You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই জুন, রোববার, ১লা আষাঢ়, ১৩৮১

কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে

ন’ই এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কাল সতেরই জুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন। আবাসিক ছাত্র ছাত্রীরা যাতে নির্ভয়ে ফিরে আসতে পারে সেজন্য প্রহরার নাকি বন্দোবস্ত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯ দফা নিয়মরীতি বেঁধে দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এখন থেকে নেই নকল নিয়ম-নীতি কড়াকড়িভাবে শিক্ষার্থীদের মেনে চলতে হবে এ নিয়ম-রীতি আগেও ছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মানতে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য করতে পারেননি। বর্তমান অবস্থায় সেই নিয়মরীতি আবার নতুন করে ঘোষণা করে তারা কতটুকু সফল হবেন তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বলতে পারেন।
ন’ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল আর সেইসঙ্গে আবাসিক ছাত্রদের উপর নোটিশ জারি করা হয়েছিল ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে। দুই মাসেরও বেশি সময় ছাত্রাবাস এবং আশপাশের এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ বিভিন্ন সময় হানা দিয়ে বেআইনি অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। যে নিশংস হত্যাকাণ্ড পাঁচ দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ। খুব শিগগিরই তা আদালতে উঠবে। অথচ এত কিছুর পরও ছাত্র-ছাত্রীদের মনে কেমন ভয় ভয় ভাব। পড়তে এসে জীবন হারানোর আশঙ্কায় এখনও সবার মন থেকে দূর হয়নি।
কেন এমন হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গন যে খোকা-পাঁচ পান্ডুর দল একসময় কলুষিত করেছিল তারাও তো আর নেই। একটা রণতরী সংগ্রামের পর স্বাধীনতা অর্জন করে তো আমরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ এ ওয়াদা করেছিলাম। এক সময়ের আদর্শবাদী ছাত্র যুব কর্তা মনীষীরাই ত আজ বিশ্ববিদ্যালয় জাঁকিয়ে বসে আছেন। তাদের কথা নির্দেশই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিখিত আইন। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলো না। নিহত হলো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বেশ ক’জন তরুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল চেতনার প্রতীক। বহিঃর্বিশ্বে তার একটা মর্যাদা ছিল। এই পবিত্র বিদ্যাপীঠকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাতো বাইরের মনীষীরাও। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কেমন করে ‘সুরক্ষিত একটা বদ্ধভূমি’ হয়ে দাঁড়ালো? একাত্তরের পঁচিশে মার্চ যারা পশুর মত এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের প্রেতাত্মারা কি আজব ঘুরে বেড়ায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে?
৪ঠা এপ্রিলের গভীর রাতে সাত সাতজন তরুণ নৃশংসভাবে নিহত হবার পর ৮ই এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড ছোড়া হল কলাভবনে। একজন ছাত্রী আহত হলেন। তারপর ৯ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শিক্ষকরা বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নেই। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হলেন। আর সমগ্র জাতি মাথানত করল। ছাত্রাবাসের কক্ষ থেকে বের হলো আগ্রেয়াস্ত্র, গাঁজার কলকে।
প্রহরা বসিয়ে আর কিছু নিয়ম-রীতি বেঁধে কি সেই শিক্ষার পরিবেশ আবার ফিরিয়ে আনা যাবে? গত উনিশ মাস যে ভুলের পুনরাবৃত্তি বারবার হয়ে এসেছে তা কি আর হবে না? ছাত্র নামধারী ক্রিমিনালরা কি আবার আস্তানা গাড়বে না ছাত্রাবাসগুলোতে? রাজনীতির নামে আবার ভন্ডামি আর সন্ত্রাস চালানোর নিরব সম্মতি কি বীরবলরা জানাবেন না?
শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিষ ঢুকানো হয়েছে তা গত উনিশ মাসে রাতারাতি তা থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় আমাদের নেই। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপরওয়ালাদের আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা। এটা যতদিন তাদের আসবে না ততদিন প্রহরী লাগিয়ে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যাবে না। ইতিমধ্যে প্রায় একটা জেনারেশন খতম হতে চলেছে। নেপথ্য নায়কদের আসল উদ্দেশ্যও যদি এই জেনারেশন খতম হয়ে থাকে তবে তাতে তারা সফল হয়েছেন পুরোপুরি। এখন জাতির ভবিষ্যৎটা যদি কোনো রকমে মাটির ওপর দাঁড় করানোর এতোটুকু ইচ্ছে কর্তাব্যক্তিদের থেকে থাকে তবে আগাগোড়া অবস্থাটা পর্যালোচনা করে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় সামরিক স্থূল স্বার্থবুদ্ধি একসময় বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে।

মিশর-মার্কিন যুক্ত ইশতেহার

মধ্যপ্রাচ্যের পালাবদলের সংগীত শোনা যাচ্ছে। এ সংগীতের নেপথ্যে শিল্পী হচ্ছেন মার্কিন মুল্লুক এর বর্তমান নিক্সন সরকার। তিয়াত্তরের অক্টোবরে আরব ইসরাইল সংঘর্ষের সূত্রপাত হবার পর হাওয়া বদলে গিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে আরব দেশগুলোর সাফ জবাব ছিল-(এখনো যে নেই তা নয়) যে ইসরাইলকে সাহায্য সমর্থনকারী দেশ গুলোকে তেল সরবরাহ করা হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামও ছিল সে তালিকায়।
তৈলাস্ত্রের হুমকিতে অবশ্য ত্রাহি মধুসূদন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়েছিল খাদ্যশস্য সরবরাহ বন্ধ করার ইত্যাদি ইত্যাদি। হুমকি আর পাল্টা হুমকি জোর খানিকটা বিঘ্নিত হবার পর শুরু হল আলাপ-আলোচনা। শলা পরামর্শ। যাতে সাপও মা মরে লাঠিও না ভাঙ্গে তেমন একটা কিছুর সন্ধান করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ছুটলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। সংঘর্ষরত দু’পক্ষকেই চাপ প্রয়োগ করা হল। যুদ্ধ বন্ধ হল সাময়িকভাবে কিন্তু সিরিয়া বসে থাকল না। গোলাম মরুভূমিতে সংঘর্ষ চলতেই থাকল। আবার শুরু হল আলোচনা পর্ব। তারপর যুদ্ধবিরতি চুক্তি।
স্পষ্টতই বোঝা গেল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর যাইহোক বর্তমানে আরব দেশগুলোকে ঘাটাতে চান না। তার কারণও অনেক। একদিকে বাইরে আঘাত অপরদিকে ভেতরের আঘাত। দুয়ে মিলে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম।
মুদ্রাস্ফীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে এখনো ব্যয় না বেশি দূর। সুতরাং ইসরাইলকে যেমন একদিকে বাঘ মানাতে হবে অন্যদিকে তেমনি আরব দেশগুলোর সঙ্গেও সৌহার্দ্য স্থাপন করতে হবে-অন্যথায় তুলে মূলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মিশর সফরে আসতে হয়েছে। মিসর থেকে জেদ্দা তিনি ইতিমধ্যেই চলে গেছেন। সেখানে বাদশাহ ফয়সালের সাথেও আলাপ-আলোচনা করবেন।
মিশরে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দু’দিনব্যাপী সফর শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত ইস্তেহারে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিশরের অর্থনীতি পুর্ণগঠনে সুদূরপ্রসারী সাহায্য কর্মসূচি গ্রহণে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে কায়রো সরকারের কাছে মার্কিন আণবিক চুল্লি বিক্রির সম্ভাবনাও রয়েছে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র মিঃ জিগলার বলেছেন যে, যুক্ত ইশতেহারে প্যালেস্টাইন প্রশ্নের শর্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বাদ দেয়া হয়েছে।
যুক্তিতে মার্কিন আনবিক সাহায্যের ভিত্তিতে মিশরের অস্ত্র তৈরি করা সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। যুক্ত বিরতিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রেসিডেন্ট সাদাত ১৯৭৩ সালের ২রা অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ৩৩৮ নং প্রস্তাবের ভিত্তিতে অবিরাম আলোচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট সাদাত যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তিনি এ বছরেই যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মধ্যপ্রাচ্য সফর এর কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং সেখানে কোন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কিনা তা আপাততঃ বলা দুরূহ ব্যাপার। তবে এটা ঠিক যে, মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশ নিক্সন-সাদাত এর বর্তমান ঘনিষ্ঠতাকে একটু বাঁকা চোখে দেখতে পারেন। যুক্ত ইশতেহারে যখন প্যালেস্টাইন প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তখন তেমন সম্ভাবনা নেই তা নয়। তবে এটা সত্য কথা যে, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রুতা বলে কোন শব্দ নেই। সময় ও ঘটনার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে। সেই দিক থেকে যদি বিচার করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, মিশর ও অন্যান্য আরব দেশগুলোর জন্য ইসরাইলই হচ্ছে একমাত্র বিষফোঁড়া। ইসরাইলের যুদ্ধ মানসিকতা পরিবর্তন না হলে সবসময়ই শঙ্কিত থাকতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভাবনাচিন্তাকে বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকতে হবে। এবং তা যে হচ্ছে বর্তমান মিশরী তার প্রমাণ। প্রেসিডেন্ট নাসিরের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট সাদাত এর পক্ষে সম্ভব হয়নি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামানো। বারবার মিশরীয় জনসাধারণকে আশ্বাস দিতে হয়েছে এবারের যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ। এমনই একটা জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে তো কোন জাতি বা দেশ টিকে থাকতে পারে না। সে দিক থেকে বিচার করতে গেলে প্রেসিডেন্ট সাদাত এর বর্তমান উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কেননা ঘরে-বাইরে সংকটে জর্জরিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন তখনই তিনি সেই উদ্যোগ সাদরে গ্রহণ করেছেন। এটা কারো অজানা নয় যে, ইসরাইলের খুঁটির জোরই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই খুঁটি যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে অথবা একপাশে হেলে পড়ে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইলের গলার জোরও নামবে। তাই প্রেসিডেন্ট সাদাত সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করেই মার্কিন সাহায্য গ্রহণে এগিয়ে এসেছেন। এটা ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে তার জবাব দিতে পারে অনাগত ভবিষ্যৎ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!