You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.28 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | তাজউদ্দীনের পদত্যাগ | কনফারেন্স লাইনের একপেশে সিদ্ধান্ত | সত্তুর কোটি অপুষ্ট শিশু | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৮শে অক্টোবর, সোমবার, ১৯৭৪, ১০ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

তাজউদ্দীনের পদত্যাগ

গত ২৬শে অক্টোবর অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদ থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ঐদিন সকালে মন্ত্রীপরিষদের এক অনির্ধারিত স্বল্পকালীন বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থমন্ত্রীকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পদত্যাগ করতে বলেন। জনাব তাজউদ্দীন উক্ত নির্দেশ মেনে নেন এবং অপরাহ্নে রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদউল্লাহ তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। আপাতঃ দৃষ্টিতে বিষয়টি নাটকীয় ও আকস্মিক বলে প্রতীয়মান হলেও জনাব তাজউদ্দীনের ক্ষমতা থেকে পতনকে আমরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করি না। দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জনাব তাজউদ্দীন তাঁর পদত্যাগের তারিখটিকে অত্যন্ত পবিত্র দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার জনৈক ভাষ্যকার এই ঘটনাকে রুশ-ভারত অক্ষশক্তির প্রভাব বলয়ের একটি স্তম্ভের পতন বলে চিত্রিত করতে চেয়েছেন এবং আভাস দিয়েছেন জনাব তাজউদ্দীনের মন্ত্রীসভা থেকে নিষ্ক্রমণ মিঃ কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের সাথে সম্পৃক্ত। এ থেকে বোঝা যায় জনাব তাজউদ্দীন নিজে এবং আরো কিছু কিছু মহল অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের গুরুত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করবেন। শাসকদলের পক্ষ থেকে অপরিপক্ক কথাবার্তা বলে কেউ এদের ফাঁদে পা দেবেন না এটাই আমরা কামনা করি।
কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সূর্যশক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের চেতনার আলোকরশ্মি ঐ মূল শক্তিতে কেন্দ্রীভূত। দেশ-বিদেশের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সমর্থন বা বিরোধিতা তাঁকে ঘিরেই। অন্য সবকিছু এই প্রজ্জ্বলিত অগ্নিনেতৃত্বের কাছে তুচ্ছ। ঐ মহা সূর্যশক্তির আলো যখন কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের, এমনকি দুষ্টগ্রহের উপর পতিত হয় তখন তাকে মাঝে মাঝে বা কিছুক্ষণের জন্য উজ্জ্বল বলে মনে হয়। রশ্মিটা প্রত্যাহার করা হলে বা আলোকমন্ডলের বাইরে চলে গেলে গ্রহগুলো অমাবস্যার চাঁদের মতো আঁধারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। কারণ গ্রহের নিজস্ব কোনো তাপ বা আলো থাকার কথা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির এই বাস্তবতা অগ্রাহ্য করা কারো পক্ষেই সঙ্গত হবে না।

কনফারেন্স লাইনের একপেশে সিদ্ধান্ত

কনফারেন্স লাইন দীর্ঘদিন ধরেই জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছিলেন। জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর কথা যখনই উচ্চারিত হয়েছে, তখনই বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিল জানিয়েছেন প্রতিবাদ। কিন্তু এই প্রতিবাদের প্রতি কনফারেন্স লাইন তেমন কর্ণপাত করেননি। বলতে গেলে কনফারেন্স লাইন এবার পাকা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। সিদ্ধান্তানুযায়ী আগামী জানুয়ারী মাস থেকে কনফারেন্স লাইনের জাহাজ ভাড়া শতকরা বারো ভাগ বাড়বে। যদি কনফারেন্স লাইনের জাহাজ ভাড়া এইভাবে বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানী বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিল অন্যান্য বারের মতো এবারও সোচ্চার হয়েছেন, গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে কনফারেন্স লাইন যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন, তা একরৈখিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই একতরফা সিদ্ধান্তের যাঁতাকলে শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের অন্য দু’টি দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের রপ্তানী বাণিজ্যও হেস্তনেস্ত হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের রপ্তানী বাণিজ্য যাতে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতার কবলে পড়ে হেনস্তা না হয়, সেদিকে কনফারেন্স লাইন কর্তৃপক্ষের শুভদৃষ্টি দিয়ে জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই ছিল যৌক্তিক। কিন্তু কনফারেন্স লাইন জাহাজ ভাড়া বাড়াতে গিয়ে যৌক্তিক-অযৌক্তিকতার ছায়া বড়ো একটা মাড়াননি, অর্থাগমের প্রশ্নটিকেই বড়ো করে দেখেছেন। বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কনফারেন্স লাইনের জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তটিকে ‘অন্যায়’ অযৌক্তিক ও অসঙ্গত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সত্যিই তো, কনফারেন্স লাইনের আচরণ বিধি সংক্রান্ত যে নীতিমালা জেনেভায় সম্পাদিত হয়েছে, কনফারেন্স লাইন জাহাজ ভাড়া বাড়িয়ে সেই সম্পাদিত নীতিমালাকে অবলীলাক্রমে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছেন। এতে করে বোঝা যাচ্ছে, কনফারেন্স লাইন কর্তৃপক্ষ ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার উপর গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের একগুয়েমিকেই দিয়েছেন প্রশ্রয়। আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও কনফারেন্স লাইনের এই ‘এক চক্ষু হরিণে’র নীতিকে আমরা আমাদের রপ্তানী বাণিজ্যের স্বার্থের পরিপন্থী বলেই মনে করছি। কনফারেন্স লাইনের চেয়ারম্যান মিঃ হাডসন বলেছিলেন, পারস্পরিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কনফারেন্স লাইন জাহাজ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরী করবেন না। কিন্তু কার্যতঃ মিঃ হাডসনের কথারও কোনো দাম রইলো না। মনে হচ্ছে, তিনি তাঁর কথার বরখেলাপ করে একপেশে সিদ্ধান্তকেই জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এ ধরনের একপেশে সিদ্ধান্তে শুধু সমস্যাই বাড়বে—সমাধানের পথ অন্ধকারের মাথা কুটে মরবে। তাই আমরা আশা করি, কনফারেন্স লাইন হুট করে জাহাজ ভাড়া না বাড়িয়ে শিপার্স কাউন্সিলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছলে উদ্ভূত পরিস্থিতির মীমাংসা সম্ভব।

সত্তুর কোটি অপুষ্ট শিশু

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডিরেক্টর ডাঃ ফ্রানসিসকো জে. ডাই সম্প্রতি ম্যানিলায় বলেছেন, প্রায় ৭০ কোটি ৪ বছর বয়স পর্যন্ত এশীয় শিশু বর্তমানে মারাত্মক রকম আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। ৯০ ভাগই আবার ভুগছে শারীরিক চাহিদায় লৌহ ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতায়। শতকরা ২০ ভাগ প্রসূতি ও মাতাও ঐ একই কারণে রক্তাল্পতা রোগে আক্রান্ত। এবং এশীয় জনসংখ্যায় শুধু মা বা শিশুই নয় বহু মানুষও অপুষ্টিতে আক্রান্ত এবং রুগ্ন। ডাঃ জে. ডাই প্রদত্ত তথ্যে আরও বলা হয় যে, আমেরিকার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৫ বছরের নীচে যে সব শিশু মারা যায় তাদের শতকরা ৫০ ভাগ শিশুই প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত থাকে।
এশিয়াবাসীদের জন্য এই তথ্যপূর্ণ সংবাদ মর্মান্তিক। কিন্তু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই পৃথিবীতে বাঁচতে হয়। তাই এ কথা ঔপনিবেশিক শাসনে চূড়ান্ত রকমে পিষ্ট এই মহাদেশের বর্তমান অবস্থা আমাদের কাছে দুঃখজনক হলেও হতাশাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে এদেশ থেকে যে হাত গুটাতে হয়েছে তার পেছনে যেমন ছিল অকপট ও অক্লান্ত সংগ্রাম তেমনি আগামী দিনে এশিয়াবাসীর সংগ্রাম হবে পুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে। সে সংক্রামক হতে হবে অধিকতর কষ্টকর ও নিখাদ। এশিয়ার অধিকাংশ দেশ আজও শিল্পায়িত নয়। কৃষিভিত্তিক তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো। তাই মাটি কর্ষণ করে ভালো ভালো সোনা ফলাতে পারলে উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোর চেহারা যে বদলে যাবে সে কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তাই ক্ষেতজোড়া ধান, নদ-নদী-পুকুর-ডোবা ভরা মাছ, খামার ভর্তি গো-মহিষাদি সহ গৃহপালিত জীবজন্তুর চাষ যদি এশিয়াবাসী করতে পারে—তাহলে আমিষ জাতীয় খাদ্য সহ শর্করা জাতীয় খাদ্যের ঘাটতি অনেকাংশে কমবে। পেটের ধান্দায় নির্ভরশীলতার অনিশ্চয়তা পাবে হ্রাস। এবং অপুষ্টির ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে এশিয়ার কোটি কোটি নিষ্পাপ অমৃতের সন্তান। হয়তো এ কাজ একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু অপুষ্টির অভিশাপগ্রস্ত রুগ্ন মানব শিশুর বোঝার ভয়াবহতা সম্বন্ধে আজ এশীয় দেশগুলো একেবারে উদাসীন নয়। উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোর উন্নতি ও প্রগতির পথ পরিক্রমায় তার প্রকাশ ঘটছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সম্প্রসারণে বিশ্বব্যাপী যে আন্তঃদেশীয় আত্মীয়তা ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছে—এশিয়ার প্রায় ৭০ কোটি অপুষ্ট শিশুর জন্য সেখানে কোনো মানবিক চিন্তার অবকাশ নাই কি? খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশগুলো সহ মোটামুটি স্বয়ম্ভর দেশগুলোরও এ ব্যাপারে মানবিক দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি। তাই বৃহত্তর চেতনায় এশিয়ার কোটি কোটি অপুষ্ট শিশু আজ সমগ্র বিশ্বেরই বোঝা। ইচ্ছে থাকলেও এ দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণ পাবার যো নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন