You dont have javascript enabled! Please enable it!

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ আর সিদ্দিকীর সাক্ষাতকার

* জনাব সিদ্দিকী, আপনি একাত্তরের ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? ** কিছুদিন আগেও আমি মাসিক ডিফেন্স জার্নাল পত্রিকার প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক ছিলাম। এ পত্রিকার কাজ আমি ১৯৭৫-এ শুরু করি। ২২ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। তারপর আরেকজনের হাতে এর দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়েছি। পত্রিকায় এখনাে আমার নাম ছাপা হয়, যদিও পত্রিকার কাজের সাথে আমার যােগাযােগ নেই। আমি সম্প্রতি কিছুকাল ধরে একটা ইনস্টিটিউটে কাজ করছি। এই ইনস্টিটিউটের নাম “রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স (আরআইপিএসএ)। এ প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি, কল্যাণ-যুদ্ধ নয়। আমি গুরুত্বহীন ও গতানুগতিক কোনাে বিষয়ে নিয়ােজিত থাকতে চাই না। আমি শান্তিপূর্ণ সব কাজে ও উদ্দেশ্যে নিয়ােজিত থাকতে চাই। আমি পাকিস্তান ও ভারত-এ দু দেশের ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। আমি মনে করি, সকল অমীমাংসিত সমস্যার ইতিবাচক নিষ্পত্তির জন্য তাদেরকে আলােচনায় বসতে হবে, দেখতে হবে কী কী কারণে তাদেরকে যুদ্ধে যেতে হয়েছে। এটা যত শিগগির হয় ততই ভালাে। কেননা, সমস্যার বােঝা দীর্ঘকাল বহন করার সাধ্য দুই দেশের কোনাে দেশেরই নেই। আর সামরিক ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার মত হলাে, যে প্রতিরক্ষা সাধ্যের মধ্যে নেই, সেই প্রতিরক্ষাই সম্ভবত উত্তম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষুন্ন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত হতে পারে না। এসব বিষয় নিয়েই আমি কাজ করছি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে, কারণ আমি সেখানে ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলাম।

* আপনার কর্মদায়িত্ব কী কী ছিল? 

** আমি সেনা সদর দফতরে নিয়ােজিত ছিলাম আন্তঃবাহিনী জনসংযোেগ দফতরের পরিচালক হিসেবে। আর সে হিসেবে আমি জনকল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই বিভাগটিকে যথাসাধ্য, সুপরামর্শ দিয়েছি। আমি নীতিনির্ধারক মহলের খুব কাছে থাকলেও নীতিনির্ধারণী সেলের কোনাে অংশ ছিলাম না। বরং আমি ছিলাম দর্শক মাত্র। একাত্তরের ২৫ মার্চ আমি ছিলাম ঢাকায় ১৬ মার্চ আমাকে ঢাকায় সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য রিপাের্ট করতে হয়। ওটা ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ১৫ মার্চ ঢাকা সফরের পরের দিন। ১ এপ্রিল অবধি থাকার পর আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসি। আর সে কারণে খুব কাছে থেকে অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করার সুযােগ আমার হয়েছে, প্রত্যক্ষ করেছি নীতিনির্ধারক হিসেবে নয়-পর্যবেক্ষক হিসেবে । ২৫ মার্চের রাতে কী ঘটেছে তা প্রকৃত অর্থে দেখেছি, শুনেছিও। ওখানকার মহল্লাগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় চারদিক থেকে। আমি শহরেও গিয়েছি। খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। এখানে আমি ও আমার লােকেরা পূর্ব পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী রিপাের্ট কভার করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তান সফরে মাঝে মাঝেযেতে হতাে। নিয়াজিওঁ পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে রিপাের্ট করেছিলেন। তবে তা আমার জন্য প্রীতিকর ছিল না। কিন্তু তিনি ঐ কাজটি করেছিলেন। সম্ভবত আমি অন্য কারও তুলনায় সবচেয়ে বেশি ঘন ঘন ঢাকা সফরে গিয়েছি। আমি পরিস্থিতি যতটা সম্ভব ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছি। সেই সময়কার অভিজ্ঞতায় নিয়াজীর কার্যকলাপে আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি এ কথা তাকে আমি বলেছি। এ নিয়ে বারবারই তার সাথে আমার কথা হয়েছে। ১ অক্টোবর তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। তখন যে কোনাে সাধারণ লােকেরও না বুঝতে পারার কথা নয় যে, সব কিছুই প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের সেনাবাহিনী ছিল, আর সে সেনাবাহিনী এসপার-ওসপার লড়াই করতে পারত আর সে লড়াই হতাে আখেরী জং। কেননা আমাদের বাহিনীর সব সৈন্য ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-তারা আদৌ কেন্দ্রীভূত ছিল না। জেনারেল নিয়াজী ছিলেন এক নিরেট নির্বোধ। তাকে আমি একথা বলে তার প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছি। কেননা, তাকে আরাে কটু ভাষায় সম্বােধন করলেও তা অযৌক্তিক হতাে না। নির্বোধ নিয়াজীর ধারণা ছিল, পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় রয়েছে। আর সেই সুবাদে তার ধারণা ছিল, ৫/৬ মাইলের মতাে পরিমিত এলাকায় তিনি এক নিরাপত্তা বেষ্টনী, প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে পারবেন। তাঁর সাথে সেই আমার শেষ দেখা।

* তারপরে…না ঠিক আছে, চমৎকার! আমি শুধু আপনাকে কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছি।

** তারপর আমি রাওয়ালপিন্ডি সেনাবাহিনী সদর দফতরে ফিরে আসি। আমার ধারণা, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তারপর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। এরপর ২১/২২ নভেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে।

* নভেম্বর?

** একাত্তরের নভেম্বর। তারা আক্রমণ করে-আমি এ কথাগুলি এভাবে। ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছি। প্রকৃত ঘটনাও ছিল তাই। ওরা সে সময় সাতটি 

ফ্রন্টে পূর্ব পাকিস্তানে সকল দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। সে ছিল ঈদের পরের দিন। আমরা ভেবেছিলাম যে, ইসরাইয়েল যেমন ঈদ-উল-ফিতরের কাছাকাছি সময়ে শেষ রমজানে মিসরের ওপর সামরিক হামলা চালায়, তারা সেই ইসরাইয়েলী কৌশলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে। সে সময় অবশ্য প্রথমে হামলার উদ্যোগ নেয় মিসর। আমাদের বেলায় ভারতীয়রাই আক্রমণ করে, আমরা নই । আমাদের সেনারা যেদিন ঈদ করছে, ঠিক তার পরদিনই শুরু হয় ভারতের আক্রমণ। আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপর দৈনিক ব্রিফিং দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি পূর্ব পাকিস্তানের মুখপাত্র। সময় যখন এভাবে এগিয়ে চলেছে তখন আমরা আশা করেছিলাম, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সেনা সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে রণাঙ্গন আরাে প্রসারিত করে এ পরিস্থিতি। মােকাবিলায় সাড়া দেবেন। তেহরানে ইরানী রাজবংশের ২৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যােগ দেবার উদ্দেশ্যে ১১ অক্টোবর রওনা হবার আগে তিনি। বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে সামগ্রিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আক্রমণ হলেও সামগ্রিক কোনাে যুদ্ধ হলাে না। আমার ওপর দায়িত্ব। পড়ল পত্রপত্রিকা তথা গণযােগাযােগ মাধ্যম ও বহু বিদেশী সংবাদদাতাকে দিনে এক বা দু’বার করে ঐ আক্রমণ বিষয়ে ব্রিফ করার। তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তেমন একটা খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাকে যুদ্ধ সম্পর্কে সামরিক ‘সিচ্যুয়েশন রিপাের্ট যা কিছু করা হচ্ছিল সেগুলির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল। বেশি করে। আসলে এসব সিচ্যুয়েশন রিপাের্ট ছিল অসার-কোনাে কাজেরই নয়। এসব রিপাের্টে ছিল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রং চড়ানাে। এতে অনেক কিছু কাল্পনিক, অলীক । এর মতলব ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ গড়ে তােলা…।

* কিন্তু এই কাজটি করেছিল কে? ** কে আবার, নিয়াজী। তিনিই তাে ছিলেন কমান্ডার, অধিনায়ক।

* তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি যেসব ব্রিফিং দিয়েছিলেন তা আসলে ছিল…?

** সিচ্যুয়েশন রিপাের্টের ভিত্তিতে। * অধিকাংশই তাহলে সেনাবাহিনীর বিচ্যুয়েশন রিপাের্ট ** হ্যাঁ, কেননা এগুলিই ছিল একমাত্র তথ্যসূত্র। * আর আপনার ধারণায় যেগুলি ছিল অতিরঞ্জিত? ** শুধু অতিরঞ্জিতই নয়…..

* ‘৭১ সালে যুদ্ধের সময় আপনি সশস্ত্র বাহিনীর ব্রিফিং নিয়ে যে সকল ‘রিপাের্ট করতেন, তা কেবল অতিরঞ্জিত ছিল না, ছিল মিথ্যাও?

** সেগুলি ছিল অসার, অকেজো। আসলে রণাঙ্গনের বাস্তবতা এতে প্রতিফলিত হয়নি বরং নানা কারণে কমান্ডার তার মানসনেত্রে কি হেরিতেছেন সেটির গাঁজানি ছিল। আর তা ছাড়া তিনি গােমর ফাঁক করতেও চাননি এসব রিপাের্টে। একদিন ঐ বিষয়ে চিফ অব স্টাফ আমাকে বললেন, সেটি ৩ নভেম্বরের পর আর ততদিনে সার্বিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, রিপাের্টে পরিস্থিতি সাজানাে হয়েছে শুধুমাত্র ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে । অথচ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এভাবে ক্ষয়ক্ষতি, হতাহতের উল্লেখে আসলে সেনা মনােবল ভাঙছিল মাত্র। বিষয়টি নিরেট নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। তাই যুদ্ধ যখন চলছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে একটা অচলাবস্থা দেখা দেয়, যা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। আমরা পাল্টা চাপ সৃষ্টিমূলক একটা অপারেশন পরিচালনা করছিলাম। কিন্তু যেভাবে আমাদের জবাব দেবার কথা সে রকম কিছু ঘটেনি। অথচ ঐ জবাবের নেপথ্যের মূল প্রেরণাটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা। এজন্য দরকার ছিল আরাে বড় বড় আয়ােজন ও প্রয়াসের। কিন্তু বাস্তবায়িত করা যে কারণেই হােক তা হয়নি। আর সে কারণটা আপনি জানতে চাইতেই পারেন। যা হােক, আমরা তা করিনি। আমরা শুধু চেষ্টা করছিলাম লাহাের, রিসালপুরের মতাে জায়গায়  সুবিধাজনক অবস্থানগুলিকে মজবুত ও নিরাপদ রাখতে। কিন্তু আক্রমণাত্মক বড় রকমের কোনাে সেনা অভিযান করা হয়নি, নামানাে হয়নি রিজার্ভ বাহিনীকেও ফলে যা হবার তাই হয়।

যুদ্ধের ৩য় ও ৪র্থ দিনে এখানে আমাদের দিকে যুদ্ধ এগিয়ে না এলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে খবর আসতে থাকে যে, ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে আসছে, চলে আসছে ঢাকার কাছে  কখন কী খবর পড়া হচ্ছিল তা আপনাদের ভালােভাবেই জানা। ওরা তখন এগিয়ে আসছে প্রধান সড়ক ও অন্যান্য বড় রাজপথ ধরে নয়, অপ্রধান গৌণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি ধরে ওরা প্রধান প্রধান রাজপথ ও শহরগুলি এড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের প্রতিরক্ষার প্রধান ঘাঁটিগুলি এভাবেই পদানত করে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম একমাত্র যশাের। যশাের দুর্গের পতন হয় ৭ ডিসেম্বর। এ ক্ষেত্রেই শুধু আক্রমণের লক্ষ্য সরাসরি দখল করে ভারতীয় বাহিনী এবং তা সবার চোখের সামনে। তারা সিলেটকে এড়িয়ে আসে, কুমিল্লাকে পাশ কাটিয়ে আসে। আর আমরা তখন ছিলাম, আমাদের ভাষায় আমাদের প্রতিরক্ষার কেল্লাগুলিতে ভারতীয় বাহিনী কখন আমাদের ওপর চড়াও হবে আর আমরা তাদের ওপর কখন ঝাঁপিয়ে পড়ৰ তারই ইন্তেজার করছিলাম সেখানে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! কি বলব আমি আপনাদেরকে! এ রকম বলিহারি চমৎকার প্রস্তুতি আর হয় না! আমাদের তরফে সমন্বিত কমান্ড বা বুদ্ধিদীপ্ত কমান্ডের অভাব বেশি, এটা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! এখানে অসাধারণ মেধার অধিনায়কের ইচ্ছাশক্তি, মনােবল-না, এমন কিছুর বালাই ছিল না।

* আরে কী যে বলেন, উনি তাে অত্যন্ত বড় বড় খেতাবখচিত জেনারেল ! তাহলে…। মানে আমি বলতে চাইছি…তা হলাে ব্যাপারটা, কী বলে আপনার ধারণা? | ** ভালােই বলেছেন বটে। আমি বলি কি, ওখানে একটা জিনিসই ছিল যাকে মহাসম্মানে ভূষিত করা উচিত। তবে ওটা এক ব্যাপার, আর একজন ভালাে কমান্ডার হওয়া একেবারেই ভিন্ন বিষয়। জেনারেল (নিয়াজী) ছিলেন মেজর বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিংবা বড়জোর ব্রিগেডিয়ার স্তরের একজন ভালাে অফিসার। কেন্দ্রীয় বা মূল অধিনায়কের কোনাে যােগ্যতা, আর যা-ই হােক, তার ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ও এর আগে ‘৬৫-র যুদ্ধে-উভয় যুদ্ধে সেভাবেই তার দরদাম যাচাই হয়েছে। হয়েছে আবার একাত্তরের যুদ্ধেও…। তাই আপনার জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দিতে গেলে আমাকে বলতেই হচ্ছে, এ ধরনের কলঙ্কজনক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তিনি উত্তম অধিনায়কের ভূমিকাভিনয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা, তার অত উঁচু স্তরের মেধা ও উল্কর্ষ ছিল না।

* দৈনন্দিন অসামরিক পরিস্থিতির ওপর রিপাের্ট দেয়াও কি তাঁর দায়িত্ব ছিল?

** না, যুদ্ধের নয়। আসলে পূর্ব পাকিস্তানের অসামরিক প্রশাসন। চালানাের দায়িত্বও ছিল সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের ওপর।

* আর আপনার কাজ ছিল খবরের কাগজের লােকজন, বিদেশী যােগাযােগের মাধ্যম ইত্যাদিকে দৈনিক এই বলে ‘ব্রিফ করা যে, বিলকুল ঠিক হ্যায়, সব কিছু স্বাভাবিক। তাহলে সেই স্বাভাবিকতা কতটুকু স্বাভাবিক ছিল তখন জনাব?

** কোনাে কিছুই তখন স্বাভাবিক ছিল না। উল্টো পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক ছিল তখন।

* কিন্তু আপনাকে তাে রিপাের্ট করতে হচ্ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক।

** না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক এমন রিপাের্ট আমরা করছিলাম না। বরং পৃথিবীর অন্য যে কোনাে জায়গায় যুদ্ধের রিপাের্ট যেমন করা হয়, সেভাবেই যুদ্ধ সম্পর্কিত রিপাের্ট করছিলাম।

* কথাটা ঠিক হলাে না। যুদ্ধ শুরু হয়েছে আরাে পরে। আমি তাে ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি।

** ঠিক ধরেছেন, আসলে আমি টিক্কা খান সম্পর্কে এ যাবত আদৌ কিছু উল্লেখ করেনি। টিক্কা খানই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করেছিলেন। সি-ইনসি’র তরফে ইয়াহিয়া খান তখনকার অপারেশন কমান্ডার জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের সাথে সলাপরামর্শ করে এ অপারেশনের সব কিছু ঠিক করেছিলেন। হ্যা, আসলে এ বিষয়গুলিও আলােচনার দরকার। আমি এখন সে আলােচনাতেই আসছি। | ২৫ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিলের মধ্যে যুদ্ধ (অপারেশন সার্চলাইট) যখন শুরু হয় তখন কী ঘটে সে ব্যাখ্যার বর্ণনা এখন আমি আপনাদের দেব। তার আগে এ সবের একটা পটভূমি দেয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যখন জেনারেল অরােরার কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন কী ঘটে আমি তার বিবরণ দেব। ….১১ ডিসেম্বর আমি প্রেস ব্রিফিং করছিলাম। আমার ওপরওয়ালা সিজিএস লে. জেনারেল গুল হাসান খান আমাকে এ কথা জানিয়ে দেন : ‘পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সব খেল তাে খতম! কাজেই তােমার এখন একটা কিছু করে ফেলাই ভালাে। তবে এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়টি সত্যিই এক বড় রকমের শক বা আঘাতের মতাে। আমি নিজে কথাটি শুনে স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ধরুন, আমার কোনাে অতি ঘনিষ্ঠজন শুয়ে আছেন মৃত্যুশয্যায়। আপনি জানেন, মৃত্যু নিশ্চিত। শুধু সময়ের অপেক্ষা, তবু…তবু যখন ঘটনাটি আসলে ঘটে, আর কেউ এসে জানায়, সব শেষ। খুব বড় শক্ সেটি…নয় কি? পূর্ব পাকিস্তানের সাথে আমি অনেকখানি জড়িয়ে ছিলাম । আর সে সম্পর্ক স্পর্শকাতর নয় ঠিকই, তবে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল অন্যত্র। এখনাে আমার বন্ধু স্বজন রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। বাস্তবিকই আমার পরিবার…পরিবারের একটা অংশ রয়েছে। সেখানে। আমি সেখানে দীর্ঘকাল না থাকলেও আমার আত্মীয়দের সেখানে বড় ব্যবসা ছিল। আপনি মনে হয় জনাব এহসান আলীর নাম শুনেছেন, তিনি। আমার শ্বশুর। তাই আজও পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঢের বেশি। তাই আমার মনে হতাে, পূর্ব পাকিস্তানে এই যে এত কিছু ঘটে গেল, এসব এড়ানাে যেত, এমনকি পাকিস্তানের দুই অংশের বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য হলেও  আর সে ব্যবচ্ছেদ অস্ত্রে ও হিংসায় না করে আলােচনার টেবিলে করাই বাঞ্ছিত ছিল।

* বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে আপনি কি সংক্ষেপে কিছু বলতে পারেন। আমাদেরকে?

** আপনারা যা জানেন তার বেশি কিছু আমার জানা নেই। এর।

সিংহভাগ আমাদের কিংবদন্তি। আমি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর হত্যা ও তার কথাবার্তা শুনেছি বটে। তবে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। সে সময়টায় আমি ওখানে ছিলাম না, কোনাে তথ্যও বিস্তারিত আমার জানা নেই।

* আপনি তখন ঢাকায় ছিলেন না? ** আমি ছিলাম না। * তা-ই? ** আমি তাে বলেছি, কোনাে সংস্রবের অবকাশ ঘটেনি আমার । * কে এর পরিকল্পনাকারী? কী করে এসব ঘটে বলে আপনি মনে করেন?

** কে এসব পরিকল্পনা করে থাকতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে এর দায়িত্ব কমান্ডারের। নাটের গুরু আমার কাছে একজনকে মনে হয়-তবে এও বলি, প্রমাণ করতে পারব না আমি।

* না, মানে আপনি অনুমানের কথাই…

** আমার ধারণা ফরমান আলিই সেই ব্যক্তি। কেননা ফরমান সেই ব্যক্তি যার ওপর কর্তৃপক্ষের আস্থা ছিল সবচেয়ে বেশি। ফরমানই পারত নিঝুম নীরবতাকে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সরব বিষয় করে তুলতে। ফরমান হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বক্তব্য শুনবেন, যার চেহারায় ধরে রাখা আছে একটা বৈদগ্ধ্যের ছাপ। চোখে আছে চশমা, আছে সর্পিল সম্মােহনী এলাজ।

* তা আপনিও ঐ সময় চশমা পরতেন বুঝি? ** আমিও। * তাহলে বেশ একটা জুটিই বটে।

** তার সাথে আমার কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল সিভিল অ্যাফেয়ার্স (এমজিসিএ)-অসামরিক বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল । তিনি ছিলেন আস্ত একটি গাধা। তিনি ছিলেন সব কিছুর নেপথ্য চক্রী।

* তিনি ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএপি), রাজাকার, আল-বদর, আর-শামস ইত্যাদি বাহিনীও তৈরি করেছিলেন?  ** সে কথা আমি বলব না। আপনারা এ বিষয়ে আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন। আপনারা বলতে পারেন, হ্যা বা না। কেননা, ফরমান ছিলেন এমজিসিএ। তিনি গভর্নরের পরামর্শদাতাও ছিলেন। আপনারা অবশ্য বলেছেন আগেই। তবু আমি আবার বলছি, বেসামরিক ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটত তার কোনাে কিছুই ফরমানের অজ্ঞাতসারে হতে পারত না। আর তাই বলে যে তাকে সে সবের জন্য আদেশ-নির্দেশও দিতে হতাে এমন নয়।

সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিধর ব্যক্তি। সেই ব্যক্তি কি না এখন। বলেন, কিছুই জানেন না! না, আমি বলি, সব কিছু জানা ছিল তার।

* ফরমান তার লেখা বইতে দাবি করেছেন যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বিরাট বন্ধু মানুষ ছিলেন। আপনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন? কোনাে মন্তব্য আছে আপনার? তিনি কি আসলেই শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন?

* না, তিনি হয়তাে বা অফিসিয়ালি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকবেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তার হয়তাে দিনে তিনবার শেখ মুজিবুর রহমানের। সঙ্গে দেখাও হয়েছে। কেননা, একমাত্র তার পক্ষেই দাবি করা সম্ভব হয়েছে যে, একজন ভদ্রলােকের সঙ্গে তার যােগাযােগ বা ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে খুব পরিষ্কার চেহারায় বেরিয়ে আসা। তিনিই প্রশাসনকে জানিয়েছেন…। এই ফরমান আলী এমন কাজ করেছেন যা তার করা উচিত ছিল না। ফরমান ছিল পুরােপুরি এক ভিন্ন শ্রেণীর লােক, একেবারে আলাদা। তার মতাে লােকের পক্ষে বন্ধুকে পুরােপুরি পথে বসানাে বা তার সর্বনাশ ডেকে আনা সম্ভব। বাস্তবিকপক্ষেও তিনি একজনকে বন্ধু হিসেবে নেন তার বারােটা বাজানাের জন্য, যে কাজটি আপনারা কেউ বন্ধু হলে তার বেলায় করতে পারতেন না। তাই আমি তার ব্যাপারেও উদার হতে চেষ্টা করেছি। আমি তাকে কখনাে বিশ্বাস করিনি। ফরমান লােকটি এমন যে, সব সময় যেন মুখােশ পরে আছেন। আপনি ওর চোখ-মুখ দেখলেও ধরতে পারবেন না ঐ মুহূর্তে তিনি কী ভাবছেন, কী ফিকির করছেন, কিংবা ওর মনে কী আছে! লােকটা বুদ্ধিমান, চতুর ও প্রচণ্ড রকমের নিষ্ঠুর। এ রকমই মানুষ হলেন ফরমান যার মাঝে দয়ামায়ার কোনাে অনুভূতি নেই, কিছু নেই। এ হলাে গিয়ে আদ্যোপান্ত ফরমান। তার চেহারা তিনি আমায় একবার দেখিয়েছিলেন নির্বাচনের ঠিক পরপরই, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারির দিকে। তার অল্প কিছুদিন আগে একাত্তরের ২৭ ফেব্রুয়ারি গভর্নর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফরমান এই সম্মেলনের জন্য একটি দলিল বা পেপার তৈরি করেন। ওটা ছিল সাধারণ লেড পেন্সিল দিয়ে লেখা, আমাকে দেখিয়েও ছিলেন সেটি। তাতে ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতি বিভাগীয় সাড়া বা প্রতিক্রিয়া কী হবে তা প্রদর্শিত ছিল। অবশ্য এ সবের পরেও আমি বলতে চাই যে, ফরমান যদি বলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন তাহলে তাকে সঠিকও বলতে হয় । কিন্তু মজার ব্যাপার, তিনি একথা আমাদের জানাননি যে তিনি তার ঐ মহৎ বন্ধুর জন্য কাজও করেছেন তাকে অধিকার দেবার জন্য। কাউকে না কাউকে অবশ্যই আপনার বন্ধু হতে হবে।

* আমরা এখানে আসার মাত্র কয়েকদিনে আমরা এর একটা কারণের কথা শুনেছি। শুনেছি কেন ‘অপারেশন সার্চলাইটের পক্ষে এখানে প্রবল অভ্যন্তরীণ অভিমত ছিল। এই হেতুর পেছনের অন্যতম বাস্তবতা ছিল এই যে, আইয়ুব শাহীর যখন পতন হয় তখন সেই পতনের অন্যতম কারণ ছিল ছাত্র বিক্ষোভ। আবার সামরিক আইন পুনঃআরােপ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে ক্ষান্ত দেয়।  ** আপনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন আরােপের কথাটা কী বলছেন তা আমার বােধগম্য নয়। কেননা, সামরিক আইন তাে গােটা পাকিস্তানেই আরােপ করা হয়েছিল।

* না। মানে হ্যাঁ। বলতে চাই ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানেও ছাত্র বিক্ষোভ হচ্ছিল। সামরিক আইন জারির পর তারা ঐ বিক্ষোভ বন্ধ করে ও পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। আর তাই এ ধারণা গড়ে ওঠে যে, এ রকম একটা সামরিক শাসনের প্রবর্তন করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও শান্ত হবে।

** কথাটা মােটেও সত্য নয়। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র বিক্ষোভের সূচনা হয় ১৯৬৮’র অক্টোবরের দিকে যখন আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশকের ইতি ঘটছিল। এ বিক্ষোভে পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। তখন ওখানে সেনাবাহিনীর জিওসি ছিলেন জেনারেল মুজাফফার উদ্দিন ছাত্র বিক্ষোভের মােকাবিলায় ঐ সময় সেনা মােতায়েন করা হয়। আসগর খানও ঐ। সময় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। এ ছিল ওখানকার ছাত্র আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন জুলফিকার আলী ভূট্টো।

* আমার ধারণা পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভকারীরা সামরিক আইন জারির পরপরই বিক্ষোভে ক্ষান্ত দেয়। ১৯৬৯-এ সামরিক আইন আরােপের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন শেষ হয়ে যায়। তাই এ পরিপ্রেক্ষিতে নানা যুক্তি খাড়া হতে থাকে এই বলে যে, আদি ‘অপারেশন সার্চলাইট’- এর মতাে একটা বিদ্যুৎ গতির সামরিক অভিযান পরিচালনা করা যায় তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে।

** আপনি কি সামরিক আইন জারির কথা বলছেন? “

* আমরা মনে করি, এ ধরনের কিছুর কথা ভাবা হয় । উচ্চতর সামরিক মহলে একটা ধারণা গড়ে ওঠে যে, ১৯৬৮-৬৯-এ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এর শুরু ‘৬৮তে। এ আন্দোলনের কারণে আইয়ুব গতিচ্যুত হন। আর পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছু শান্ত হয়ে আসে। এ কারণে

সেনাবাহিনীতে উঁচু মহলে এমন এক ধারণা গড়ে ওঠে যে সেনাবাহিনী যদি দ্রুত তৎপরতা চালাতে পারে তাহলে কাজ হবে।

** বলার দরকার, সর্বকালেই সেনাবাহিনী যখন কোনাে অ্যাকশনে যাবার কথা বিবেচনা করে তখন তারা এও ভাবে ও বিশ্বাস করে যে, তারা সম্ভাব্য কম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে। আর তাই এ ধরনের পরিকল্পনা বরাবরই করা হয়ে থাকে। এতে নতুন কিছু নেই। অবশ্য, অপারেশন সার্চলাইটের জন্য সময়সীমা নির্ধারিত ছিল ১০ এপ্রিল। ওদের বিশ্বাস ছিল, এই ১০ এপ্রিল তথা অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার ১৫ দিন পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে, সব কিছু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। কিন্তু যে ক্রোধ, ক্ষোভ ও তিক্ততা ওখানে পুঞ্জীভূত হয়েছিল সে বিষয়টি তারা আঁচ করতে পারেনি। আর এও ভুলে যায়, এ ধরনের অপারেশনে ব্যাপক সমর্থন দরকার; তা না থাকলে সেটি সফল হতে পারে না।

* ‘অপারেশন সার্চ লাইটের হিসাব-নিকাশ গলদের বিষয়টি কেন তারা আগে থেকে অনুমান করতে পারল না?

** এ জন্যই তাে ওদেরকে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আর ইয়াহিয়া খান রােমেলের চেয়েও বড় কোনাে জেনারেল ছিলেন বলে আমি মনে করি না। তিনি হিটলারের চেয়ে কোনাে বড় নেতাও ছিলেন না। তুবু হিটলার যুদ্ধে পরাজিত হন। অথচ আগে তিনি যুদ্ধে ক্রমাগত জয়ী হচ্ছিলেন। তিনি। কার্যত গােটা পশ্চিম ইউরােপ জয় করেন। রােমেল তার অপারেশন বারবারােসা’র নেতৃত্ব দেন যুদ্ধের দুটি রণাঙ্গন খােলার জন্য, একটি রাশিয়া। অভিযানের জন্য। আপনারা জানেন, সে অভিযানের কী পরিণতি ঘটে। এ সবই ঘটনা। যুদ্ধ চলে সাধারণত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে। এ কথা ভুলবার নয়। | লিবার্টো প্রসঙ্গত বলেছেন, যুদ্ধ শুধু জেনারেলদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে-যুদ্ধ আদৌ এমন হালকা বিষয় নয়। আর আমি আপনাদেরকে এ বিষয়ে একটু যােগ করেই বলি, যুদ্ধ খুবই গুরুতর বিষয় যা আধুনিক জেনারেলদের হাতে ছেড়ে দেয়ার বিষয় নয়। রাজনীতি ও সমরশক্তি উভয়কেই নানা স্তরে সম্পর্কিত থাকতে হবে, তাদের ভূমিকাও থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানে রাজনীতিক ও আমলাদের সমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছে। তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোনাে আপত্তি ওঠেনি, কোনাে প্রতিরােধ সংগঠিত আকারে আসেনি, বিরােধিতা করা হয়নি, বিক্ষোভ হয়নি অথচ পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছিল সে বিষয়েও কেউ তেমন আগ্রহ বা কৌতূহল দেখায়নি। তাই আমি নিশ্চিত, সামরিক বাহিনী কালপ্রিট বা অপরাধী নয় তবু সেই সামরিক বাহিনীই ছিল আসামী। সে কথাই আমাকে শুনতে হয়েছে। সামরিক বাহিনী তার অপরাধীসুলভ কার্যকলাপে দেশের বেসামরিক মহলগুলির সমর্থন পেয়েছে। এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। নিরেট, নিটোল বিষয় এটি। পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান যা-ই হােক, এই ছিল বিধিলিপি । যখন বাঙালি আধিপত্যশীল ছিল ঠিক সেই সময় যুগপভাবে পাঠান, সিন্ধী, বালুচরা সামাজিকভাবে একই রকমে আধিপত্যশীল হয়ে উঠতে পারেনি। আর বাঙালিরা ছিল…।

* জেনারেল নিয়াজি তাঁর বইয়ে একটি পরিকল্পনার অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। আর সেটির তথ্যে তিনি জানাচ্ছেন, এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল কোনাে জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে যাক-না যাক নিয়াজীকে যেতেই হবে (বলির পাঁঠা হিসেবে!)। আর তাকে যুদ্ধে পরাজয়বরণ করতেই হবে, কেননা তাকে কোনাে মদদ দেয়া হবে না।

** আপনাদের তরফে কেবল তেমনটি প্রত্যাশা করাই সম্ভব। আমি আসলে বলতে চাই যে, আল্লাহর ওয়াস্তে বিশ্বাস করুন তিনি এখানকার হাই কমান্ডে থাকলেও নেতিবাচক দৃশ্যপটে তিনিও তেমন রদবদল করতে পারতেন এ রকম দায়িত্ব তাকে দেয়াই উচিত ছিল। আশা করি আপনারা ভুল বুঝবেন না, কেননা, এ এক তাৎক্ষণিক কাকতালীয় ব্যাপার। এ নিয়ে আমি লিখেছিও। এ হলাে নিয়াজীর বই সম্পর্কে আমার বলার। এ নিয়ে আমি বিস্তৃত কলেবরে পুস্তক সমালােচনার আকারে লিখেছি এবং তা নিবন্ধ আকারে প্রকাশিতও হয়েছে। জেনারেল জ্যাকবের বই সম্পর্কেও লিখেছি। জ্যাকব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ওপর একটি বই লিখেছেন, তার একটি কপিও আমি পেয়েছি।

* এ সপ্তাহে?

** জ্বি। আমি সঠিক মন্তব্য করেছি, বক্তব্যের সারসংক্ষেপ দিয়েছি এবং একটি দলিল উপস্থাপন করেছি-এর পাঞ্জাবি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। দলিলটির রচয়িতা আসমত ইরানীর বাবা। আমার মনে হয়, এটি অত্যন্ত প্রামাণ্য দলিল-এর একটি কপি আপনিও পেতে পারেন। যা কিছু একাত্তরে ঘটে গেছে তার ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এ দলিলে। এটি আসলে একটি চিঠি যা লেখা হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে।

* ঐ চিঠির লেখক তার চিঠিতে কী বলেছিলেন? ** তিনি বলেছিলেন, সব কিছুর নিষ্পত্তি হবে বিশ্বজনীন পর্যায়ে, আর আপনারা (পাকিস্তানিরা) হেরে যাবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পূর্ব পাকিস্তানে আপনারা আজ যা করেছেন আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করুন। এই আসমত ইরানীর পিতাই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি কাগজে-কলমে তার এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এ চিঠির একটি কপি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, যা এখনাে আমার কাছে রয়েছে। যার অংশবিশেষ….। বইয়ের একটা কপি আপনারা রাখুন।  * আপনাদের এখানকার কেউ কেউ আমাদের জানিয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শাসন কেন্দ্র তথা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শাসকবর্গ ‘৬০-এর দশকের শেষের দিকে থেকেই বলে আসছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্ত নের জন্য দায়-তার ভার বােঝা হয়ে উঠেছে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ফেলাই ভালাে।  ** কথাটা নতুন নয়। একেবারে প্রথম থেকেই এ ধারণা চলে আসছে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ সন্দেহাতীতভাবে পরাজিত হয়। এ ঘটনাও হয়তাে তেমন কিছু। যদি তাই না হবে তাহলে মি. জিন্নাহ কেন পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছিলেন? কেন তিনি ঢাকায় গেলেন না? অথচ পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচকরা ছিল শতকরা ৫৬ জন। এসব কথা বলতে গেলে কাহিনী অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সেটি আপনারা ভালাে করেই জানেন। আমার এ বিষয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। আমি বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা-গবেষণা করছি। বলা যায়, এতে আমি খুব একটা আনন্দিত নই। আর একটা বড় কথা যে, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি তাকে দিয়েছিলেন জনাব সােহরাওয়ার্দী, কিরণশংকর রায় ও এনামুল হাসান খান প্রমুখ জিন্নাহ এ প্রস্তাবের জবাবে বলেছিলেন, বেশ তাে, আমার কোনাে আপত্তি নেই। আর কলকাতা ছাড়া বাংলা? সে কথা আমি ভাবতেই পারি না। আপনারা তাহলে। এগিয়ে যান। তবে হ্যা, সেটি একটি মাত্র শর্ত সাপেক্ষে। তা হলাে, আপনার ‘ কখনাে স্বাধীন ভারত ইউনিয়নের অংশ হবেন না। কাজেই ঐ অবধি তিনি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

* আরেকটি বিষয়ের কথা আমাদের কানে এসেছে। সে সময় নাকি হিন্দু শিক্ষকরা পূর্ব পাকিস্তানিদের শিক্ষা দেবার ছলে তাদেরকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে?

** বলছি আপনাদেরকে * এ হলাে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। এখনই কেবল এসব কথা শুনছি।

** ফরমান আলির বই থেকে বিষয়টি আমি জেনেছি। আর এভাবেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের কাজের যুক্তি খুঁজে পেয়েছে। আমি বিষয়টি আদৌ বুঝি না, কেননা দেশ ভাগের আগে তাে হিন্দু শিক্ষক, অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি ছিল। মুসলিম শিক্ষক ছিল কম। আর তাদের বিরুদ্ধে যা-ই বলা হােক, আমাদের আন্দোলনে তারাও আগ্রহ নিয়ে অংশীদার হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আমার একদিন এক কৌতূহলােদ্দীপক তর্ক-বিতর্ক হয়। আমি বলেছিলাম, অসুবিধাটি কোথায়? আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি আমাকে বল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এ রকম একটা ডাক বিভাগীয় ঠিকানায় যদি তােমার আপত্তি না থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে তাে পাকিস্তানের আওতাতেই রেখেছ? কাজেই আলাদা দেখলেও আসলে তা একসাথে মিলে একক দেশ। সে জবাবে বলেছিল, বাংলাদেশ বলে কি বােঝাতে চাও তুমি? আমি বললাম, বাংলাদেশ  ও বলল, তুমি কি দেশ আর প্রদেশের তফাত বােঝ না? আমি নীরব থেকে ওকে সময় দিলাম ভাববার । সে আবার বলল, দেশ হলাে একটা রাষ্ট্র অঞ্চল আর প্রদেশ হলাে রাষ্ট্রীয় অঞ্চল বা দেশের অংশ। যেমন, উত্তর প্রদেশ ভারতের একটি প্রদেশ । আমি বললাম, দোহাই জেনারেল, আল্লাহর ওয়াস্তে ও রাস্তায় ব্যাপারটাকে নিও না। এতে কোনাে ফল পাওয়া যাবে না। বস্তুত ওভাবেই ওরা সব কিছুকে বিচার করে, ওটা ওদের রীতি, আদর্শ, নিয়ম-আচার । আদর্শিকভাবে ধরে নিলাম, “দেশ’ বা ‘প্রদেশ’ যা-ই হােক, দোষটা কী? দেশ যদি বাংলাদেশ-পাকিস্তান হয়! কী হয় তাতে? আমার এখনাে নিশ্চিত বিশ্বাস, বাংলাদেশ আর যা-ই হােক কখনাে ‘দেশ’-এর তল্লাশে ছিল না। বাংলাদেশ কেবল স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। তারা তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয়-আশয়ে নিজ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। আমার বরাবরের ধারণা ছিল এ রকমই। আমি আমার জীবনের দীর্ঘ সাতটি বছর কাটিয়েছি পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষায়  আমি একটা বইও প্রকাশ করেছি। সেই বইয়ের অংশবিশেষ আমার লেখা কতকগুলি নিবন্ধ ধারাবাহিক দ্য নেশন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল  সেগুলি নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন। দেখে থাকলে আপনাদের মন্তব্য কী আমার জানা নেই এ হলাে সেগুলির কপি, আপনাদের জন্য ।

* আমরা জেনারেল উমরের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন ২৫ মার্চ রাতে তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাবলি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন না।

** আমিও এ বিষয়ে কোনাে কিছু জানতাম না। তবে স্পষ্টত বুঝতে পারছিলাম এ লােকটি এর মধ্যে ছিলেন ।

* ২৫ মার্চ যা ঘটেছিল তাতে জেনারেল উমর ছিল একথা কেন আপনার মনে হয়?

** কারণ তিনি এতে ছিলেন বলে । ২৫ মার্চ সকালে তার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমার পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরার সময় হয়েছে। আর সে কারণেই আমি জেনারেল পীরজাদার কাছে বিদায় নিতে যাই। তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন। আমি তাকে রীতিমাফিক স্যালুট দিয়েছিলাম। আমার মুখের আকৃতি তেমন সুদর্শন কিছু নয়। আমার মুখটা বরং সিরিয়াস গম্ভীর প্রকৃতির। আর ২৫ মার্চে তাে অনিবার্যভাবেই আমার মুখমণ্ডল খুব গম্ভীর হওয়ারই কথা। তাই তিনি আমাকে বললেন, ওহে, কী জন্য তুমি এত গম্ভীর? আমি বললাম, স্যার, এখানকার পরিস্থিতি তাে জানেনই। তিনি বললেন, আরে না না, চিয়ার আপ, মুখ গােমড়া করে থেকো না। সেদিনই ২৫ মার্চ, ১৯৭১।

* কথাগুলি কার? জেনারেল উমরের?

** জেনারেল উমরের। আর তারপর তিনি একটি শায়ের (কাব্য স্তবক) আবৃত্তি করলেন। বললেন সবকিছু ভুলে থাকতে। . * তা কাব্য স্তবকটি কী ছিল? শায়ের সুনাইয়ে জারা?

** হ্যা, শশানাব। সম্ভবত আমার এর পুনরাবৃত্তিতে ভুল হয়ে যেতে পারে । . * ইয়ে গুজারনে কোয়ি বাত নেহি। ** “মায়ই যবভি ঢাকা যাতাহু ওয়াে কাতিল ছে কাহতা যাতাহু তাওহি মে দ্যাস্তো বালু হ্যায় ওয়ে ওয়াক্ত কি যাে…।”

কোনাে আঘাত করার সময় পুরাে গায়ের বল কাজে লাগাননা না হলে তা। এক অবমাননাকর অমর্যাদাই বটে-ঐ ব্যক্তির জন্য যে তাকে বিশ্বাস করবে। সে আঘাতটাই আসে পঁচিশের নিশুতি মধ্যরাতে-১১টা বা ১২টায়। আর সে কারণেই জেনারেল উমর যদি বলে থাকেন, বলতেই পারেন, কেননা তিনি। পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। আর, কারণটি সম্পর্কে জেনারেল জ্যাকব তাঁর বইয়ে বলেছেন, জেনারেল: উমর ছিলেন। ইয়াহিয়ার কসাই! তবে ওটা আমার মন্তব্য নয়।

* তাহলে আপনি কী বলেন? . ** তিনি এসব ব্যাপারে খুব ভালাে করেই ছিলেন কিংবা অনেকটাই এর ভেতরে ছিলেন। এ রকম করে বলছি এ কারণে যে আমি ছিলাম জনসংযােগের লােক। সবকিছুই আমার নজরে আসত, তবে সবার শেষে। আর এ কারণেই আমি বলছি, আমি ধারেকাছেই ছিলাম । কিন্তু সিদ্ধান্ত প্রণয়নে কোনাে অংশীদার ছিলাম না।

* এ সম্পর্কিত বইপত্র পড়লে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয় আমি সেটিকে কীভাবে বলি… কেমন যেন, এলােমেলাে, বিভ্রান্তিকর, স্ববিরােধী মনে হয়।

** আরে না, এ জন্য অনেক দলিল, কাগজপত্রও তাে রয়ে গেছে। মানে আমি বলতে চাই, তাদের সকলের মতামত একই হতে পারে কী করে?

* ঠিক তা নয়, এক সময় তারা জেনারেল উমরের মতােই বলছে, আমি এই করছিলাম। আমি সেই করছিলাম । ইয়াকুব, নিয়াজিও বলছিলেন। কিছু জনসাধারণ বলেছে ভিন্ন কথা।

** আমার তা জানা নেই। আমি জানি না জেনারেল উমর এসব বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন। দলিলপত্রই বা কেমন তাও আমি জানি না। আমি জেনারেল ইয়াকুবের বরাত দিতে পারি। তিনি অনেক কিছুই স্বীকার করেছিলেন। জেনারেল ইয়াকুবের সাথে তার সামরিক আইন প্রশাসন দফতরে আমার দেখা হয়। সর্বশেষ তার সাথে আমার দেখা হয় ঢাকায়। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৭০-এর নভেম্বরের নির্বাচনের দিন কয়েক আগে অস্ত্রশক্তিতে বিশ্বাসী কিছু সৈনিক একটি জরুরি পরিকল্পনা তৈরিতে উদ্যোগী হয়। আর এ বিষয়ে আমার এই যে নিবন্ধটি দেখছেন আগামী সপ্তাহে ইসলামাবাদের কোনাে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাই বলতে পারি জেনারেল ইয়াকুব ছিলেন তাঁর স্বকীয় ধারার এক জঙ্গী বাজপাখি । তার ধারণা ছিল এভাবেই তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তবে তারা আসলে দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেননি। সে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এ ধরনের অভিযান আগাগােড়াই নিরর্থক। ১৯৭০-এর নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তীকালে আমি সেখানে ছিলাম। আমি ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এসব উপকূলীয় এলাকা যেমন-ভােলা, হাতিয়া ও এ ধরনের আরাে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছি। ঐ সময় বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি অনুমান করেছিলাম, আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, আর অন্য দলগুলির ভরাডুবি হবে। তবু ওদের কোনাে চৈতন্যোদয় ঘটেনি।

* বাংলাদেশ সম্পর্কিত বইগুলিতে ৭০ সালের নির্বাচনের ব্যাপারে গােয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কেমন ব্যাপার? কী মনে করেন আপনি এ বিষয়ে? কতগুলি আসন কোন দল পাবে তা ওরা নিরূপণ করতে পারল না?

** দেখুন, গােয়েন্দা বিভাগ বরাবরই ব্যর্থ হয়-সব সময় । আর গােয়েন্দা প্রবরেরাই কর্তৃপক্ষকে ডােবায় । দেখুন না, ভারতে কী ঘটেছে, ওখানকার বােমা বিস্ফোরণ, বিশিষ্ট ব্যক্তি হত্যা-যার কোনাে কূলকিনারা, নিশানা-আভাসও পাওয়া যায়নি। সব সময়ই এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই ললাট লিখন।

* আবারও আমি সামরিক বিষয়েই প্রশ্ন করছি। জেনারেল নিয়াজী সম্পর্কে । আপনি তাে তাকে ভালাে অফিসার বলে মন্তব্য করেছেন। এখন আমি। যােগ করতে চাই-বহুগুণে শক্তিশালী ভারতকে ঠেকাতে তাে তিনি তার যথাসাধ্য করেছেন। আসলেও তিনিও যা করেছেন তা তার সাধ্যের বাইরেও। অথচ বহু লােকে এখন বলছেন জেনারেল নিয়াজী কোনাে যােগ্য জেনারেল ছিলেন না। আমার প্রশ্ন হলাে, তার যােগ্যতার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনা সদর দফতরের কি জানা ছিল না? যদি থাকে, তাহলে বিষয়টি কেমন বিসদৃশ দেখায় কি?

** আপনি কিন্তু অনেকগুলি বিষয়কে বেমালুম টপকে যাচ্ছেন । ভারতের মতাে দেশও অনেক জায়গায় সামরিকভাবে পরাজিত হয়েছে, কাশ্মীরে তাকে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে, অহমিয়াদের হাতে বহু সেনা খুইয়েছে, এগুলি কি সত্যি নয়? . * এগুলি তাে আছেই । কিন্তু আমরা বলতে চাই, জেনারেল হিসেবে নিয়াজী ধাধার জবাব কী?

** না, আমি কেমন করে বলি, তিনি ভালাে জেনারেল নন। আমি বলি তিনি নিষ্ঠাবান, খুব ভালাে একজন সামরিক অফিসার। | * আপনি তাে জানেন যে তিনি জানিয়েছেন, দুই-তিন জন জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে সেনাপতিত্বের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। কাজেই বাছাইয়ের সিড়িতে নিচে থাকা সত্ত্বেও নির্বাচকরা তাকে পূর্ব পাকিস্তানে সিপাহসালার। হিসেবে তুলে নেন।

** আর সেটাই হলাে আখেরের বাছাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ঘটেছিল জানেন? রেবেন এক সময় লক্ষ্য করেন যে, তিনি যে সময় সিদি ইব্রাহিমে ছিলেন তখন তার ঐ অবস্থান থেকে তিনি জার্মান জেনারেল রােমেলকে,সেখান থেকে হটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু রিচার্ডসনের কাছ থেকে আদেশ এলাে তার কাছে : দুই ডিভিশন সেনা পাঠাও গ্রিসে।। তিনিও সে হুকুম তামিল করলেন। কিন্তু তাতে কী হলাে, গ্রিসে কোনাে ভালাে ফল তাে পাওয়াই গেল না, সিদি ইব্রাহিমের দিকে অগ্রগতিও স্তব্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধ শেষ হলে এ নিয়ে বহু সমালােচনার বার্তা আসতে থাকলে ক্লোবেন বললেন, না ওটা ছিল আমারই ভুল ।

আমি সেভাবেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নােট পাঠানাের সাহস রাখি। আর সেটিই কথা। জেনারেলের এখানে কোনাে প্রশংসা পাবার নেই। জেনারেল নিয়াজী। আমার সাথে অত্যন্ত চমৎকার আচরণ করেছেন। আর আমিও একমাত্র ব্যক্তি, যে তার সম্পর্কে অত্যন্ত সদয় মন্তব্য করেছি।

* জ্যাকব সম্পর্কে আপনি কী বলেন?

** জ্যাকব তাে আরেক ইয়াকুব। আমি বলব, আরেক নিয়াজী। কারণ জ্যাকব অনেক কাজই করেছেন। ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’র সাথে ১৯৯২-এর নভেম্বরে তিনি পাকিস্তানে এলে অল্পকালের জন্য আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে । আমি তখন লাহােরে ছিলাম । লােকটি রীতিমতাে সুরাসক্ত, জানতেনও না বােধ করি যে তিনি একজন জেনারেল। খুবই মােটা থলথলে শরীর । আর তার মুখ থেকে যেসব বচন বেরােয় তা সত্যিকার পেশাদার সৈনিক শুনলেও লজ্জা পাবে। এহেন জ্যাকব এখন যুদ্ধে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হবার দাবিদার। তাঁর সে। দাবির নিক্তির প্রান্তে ঝুলে আছেন মানেক শ, আর আরােরা বেচারা তাে লাপাত্তা। তিনিই সে দিন্নজ যিনি যুদ্ধের সব কিছুর প্রণেতা। তারপর মানেক শ…. । এহেন জ্যাকবের উক্তি, না-না, ঢাকা তাে আপনাদের রাজনৈতিক কেন্দ্র, কত কিছু। আমি জবাবে বলেছিলাম, জ্বি, যা ঘটেছে তাতাে নিশ্চয়ই, তবে। কখনাে বলবেন না…। আমি তাই বলি জ্যাকব ও নিয়াজী একই শ্রেণীভুক্ত। তফাত শুধু এই জ্যাকব নিয়াজীর চেয়ে…

* আপনি বলেছেন, যুদ্ধের বিষয় এমন গুরুতর যা জেনারেলদের হাতে যেমন ছেড়ে দেয়া যায় না, তেমনি রাজনীতিকদের হাতেও নয়। এখন বলুন। ভূট্টোর ভূমিকা কী ছিল? তিনি ছিলেন…

 ** তিনি ছিলেন মূর্তিমান বিপর্যয় আর কি! তিনি কোনাে সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন একই দেশের দুই দেশরক্ষা দফতর, জোড়া প্রধানমন্ত্রী পদের। তিনি আটকেই থাকুন বা লারকানা, ইসলামাবাদে থাকুন, তিনি সব সময় ক্ষমতার জন্য ছোঁক ছোঁক করতেন, আর সেটাই তার… সব। আমি মনে করি প্রশ্নটি আসলে ক্ষমতা হস্তান্তরের ছিল না, বরং বেশ। কয়েকটি স্তর পেরিয়ে তা হবার কথা ছিল। ১নং স্তর : নির্বাচন ২নং স্তর : জাতীয় পরিষদে উদ্বোধনী অধিবেশনের দিন তারিখ নির্ধারণ। ৩নং স্তর : জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের উপস্থিত ও ভাষণদান। ৪নং স্তর : খােদ শাসনতন্ত্রের বিষয়াবলী ১২০ দিনের সময়সীমার মধ্যে নির্ধারণ। ৫নং স্তর : প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শাসনতন্ত্রের অনুমােদন ৬নং স্তর : ক্ষমতার হস্তান্তর  কিন্তু সবকিছু গােলে হরিবােল করে দেয়া হয় ক্ষমতা  হস্তান্তরের প্রশ্নটি আমার বিবেচনায় মােটেই সঠিক ছিল না। আমি আমার  ওপরওয়ালা মেজর জেনারেল গুল হাসান খানকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, আল্লাহর ওয়াস্তে প্রেসিডেন্টকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে দিন। জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী | অধিবেশন নির্ধারিত তারিখে হতে দিন। সেই অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাবেন ও ভাষণ দেবেন। আর সেই সাথে তিনি তাঁর যােগাযােগ রক্ষা করবেন এবং পরস্পর আলােচনার মাধ্যমে কোনাে একটা  কার্যকর রফা ও ব্যবস্থায় উপনীত হবেন। আর তাতে দুই-তিন বা পাঁচ মাস লাগতে পারে। এ সময়টি ১২০ দিন সময়সীমার বাইরে থাকবে এবং ফেডারেল শাসনতন্ত্রের জন্য ১২০ দিনের যে মেয়াদ তা নির্দিষ্ট তারিখে শুরু হবে-পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে শাসনতন্ত্র প্রশ্নে আলােচনা শুরুর ঠিক পর থেকে। আর সেটিই  হতে পারে নিখুঁত কাজের উপযােগী ব্যবস্থা। কিন্তু তারপর কী ঘটে সে তাে আপনাদের জানা। লারকানার সলাপরামর্শের পর ভূট্টোর ভােল পাল্টে গেল সবকিছুর তালগােল আরাে একবার পাকিয়ে গেল । ইয়াহিয়া খান কখনাে একথা বলেননি, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি একাত্তরের ১৪ জানুয়ারি বিমানবন্দরে বিমানে ওঠার আগে কোনাে এক ব্যক্তির দেশের  অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, আমি দেশের যে  অর্থনৈতিক বুনিয়াদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি তা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর হাতে  তুলে দিতে যাচ্ছি। ঐ ব্যক্তি তাকে আরাে প্রশ্ন করেন : কে তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বলে আপনি মনে করেন? ইয়াহিয়া বলেন, “কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি কোনাে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি তিনি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কথাই বলেছিলেন। আর কিছুই নয় । কিন্তু এরপর ইয়াহিয়া | যান লারকানায়, আর তারপরই গােটা রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়।

* বিষয়টা কি সেনাবাহিনীতে জানা ছিল যে তিনি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন?

** অবশ্যই। তারা অলস বসে ছিল না, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তাদের সহানুভূতি ছিল। আর ভূট্টো তাদের মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি নানা রকমের কাহিনী ফাঁদতে শুরু করেন। তিনি এমন আজগুবি কথা শুরু করে | দেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সব ট্যাঙ্ক ও বিমান নিয়ে যাবেন। অথচ সকলের জানা উচিত যে, রাওয়ালপিন্ডি থেকে করাচি, করাচি থেকে চট্টগ্রাম ট্যাঙ্কগুলি নিতে বেশ একটা সময় লাগার কথা। যা হােক, আপনি কি সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম গেছেন চট্টগ্রামের নতুন পাড়ার সেনাবাহিনীর | রেজিমেন্টাল সেক্টরে একটা রুশ উভচর ৭৬-টি ট্যাঙ্ক এখনাে থাকার কথা।

সেটা এখনাে আপনি দেখতে পাবেন। এই ট্যাঙ্কটিকে কাসুর থেকে চট্টগ্রাম নিতে তিন মাস সময় লেগেছিল।

* তাহলে তিনি ওদের ভীতির এই বিষয়টি নিয়ে ‘মাদারির খেল’ শুরু করেছিলেন। | ** ভীতি নয় বরং বলুন উচ্চাভিলাষ, যার নির্গলিতাৰ্থ আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, নির্বুদ্ধিতা। উচ্চাভিলাষ? হ্যা, ওটা ছিল বটে তবে কোনাে ভীতি ছিল না।

* আসলে পশ্চিম পাকিস্তানে তখন এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় চলছিল সে সময় ভূট্টো সেনাবাহিনীতে তার একাধিক সমর্থকগােষ্ঠীর উদ্দেশে বার্তা পাঠাচ্ছিলেন, বার্তা ছিল জেনারেলদের জন্যও, বার্তা ছিল সর্বস্তরের সেনামহলগুলির জন্য।

** না, না, তা মােটেও নয়  সেনাবাহিনী মূল্যের নিরিখে যা-ই হােক না কেন, এ সংগঠনটি বাস্তবিকপক্ষেই মনােলিথিক, একাট্টা, কেন্দ্রাভিমুখী। ভূট্টো সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ হলাে আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর কথা। আমি আপনাদের দেশে গিয়েছি। জেনারেল এরশাদের সঙ্গে আমার সুদীর্ঘ আলাপ হয়েছে। সে সময় তিনি ছিলেন আপনাদের প্রেসিডেন্ট আপনাদের সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর মতােই উত্তম। আপনাদের বেলায় শুধু তফাতটি হলাে যে, তারা অস্ত্রসজ্জিত নয় সেনাবাহিনী হলাে এককেন্দ্রিক সংগঠন। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীতে এখনাে মধ্যপ্রাচ্য দেশীয় ধাচ আসেনি। অথচ আপনারা লে. কর্নেলদের জন্য একটি ভাষার, অন্যদের জন্য অন্য ভাষার প্রস্তাব করেছেন। এটি হয়তাে বা কিছুকাল পরে হবে সে বিষয়ে আমি বলতে পারি না। এরপর জেন্টলম্যানদের (জেন্টলম্যান ক্যাডেট) জন্য আরেকটি ভাষা রেখেছেন।

* নওয়াজ শরীফের সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন?

** মনে হয় ঠিক হবে না। কেননা আমি আমার নিবন্ধে ইতােমধ্যে এ বিষয়ে আলােকপাত করেছি। আমি আশা করি, নওয়াজ শরীফ যা বলেছেন তা কখনাে তিনি অস্বীকার করবেন না। কারণ, ওটা এখন বাস্তব সত্য। এ নিয়ে আর বেশি কিছু মাথা ঘামানাের দরকার নেই। কেবল আপনি যদি সংশ্লিষ্ট নিবন্ধগুলির কপি আমাকে পাঠান তা-ই যথেষ্ট হবে।

* অবশ্যই, যা কিছু হােক আপনি তার কপি পাবেন।

** আর হ্যা, আব্দুল হাফিজ, যিনি এক সময় ভূট্টোকে সমর্থন করতেন, তার কিছু অদ্ভুত ধ্যানধারণা আছে আমার ও আমাদের ব্যাপারে। তবে আমি

বিষয়টি গায়ে মাখি না। কেননা কেউ যদি সদ্য পরিচিত কারও সম্পর্কে একভাবে চিন্তা করে বা করার বিষয়ে স্থির করে থাকে, তাতে আমার বলার কিছু নেই। তেহরানে তিনি আমার সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন, কেন আমাকে আপনার অফিসে ডেকেছেন? আমি কোনাে জন্তু বা এরকম কোনাে কিছুর সাথে কথা বলি না। সে যাই হােক আমি তাকে ডেকেছিলাম। তিনি একজন লাগামবর্জিত মানুষ, কেননা…।

* ও, হাফিজের কথা বলছেন! এ ব্যাপারে তাে তাঁর রীতিমতাে সুখ্যাতিই আছে।

** না, না, তিনি ও জন্য খ্যাত নন। তিনি সে রকম মানুষ নন। তিনি অসহিষ্ণু অহমিকাক্লিষ্ট- একবার কিছু সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে তিনি নড়েন না।

* এ ঘটনা ঘটে কবে? ** ১৯৮৯-এ আমার তেহরানে সফরের সময় ।

* তা আপনি কেন ভাববেন হাফিজ এখনাে বিআইআইএসএস-এর মহাপরিচালক? তিনি ইতােমধ্যে ওখান থেকে চলে গেছেন।

** ঐ সময়টায় আমি বাংলাদেশের গােটা বিষয়টি বিচার-বিবেচনা ও সমীক্ষা করছিলাম। তখন ১৯৮৬। আমি এরশাদের সঙ্গে বাংলাদেশে যাই। তার সাথে বৈঠকে মিলিত হই। একথা আপনাদের খুব ভালাে করে জানা। ঐ সময় বাংলাদেশে, ডিসিএমএলএ বা উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন জেনারেল আতিকুর রহমান। তিনি এক বিশদ বিস্তৃত বৈঠকের আয়ােজন করেন। তিনি খুবই সদয় ব্যক্তি। তিনি আমার স্ত্রীর সাথেও সাক্ষাৎ করেন। কারণ আমার আত্মীয়-স্বজন কিছু বাংলাদেশেও রয়েছে। এ সফরে আমাকে যে ভিআইপি ফ্ল্যাটে থাকতে দেয়া হয়, তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেই একই ফ্ল্যাটে আমি ছিলাম। আমি আপনাদের দেশ ও দেশের লােকজন দেখেছি। খুবই চমৎকার। এরশাদের সাথে আমার তিন দফা বৈঠক হয়। আর অপরিহার্যভাবেই আপনাদের আবাসিক সেনাবাহিনী সম্পর্কে আমার একটা ধারণা নেবার সুযােগ হয় । কিন্তু বলার বেশি কিছু নেই, কেননা, আপনাদের সেনাবাহিনী অস্ত্রসজ্জিত নয়। এটি আপনাদের বিবেচ্য বিষয়। মহােদয়, সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্বের প্রতীকও বটে, এরশাদ এসবের জবাবে বলেন, ঠিকই বলেছেন। ধরুন যদি বদমাশ ভারতীয়রা, আমি মনে করি নিশ্চিত আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন। দেখেশুনে মনে হলাে লােকটির আদ্যোপান্ত সব দেখা হয়ে গেছে। তবে তার সম্পর্কে একটা ধীর আর সহিষ্ণু ধারণাই হলাে।

তাকে খুব ভালাে করে জানা এর আগে হয়নি। তিনি এখানে ছিলেন। এখানে যে ২০-২৮ হাজার বাঙালি সৈনিক ছিল তিনি তাদেরই একজন। * * যাই বলুন এঁরা তাে সবাই পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক একাডেমী থেকেই বেরিয়েছে।

** আর সেটাই জঘন্যতম ব্যাপার। * কী আর বলা!

** মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার একদিকে, বাঘা সিদ্দিকী একদিকে, আর এরশাদ, বিএমএ একদিকে। সব মিলেমিশে ওরা একাকার। এক হয়ে যায় । সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে গেরিলা বাহিনী। বাঘা সিদ্দিকী বাঘা সিদ্দিকীই থেকে যান। আর যে মুহূর্তে শিক্ষিত সেনাবাহিনী এসে যায়, কাদেরিয়া বাহিনী তাতে রণক্ষেত্র হারায়। কেননা, বাঘা সিদ্দিকীর গেরিলারা কোন্ টাইপের তা আপনারা জানেন। আর ওরা সব সময়ই এক রকমের। অথচ যা উচিত তা হলাে গেরিলাদেরকে অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়। একবার শান্তি ও নিয়মিত বাহিনী এলে সেখানে আর গেরিলা বাহিনী থাকতে পারে না । টাইগার সিদ্দিকী সম্পর্কে অনেক লােমহর্ষক বিবরণ রয়েছে। আমাদের একজন সংবাদদতা জানিয়েছেন যে, এই বাঘা সিদ্দিকী অবাঙালি লােকজনকে ঘেরাও পাড়কাও করার পর তাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের রক্ত নিজেদের হাতে আঙুল রাঙিয়ে নিতেন। সেটা তারা করেছেন বিশ্ব যােগাযােগ মাধ্যমের উজ্জ্বল পাদপ্রদীপের সামনে। কিন্তু যাই হােক, তিনি তার কাজ তাে করেছেন। বাঘা সিদ্দিকী সমস্যার নিষ্পত্তি করেছেন। সে রকমই মানুষ তিনি। এসব কাজের শর্তই এমন। আমি হলে আমাকেও এমন কাজে অংশীদার হতে হতাে।

* কিন্তু কাজটা তাে ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময়!

** সর্বাত্মকভাবে। কিন্তু সবকিছুর পরেও এ কথা তাে নির্মম সত্য, কার্যকলাপ চলেছে। ভেতরে এ সব হিংসা নির্মমতা, বহিঃপ্রলেপের প্রসাধনীই তাে কেবল সাধারণের নজরে পড়ে।

* আসলেও দীর্ঘ নয় মাসের দুঃসহ বিভীষিকার রাজত্বের পর ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর এলে কারুর পক্ষে জান্তব আক্রোশ, তথা প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখা ছিল খুবই কঠিন কাজ।

 ** আমি স্বীকার করি সে কথা, হ্যা, আমি আপনার সাথে এ ব্যাপারে একমত। আরাে একটি জিনিস। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বলে সেটি ছিল সবচেয়ে জঘন্য। আমরা বিদেশী সংবাদদাতাদের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেছিলাম। এই একবারই মাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টিক্কা খান তার সারা জীবনে অতীতে কিছু দেখানাের ছিল না, তাই কখনাে তিনি সিদ্ধান্ত নেননি। ঢাকায় তখন কাফু ছিল । আমি নিজে গাড়ি চালিয়ে লম্বা ড্রাইভে পােস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে বহু লাশ আমার চোখে পড়েছে। অবশ্য ঢাকা ক্লাবের বাইরে মাত্র ২/১টি লাশ দেখেছি। আর কিছুই না। কিন্তু তবু বিদেশী সংবাদদাতাদের অনতিবিলম্বে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্তটিতে গৌরবের কিছু ছিল না। তাদের আগে কোনাে বিদেশী সংবাদদাতাকে পরিদর্শনে নিয়ে যাবার  অনুমতি দেয়া হয়নি। আমিই পরে প্রথমবারের মতাে ছয়জন বিদেশী | সংবাদদাতার একটি দলকে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে নিয়ে যাই। এরা হলেন, টাইম ম্যাগাজিন, ফিনান্সিয়াল টাইমস, সিনহুয়া, রয়টার, নিউইয়র্ক টাইমস ও আরাে কয়েকজন সংবাদদাতা। তারা উপদ্রুত এলাকাগুলি ঘুরে দেখেন। তাদেরকে ঘুরে দেখার সময় লােকজনের সাথে কথা বলার সকল স্বাধীনতা। দেয়া হয়। কিছু লােক আমাদের দেখে সরে পড়ে। আমরা ওদের বাইরে আনতে পারিনি। এসব ঘটনা ঘটে যায় দুর্ভাগ্যক্রমে। খুব বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। বলেই আমার ধারণা। আমি এ বিষয়ে নিবন্ধ লিখে তখন পাঠিয়েছিলাম। আমি মনে করি আমাদের মধ্যে সহযােগিতামূলক ক্ষমতা চাওয়া দরকার রয়েছে এ বিষয়ে। আমরা যে সব দোষ করেছি আপনাদের তুলনায় তা অনেক বেশি। তবে আপনারাও ভুল করেননি, অন্যায় করেননি এমন নয়। পাকিস্তান যা ছিল। আজ আর তা নেই।

* জানতে চাই, কীভাবে এই সহযােগিতামূলক ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা | ঘটবে?

** আমি বলতে চাই, আমাদের দুই পক্ষকে পরস্পর ক্ষমা চাইতে হবে । কেননা, আপনারাও সব সময় ঠিক কাজ করেননি।  * হলাে তাই  কিন্তু এ বিষয়ে কাউকে তাে কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে? মানে দুই তরফকে তাদের সীমানা অবধি এগিয়ে আসতে

 ** না, আমার ধারণায় সর্বোত্তম জিনিসটি হলাে পরস্পরকে বল্য যে, ভাই যা-ই ঘটেছে সে জন্য আমরা দুঃখিত। আর সেটিই সব। “

* ক্ষমা প্রার্থনা করায় কি এমন কিছু অশুদ্ধ হয়ে যায়,.. আমি তাে মনে করি না।  ** আমিও মনে করি না।

* বিষয়টি সম্পর্কে আপনি ইতােমধ্যে বলেছেন। থাক-অনেক বাস্তব তথ্যও বেরিয়েছে আপনার কথা থেকে।

** আমি যা বলেছি, তাতে পাকিস্তানের ভেতরটা আপনারা দেখেছেন। * তাতে কী? বলি…।

** না, না। এ কথাটা বলতে দিন আমাকে। এ ধরনের কথাবার্তা বলতে যথেষ্ট বুকের পাটার প্রয়ােজন হয়।

* আমি সেটা বিশ্বাস করি। ** বিশেষ করে একজন পাঞ্জাবির এ ধরনের কথাবার্তা বলা…। * আমি মনে করি এটি যথেষ্ট তাৎপর্যবহ।

** আসলে এ বিষয়ে চাপা দেয়ার বিষয়টি বেশ কঠিন। আপনার কথা আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি জানি পরস্পর ক্ষমা চাওয়ার যুক্তিযুক্ত নিখুঁত কারণ রয়েছে। কেননা, ভুল করেছে দুই পক্ষই। সবকিছু জগাখিচুড়ি পাকিয়েছি আমরা এধারে, আপনাদের ওদিকে নয়। তবে এসব আর নয়। শেখ মুজিবুর রহমান জয়ী হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে, তার কেন আসার দায় থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানে? আমাদের সে তর্কের অবকাশ নেই।

জেনারেল খালিদ মাহমুদ আরিফের জন্ম ১৯৩০ সালে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন ১৯৪৯ সালে। জেনারেল জিয়াউল হক যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন ১৯৭৭ সালে আরিফকে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেন। ১৯৮৪ সালে উন্নীত হন তিনি জেনারেল পদে এবং তাকে ভাইস চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়। তবে সেনা প্রধানের দায়িত্ব তার ওপরই ন্যস্ত ছিল। ১৯৮৭ সালে। তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর লেখালেখি শুরু করেন। কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার তিনটি উর্দু কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে তিনি দুটি বই লিখেছেন। একটি ওয়ার্কিং উইথ জিয়া, দ্বিতীয়টি খাকি শ্যাডােজ। প্রথমটির সময়কাল ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আমল। দ্বিতীয়টির সময়কাল ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৭। প্রথম বইটির অনেকাংশ ব্যবহৃত হয়েছে দ্বিতীয় বইতে।

দুটি বইয়ের ভঙ্গিই অ্যাকাডেমিক । দুটি বইতেই ১৯৭১ সম্পর্কে দুটি অধ্যায় আছে। তবে, তাতে নিজের মন্তব্য কম। অন্যান্য লেখকদের তথ্যাবলির ওপর ভিত্তি করেই বিবরণ দুটি লেখা।

প্রথম বইতে বাংলাদেশ সংক্রান্ত অধ্যায়টির নাম ‘ঈষ্ট পাকিস্তান অ্যামপিউটেড’। কেন পাকিস্তান ঢাকা হারাল, বিবরণের শেষে এক অনুচ্ছেদে তার কারণগুলি বর্ণনা করেছেন। এতে নতুন কোনাে তথ্য বা মন্তব্য নেই। দ্বিতীয় বইতে এই অনুচ্ছেদই বিস্তারিতভাবে একটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে।

দ্বিতীয় বইটি আত্মজীবনীমূলকও বটে। অ্যাকাডেমিক বিবরণের মাঝে তার স্মৃতিকথাও বিধৃত হয়েছে। এ বইয়ে বাংলাদেশ সংক্রান্ত অধ্যায়ের নাম ‘ডিবাল অ্যাট ঢাকা।

প্রথমেই দেখা যাক পদ্ধতিগত বিষয়টি। তিনি বেশি ব্যবহার করেছেন এ বাসিতের দি ব্রেকিং অব পাকিস্তান ও কামাল মতিনউদ্দিনের উল্লিখিত বইটি। বাসিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিদের ওপর বাঙালিদের অত্যাচারের বিবরণ নিয়েও একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। বাঙালিদের ‘নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিতে গিয়ে অধিকাংশ জেনারেল বাসিতের বইটি ব্যবহার করেছেন। মতিনউদ্দিনও। আর মতিনউদ্দিনের বই সম্পর্কে তাে আগেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং জেনারেল আরিফের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা এখানেই বােঝা যায়, ভঙ্গিটা যতই অ্যাকাডেমিক থাকুক না কেন। | প্রথমেই তিনি লিখেছেন, শূন্য থেকে ১৯৭১ হয়নি। পাকিস্তানের অভ্যন্ত রীণ ব্যর্থতার সুযােগ নিয়েছে শত্রুভাবাপন্ন ভারত। তার মতে, পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য সে সব ব্যক্তিকে দায়ী করতে হবে যারা ব্যর্থ হয়েছে ও দেশের সঙ্গে ঐ টালমাটাল সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এর সঙ্গে জরুরি বাস্তব ও ‘ধারণাকৃত কারণগুলি যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। ১৯৪৭ সালের পর বাঙালি মনে ক্ষোভের অনেক কারণ আছে, যেমন- এলাকার পশ্চাতপদতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং হিন্দু জনসংখ্যার সাংস্কৃতিক আধিপত্য। এছাড়া ছিল কেন্দ্রের প্রশাসনিক ভুল যা এই ধারণার সৃষ্টি করেছিল। যে কেন্দ্র অবহেলা করছে। তাছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সন্দেহজনক ভূমিকা এলাকায় ঝামেলা সৃষ্টি করেছিল।

লক্ষ্য করুন, এমনভাবে বিষয়টা সাজানাে হয়েছে যে, দোষ কার তা নির্ণয়। করা কঠিন। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা জন্মগত। কেন্দ্র ভুল করেছে, করতেই পারে, তাতে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে যা যৌক্তিক নয়। আর এসব হচ্ছে। ‘ধারণাকৃত’। এর সঙ্গে যুক্ত হিন্দু ও ভারতের আধিপত্য।

হিন্দুদের বিষয়টি আবারও এসেছে। তিনি লিখেছেন, সংখ্যালঘিষ্ট হিন্দু অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও সমাজ জীবনে এভাবে বিস্তার করেছিল “far

in excess of its population ratio” (পৃ. ৯৬) আরিফ ভুলে গেছেন ১৯৪৭ সালে প্রভাবশালী হিন্দুরা দলে দলে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে। যারা রয়ে গেল তাদের কিছু স্বইচ্ছায় বা যাওয়ার উপায় ছিল না বলে। তাদের জমিজমা ব্যবসার স্থান পূরণ করেছে বাঙালি ও অবাঙালিরা। আরিফ লিখছেন, ‘Bengali bond’ খুবই শক্তিশালী ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সে সম্পর্ক ছিল না। ইকবাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্রাধিকার পেয়েছেন। সত্যি কথা অবশ্য একটি লিখেছেন, বাঙালিরা, অবাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য উর্দু শিখেছিল, অবাঙালিরা বাংলা শেখেনি। এতে ক্ষোভ ছিল বাঙালির।

কিছু সামান্য সমস্যার কথা উঠেছিল শুরুতে, লিখেছেন আরিফ। যেমন, সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে রাজধানী স্থাপন করা। জিন্নাহ করাচিতে রাজধানী হবে ঘােষণা করে তার সমাধান করেন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন পূর্ব পাকিস্তানিরা। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি আমলাদের ‘stiff-necked’ ব্যবহার পছন্দ করেনি। এরা পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চপদগুলিতে ছিল।

“The popular feeling was that such job opportunities rightfully belonged to the sons of the soil.” [পৃ. ৯৬ এরপর এসেছে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ইত্যাদি। এগুলি আরিফের কাছে ‘minor grievances’। মন্তব্য নিষ্প্রয়ােজন আরিফ আরাে মনে করেন, ইতিহাসও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। “History played an important part in the issue that confronted East Pakistan.” পৃ. ৯৭] যে ইতিহাসের শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে এসব উত্তরাধিকার সূত্রে পান। অর্থাৎ তার কীইবা করার ছিল। নির্বাচনের পর দুই ক্যারিশমেটিক ও জনপ্রিয় নেতার অহঙ্কার উদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি, ইরেশন্যাল ব্যবহার এবং আপসহীন ভঙ্গি দু প্রদেশকে মুখােমুখি দাঁড় করাল। তার ভাষায় “The regional split was accentuated by the egocentric attitude of the two charismatic and populist leader- Mujib and Bhutto- Whose irrational behaviuor and uncompromising attitudes put the country on an irreversible collision course.” (পৃ. ১০৭ | তাহলে অন্তিমে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে, দুই রাজনৈতিক নেতার কারণেই পাকিস্তান ভেঙে গেছে। পুঞ্জিভূত ক্ষোভ; সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখানে গৌণ।

এরপর বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অন্তিমে আরিফ জানাচ্ছেন, শেখ মুজিব সামগ্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ও পাঞ্জাবি ‘শালা’দের বিরুদ্ধে বিষ উগরে বাঙালিদের আবেগকে মথিত করে তুললেন। সমস্ত দোষ পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রশাসনিকভাবে ভারত সূক্ষ্মভাবে এই আবেগকে তাতিয়ে তুলেছিল কীভাবে তার উল্লেখ নেই)। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও একই কাজ করল । সংকটের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত প্রবলভাবে মুক্তিবাহিনীকে প্রভাবিত করল।

শুধু তাই নয়, ২-২৬ মার্চ বাঙালিরা নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা এক লাখ বিহারি ও অবাঙালিকে হত্যা করে। এখানে বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা শুনেছেন, জিয়াউর রহমান তার কমান্ডিং অফিসারকে হত্যা করেছেন অফিসারের ব্যাটম্যানকে দিয়ে। এসব ঘটনা আরিফের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়া পাকিস্তান গেলে তার সম্মানে প্রদত্ত নৈশভােজে তিনি যাননি কারণ তার “Presonal instinct prevented me from lunching with a murderer who had stooped so low as to have his own commanding officer gunned down.” [পৃ. ১২০] তাহলে আরিফদের সঙ্গে বসাই তাে যাবে না যারা ৩০ লাখ হত্যা করেছেন।  আরিফ বিস্মৃত হয়েছেন ২৫ মার্চ কী ঘটেছিল? পরবর্তী নয় মাস কী। হত্যাযজ্ঞ চলেছিল।১ লাখ বিহারি ও বাঙালি হত্যা আমার কাছে অনেক পশ্চিম। . পাকিস্তানিও বলেনি। এরপর সেনাবাহিনীর ভূমিকা, যুদ্ধকালীন কৌশল ইত্যাদি আলােচিত হয়েছে। কোথাও সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়নি। মার্চ-ডিসেম্বর এই নয় মাসে সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ আলােচিত হয়নি। তবে বারবার ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। কীভাবে ভারত ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার । চেষ্টা করেছে। আরিফের এই অধ্যায়ের উপসংহারটি পড়লে বাঙালি, বাংলাদেশ, রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হবে। তিনি লিখছেন “The fall of Dacca resulted from a faulty political situation and weakness in generalship. While impetuous Bhutto and unfaithful Mujib share considerable blame for the national tragedy in 1971, General Yahyah Khan bears the stigma for presiding over the destruction of the country. Pakistan gallant soldiers, sailors and airmen did not get a fair chance to defend their country and demonstrate their skill while faring the orchestrated challenge of internal subversion and external aggression.” পৃ ১৩৭

পাকিস্তান তাহলে ভেঙে ছিল অবিশ্বস্ত’ মুজিবের কারণে। আর কেউ তার। জন্য দোষী নয়। আর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দেশ রক্ষায় পর্যাপ্ত সুযােগ পায়নি-এ মন্তব্যের অর্থ কী? উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে আরিফ ইসলামাবাদে সদর দপ্তরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। পাকিস্তানি আদি সৈনিকদের একজন ব্রিগেডিয়ার জেড. এ. খান বা জহির আলম খান তার পিতা ছিলেন সেনাবাহিনীতে পিতা চাননি, তিনি আসুন সেনাবাহিনীতে কিন্তু জোরজবরদস্তি করে গেছেন সেনাবাহিনীতে পরবর্তীকালে তার ছােট ভাইরাও বিমান ও নৌবাহিনীতে যােগ দিয়েছেন ১৯৪৯ সালে যােগ দেন সেনাবাহিনীতে ১৯৭২ সালে ভূট্টো ক্ষমতায় আসার পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। তার এই সৈনিক জীবনের ইতিবৃত্ত তিনি রচনা করেছেন ইংরেজিতে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত বইটির নাম- The Way It Was. ৩৯৭ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হয়েছে করাচি থেকে প্রকাশ কাল ১৯৯৮ বৃহৎ এই গ্রন্থটির প্রথম নটি অধ্যায় পাকিস্তান পশ্চিম পর্ব । দশম, এগার অধ্যায় পূর্ব পাকিস্তান’ বা বাংলাদেশ নিয়ে। আবার দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ অধ্যায় পাকিস্তান নিয়ে। অর্থাৎ এ গ্রন্থে মাত্র দুটি অধ্যায় রচিত বাংলাদেশ নিয়ে ।  জহির আলমের বর্ণনা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিকশিত হওয়ার সময়টা বােঝা যায়। তিনি যখন সেনাবাহিনীতে যােগ দেন তখন কমান্ডে ছিলেন ইংরেজরা। পরে যারা দায়িত্ব পান তারাও ছিলেন ঔপনিবেশিক বাহিনীর। তার অবসর গ্রহণ কালীন অবস্থা পর্যন্ত সেই কমান্ড স্ট্রাকচারই ছিল। তিনি বিস্ত রিতভাবে প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন ইউনিটের গড়ে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রতিটি পর্যায়েই তার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে। কখনও শাস্তি পেয়েছেন, কখনও বেঁচে গেছেন। এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল এ.ও. মিঠা মন্তব্য করেছেন ভূমিকায় যে, অনেক অফিসারকে বিচার করা হয় দেশ বা সেনাবাহিনীর প্রতি তার আনুগত্য দেখে। তার ভাষায়-:”The demand of some senior for personal loyalty over loyalty to the army and the country.” জহির আলমের প্রমােশন নিয়েও শংকা ছিল। তবে দেরিতে হলেও কর্নেল অব্দি পৌছলেন। ফের কমান্ডারের সঙ্গে বিরােধ বাধলে তিনি ঠিক করলেন বদলি চাইবেন। এরি মধ্যে শুনেছিলেন, চট্টগ্রামে সিভিলিয়ানদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের। কমান্ডিং অফিসারকে বদলি করা হবে। জেনারেল মিঠার কাছে অনুরােধ জানালেন তাকে ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হিসেবে বদলি করার জন্য। তার আবেদন মঞ্জুর করা হলাে। তিনি এলেন বাংলাদেশে। সাল ১৯৭০।

মুক্তিযুদ্ধের অনেকটা সময় ছিলেন তিনি বাংলাদেশে। পুংখানুপুংখভাবে সেই সময়ের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন ফলে, অনেক নতুন তথ্য পাই আমরা বিশেষ করে মেজর মান্নান সম্পর্কে যিনি পরে বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন। তারপর গড়ে তােলার চেষ্টা করেছিলেন ‘বিকল্প ধারা। ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন গঠিত ছিল দুটি কমান্ডাে কম্পানিকে নিয়ে। এর ছিল একটি সদর দফতর প্ল্যাটুন। একটি সিগনাল প্লাটুন এবং একটি ফ্রগম্যান প্লাটুন ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে রুটিন মাফিক কাটাতে হতাে। মেজর আব্দুল মান্নান ছিলেন একটি কোম্পানির কমান্ডার।  জহির যখন কুমিল্লা পৌছলেন [এখানেই ছিল সদর] তখন শুনলেন বিদায়ী কমান্ডার লে. কর্নেল শামসুল হক চৌধুরী রাঙ্গামাটি এবং চট্টগ্রামে গেছেন। বিদায় নিতে। জহির ও চৌধুরী ছিলেন একই কোর্সের চৌধুরী জহিরকে বলেছেন চট্টগ্রাম চলে যেতে। চট্টগ্রামে দুই বন্ধু মিলিত হবেন চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পরিদর্শন শেষে দুজন কুমিল্লায় এসে পৌছলেন কমান্ড গ্রহণ করার প্রথম দিনই তিনি সমস্যায় পড়লেন। খবর পেলেন, রাঙ্গামাটিতে তার ফ্রগম্যান কোম্পানির হাতে একজন খুন হয়েছেন ঘটনাটি ছিল এরকম ফ্রগম্যান ডিটাচমেন্টের প্রশিক্ষণ চলছিল সরকারি রেস্টহাউসে। রাস্তা থেকে দুজন স্থানীয় প্রশিক্ষণ দেখছিলেন। স্পাই হিসেবে তাদের ধরা হয় ক্যাপ্টেন খােক্কার ছিলেন চার্জে। পুলিশের কাছে তাদেরকে হস্তান্তর না করে ফ্রগম্যানরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের রেস্টহাউসের ভেতরে নিয়ে উল্টো করে ঝােলানাে হয় এবং তাদের নাকের কাছে মরিচ পােড়ানাে শুরু হয় যাতে পােড়া মরিচের ধােয়া তারা টেনে নিতে বাধ্য হয় এ প্রক্রিয়ায় নির্যাতনের সময় একজন মারা যান তখন জাল দিয়ে মৃতদেহটি মুড়ে কাপ্তাই লেকে নিক্ষেপ করা হয় পুরাে ঘটনাটি রেস্ট হাউসের চৌকিদার প্রত্যক্ষ করেন এবং তিনি রাঙ্গামাটির ডিসিকে জানান তিনি রিপাোঁ পাঠান সরকারের কাছে। লে. কর্নেল চৌধুরী ইতােমধ্যে বিষয়টি জানতে পেরে রাঙ্গামাটি আসেন। সবকিছু জানার পরও তিনি তা চেপে যান বাকি যে জন বেঁচেছিলেন তাকে নিয়ে এসে কুমিল্লায় ফিল্ড ইনটিলিজেন্স ইউনিটে হস্তান্তর করা হয়। প্রথম দিন প্ররিদর্শনের সময় জহিরের নজরে পড়ে একজন সিভিলিয়ানকে কোয়ার্টারগার্টে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি এর কারণ জানতে চাইলে সুবাদার তাকে ঘটনাটি জানায়।

ইতােমধ্যে গােয়েন্দারা জহিরের কাছে জানতে চান আটক ব্যক্তির সঙ্গে আরেকজন ছিল সে কোথায়। জহির তখন ১৪ ডিভিশন সদর দফতরে ফোন করে জানান, তিনি ঢাকায় কিছু বিষয় আলােচনা করতে চান যা টেলিফোনে আলােচনা করা সম্ভব নয়। জহির তখন ঢাকায় গিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজাকে পুরাে ঘটনাটি জানান। কমান্ড গ্রহণের পর জহির দেখা করেন স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সঙ্গে। এস এস জি তার কমান্ডে না থাকায় শফি অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ, তারা কুমিল্লায় অবস্থান করছে (অর্থাৎ জহিরের নেতৃত্বাধীন। বাহিনী) তিনি জহিরকে নির্দেশ দেন কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করার। জহির তাতে রাজি হলেন না এবং জানালেন এসএসজি অফিসারদের সামরিক আইনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পরে জহির জানলেন লে. কর্নেল চৌধুরী এই দায়িত্ব পালন করতেন। এবং শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে এনে কোয়ার্টার গার্ডে আটকে রেখে সামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ইন্টারগেট করতেন, ভয় দেখাতেন। এসব কারণে, জহিরের মতে, সৈন্যদের মধ্যে “developed arrogance false sense of superiority in the men.” [পৃ. ২৪৬]

জহির এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন । কুমিল্লা সামরিক হাসপাতালে এক সৈন্য গেছে। পরীক্ষার পর তাকে ঔষধ দেয়া হলাে। সে ঐ ঔষধ না নিয়ে অন্য ঔষধ চাইল । এবং তা না দেয়াতে ডাক্তারের দেয়া ঔষধ। ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যায় । হাসপাতালে ঢােকার গেট ছিল দুটি। একটি গেট দিয়ে সরাসরি। হাসপাতালে ঢােকা যেত কিন্তু তা তালাবন্ধ করে রাখা হতাে। যে গেট দিয়ে। ঢুকতে হতাে সেটি ছিল দূরে। দুই সৈন্য জিপ নিয়ে কাছের গেটটি ভেঙ্গে হাসপাতালে ঢােকে। জহির ঘটনা দুটি দেখে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন।  জহির অনুধাবন করেন মার্শাল ল’ এর কারণে এবং এসএসজি’র সদস্য হওয়ায় তার বাহিনীর মধ্যে ঔদ্ধত্য এসেছে। তাদের চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়। জহির জানান, তারা যা করছে তা তাদের উন্নত সৈনিকে পরিণত করছে না। তার ভাষায়-” It was:for the army and the country to point them out as the best soldiers, as the elite of the army, as commandos, it was not for them to claim being superiors.”

পৃ ২৪৬

এরপরও এই উৎপাত বন্ধ হয়নি। দু একটি ঘটনা ঘটতেই থাকে যার বিবরণ আছে জহিরের বইয়ে। জহির পূর্ববঙ্গের গ্রামের একটা বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনায় বােঝা যায় পশ্চিমাদের অনুভূতি ছিল কেমন? তার বর্ণনা থেকে ইঙ্গিত পাই কেন পাকিস্তানের আজ এই করুণ অবস্থা  এর কারণ, অব্যাহত সামরিক শাসন। তারা পেশাদারী সৈনিক হতে চায় নি, তারা চেয়েছে অস্ত্রধারী হয়ে দেশ শাসন করতে। নদী-নালায় ভরা পূর্ব পাকিস্তান। বাড়িগুলাে মাটি ফেলে উঁচু করা জমির ওপর। সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে রেলওয়ের জন্য তৈরি বাঁধ। বাড়িগুলাে বাঁশ, কাঠ, খড়ের তৈরি। সরকারি সব স্থাপনায়, কবে তার নির্মাণ শুরু বা শেষ হয়েছে তার। তারিখ দেয়া আছে। সব তারিখই ১৯৫৮ সালের পর। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচণ্ড গরমেও চাষিকে দেখা যাবে মাঠে কাজ করছে। এখানে সে রকমটি নয়। পাঁচ কোটির মধ্যে খুব কম মানুষই দৃশ্যমান। আবহাওয়ার কারণে খুব সম্ভব এখানে আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, মানুষ দেরিতে ওঠে ১০/১১ টার আগে কাউকে দেখা যায় না। গ্রামে দোকানপাট নেই, সপ্তাহান্তে হাট বসে। সূর্যাস্তের পর গ্রামের কোনাে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে। কোরআন পড়ার ধ্বনি কানে বাজে।  এ বর্ণনা পুরােটা সঠিক বলা যাবে না । ১৯৫৮ সালের পর সরকারি স্থাপনা নির্মাণের গতি বেড়েছে এটি অস্বীকার করা যাবে না । এতে প্রচ্ছন্ন। ” ইঙ্গিত দেয়া আছে সেনা শাসনই উন্নতির চাবিকাঠি। এখানকার মানুষ খুব। ভােরে ক্ষেতে যায়, রােদ উঠলে বিশ্রাম নেয়, আবার ক্ষেতে যায়। এ রুটিনের সঙ্গে জহির তেমন পরিচিত ছিলেন না বলে মনে হয়। সে সময় মানুষ খুব। । রাতেও ঘুমােতে যেত না। রাস্তায় হাঁটলে কোরানের ধ্বনি শােনা যায়। জহির। ১৯৭১ সালে এখানে ছিলেন। তখন এই কোরান পড়া মানুষগুলােকে কেন খুন। করা হলাে তার কোনাে উত্তর তিনি রেখে যাননি। তবে ঐ অনুচ্ছেদের দুটি বাক্য গুরুত্বপূর্ণ। লিখেছেন তিনি, কোনাে গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে বা গ্রামে গেলে একটা অনুভূতি হয় যে তুমি বিদেশে আছ, তুমি কাউকে বােঝ না, তােমাকে কেউ বােঝে না। তার ভাষায়- “While walking through a village or in a ‘haat’ the feeling was that you were in a foreign country, you could understand nobody and nobody understand you.”পৃ ২৪৯)

পশ্চিমারা যে এ অঞ্চলে আর পছন্দীয় নয় অকপটে তা স্বীকার করেছেন। জহির । লিখেছেন তিনি, কুমিল্লায় কেনাকাটা করতে যেয়ে তারা বুঝলেন যে, কেউ তাদের পছন্দ করছে না। কোনাে দোকানে গেলে কাউন্টারে দাঁড়ানাে। ব্যক্তি বা সেলসম্যান সরে যেত । ডাকাডাকি করলে আসত এবং এলেও বাংলায় কথা বলত যা আমরা বুঝতাম না। ধারণা করতাম, দোকানদার উর্দু কিছু কিছু বুঝত অধিকাংশ সময় কেনাকাটায় ক্ষান্ত দিয়ে তাদের ফিরতে হতাে । রেলওয়ে স্টেশনের মতাে জায়গায় কর্মচারীরা একমাত্র বাংলায় বলত এবং তা প্রায়ই ঝগড়ায় রূপ নিত। জহিরের কাছে কখনও মনে হয়নি তাদের বাংলা জানাটাও জরুরি ছিল। কিন্তু তারা ধরেই নিয়েছে যে, হয় বাঙালিরা উর্দু জানবে এবং বলবে। তবে তিনি সঠিক মন্তব্যই করেছেন এ বলে যে, “Language was the great divide”. পূর্ববঙ্গের বর্ণনা দিচ্ছেন জহির, বাস্তব পরিস্থিতিও তুলে ধরছেন কিন্তু সেই পূর্ব ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না। সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কাজ করার সময় কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন  তাতে এর ইঙ্গিত পাই। বন্যার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গম এসেছে বিলি বন্দোবস্তের জন্য । পরিবারের আকার দেখে গম বিলি হবে। জহির গেছেন গম বিতরণ পরিদর্শন করতে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলাে সবকিছু ঠিকঠাক মতােই চলছে। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্য করলেন গম নেয়ার পর লােকজন গ্রামের অন্য প্রান্তে যাবার জন্য হাটছে। কৌতূহলী হয়ে তিনিও হাঁটা শুরু করলেন। এবং কী দেখলেন? দেখলেন, এক হিন্দু বানিয়া দোকান সাজিয়ে বসে গম কিনছে। গম নিয়ে গম বিক্রি করে দেয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু “বানিয়া” হিন্দুই হবে, মুসলমান নয়। কারণ, হিন্দুরাই শশাষণ করছে।  জহির লক্ষ্য করেছেন কুমিল্লার ডিসি এসপিও তাকে এড়িয়ে চলেন। তাদের সবসময় ডেকে পাঠাতে হতাে। তাকে অবাক করেছে যা তা হলাে সামান্য কিছু কর্মচারী জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে এক লক্ষ লােকের দেখাশােনা করত। | রাজনীতিবিদদের প্রতি তাদের মনােভাব দেখা যাক। জহির এ পর্যন্ত বর্ণনা যত নিরপেক্ষভাবে দেয়ারই চেষ্টা করুন না কেন এই পর্যায়ে এসে তার খাটি সামরিক মন পরিস্ফুট হয়েছে। তিনি লিখেছেন, মার্শাল ল’র কাজ করার সময় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু “none of them impressed me”। কমিউনিস্ট পার্টির একজনের সঙ্গে কমিউনিজম সম্পর্কে আলােচনার পর মনে হলাে, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং “could not explain what he represented.” নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হলাে। ছুটির পর বাঙালি সৈন্য যারা ব্যাটালিয়নে ফিরে আসছিল তাদের কাছ থেকে জানা গেল, আওয়ামী লীগ পেশির ওপর নির্ভর করবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলােকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। (পৃ. ২৫৩) এ মন্তব্যটি সব সামরিক অফিসারই করেছেন।

ঢাকায় তার সঙ্গে গােয়েন্দা দফতরের লে. কর্নেল রিয়াজ শেখের সঙ্গে দেখা হলাে। তিনি জানালেন মুজিব ৩৭% আসন জিতবেন, ভাসানীও প্রায় কাছাকাছি থাকবেন আর বাকি ২৫ ভাগ অন্যান্য ছােট ছােট রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে । গােয়েন্দা দফতরের এ ধরনের ধারণা একমাত্র পাকিস্তানি বাহিনীতে ছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আমলেও আমরা তা দেখতে পাই। অর্থাৎ, গােয়েন্দা দফতরগুলাে প্রায় ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা নয় নিজেদের অবস্থানের পক্ষে রিপোের্ট দেয় ও শাসকদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর ধারণার সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা এর প্রমাণ। | মিজোদের যে পাকিস্তানিরা সাহায্য করত তা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন জহির। মিজোদের থাকা-খাওয়ার সব বন্দোবস্ত করেছিল পাকিস্তান সরকার। রাঙ্গামাটির ডিসি নিত্য অভিযােগ করতেন মিজোদের বিরুদ্ধে এ বলে যে, এরা। শৃঙ্খলা মানে না, নিয়ত বন্যপ্রাণী ও বন ধ্বংস করছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বললে জহির বিষয়টি তদন্ত করে জানলেন, যতটা বলা হয়েছে ততটা ক্ষতি তারা করেনি। মিজোদের অভিযােগ ডিসি তাদের খাবার আটকে রেখেছেন। তিনি চান, তারা যেন ভারতে ফিরে যায় ।

সাইক্লোনের পরের অবস্থা তিনি উল্লেখ করেছেন । এ বর্ণনাও অন্যান্য জেনারেলদের মতাে। তার মতে, ত্রাণ কাজে যাদের নিয়ােগ করা হয়েছিল। তারা ত্রাণ বিষয়ে ছিল উদাস। ফ্রি ওয়ার্ল্ড প্রেসের কারসাজিও তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে তারা আসতেন। খবর পেয়ে হেলিপ্যাডে ক্ষুধার্ত, জীর্ণশীর্ণ পুরুষ, মহিলা, শিশুদের জড়াে করা হতাে। রিপাের্টাররা তাদের পছন্দ মতাে ‘মডেল’ বেছে নিয়ে ছবি তুলত পয়সা দিয়ে। একইভাবে লাশ ভাসছে এমন কিছু জায়গা নির্বাচন করে রাখা হতাে ছবি তােলার জন্য। ত্রাণের সামগ্রী এখানে বেচা কেনা চলত । এ সবই যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামরিক শাসন চলছে সেনাবাহিনী ক্ষমতায়, ত্রাণ কাজ চালানাের দায়িত্বও তারা নিয়েছে । তারা। যখন বাঙালি অফিসারদের দেখছে কাজ করছে না তখন ব্যবস্থা নেয়নি কেন ? ছবি তােলার মডেল নির্বাচনে বাধা দেয়নি কেন? বা মরদেহ দেখাবার যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা বন্ধ করেনি কেন? প্রকাশ্যে ত্রাণ সামগ্রী বেচাকেনা হলাে আর তারা চোখ বুজে থাকলাে এ কেমন কথা? জহিরের মতে, সেনাবাহিনীর সবাই শুধু প্রশাসনেই খেটেছে দিনরাত, কিন্তু প্রচার পায়নি। এর জন্য সরকারি অব্যবস্থাপনা দায়ী।

আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন যাতে বােঝা যায় সেনাবাহিনীতে তখনই দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। তার একসময়ের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন আলম বদলি হয়েছে ইপিআরে । আলমের সঙ্গে দেখা হতে তিনি আলমকে জানালেন, আলম ভাগ্যবান যে ইপিআরে তার চাকরি হয়েছে। আলম জানাল এ জন্য তাকে ৫০০০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। পরবর্তীকালে সস্ত্রীক আলমকে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীর এই ঘুষ লেনদেন সম্পর্কে জহির কিন্তু কোনাে মন্তব্যই করেননি। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলাে। ভাসানী নির্বাচনে গেলেন না। মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী জহিরকে জানালেন যে , ইয়াহিয়া খান তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখায় তারা কোনাে কিছুই করতে পারছেন না। জহিরের ভাষায় “The Awami League with its strong arm suppressed (*19 Tall লক্ষ্য করুন ] all other parties and won 167 seats out of 169.” [পৃ. ২৫৮]। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৪ ডিভিশনের দফতর প্রধান ব্রিগেডিয়ার শফি ও জহিরকে ডেকে পাঠালেন ব্রিফিংয়ের জন্য। তাদের জানানাে হলাে, ৩ তারিখ সংসদ অধিবেশন হবে না। এ ঘােষণা আসবে ১ তারিখ। ফলে, প্রবল প্রতিক্রিয়া হবে। ১০০ জনের একটি তালিকা দেখানাে হলাে যাদের গ্রেফতার করা হবে। ব্রিফিংয়ের পর তাদেরকে কুমিল্লা যেয়ে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হলাে। ২৩ মার্চ দুপুরে ঢাকা থেকে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে একটি সি-১৩০ বিমান অবতরণ করল কুমিল্লা বিমান বন্দরে। দেশজুড়ে হরতাল। সৈন্যদের জন্য খাদ্য সামগ্রী নিয়ে এসেছে বিমানটি। জহির এই প্লেনে ঢাকা যাবেন। তাকে সদর দফতরে তলব করা হয়েছে। বিমান বন্দরে যাওয়ার পথে দেখলেন, একটি ন্যাংটো বালক দাড়িয়ে আছে পথের পাশে। জহিরের গাড়ি দেখে চিৎকার করে বলে উঠল-জয় বাংলা। জহিরের ছােট কন্যাটিও সময় সময় চিৎকার করে বলে ওঠে ‘জয় বাংলা’ । আর তার বড় বােন তখন তাকে থামাতে ছােটে। ২৩ তারিখ পাকিস্তান দিবস। ঢাকায় অবতরণের আগে শূন্য থেকে দেখলেন সব বাড়ির ছাদে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। মেজর বিল্লাল তাকে নিতে এসেছিলেন বিমান বন্দরে  জানালেন, মহম্মদপুরে এক বিহারির বাসার ছাদে মাত্র উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা । জহিরকে বিল্লাল নিয়ে গেলেন কর্নেল এস ডি আহমদের কাছে। তিনি জানালেন ২৪ অথবা ২৫ তারিখে গ্রেফতার করতে হবে শেখ মুজিবকে। তাকে গ্রেফতারের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে জহিরকে। রেকি করার জন্য ইউনাইটেড ব্যাংকের জোনাল ম্যানেজারের কাছ থেকে দুটি গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ি দুটিও থাকবে জহিরের কাছে। সেদিন বিকেলে রেকি করার জন্য মেজর বিল্লাল ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নং এ পৌছালেন ।

বাড়ির সামনে ভিড়। তার মধ্যে দেখলেন একদল হিন্দু বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। একদল মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা হিন্দু না মুসলমান তা জহির কীভাবে বুঝলেন তা জানাননি। এ বাক্যটি লেখার অর্থ, পাঠকের মনে এ ধারণার সৃষ্টি করা, পাকিস্তান ভাঙ্গার পিছে। হিন্দুদের প্ররােচনা বেশি। এবং এতে প্রণােদনা যুগিয়েছিল হিন্দু ভারত । ২৪ মার্চ জহিরকে বলা হয়েছিল সকাল এগারােটায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফরমান সেখানে তাকে। ফর্মালি শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেবেন। জহির জেনারেলের অফিসে গেলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, ২৫ তারিখ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য। নির্দেশ শুনে স্যালুট করে যখন তিনি বেরুচ্ছেন তখন ফরমান তাকে। ডেকে বললেন, “তুমি কি জানতে চাও না কিভাবে তাকে গ্রেফতার করতে হবে? জহির জানালেন, অর্ডার শােনার পর রীতিটা হচ্ছে প্রশ্ন না করা। অর্ডার পালন করা। কিন্তু তার যদি আরাে কিছু নির্দেশ থাকে তবে তিনি তা বলতে পারেন। ফরমান বললেন, একজন অফিসার নিয়ে সিভিলিয়ান একটি গাড়িতে যেয়ে তাকে এই গ্রেফতার পর্ব সারতে হবে।’ জহির জানালেন- শেখ সাহেবের বাসার সামনে যে রকম ভিড় থাকে তাতে ঐ প্রক্রিয়ায় তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে হলে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে যেতে হবে। ফরমান বললেন, তিনি তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তা পালনের জন্য। জহির বললেন, সে নির্দেশ তিনি গ্রহণ করছেন না, জেনারেল অন্য কাউকে সে নির্দেশ দিতে পারেন। তারপর ফরমান কিছু বলার আগেই স্যালুট করে তিনি চলে গেলেন। জহির পরে অনুধাবন করলেন, তার এই ব্যবহারের জন্য তিনি ঝামেলায় পড়তে পারেন সারাদিন তাই এমন সব জায়গায় রইলেন যেন তাকে কেউ যােগাযােগ করতে না পারে।

পরদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল, মেজর জেনারেল এম ও মিঠার আসার কথা। মিঠা আবার জহিরের শুভানুধ্যায়ী। বিকেল পাঁচটায় মিঠা পৌছলেন বিমান বন্দরে জহির সেখানে তার সঙ্গে দেখা করে সব জানালেন। জেনারেল জানালেন ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে তার সঙ্গে সকাল ৯ টায় দেখা করার জন্য। সকাল ৯ টায় জহির গেলেন ইস্টার্ন কমান্ডের জি এস কর্নেল আকবরের অফিসে। সেখানে ঢুকে দেখেন , ফরমান আলী বসে আছেন। জহিরকে দেখে ফরমান জিজ্ঞেস করলেন, তিনি এখানে কেন এসেছেন? জহির বললেন, মেজর জেনারেল মিঠার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কর্নেল আকবরকে ফরমান নির্দেশ দিলেন ১৫ মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার যােগাড় করে জহিরকে যেন কুমিল্লায় ফেরৎ পাঠানাে হয় । জহির আকবরকে জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল মিঠা এখানে আসবেন কিনা। আকবর জানালেন, মিঠা এখন লে. জে. টিক্কাখানের সাথে কথা বলছেন। জহির তখন এমনভাবে বসলেন, যাতে টিক্কা খানের অফিসের দরজা খােলার সাথে সাথে তিনি দেখতে পারেন। অস্বস্তিকর ১৫ মিনিটের পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মিঠা। ছুটে গিয়ে মিঠার সামনে পৌছে ঘটনা জানালেন তাকে। মিঠা নিজের গাড়িতে ওঠার সময় জহিরকে। গাড়িতে তুলে নিলেন। মিঠা যাচ্ছেন জেনারেল আবদুল হামিদ খানের সঙ্গে দেখা করতে। হামিদ তখন ঢাকায়। জেনারেল হামিদ যে বাংলােতে উঠেছিলেন গাড়ি সেখানে পৌছাল। জহির ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক ঘণ্টা পর তার ডাক পড়ল, ভেতরে । মিঠা জহিরকে বললেন, পুরাে ঘটনাটা হামিদকে জানাতে। সব শুনে হামিদ ফরমান আলীকে ফোন করে জানালেন, জহিরকে তিনি পাঠাচ্ছেন এবং তার যা প্রয়ােজন ফরমান যেন তার ব্যবস্থা করেন। তারপর জেনারেল হামিদ জহিরকে বললেন, শেখ মুজিবকে জ্যান্ত ধরতে হবে। জহির যখন বেরুচ্ছেন তখন হামিদ তাকে আবার বললেন, “remember he is to be taken alive:and I will hold you personally responsible if he is killed. পৃ ২৬৪

জহির এরপর গেলেন ফরমান আলীর অফিসে.): ফরমান তাকে জিজ্ঞেস করলেন কী কী তার প্রয়ােজন। জহির বললেন, ট্রুপস নেয়ার জন্য তিনটি গাড়ি এবং বাড়ির লে আউট।’ ফরমানের কাছে লে আউট ছিল, তা জহিরকে। দিলেন। আশ্বাস দিলেন গাড়িও পৌঁছে যাবে। তারপর জহির বললেন, মুজিবের বাসার পিছে জাপানি কনসাল জেনারেলের বাসা। তিনি যদি সেখানে আশ্রয় নেন তখন কী হবে? ফরমান বললেন, বুঝে সুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। শেখ মুজিবের বাড়ি ও সেখানে যাবার রাস্তার একটি মডেল তৈরি করা হলাে। অস্ত্র বিলি হলাে রাতের খাবারের পর মডেল সামনে রেখে জহির ব্রিফ করলেন। তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হলাে কোম্পানিকে। ২৫ জনের এক গ্রুপে  নেতৃত্বে থাকবেন ক্যাপ্টেন সাইদ। তার কাজ শেখ সাহেবের বাসার অভিমুখে যত রাস্তা তা বন্ধ করা বিশেষ করে জাপানি কনসালের বাসায় যাতে কেউ ঢুকতে না পারে তার বন্দোবস্ত করা। ২৫ জনের দ্বিতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে থাকবেন ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। তারা শেখ মুজিবের বাসা ঘেরাও করে বাসায় ঢুকবেন। ১২ জনের তৃতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে থাকবেন মেজর বিল্লাল। তিনি মুজিবের বাসার প্রতি তলা তল্লাশী করবেন।  ঠিক হলাে রাত ১২ টায় অভিযান শুরু হবে ১০ টার সময় ক্যাপ্টেন হুমায়ুন এসে রিপাের্ট করলেন। রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছে জহির তাকে বললেন দুটি রকেট ও রকেট লাঞ্চার নিয়ে নিতে ১১ টার সময় তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে এম এন এ হােস্টেলের পাশ দিয়ে মােহাম্মদপুরের দিকে জহিরের নেতৃত্বে কনভয়ের যাত্রা শুরু হলাে কয়েকমিনিট পর দেখা গেল, প্রতিরােধকারীরা রাস্তা বন্ধের জন্য যে ক’টি গাড়ি এনে রেখেছিল রাস্তার মাঝে সেগুলাে জ্বলছে, প্রতিরােধকারীরা পালিয়েছে। অনেক কষ্টে রােড ব্লক উঠিয়ে ২০০ গজ এগােনাের পর আরেকটি রােড ব্লক চোখে পড়ল  পাইপ দিয়ে রাস্তা আটকানাে হয়েছে। ট্রাক চালাবার মতাে জায়গা করে রােড ব্লক সরানাে হলাে। শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে এসে পরিকল্পনা মতাে ব্যুহ তৈরি করে সৈন্যরা ঢুকল গুলি চালানাের নির্দেশ দেয়া হলাে বাড়ির কম্পাউন্ডে থাকা কিছু লােক গেট খুলে পালাতে লাগল । নিহত হলাে একজন। বাড়ির বাইরে তাবু খাটিয়ে যে সব পুলিশরা পাহারা দিচ্ছিল তারা তাবুসহ লেকের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ল।

চারদিকে ঘন অন্ধকার। | সার্চপার্টি ঘরে ঢুকল। বাড়ির একজন গার্ডকে এক সৈন্য বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। খানিকটা যেতেই সেই গার্ড একটি দা বের করে সৈনটিকে আক্রমণ করল। সে জানত না পেছনে কভার দিচ্ছে আরেকজন। গার্ডকে গুলি করা হলাে কিন্তু হত্যা করা হয়নি। নিচতলায় কাউকে পাওয়া গেল না। দোতলায় রুমগুলি খােলা, কেউ | নেই। একটি রুমের ভেতর থেকে আটকানাে । জহির উপরে উঠলে একজন জানাল, বন্ধ ঘরের ভেতর কথাবার্তা শােনা যাচ্ছে। মেজর বিল্লালকে জহির নির্দেশ দিলেন দরজা ভাঙ্গতে এবং নিজে নিচে নেমে গেলেন ক্যাপ্টেন সাইদ এসেছে কিনা বা মানুষজন ভিড় করছে কিনা দেখতে। নিচে নেমে দেখলেন সাইদ এসেছে। একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে সাবমেশিনগানের গুলির আওয়াজ পেলেন। জহিরের মনে হলাে কেউ বােধহয় শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। তিনি ছুটলেন ওপরে। দেখলেন যে দরজাটি বন্ধ তার সামনে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব। জহির মুজিবকে বললেন, তার সাথে যেতে হবে। শেখ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, পরিবার পরিজন থেকে তিনি বিদায় নিতে পারেন কিনা। জহির বললেন, অবশ্যই। শেখ মুজিব ভেতরে গিয়ে বিদায় নিলেন। জহির রেডিও মারফত জানালেন, শেখ মুজিবকে তারা পেয়েছেন। গাড়িতে ওঠার আগে শেখ মুজিব বললেন, তিনি পাইপ ফেলে এসেছেন। জহির তার সঙ্গে ওপরে গেলেন। জহিরের মতে, শেখ সাহেব ইতােমধ্যে বুঝে ফেলেছেন তাকে হত্যা করা হবে না। জহিরকে তিনি বললেন, এত ঝামেলার দরকার ছিল না। তাকে বললেই তিনি চলে আসতেন জহির জানালেন, তারা দেখাতে চেয়েছেন যে শেখ মুজিবকে তারা গ্রেফতার করতে পারেন। শেখ মুজিবকে বহরের সাথে একটি গাড়িতে রাখা হলাে গাড়ি চলল। ক্যান্টনমেন্টের দিকে। পরে জহির জেনেছেন তিনি যখন নিচে ছিলেন তখন দরজা ভাঙ্গার আওয়াজ করা হয় এবং একজন একটি গুলি করে। শব্দটা এসেছিল বারান্দা থেকে। কেউ কিছু বলার আগে তখন এক সৈন্য বারান্দায় একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে ও আরেকজন মেশিনগান চালায়। শেখ মুজিব ভেতর থেকে বলে ওঠেন, তার কোনাে ক্ষতি করা না হলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। তাকে আশ্বাস দেয়া হলাে। তিনি যখন বেরিয়ে এলেন তখন হাবিলদার খান ওয়াজির তাঁকে সজোরে একটি চড় মারে। | জহিরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য। কিন্তু কোথায় নিয়ে কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে সে সবের কিছু জানানাে হয়নি। জহির নিজের বুঝ অনুসারে তাকে সংসদ ভবনে নিয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাকে সেখানে আটকে রেখে পরবর্তী নির্দেশ জানতে যাবেন। সংসদ ভবনের সামনে জিপ থামিয়ে একটি সিট খুলে ল্যান্ডিং এ শেখ সাহেবকে বসালেন। এ সময় ফার্মগেট থেকে প্রচুর মানুষের গােলযােগের আওয়াজ পেলেন। তারা ভাবলেন লােকজন বােধহয় সংসদ ভবনের দিকে আসছেন। তারা প্রতিরােধের প্রস্তুতি নিলেন। কিছুক্ষণ পর সেই শব্দ মিলিয়ে গেল পরে জেনেছিলেন, ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য আওয়ামী লীগ কিছু লােক জড়াে করেছিল, ফার্মগেটে তারাই ছিল। পরে দলবেঁধে তারা পালিয়ে যায়। সংসদ ভবন থেকে জহির গেলেন সামরিক আইন প্রশাসকের দফতরে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন টিক্কা খান।

ব্রিগেডিয়ার জিলানী ছিলেন সেখানে, তিনি তখন ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করছেন। জিলানীকে জহির জানালেন শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে তিনি সংসদ ভবনে। রেখে এসেছেন। টিক্কা খান শান্তভাবে বসেছিলেন। ইতােমধ্যে তিনি নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন গ্রেফতারের। ফর্মালি তিনি তা জানতে চাচ্ছিলেন। জহির তামাশা করার জন্য তাকে বললেন, তিনি একজনকে গ্রেফতার করেছেন। মনে হচ্ছে তিনি মুজিব কিন্তু নিশ্চিত নন। এ কথা শুনে টিক্কা খান লাফ দিয়ে চেয়ার  ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জিলানী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জহিরের কথা শুনে টিক্কা খানকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি খবর নিচ্ছেন। কর্নেল এস ডি আহমেদকে তিনি পাঠালেন সংসদ ভবনে, খবর নিয়ে আসার জন্য। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি আসল নাকি নকল মুজিব। জহির বাইরে এসে সিগারেট ধরালেন। সদর দরজার সীমানায় একজন সৈনিক লাইট মেশিনগান নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। সে কিছু দেখতে পেয়ে নাকি অজান্তে ট্রিগারে চাপ দিল। গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ তারপর ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে যত অস্ত্র ছিল সবগুলি থেকে গুলির আওয়াজ শােনা গেল। অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান থেকে ট্রেসার ছোঁড়া হতে লাগল  কয়েকমিনিট পর আচমকা আবার সব থেমে গেল। কর্নেল এস ডি আহমেদ মিনিট বিশেক পর ফিরে জানালেন, আসল মুজিবকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে কী করা হবে তখনও সে বিষয়ে স্পষ্ট কেউ কিছু বলতে পারছিল না। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তাকে ক্যান্টনমেন্ট যে কক্ষে রাখা হয়েছিল সেখানেই রাখা হবে। ১৪ ডিভিশনের অফিসার্স মেসে একটি বেডরুমে শেখ মুজিবকে রাখা হলাে। প্রহরী রাখা হলাে একজন। পরেরদিন জেনারেল মিঠা জহিরকে জিজ্ঞেস করলেন, শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হয়েছে জহির জানালেন ক্ষুব্ধ, হলেন মিঠা  বললেন, অবস্থা সম্পর্কে কারাে কোনাে ধারণা নেই মনে হচ্ছে। কারণ, যে কোনাে সময় তাকে মুক্ত করার চেষ্টা হতে পারে পরে, মিঠা একটি স্কুল বিল্ডিংয়ের তিনতলায় শেখ মুজিবকে স্থানান্তর করেন। 

সূত্র : পাকিস্তানী জেনারেলদের মন -বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!