আযম সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এপিপির খবরে লাহাের থেকে বলা হয়, ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহােরে ফিরে এসে গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনাে তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আযম বলেন, পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যে অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা উচিত।’ এ পর্যন্ত উপস্থাপিত তথ্য ও ঘটনাবলীর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী কেবল বিরােধী অবস্থানই নেয়নি, একে সমূলে নস্যাতের জন্যও দলটির প্রচেষ্টা ছিলাে সর্বাত্মক। স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন না করাটা অন্যায় হলেও মারাত্মক অপরাধ নয় সত্য, কিন্তু একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী তার ভূমিকাকে এমনিতর নীতিগত প্রশ্নেই শুধু সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইতিহাসের পর্যালােচনা বরং এই সত্যই তুলে ধরে যে, বিরােধিতার নামে স্বাধীনতা সংগ্রামকে নির্মূল করার চেষ্টার পাশাপাশি নৃশংসতার সাথে জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের উৎখাতেরও ভয়ংকর কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতিরা এগােতে শুরু করেছিলাে। এজন্যই তারা রাজাকার ও বদর বাহিনী তৈরি করেছে, শান্তি কমিটিতে যােগদানসহ সর্বতােভাবে সমর্থন ও সহযােগিতা দিয়েছে পাকিস্তানের খুনী সেনাবাহিনীকে। বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষিত বাঙ্গালী মাত্রকেই হত্যা করার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং মন্ত্রিত্বের সুযােগ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগও ছিলাে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই উদ্ভাবিত। শােষণ ও শাসনের স্থায়ী পদানত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার যে প্রক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলে আসছিলাে, ইসলাম এবং মুসলিম জাতীয়তার নামে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার উদ্ধত পদক্ষেপ নিয়েছিলাে। বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিনাশ ছিলাে জামায়াতের সকল আয়ােজনের উদ্দেশ্য। বাঙ্গালীর জাতিগত ঠিকানা এবং স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই জামায়াতিরা অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করে। তাদের নৃশংসতা এমনকি পাক হানাদার বাহিনীকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে।

সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত