You dont have javascript enabled! Please enable it! নারী অধিকারের প্রতি জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি - সংগ্রামের নোটবুক

মহিলাদের অধিকার ও জামায়াত

জামায়াতিরা সব সময় প্রচার করে বেড়ায়, দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করাই তাদের চরম ও পরম লক্ষ্য। কিন্তু তাদের এ প্রচারণা ও কর্মধারায় কোনাে সাদৃশ্য নেই বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মূলত তাদের নীতি বলতে কিছুই নেই। সময় ও সুযােগ বুঝে তারা যেকোনাে রূপ ধারণ করতে পারে। তবে এই পরিবর্তনে একটা বিষয় লক্ষণীয় হলাে, ইসলামী মুখােশটা সব সময় ও অবস্থায় তাদের মুখে থাকে। এটা ভুলেও কোনাে সময় তারা ছাড়ে না। ধর্মের তথাকথিত ছদ্মাবরণেই তারা সব সময় বাজিমাৎ করার চেষ্টা করে। আমাদের এ দাবির একাধিক প্রমাণ আপনারা পেছনে দেখতে পেয়েছেন। এ ধরনের আর একটা দৃষ্টান্ত হলাে, পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেবার মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থিনীর সপক্ষে তারা যে অভিনয় করেছে তা পূর্ববর্তী সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মওলানা মওদুদী ১৯৬৫ সালের নির্বাচনের কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তাঁর একাধিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বলে এসেছেন মহিলা সমাজকে রাজনীতিতে টেনে আনা, আইন পরিষদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া, এমনকি কোনাে দায়িত্বপূর্ণ সরকারী পদে নিয়ােগ করাও ইসলামের মূলনীতি বিরােধী। তিনি বলতেন, এটা পাশ্চাত্য জগতের অন্ধ অনুকরণ বই কিছু নয়। মওলানা বলেছেন, “আইন পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া হলাে পাশ্চাত্য জাতিসমূহের অন্ধ অনুকরণ। ইসলামের। নীতিমালা এর এতটুকু অনুমতি দেয় না। ইসলামের রাজনীতি ও দেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব কেবলমাত্র পুরুষের উপরই ন্যস্ত। এসব দায়িত্ব। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রের বাইরে।” (দস্তুরী তাজাবি-মওদুদী)। তিনি বলেছেন, “পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও এ কথার কী অবকাশ আছে যে, মুসলিম মহিলারা কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস্য হবে? ঘরের বাইরে সামাজিক তৎপরতায় দৌড়াদৌড়ি করবে, সরকারী দফতরে পুরুষের সাথে কাজ করবে, কলেজগুলােতে ছেলেদের সাথে শিক্ষাগ্রহণ করবে, পুরুষদের হাসপাতালে নার্সিংয়ের দায়িত্ব পালন করবে, বিমান ও রেলকারে যাত্রীদের মনােরঞ্জনে ব্যবহৃত হবে এবং শিক্ষাদীক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা-ইংল্যান্ড যাবে?” (তাফহিমুল কোরআন, ৪৬ পৃষ্ঠা-মওদুদী) । উপরােক্ত উদ্ধৃতি দুটোর প্রথমটি তাে একেবারে স্পষ্ট। তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়ােজন।

দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি মওলানা মওদুদী রচিত তাফহিমুল কোরআন থেকে সংকলিত। তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, “মহিলাদের কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস হওয়া, ঘরের বাইরে সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা, পুরুষের সাথে চাকরি করা, সহশিক্ষা, নার্সিং প্রভৃতি ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের এসব। ব্যাপারে অংশ নেয়ার কোনাে অবকাশ নেই।” এ হলাে সকল মুসলিম মহিলার অধিকার সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা অভিমত। মহিলাদের ব্যাপারে মওলানার বিভিন্ন গ্রন্থে এ ধরনের আরাে বহু উদ্ধৃতি রয়েছে। ১৯৬৪ সালে মিস ফাতিমা জিন্নার মনােনয়ন লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ ছিলাে মহিলাদের সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে জামায়াতে ইসলামী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যফ্রন্টে যােগদান করে। জামায়াতে ইসলামী প্রমাদ গােনে, ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধী দলীয় প্রার্থিনী মিস ফাতেমা জিন্না হবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তাতে করে জামায়াতে ইসলামীও ক্ষমতার বখড়া লাভ করবে। নিছক ক্ষমতার লােভে সেবার জামায়াতে ইসলামী মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থিনীকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই নয়, মিস। ফাতেমা জিন্নার সপক্ষে জামায়াতে ইসলামীর পুরাে মিশনারী নিয়ােগ করা হয়। এরূপে মওলানা মওদুদী অতীতে মহিলাদের ব্যাপারে যেসব ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে আসছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান। মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার তিনি যে কোরআনের দোহাই পেড়ে হরণ করার প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন, ক্ষমতার মােহে সে কোরআনের নামেই মওলানা পুনরায় মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হওয়ার সপক্ষে প্রচারণা চালান।

১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনী প্রচারণায় মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামায়াত মিস ফাতেমা জিন্নার সমর্থনে যেসব বিবৃতি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংক্ষেপে এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। তিনি বলেছেন, “মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে নির্বাচন করায় এ ছাড়া কোনাে অসুবিধা নেই যে, তিনি একজন মহিলা। এদিক ছাড়া আর সব গুণাবলীই তাঁর মধ্যে রয়েছে যা একজন যােগ্য রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থীর জন্য বলা হয়েছে।” (সাপ্তাহিক শেহাব, ১১ অক্টোবর, ‘৬৪) “মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে কোনােই বাধ্যবাধকতা নেই। মহিলার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা কিংবা হজ করা অবৈধ বলাও অন্যায়।” (শেহাব, ১৮ই অক্টোবর, ‘৬৪) “আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থী মাদারে মিল্লাত মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের চাইতে হাজার গুণ উত্তম।” (নাওয়ায়ে ওয়াকত, ২৪ ডিসেম্বর, ‘৬৪)। “বর্তমান অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বিরােধী দলগুলাের পক্ষ থেকে মিস ফাতেমা জিন্নার পরিবর্তে যদি কোনাে ন্যায়নিষ্ঠ ও খােদাভীরু পুরুষকে রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেয়া হতাে তবে তা হতাে পাপ। কাজ।” (শেহাব, ১ জানুয়ারি, ‘৬৫) “জনসাধারণের এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা উচিত নয় যে, যদি তাদের অবহেলার দরুন তাদের প্রতিনিধিরা ভুল সিদ্ধান্ত করে (মিস ফাতেমা জিন্নাকে রাষ্ট্রপ্রধান মনােনীত না করে তবে খােদাও তাদের প্রতি অনুগ্রহ। প্রদর্শন করবেন না।”

(এশিয়া, ২৭ ডিসেম্বর, ‘৬৪)। “আমাদের উপর ফরজ হলাে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে বর্তমান সরকারকে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতাচ্যুত করা। আল্লাহ্ তায়ালাও এর চাইতে সুবর্ণ সুযােগ আর দান করতে পারেন না।” (নাওয়ায়ে ওয়াকত, ২৬ অক্টোবর, ‘৬৪) এসব হলাে মওলানা মওদুদীর উক্তি। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি মিস ফাতিমা জিন্নার সপক্ষে এসব বলেছিলেন। চিন্তা করুন, স্বার্থসিদ্ধির মােহে মওলানা মওদুদী ও তার দল জামায়াত কাহাতক গিয়ে পৌছে! যদি অন্য কারাে মুখ থেকে এরূপ উক্তি বেরুতাে তাহলে সবার আগে এই মওলানাই তাকে কাফের ফতােয়া দিতেন। অপরদিকে মওলানা মওদুদী ১৯৬৪ সালে ফাতেমা জিন্নাহকে বিরােধী দলের তরফ থেকে মনােনয়ন দানের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া দূরে থাক, মহিলাদের সাধারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দানেরও বিরােধিতা করেছেন। তিনি একে কোরআন-সুন্নাহ বিরােধী ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছেন। মওলানা মওদুদীর অনুসারী বাংলাদেশের জামায়াতীরাও বর্তমানে মহিলা নেতৃত্বের সাথে জোট করেছেন, একসাথে পােস্টার ছেপেছেন। ষড়যন্ত্র করে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে, জামায়াতীরা যে মুখে দীর্ঘদিন যাবত এসব উক্তি করেছিলেন, স্বার্থ হাসিলের মােহে সে মুখ দিয়েই এগুলাের বিপরীত কাজ করছেন । এর পরেও কারাে পক্ষে বিশ্বাস করা কি সম্ভব, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন। এবং ইসলামই তাদের দলের একমাত্র আদর্শ !

সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত