১৯৭১ ছিল ইমেজের সূর্যাস্ত (দি সানসেট অব দি ইমেজ)। এ অধ্যায়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সে সময় সিদ্দিকী সামরিক বাহিনীর জনসংযােগের প্রধান ছিলেন। এবং তার ব্রিফ ছিল, বিশ্ববাসীকে বােঝানাে যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সিদ্দিকি জানাচ্ছেন, নির্বাচনের পর সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভাব-ই জাগছিল যে তারা অপাংক্তেয়। জাতীয় সব কর্মকাণ্ড থেকে তারা বাদ পড়ে যাবে। ১৩ বছরের সামরিক শাসনে তারা পেয়েছিল অপার ক্ষমতার স্বাদ। সামরিকবাহিনীর স্থান যেখানে হওয়া উচিত, নির্বাচন তাদের সে স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তাছাড়া অন্য একটি বিষয়ও ছিল। বাঙালিরা এখন ক্ষমতায় আসবে, আরাে বাঙালি সেনাবাহিনীতে আসবে, ভারতের সঙ্গে শান্তি স্থাপিত “The consequent domination of the West Pakistan military power and of its image.” ‘ এ বক্তব্য থেকেই আমরা জেনারেলদের মানসিক জগতের ধারণা পাই। আসলে, কখনােই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। গােয়েন্দা রিপাের্টও তাই বলছিল সুতরাং, সেনাবাহিনীই শাসন চালাবে নির্বাচনের ফলাফল তাদের ছক উল্টে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে এ সময় একটি ঘটনা ঘটে, জানিয়েছেন সিদ্দিকি। সেনাবাহিনীর ইমেজ তখন বাঙালিদের কাছে আলাদা কিছু নয়। তারা আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা এক যারা দমিয়ে রাখতে চায় বাঙালিকে এ পরিস্থিতিতে ৯ মার্চ সেনাবাহিনীর চাপে প্রাদেশিক সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় এ পর্যন্ত ১৭২ জন নিহত হয়েছে, এর মধ্যে ২৩ জন নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর দ্বারা। সেনাবাহিনী বােঝাতে চেয়েছিল, বাঙালিদের ওপর শুধু তারা নয়, পুলিশও গুলি চালাচ্ছে এবং সিংহভাগ মানুষ মারা গেছে বাঙালির গুলিতে! এতদিন বাঙালি আধা-সামরিকবাহিনী বা পুলিশ, পশ্চিম পাকিস্তানি ওপরঅলার হুকুম শুনছিল কিন্তু এবার তারা শংকিত হয়ে পড়ে এবং ক্রুদ্ধও। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত সবখানে এখন বাঙালি-অবাঙালি বিভেদের সৃষ্টি হয়। এর দশ দিন পর জয়দেবপুরে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আবরারের হুকুম মানতে বাঙালি সৈন্যরা অস্বীকার করে। জেনারেলরা যে কী রকম জেনােফোবিয়ায় ভুগছিলেন তার একটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। সিদ্দিকি লিখেছিলেন, দি পিপল-এ প্রতিদিন সামরিক শাসনবিরােধী প্রবন্ধ প্রকাশিত হতাে। জ্বালাময়ী এরকম একটি প্রবন্ধের নাম ছিল- “Whos who in the Aviary লেখক একজন শওকত ওসমান।
তিনি জানাচ্ছেন, আসলে এটি ছিল কর্নেল ওসমানীর লেখা সামরিকবাহিনীর জনসংযােগের প্রধানের ধারণা ছিল এরকম! পত্র-পত্রিকায় তখন নিয়মিত সামরিকবাহিনীর বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছিল, বিশেষ করে দি পিপল-এ। (বাংলা তারা পড়তে জানত না দেখেই পিপল-এর কথা ঘুরেফিরে এসেছে)। সিদ্দিকি জানাচ্ছেন, সেনাবাহিনী ক্রমেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিল এবং “The mere word Bengali stank in their nostrils.” বাঙালিরা তাদের কাছে ছিল বিদেশী আর বাঙালিদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিদেশী। যে-কারণে ২৫ মার্চ প্রথমেই দি পিপল-এর অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ, ঢাকা শহরে কোনাে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ না দেখে ইয়াহিয়া খান কুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তখনই প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। তারপর এলাে ২৫ মার্চ। ২৬ মার্চ বিদেশী সাংবাদিকদের ফেরৎ পাঠানাে হলাে। সিদ্দিকি লিখেছেন, ও-কারণেই তারা পাকিস্তানবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই জানাচ্ছেন, ভাগ্যিস ২৬ মার্চ তাদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। না হলে ২৬ মার্চ সকালে ঢাকার রাস্তায় বেরুতে পারলে আরাে খারাপ হতাে কারণ, “It was a picture of death and desolation.” এ সময় জনসংযােগের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তথ্যসচিব রােয়েদাদ খান। তিনি তখন অত্যন্ত ক্ষমতাবান ব্যক্তি, জানাচ্ছেন সিদ্দিকি, তার কাছে “Every problem was ultimately a PR problem.” তিনি বাঙালিদের মধ্যে আল্লাহর ভয়’ ঢােকাতে চাচ্ছিলেন। প্রয়ােজনে, বাঙালিকে জাতি: শুদ্ধ করার ব্যবস্থাও। শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তান নিয়ে গেলে, রােয়েদাদ বলেছিলেন, “Let the world know that the bastard is in our hands.” Astra foto utao 2747 দিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এ সময় সাংবাদিকদের নিয়ে আসা হয় পূর্ব পাকিস্তানে তারা তাদের ডেসপ্যাচে পাকিস্তানি সৈনিকদের বীরত্ব তুলে ধরতে থাকেন।
কিন্তু সমস্যা হলাে, সিদ্দিকি লিখছেন, সবই যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধ করছিল কেন? এই কন্ট্রাডিকশন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা মাথা ঘামায়নি। তারা খুশি ছিল যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে বেশ ভালাে কাজ করছে। এভাবে সিদ্দিকি লিখেছেন, সেনাবাহিনীর এতদিনকার গড়ে ওঠা ইমেজে ফাটল ধরল। “It was ‘foregin’ in the East and ‘national in the West, a devoted and a self sacrificing fighting force for one wing and an engine of oppression for the other.” Cortiotcs, একজন সৈনিকের মনে সন্দেহ জাগছিল, তারা কীভাবে কাউন্টার ইনসারজেন্সির বিরুদ্ধে লড়বে যার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ নেই। তাই একমাত্র প্রপাগাণ্ডায়-ই তারা স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিল ইয়াহিয়া তখন আদেশ দিয়েছিলেন পূর্ণোদ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানাের। শ্বেতপত্র প্রকাশের তােড়জোড় শুরু হলাে। নির্মিত হলাে ডকুমেন্টারি ‘দি গ্রেট ব্রিটেয়াল’, এ ব্যাপারে সব ধরনের সহায়তা করলেন বাঙালি অধ্যাপক জি. ডব্লিউ. চৌধুরী। ইয়াহিয়া ও জেনারেলরা ছবিটা দেখলেন। ছবি শেষ হলে, ইয়াহিয়া প্রশ্ন করলেন, “I hope all the devastation shown in the film is not result of army action.” ছবিটি আর রিলিজ করা হয়নি। সিদ্দিকি ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির যতই অবনতি হচ্ছে, ততই প্রচারণা চলছে- সব স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, জেনারেলরা সবাই জানতেন বাংলাদেশে কী ঘটেছে। ঘটনা আর তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। প্রপাগাণ্ডার আড়ালে তারা স্বস্তি খুঁজছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের পর এতদিনের গড়ে ওঠা ইমেজ ভেঙে খানখান হয়ে যায়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, সিদ্দিকি তার কুশীলব যাদের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের প্রায় সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কী ঘটেছিল? তারা কি তা জানতেন? সবাই একবাক্যে বলছেন, না তারা জানতেন না। এমনকি রােয়েদাদ খানও একই কথা বলেছেন। অন্য জেনারেলদের থেকে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির বইটি অনেক বেশি অবজেকটিভ।
তিনি তুলে ধরেছেন, কীভাবে ফাঁকা বুলির উপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর ইমেজ গড়ে উঠেছিল যার সঙ্গে বাস্তবের কোনাে মিল ছিল না। এবং কীভাবে সে প্রচারণা আবার দু’প্রদেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করছিল। বাস্তবতার সঙ্গে জেনারেলদের কোনাে ধারণা না থাকায় মিথ্যার ওপর গড়ে ওঠা এ ইমেজ ১৯৭১ সালে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। এ ইমেজ তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য। এখনও পাকিস্তানে তারা আবার সে ইমেজ গড়ে তুলতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। বাংলাদেশের পরাজয়ের শােধ তুলতে তারা জড়িয়ে পড়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানেও তারা মার খেয়েছে। যে কারণে, নওয়াজ শরিফের পক্ষে সম্ভব হয়েছে সামরিকবাহিনীর প্রধানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা যা পাকিস্তানের ইতিহাস বিচার করলে অভূতপূর্ব ঘটনা। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তানিদের সাহায্য করছে। গণতন্ত্রের পথে যেতে। অবজেকটিভ হওয়া সত্ত্বেও লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ অন্তিমে তার কাছেও ছিল পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। বাঙালিরা যে ন্যায্য বিচারের জন্য যুদ্ধ করেছে তা তার বইতে একেবারেই অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, তাঁর এক লেখায় (পরিশিষ্ট : ৫) উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে সংকটের জন্য উভয় অংশই দায়ী। এবং মুজিব-ভূট্টো দুজনেই এর জন্য দায়ী। তার ভাষায়, “While West Pakistan’s share of blame is admittedly much larger than East Pakistan, the latter can not be altogether absolved. As for the Army, it was inexorably sucked into the political quagmire. Mainly of the making of Mujib and Bhutto.” রাজনীতিবিদরা কখনাে পাকিস্তানি জেনারেলদের কাছে গ্রহণযােগ্য ছিলেন না।
২০০৪ সালে করাচির অক্সফোর্ড প্রকাশ করেছে সিদ্দিকির ২৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থ ইস্ট পাকিস্তান দি এন্ডগেম : অ্যান অলুকারস জার্নাল ১৯৬৯-১৯৭১। ১৯৭১ সাল সম্পর্কিত পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা প্রায় সব বই-ই আমি পড়েছি। পড়তে পড়তে এক ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান লাভ করেছি এই যে, ঠিক কোথায় তারা বাঙালি-হিন্দু বা বাঙালি-ভারত বা বীর পাকিস্তানি সৈন্যদের কীর্তির কথা লিখবে ধরতে পারি কিন্তু, এই প্রথম একটি বই পড়লাম যা পূর্বের বইগুলি থেকে একেবারে আলাদা বইটি কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক জান্তার মুখপাত্র হিসেবে আবদুল রহমান সিদ্দিকি কর্মসূত্রে ছিলেন ইয়াহিয়া চক্রের ঘনিষ্ঠ ফলে, তাদের সম্পর্কে ফার্স্টহ্যান্ড এমন তথ্য আছে যা অন্য কোনাে গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, ১৯৬৯-১৯৭১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে পাকিস্তানের পরাজয় পর্যন্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা পূর্বাঞ্চলে নিয়ােজিত এবং উচ্চপদস্থ ও নিম্ন পর্যায়ের অফিসাররা কী ভাবছিলেন এবং বাঙালিদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল সেটি স্পষ্ট বােঝা যাবে ভূট্টো কীভাবে সামরিক চক্রের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন এবং পরস্পর পরস্পরকে কীভাবে ব্যবহার করেছিল তার সূত্রগুলি দেয়া আছে ফলে, দেখা যাবে, ১৯৭১ সালের ওপর পাকিস্তানিরা ছাড়া অন্যরা যে সব উপসংহারে পৌছেছেন, সিদ্দিকিও সেসব উপসংহারে পৌঁছেছেন। এ বইয়ে বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ নেই। পুরােটা নিজের ডায়েরির ওপর ভিত্তি করে লেখা। সবশেষে বলা যেতে পারে, বাঙালি বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে কোনাে পূর্ব ধারণা ছাড়াই গ্রন্থটি লেখা হয়েছে। সুতরাং এই বই সম্পর্কে সমালােচনা করার কিছু নেই আলােচনা করার আছে। আবদুল রহমান সিদ্দিকি প্রথম জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। তারপর সেনাবাহিনীতে যােগ দেন আগে যা উল্লেখ করেছি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানভারত যুদ্ধের সময় ছিলেন মেজর এবং জেনারেল ওসমানীর অধীনে তখন কাজ করেছেন। এরপর তাকে সেনাবাহিনীর জনসংযােগ বিভাগে (আইএসপিআর) নিয়ে আসা হয় লে. কর্নেল হিসেবে। ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত আইএসপিআরের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন এবং সেখানেই কর্নেল । পরে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে প্রমােশন পান।
অবসর গ্রহণের পর করাচির রিজিওনাল ইনস্টিটিউটের পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহীর পরিচালক হিসেবে কাজ করে আসছেন। প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি জার্নালও তিনি সম্পদনা করেন। বইটির শুরু ১৯৬৯ থেকে প্রথম অধ্যায় ‘এন্টার ইয়াহিয়া অর্থাৎ ইয়াহিয়ার প্রবেশ। মন্তব্য করেছেন, আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়ার সূত্র ধরে যে, ভাগ্যের পরিহাস মিলিটারি কমান্ডার যারা পরে একনায়ক হয়েছে তাদের জেগে ওঠার সময়টা পূর্ববঙ্গ/পাকিস্তান। ইয়াহিয়া, আইয়ুব দুজনই জিওসি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। আইয়ুব খান কী পরিস্থিতিতে ক্ষমতা ছাড়লেন এবং ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এলেন তার বিবরণ দেয়া আছে যা কমবেশি আমরা জানি। সিদ্দিকির বিবরণ যে বিষয়টি স্পষ্ট করল তা’হলাে, ইয়াহিয়া আইয়ুবকে বাধ্য করেছিলেন ক্ষমতা ত্যাগে। জেনারেলদের এবং গবেষকদের বিভিন্ন বইয়ে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা আছে যে, ইয়াহিয়া ক্ষমতালােভী ছিলেন না এবং প্রথমদিকে আন্ত। রিকভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। আমি অনেক সময় অবাক হয়েছি ভেবে যে, পাকিস্তানি কোনাে জেনারেলের পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব? সিদ্দিকি আমাদের হাইপথেসিসকে সমর্থন করেছেন। ১৯৬৯(?) সালের মে মাসে ইয়াহিয়া অ্যাবােটাবাদে লে. কর্নেল এবং তার ওপরের কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেছিলেন, আগামী চৌদ্দ বছর এই অভাগা দেশটিকে শাসন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নেকড়েদের মুখে আমরা দেশটিকে ছেড়ে দিতে পারি আমি নেতৃত্বে না থাকলেও পরবর্তী সিনিয়রকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাব। তার ভাষায় “Gentlemen, we must be prepared to rule this unfortunate country for the next 14 years or so. For I simply can’t throw the country to the wolves. And if and when I am relieved of my command, I would handover to the next senior, like one guard commander replacing the other.” [পৃ. ২৫] সুতরাং সেনাবাহিনীর লক্ষ্য সম্পর্কে বিতর্কে না যাওয়াই ভালাে। আর বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে অনেকে এ অলীক ধারণা পোেষণ করেন যে, ইয়াহিয়ার সদিচ্ছা ছিল শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তরে। ঐ ভাষণে মুজিব বা ভাসানীর নাম উল্লেখ না করে তাদের নিয়ে যে মশকরা তাদের ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে) করেছেন তা উল্লেখ করছি। আরাে উল্লেখ্য মুজিবকে ইয়াহিয়া ‘বাস্টার্ড’ও বলতেন। পরবর্তীতে সে প্রসঙ্গ আসবে। ঐ সভায়।
ইয়াহিয়া বলেছিলেন (ভাসানীকে ব্যঙ্গ করে?” “স্যার, সফেদ দাঁড়িঅলা একজন বলল, ‘মুজিবকে ক্ষমতা দেবেন না, সে একজন বিশ্বাসঘাতক ‘কিন্তু মৌলবি সাহেব, বললাম আমি, রাজনীতিবিদ হিসেবে মুজিবের সঙ্গে আপনার কথা বলা উচিত, আমি তাে সৈনিক। ‘স্যার, আমি একজন আন্দোলনকারি (এজিটেটর) আমার কাজ উত্তেজনা সৃষ্টি করা। আপনি প্রশাসক, আপনার কাজ শাসন করা…” ঐ সময় মানিক মিয়া দেখা করেছিলেন সিদ্দিকির সঙ্গে। অসুস্থ ছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন, ৬ দফা নিয়ে আলােচনা করা যাবে। এর পরের দিনই মানিক মিয়া মারা যান। সিদ্দিকি লিখেছেন, বাঙালিদের চাওয়া ঐ সময় এত কম ছিল কিন্তু সামরিক বাহিনীর কাছে ঐ কম চাওয়াটাই একটা ফাদ মনে হয়েছিল। তার ভাষায় “It was amazing how little the Bengalis demanded at that stage. For the army in its West Pakistani perception, however, the little’ might well have been a trap; a small step, to be followed by a giant leap, leading to an eventual separation.” ধর্মকে যারা ব্যবহার করে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিল। দু’পক্ষই দু’পক্ষকে সহায়তা করেছে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে। তার বিবরণও দিয়েছেন [পরেও] সিদ্দিকি। ইয়াহিয়া প্রাক্তন জেনারেল শের আলীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শের আলী মন্ত্রি হয়েই পাকিস্তানের সেই পুরনাে ইসলামি আদর্শের কথা তুলে ধরতে লাগলেন যা জামায়াতের পক্ষে যায়। প্রথমদিকে কর্তাদের অনেকে এতে অস্বস্তি বােধ করছিলেন কারণ বহিরঙ্গে সেনাবাহিনীর পক্ষপাতহীন থাকার কথা। কিন্তু শের আলী পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছিলেন। হুসাইন হাক্কানি লিখেছেন, ইয়াহিয়া খানও তখন সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ভুলে শের আলীকে উৎসাহিত করেছিলেন। শের আলীর কৌশল ছিল, সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়বে না বরং রাষ্ট্র ও জাতীয় বিষয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সংরক্ষণ করা হবে ও অব্যাহত থাকবে। সুতরাং পার্লামেন্টকে বিভক্ত রাখতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলি ঝগড়াঝাটি করবে আর সেনাবাহিনী রেফারির ভূমিকা পালন করবে। দুর্বল দলগুলি যাতে নির্বাচনে ভালাে করতে পারে সে জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল। পৃ: ৫৪] এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল উমর আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন।
এ নিয়ে পরবর্তী কালে জুন্তার সদস্যদের মধ্যে রেষারেষি দেখা দিলেও ১৯৭১ সালে গণহত্যার সময় পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন উমর। যা হােক, ক্রমেই ইয়াহিয়া অনুধাবন করেন তার উচ্চাশা বাস্তবে রূপ পেতে পারে শের আলীর বক্তব্যের মাধ্যমে। জুন্তাও বুঝতে পারে শের আলীর বক্তব্য তাদের কাজে লাগবে। সিদ্দিকির ভাষায়– “Sher Ali’s lectures and ideological involvement might have been the unfolding of Yahyahs own secret ambition to stall the transfer of power. Sher Ali ideological stance fitted into the arm’s secretly cherished slowly, emerging plan to retain a hold on the political situation in perpetuity.” [পৃ. ২৯] | ইয়াহিয়ার প্রধান স্টাফ অফিসার ছিলেন জেনারেল পীরজাদা । সিদ্দিকি তার মাধ্যমে চেয়েছিলেন শের আলীকে নিরস্ত করতে। অনুরােধ করেছিলেন পীরজাদাকে প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি জানাতে। পিরজাদা বলেছিলেন, কীভাবে তিনি শের আলীকে নিরস্ত করবেন যেখানে তিনজন পাঞ্জাবি তার গােয়েন্দা সংস্থার প্রধান? এরা ছিলেন মেজর জেনারেল আকবর খান (মহাপরিচালক, আইএসআই), রিজভি (পরিচালক ইনটেলিজেন্স ব্যুরাে ও উমর (এনএসসি)। এ মন্তব্যে আরেকটি বিষয়ও পরিষ্কার হয়। জেনারেলদের চক্রের মধ্যেও আধিপত্য বিস্তার করেছিল পাঞ্জাবিরা। উপসংহারে সিদ্দিকি লিখেছেন, সামরিক শাসনে বিরাজনীতিকরণ ইসলামাদের ঔদ্ধত্য বৃদ্ধি এবং বাঙালিদের কোনােরকম ছাড় না দিয়ে শাসন করার লক্ষ্য দৃঢ় করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে বাঙালির অধিকার আছে তার নৈতিক ও আইনগত দিকটি তারা উপেক্ষা করেছিল। তার ভাষায় “Depoliticization under military rule only added to Islamabad’s arrogance, and strengthened its determination to rule without the slightest concession to the opposition from Bengali. It also blinded them to the moral and legal imperative of transfering to the Bengalis a due share of state power commensurate with their numerical strength.” পৃ ৩১] ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার পাঁচ শর্ত বা এলএফও (লিগাল ফ্রেম অর্ডার ঘােষণা করলেন দ্বিতীয় অধ্যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলাে। পাকিস্তানে দুই অংশে জামায়েত দুটি পত্রিকা বের করল।
করাচি (প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল মুলতান থেকে থেকে দৈনিক মুসাওয়াত ও ঢাকা থেকে দৈনিক সংগ্রাম। দুটি পত্রিকাকেই নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন দিল আইএসআই আইয়ুব খানের নীতি পূর্ব পাকিস্তানিরা পছন্দ করেনি। তারা ছিল ক্ষমতার বাইরে আর সব ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। এর ফলে সিদ্দিকির মতে বাঙালির ‘শভিনিজম’ দৃঢ় করল। সমষ্টিগত জাতীয় উন্নয়নের অগ্রাধিকার চিহ্নিত না হওয়ায় বিকশিত হলাে আঞ্চলিক ‘প্রিজুডিস’ ও ‘ভার্নাকুলারিজম’। সিদ্দিকি উপযুক্ত তিনটি শব্দ ব্যবহার আবার তুলে ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচারিত ও প্রচলিত পূর্ব ধারণা। আসলে, যদি তিনি বলতেন, এতে ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং এর ফলে বিকশিত হচ্ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাহলে বিষয়টি আরাে বাস্তবসম্মত হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন, কায়েমি স্বার্থ বিকাশ ও সংহত হওয়ায় সেখানে ইসলামি আদর্শ’ নামে এক মেকি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। শব্দটির প্রচুর অপব্যবহার হয়েছে যা-ই তাদের স্বার্থের বিপরীতে গেছে তাই ইসলামি স্বার্থের বিপরীতে বলে তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে ‘obscurantist’ শক্তিসমূহ বিরােধীদের গলা চেপে ধরার জন্য এটি ব্যবহার করেছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার নিজের লক্ষ্য ও ইচ্ছার ইতােমধ্যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তিনি কোনাে তাড়া বােধ করছিলেন না। কারণ, মুসলিম লীগ (কাইয়ুম), নুরুল আমীনের পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটি পার্টি, জামায়েত ইসলামী তাকে সমর্থন যােগাচ্ছিল রাজনৈতিকভাবে আর গােয়েন্দা সংস্থাগুলি খবর দিচ্ছিল নির্বাচনে ঝুলন্ত সংসদ হবে যার অর্থ ইয়াহিয়া নিজের খেলা খেলতে পারবেন ১৯৭০ সালের টর্নেডাে প্রাক নির্বাচনী এবং নির্বাচনে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। সিদ্দিকির বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের শিরােনাম-‘প্রাক নির্বাচনী জ্বর এবং সাইক্লোন অক্টোবর, ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড উষ্ণ হয়ে উঠল। একদিকে ভূট্টো অন্য দিকে বাকিরা। শেখ মুজিবও এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে, বক্তৃতা দিয়েছিলেন করাচি ও লাহােরে। লাহােরে তাঁর সভায় গণ্ডগােল হয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন তিনি ঢাকায়। কাইয়ুম মুসলিম লীগকে তখন জুন্তা সমর্থন দিচ্ছিল।
এদিকে ভাসানীকে দলে আনতে চাচ্ছিল জুন্তা, জানিয়েছেন সিদ্দিকি অর্থের অভাবে ভাসানী নির্বাচনে যেতে চাচ্ছিলেন না। নির্বাচনে তার দরকার ছিল, তাঁর মতে আড়াই কোটি টাকা রিজভি ইয়াহিয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন প্রয়ােজনে সেই টাকা দেবেন। কিন্তু, তা দেওয়া হয়নি ভাসানী সেই যে ক্ষুব্ধ হলেন সেই ক্ষোভ আর তাঁর হ্রাস করা যায়নি। টর্নেডাে আঘাত হানল পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া চীন থেকে ফেরার পথে। ঢাকায় নামলেন। ফকারে করে ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে এলেন কিন্তু তার কাছে টর্নেডাের ছােবল ভয়াবহ মনে হয়নি। গভর্নর আহসানের ওপর। ব্রণের দায়িত্ব দিয়ে ফিরে গেলেন তিনি ইসলামাবাদ ইয়াহিয়ার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাল সারা বিশ্ব। ব্রিটেন ও আমেরিকা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলাে। সেনাবাহিনীকে ডাকা হলাে। জেনারেল ইয়াকুব যথাযথ সাহায্য করলেন না। এই নতুন তথ্য জেনারেল ইয়াকুবের অন্য একটি। দিক তুলে ধরে। এতদিন একটি ধারণা ছিল তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রতি সহানুভূতিশীল। এবং অন্য পাকিস্তানি জেনারেলরা লিখেছেন, সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিল, হ্যা একমাত্র তারাই ত্রাণ কাজে এগিয়ে আসছিল। ইয়াকুব আহসানকে জানিয়েছিলেন বহিঃআক্রমণ রক্ষায় সৈন্যরা নিয়ােজিত। ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাবার জন্য যারা নিয়ােজিত তাদের কীভাবে পাঠানাে যায় সামান্য ত্রাণ কাজে? সৈন্য পাঠান হয়নি যে তা নয়, যা পাঠান হয়েছিল তা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় কম। তার ওপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসগর খান ছাড়া। কোনাে রাজনীতিবিদ/প্রশাসক আসেননি। বাঙালির ক্ষোভ চরমে উঠল মুজিবহয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন এলাে। জেনারেল উমর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে অন্য দলগুলােকে টাকা বিলােতে লাগলেন যাতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুজিবকে হারাতে পারে সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে বাঙালি মুজিবকে এমন ভােট দিল যে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, সারা পাকিস্তানেই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে। পরিণত হলাে। ভূট্টো শুধু গরিষ্ঠতা পেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। এই ফলাফল সেনাবাহিনকে খুশি করল না। জেনারেল গুল হাসান।
সিদ্দিকিকে ডেকে বললেন, ভূট্টোকে আমাদের ব্যাক করা উচিত। সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল খানকে ডেকে বললেন, সিদ্দিকির সঙ্গে মিলে একটি উপায় বের করতে। তাদের যুক্তি ছিল। মুজিব সেনাবাহিনীর বন্ধু নয়। ক্ষমতায় এসে তিনি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি। হ্রাস করতে চাইবেন যা বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিপন্থী। ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের, পাঞ্জাবে তিনি সবচেয়ে বেশি ভােট পেয়েছেন আর সেনাবাহিনীর ৭৫ ভাগ। পাঞ্জাবে। সুতরাং সেনাবাহিনীকে তিনি স্পর্শ করবেন না। সিদ্দিকির মতে, তখনই দান চালা হয়ে গেল- “The die had thus been cast in Bhuttos | favour,” (পৃ. ৫১] তবে, সিদ্দিকি জানাচ্ছেন, আশা করা হচ্ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে মুজিব পশ্চিম পাকিস্তান সফরে আসবেন। তাজউদ্দীন শুধু এলেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের ধারণা হলাে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কেয়ার করেন না। সিদ্দিকির মতে, জাতীয় নেতা হিসেবে যে বিবেচনা তাঁর দেখাবার কথা তা তিনি দেখাননি। সিদ্দিকির ভাষায় “Mujib’s Bangla-centric strategy created much bad blood against him and his party in West Pakistan. It was taken for granted that either he did not care for West Pakistan, or was a poor tatician politically. He did not show the acumen and maturity that was legitimately expected of him as a national leader.” 19. 08] | ইয়াহিয়া এর মধ্যে ঢাকা এলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে করাচি ফিরে সাংবাদিকদের জানালেন, মুজিবই হচ্ছেন পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। তার এই বাক্যটিকে অনেকে তার ভালােমানুষি ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু সিদ্দিকি জানাচ্ছেন অন্য তথ্য । তার মতে, এটি হঠাৎ মুখ ফসকে কোনাে কথা নয়, ভেবে চিন্তেই ইয়াহিয়া তা বলেছিলেন। প্রথমত এই মন্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে মুজিবের বিরুদ্ধে সজাগ করেছিলেন এবং ভূট্টোকে প্ররােচিত করেছিলেন। তারপর লারকানায় ভূট্টোর আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন ইয়াহিয়া। সেনাবাহিনী বা জুন্তা তখন আরাে দৃঢ় হলাে যে কোনাে বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী করা যাবে না। এবং ভূট্টোও তখন ক্ষমতার অংশিদার হতে চাইলেন।
ভূট্টো ঘােষণা করলেন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যােগ দিতে ঢাকা যাবেন না। জেনারেল উমর ছােট ছােট দলের নেতা যারা জিতেছিলেন তাদের কাছে যাওয়া আসা শুরু করলেন এই অনুরােধ বাি হুমকিও নিয়ে যেন তারা ঢাকা না যান। ঢাকায় সেনাবাহিনী পাঠানাে হতে লাগল। ২২ ফেব্রুয়ারি গভর্নরদের কনফারেন্স হলাে পিন্ডিতে সেখানেই প্রথম সিদ্ধান্ত হলাে নীতিগতভাবে যে পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি প্রয়ােগ করা হবে। রাও ফরমান আলীও এ কথা স্বীকার করেছেন সিদ্দিকির কাছে। সুতরাং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু হঠাৎ হয়নি তা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। | চতুর্থ অধ্যায়ে সিদ্দিকি দেখিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্বার্থ কীভাবে একত্রিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান দলনে নামছে। লাহােরের মােচি গেটে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন ভূট্টো জাতীয় সংসদে যােগ | না দেয়ার হুমকি দিলেন। পরদিন ইয়াহিয়া সংসদ স্থগিত করার ঘােষণা দিলেন, এতে প্রমাণিত হয়, লিখেছেন সিদ্দিকি যে, ভূট্টো এবং ইয়াহিয়ার মধ্যে একটি হটলাইন ছিল। ইয়াহিয়া অবশ্য তার বক্তৃতায় সংসদ স্থগিত করার কারণ হিসেবে সেই পুরানাে গৎ ফিরিয়ে আনলেন- ভারত যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাতে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া আবার ঘােষণা করলেন ২৫ মার্চ অধিবেশন করতে হবে। সিদ্দিকির ভাষ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বের প্রতি ইয়াহিয়া কঠোর ও প্ররােচনামূলক ভাষা প্রয়ােগ করলেন। এক হাতে দিলেন আরেক হাতে নিলেন। * আমরা যদি ইয়াহিয়ার ভাৱ, বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, ইয়াহিয়া তার লক্ষ্য পূরণে, ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আস্তে আস্তে দুপক্ষের উত্তেজনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছেন এবং বলছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ রকম ধ্বংসাত্মক কাজ কখনও চলতে দিতে পারে না এবং তাদের কাজে তারা কখনও ব্যর্থ হয়নি। ইয়াহিয়ার ভাষণের অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি “Our East Pakistani leadership reacted in a manner which resulted in destructive elements coming out in the street and destroying life and property. I will not allow a handful of people to destroy the homeland of millions of innocent Pakistanis. It is the duty of the Pakistan Armed Forces to ensure the integrity, solidarity and security of Pakistan- a duty in which they have never failed…” পৃ ৬৫]
ইতােমধ্যে ইয়াকুবকে বদলি করে বালুচিস্তানের কসাই হিসেবে খ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে আনা হলাে।ইয়াকুব ইতােমধ্যে “ব্লিৎজ পরিকল্পনা তৈরি করে গেছেন। মুজিব ও তার দল সঠিক ব্যবহার না করলে কী করতে হবে তাই হলাে ‘ ব্লিজ’ ইয়াকুবের ভাষায়- . “We may have to give him a whiff of the grapeshot, should they refuse to behave and go berserk.” (পৃ ৬৬] ‘ ৭ মার্চ পল্টনে বক্তৃতা দিলেন মুজিব, লিখেছেন সিদ্দিকি। আসলে ওটা হবে রেসকোর্স ময়দানে। স্বাধীনতা ঘােষণা তিনি করলেন না বটে কিন্তু বক্তৃতা শেষ করলেন ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। রেসকোর্সে ঐ দিন আমি ছিলাম বটে কিন্তু ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটি শুনেছি বলে মনে পড়ে না। সিদ্দিকি ১৬ মার্চ ঢাকায় এলেন। এরপর ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক, সেনা কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন যা অন্য কারাে বইয়ে পাওয়া যাবে না। দেখা যাচ্ছে রােয়েদাদ খান প্রতিদিন ভূট্টোকে আলােচনা সম্পর্কে জানাচ্ছেন এবং কবে ঢাকা আসতে হবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছেন। জাতীয় সেনাবাহিনীকে অপমান করার জন্য চক্র বাঙালিদের কঠোর শিক্ষা দেয়ার দাবি তুলছেন। ১৯ তারিখে রােয়েদাদ ভূট্টোকে পরামর্শ দিচ্ছেন ঢাকা আসার।
ডেইলি পিপলের প্রকাশিত সংবাদ আর কার্টুনও পশ্চিমা সেনাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল [২৫ মার্চ এর বহিঃপ্রকাশ দেখি। প্রথম সুযােগেই তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল ডেইলি পিপলের অফিস)। ক্যান্টনমেন্টে সিদ্দিকিকে একদিন এক অফিসার বলেছেন, বাঙালিরা সব বিশ্বাসঘাতক এদের কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, এমনকী যারা ইউনিফর্মে আছে তাদেরও। সিদ্দিকি জানতে চাইলেন সৈনিক, ইবিআর, ইপিআর মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা কুড়ি হাজারের মতাে, কী করা যাবে এদের নিয়ে। ‘কোনাে সমস্যা নয়। এই জারজগুলাে কাপুরুষ? এখনিই তাদের নিরস্ত্র করে ব্যারাকে রাখা উচিত। তাদের আমাদের দরকার নেই। সরে যাক তারা আমাদের পথ থেকে। | ভূট্টো ২১ তারিখ এলেন ঢাকায়। বিহারি-বাঙালি দ্বন্দ্ব শুরু হলাে, জানিয়েছেন সিদ্দিকি, তাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ঢাকা বিমান বন্দরের বাইরে কিন্তু সেনাবাহিনী থেকেও তারা তড়পাচ্ছিল বেশি যা বােঝা ছিল দুষ্কর। সিদ্দিকির ভাষায় [বিহারিরা] “An over display of the Biharis as a group, towards the Bengalis, was not easy to understand. Their morale was almost unnaturally high. They behaved even more hawkishly than the military. They openly asked for military intervention to control the Bengali traitors”. (পৃ. ৭৬-৭৭] জেনারেলদের দেয়া এ সম্পর্কিত আগের বিবরণগুলি দেখুন। সিদ্দিকির বিবরণ সম্পূর্ণ এর বিপরীত পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলির বিস্তারিত ‘বিবরণ দিয়েছেন। ২৫ মার্চ যদিও তিনি ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, গােলাগুলির শব্দও শুনেছেন কিন্তু জানতেন না কী ঘটেছে। সিদ্দিকির সঙ্গে চক্রের যােগাযােগ ছিল পেশাগত কারণে কিন্তু চক্রের অভ্যন্তরে তিনি ছিলেন না। তাছাড়া প্রথম থেকেই তার বিভিন্ন প্রস্তাবের বিপরীতে কাজ করছিল চক্র।
তার সুযােগ ছিল তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করার কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন বাইরের লােক। ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত যে বিস্তারিত বিবরণ তা আমাদের জানা। তাই সেই বিবরণে যাব না। তবে দেখা যাচ্ছে গণহত্যা প্ররােচনায় রােয়েদাদ খানের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে সেনাবাহিনীরা কীভাবে আক্রমণের পটভূমি তৈরি করেছিল তার কিছু বর্ণনা দেব। পীরজাদার সঙ্গে সিদ্দিকির কথা হচ্ছিল ঘটনার আগে। ২৩ মার্চ সারা দেশে পাকিস্তানের পতাকা ছিল না। এটি সেনাবাহিনী তাদের অপমান হিসেবে নিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টে প্রেসিডেন্ট যাচ্ছিলেন সে পথেও বাঙালিরা ‘rude
ডেমােনেস্ট্রশন করেছে। মুজিব যা করেছে তা বলার নয়। পীরজাদার ভাষায় “The fact is that today his very name stinks in the nostrils of every soldier. He had no business to insult and humiliate the armed forces as he did. The man is a fool. He missed his best opportunity when he refused to visit West Pakistan after the President had already named him as the would-be prime minister.” পৃ ৮৫] ঢাকা টিভি চালাবার জন্য পাকিস্তান থেকে তিনজনের ‘টিভি টিম এলাে। ক্যান্টনমেন্টে তারা বলল, মুজিব দুইবার নিজেকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণ করেছে; আরেকটি সুযােগ তাকে দেয়া যায় না। তাকে ফাসিতে ঝােলানাে উচিত। | হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। তার মতে, হামিদুলের প্রতিক্রিয়া ছিল বিহারিদের মতাে। আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর মধ্যে দখলদারি বাহিনীর চরিত্র ফুটে উঠতে লাগল । অপমানের প্রতিশােধ নিয়ে তারা এখন জাতীয় সেনাদল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। সিদ্দিকির ভাষায় “The mentality of an occupation army was gradually, and unmistakably, coming into play. Insults were being avenged and the army was exerting efforts to re-establish itself as a national army.” (পৃ ১১০)
সিদ্দিকি পােড়া ঘরবাড়ি দেখেছেন, রাস্তায় দু’একটা লাশও দেখেছেন, ভয়ার্ত মানুষের ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া দেখেছেন। কিন্তু, আমরা ঢাকায় যে ধ্বংসলীলা দেখেছি, গণহত্যা দেখেছি ও তার বিবরণ পড়েছি, সিদ্দিকির লেখায় কিন্তু তা অনুপস্থিত। যেমন, জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল ঘুরে এসে তিনি লিখেছেন, ‘হল দুটি পরিত্যক্ত, কিন্তু ধ্বংসলীলা তেমন হয়নি। জগন্নাথ হলের গণকবর ও ড. নুরুল্লাহ ভিডিও উল্টো কথা বলে। ১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে সিদ্দিকি ফিরলেন ইসলামাবাদ। এদিকে বিদেশি সাংবাদিকরা আসছেন। তাদের কীভাবে এড়ানাে যায় সেটি নিয়ে আলােচনা চলছে। ঘন ঘন সিদ্দিকির ডাক পড়ছে বড় কর্তাদের কামরায়। রােয়েদাদ তখন রেসে বেশ এগিয়ে। বিভিন্ন রকমের পরামর্শ তিনি দিচ্ছেন। বাঙালি অফিসারদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেনাচক্র বেশ খুশি। সিদ্দিকির ভাষায়, পূর্ব এখন পরিণত হয়েছে পশ্চিমের কলােনিতে এবং পশ্চিমের ভাব অনুতাপহীন উপনিবেশকারির। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। টিক্কা খান মনে করছেন, দুর্ভিক্ষ হলে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কোথাও কোনাে প্রতিক্রিয়া নেই। পশ্চিমে হাতে গােনা বা ঘেঁষা কিছু বুদ্ধিজীবী ছিলেন যারা বাঙালিদের পক্ষে ছিলেন তাদের চিহ্নিত করা হতে লাগল ভারতীয় দালাল হিসেবে। আজাদ নামে লাহাের থেকে বামদের একটি পত্রিকা বেরুত। এ পত্রিকায়ই একমাত্র সামরিক চক্রের সমালােচনা করা হয়েছিল।
সুতরাং সেটি বন্ধ হয়ে গেল। আবদুল্লাহ সালিক, হামিদ আখতার ও আইএ রহমানকে গ্রেফতার করা হলাে। আইএসআই প্রধান আকবর ঘােষণা করলেন, মুজিব এবং আওয়ামী লীগ ২৫ তারিখ একটি কুর পরিকল্পনা করেছিল। ইবিআর ও ইপিআরের সাহায্যে তারা চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দর দখল করার পরিকল্পনা করেছিল যাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যরা অবতরণ করতে না পারে। আর ভারত তাে আছেই। সিদ্দিকি লিখেছেন, “দি প্রেজেন্ট ক্রাইসিস ইন পাকিস্তান’ নামে সরকারি একটি বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল। আইএস আইয়ের মহাপরিচালকের ও সরকারি এই ভাষ্য হুবহু ছিল প্রায় একই রকম। দুটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন সিদ্দিকি যাতে বােঝা যাবে সামরিক চক্র কীভাবে সবাইকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছিল “The Awami League’s bid for secession was now under way… the armed forces have made a series of pre-emptive strikes, seized the initiative and saved the country…” (পৃ. ১২১) “The root cause of the Indo-Pakistan trouble is that India has never really accepted the fact of Pakistan. Leaders like Sardar Vallabhbhai Patel have been on record esiring the ‘re-unification of Bharat.” [পৃ. ১২১] | টিক্কা খান বিদেশি সাংবাদিকদের জানালেন, ২৫ মার্চ রাতে ১০০ থেকে ১৫০ জন মানুষ মাত্র মারা গেছে- এরা সবাই ছিল দুষ্কৃতিকারী যারা সেনাবাহিনীকে বাধা দিয়েছিল। সিদ্দিকি আবারও ঢাকা গিয়েছিলেন, অনুভব করেছিলেন, কীভাবে দু’পক্ষের সমঝােতা সম্ভব যেখানে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছে? বিদেশি সাংবাদিকরা চলে গেলে সিদ্দিকি ১১ মে দেখা করলেন নিয়াজি ফরমান এবং টিক্কার সঙ্গে। তাদের বেশ সতেজ ও আস্থাবান মনে হচ্ছিল যা সিদ্দিকির মতে ছিল বাস্তবতার বিপরীত। নিয়াজি ব্যস্ত বাঙালিদের আসল ইসলামে ফিরিয়ে আনার কাজে, হিন্দু প্রভাবের কারণে ইসলামি বিশ্বাসে বিচ্যুতি ঘটেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে যা কিছু খারাপ ঘটেছে তার কারণই ছিল হিন্দু প্রভাব ও প্রচারণা। শতাব্দী ধরে বাঙালি মুসলিম ছিল গরিব ও পদানত। হিন্দু বানিয়ারা সব সময় তাদের শােষণ করেছে। হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য তাদের সাহসী হতে হবে এবং শুদ্ধ ইসলামে ফিরে এলেই সেটি হবে। নিয়াজি সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। বাঙালি স্ক্রিপ্টেরও বদল হতে হবে। সাধারণ একজন পশ্চিম পাকিস্তানি থেকে সাধারণ একজন পূর্ব পাকিস্তানি অনেক বেশি ধর্মভিরু কিন্তু মুশকিল হচ্ছে হিন্দু প্রভাব ও বিশ্বাস যা তাকে বিভ্রান্ত করছে। ফরমান জানালেন, পীরজাদা যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তার সঙ্গে পীরজাদার আলােচনা হয়েছিল। মুজিব যদি বস হয় তাহলে কী ধরনের পাকিস্তান হবে’, জানতে চেয়েছিলেন পীরজাদা। ‘একটি দুর্বল ও শিথিল পাকিস্তান’, ফরমানের উত্তর। “কিন্তু আমরা চাই শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান। ‘We won’t let Mujib have his way.’ ফরমান উত্তরে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান এখন একটি প্রাসাদ নয়, এটি একটি কুঁড়ে মাত্র। আর এখন প্রয়ােজন সেই কুঁড়ে রক্ষা করার। পীরজাদা হেসে এই উপমা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফরমানকে দেখে মনে হচ্ছিল নিয়াজির সঙ্গে তার বনাবনি হচ্ছে না। বাঙালিদের সঙ্গে হিন্দুদের মতােই ব্যবহার করা হচ্ছে। নিয়াজি সবসময় তাদের বিশ্বাসঘাতক বলছেন। টিক্কা খান ঐ সব নিয়ে ভাবছিলেন না। অফিসাররা তার সামনে পরিস্থিতির গােলাপি চিত্র তুলে ধরছিল তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। সিদ্দিকির 2160, “Tikka’s assesment of the situation reflected military hardheadedness and the reluctance to accept failure.” 14. 3091 সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুনিয়রদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। সিদ্দিকি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। জেনারেল হামিদ, নিয়াজি সহ তারা চাঁদপুরে ব্রিগেড সদরে গেছেন। হামিদ দেখলেন দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে। ব্যাপারটা কী জানতে চাইলেন হামিদ। ‘তারা একটা গ্রাম পােড়াচ্ছে স্যার,’ বললেন একজন অফিসার। “কেন?” ‘দুষ্কৃতিদের বের করার (ফ্লাশ আউট) জন্য।’
হামিদের গালে লালের ছােপ দেখা দিল। ব্রিগেড কমান্ডার আতিককে বললেন, যে গ্রামটি পােড়ান হচ্ছে সেটি তাে পাকিস্তানেরই দুষ্কৃতিকারিদের ধরে শাস্তি দেয়া হােক কিন্তু অনুগত ও দেশপ্রেমি মানুষদের হয়রানি কেন? মন্ত ব্যটি নিয়াজির মনপুত হয়নি। সিদ্দিকি লিখেছেন, যেখানে গেছি সেখানেই এক চিত্র। শুধু বিহারিদের খানিকটা প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল যাদের অধিকাংশ ছিল শান্তি। কমিটির সদস্য। নিয়াজি খালি পাবলিক রিলেশন বা পিআরের কথা তুলতেন। যা কিছু শুনতেন সবই ছিল তার কাছে ভারতীয় প্রপাগাণ্ডা। সিদ্দিকি মন্তব্য করেছেন “His unawareness of the ground reality of the Bengali ‘Liberation War’ was simply amazing.” পৃ ১৫৪)] এ সময়ই পাকিস্তান সরকার ‘শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। পক্ষপাতদুষ্ট এই শ্বেতপত্র তৈরি করেন, সিদ্দিকির মতে, এক বাঙালি অধ্যাপক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী। এক সময় যিনি ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভায় ছিলেন। ১ সেপ্টেম্বর সিদ্দিকি শেষবারের মতাে ঢাকায় গিয়েছিলেন। নিয়াজিকে তিনি একইরকম দেখেছিলেন যিনি জওয়ানদের উৎসাহ দিতেন সবরকমের অসৈনিকসুলভ, অমানবিক এবং carnal কর্মকাণ্ডে। গতকালের তােমার স্কোর কী শেরা?’ প্রশ্ন রাখতেন সৈনিকের কাছে। সিদ্দিকি লেখেন নি, কিন্তু শুনেছিলাম, পিআইয়ের এক কর্মকর্তা নিখোঁজ হওয়ার পর তার স্ত্রী স্বামীর খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য নিয়াজির কাছে গিয়েছিলেন এবং নিয়াজি তাকে ধর্ষণ করেছিলেন। সিদ্দিকি জানিয়েছেন, ধর্ষণকে নিয়াজি সমর্থন করেছেন। তার কথা ছিল, “সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে থাকছে, লড়াই করছে, মারা যাচ্ছে আর সেক্সের জন্য কি তারা ঝিলাম যাবে?” : ‘You can not expect a man to live, fight and die in East Pakistan and go to Jhelum for sex, would you?” (4.3941 | যশােরে জিওসি ৯ ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল আনসারী অন্যদিকে সিদ্দিকিকে জানিয়েছিলেন, যেভাবে মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতীয়রা চাপ সৃষ্টি করছে তাতে বেশিদিন টেকা যাবে বলে তিনি মনে করেন না । জওয়ান ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডও তিনি পছন্দ করছিলেন না। সিদ্দিকিকে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি ধর্ষণ ও হত্যার জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ অত্যাচারিকে পছন্দ করেন না।
“We will all have to account for every single rape and killing when back in West Pakistan. Just mark my words. Allah never spares the tyrant.” [পৃ. ১৬৭]। পশ্চিম পাকিস্তানের লােকজন বিশ্বাস করতে ভালােবাসত, সবকিছু পূর্বাংশে ঠিকঠাকমতাে চলছে। বিবিসি বা আকাশবাণীর সংবাদ ছিল তাদের কাছে প্রপাগাণ্ডা’। পশ্চিম পাকিস্তানের উল্লেখযােগ্য কোনাে নেতা তখন পুর্ব। পাকিস্তানে যায়নি। ভূট্টো ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলছিলেন ‘গঙ্গা-যমুনার রক্ত লাল হয়ে যাবে।’ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায় ঢাকার পতন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধ প্রসঙ্গও এসেছে। এ ধরনের নৈব্যক্তিক বর্ণনা আর কোনাে পাকিস্তানি জেনারেল লেখেননি।
তথ্যসমৃদ্ধ এই বর্ণনায় ফুটে উঠেছে জেনারেলদের অদক্ষতা, অক্ষমতা ও ভীরুতা। সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনাে সময় ছিল না। হুইস্কি আর রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে তারা ব্যস্ত। মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে অন্যদের সঙ্গে করমর্দন করেছেন। এডিসি তাকে হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে। গ্লাস হাতে দূত বললেন “So it has happened after all… we all wished to God that it would not happen but now that it has. I can only wish you all the very best of luck.” [পৃ. ২০০]. গুল হাসান দূতকে যুদ্ধাবস্থা বােঝালেন। তিনি শুনলেন তারপর গুল হাসানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হুইস্কির গ্লাস খালি না করে চলে গেলেন। অবস্থাটা বােঝা যাবে আরেকটা ঘটনায়। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের জন্য নতুন খসড়া শাসনতন্ত্র তৈরি করেছেন। ১৭ তারিখ রােয়েদাদ তা বিলি করেছেন। সন্ধ্যায় তা প্রচারিত হবে। সিদ্দিকি ও তার সহকর্মী রিজা তাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছেন। রােয়েদাদের সঙ্গে তারা দেখা করলেন। রােয়েদাদ তখন মিটিং করছেন। তাদের দেখেই জিজ্ঞেস করলেন প্রচারের বিষয়ে। সেটি যাবে না জানালেন রিজা। সেটা কীভাবে সম্ভব? প্রেসিডেন্টের আদেশ তখন সিদ্দিকি আর রেজা জানালেন, পূর্ব পাকিস্তান এখন স্বাধীন। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এখন নিরাপত্তা হেফাজতে। সেখানে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানে কী আসে যায়? সিদ্দিকি সব শেষে আফসােস করেছেন, যারা এসব কাণ্ড করেছে খাদের কথা বিস্তারিতভাবে তিনি লিখেছেন এখনও তারা বহাল তবিয়তে আছেন। কিছুই হয়নি । আল্লাহ তাদের বিচার করবেন? “Let it be between them and their creator to decide what and where they might have erred or failed to rise to the dictates of their own conscience to do their duty to their country and the nation.”
সিদ্দিকির মতে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন সুযােগ করে দিয়েছিল সবাইকে।
কিন্তু নির্বাচনের পর শক্তির প্রয়ােগ।
“was nothing less than a sinful act of bad faith committed by the military with the support of the civil bureaucracy and much of the political leadership. The break-up of Pakistan, more than an act of fate, had been the consequence of a premeditated insouciant, if you will, political mischief and machination.” পৃ ২১৮ সিদ্দিকি দুঃখ করে লিখেছেন, সম্পূর্ণ ট্রাজেডির সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল সমাজের নীরবতা। এর মধ্যে অন্তর্গত | রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েও আমরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি, সদুত্তর দিতে পারেননি কেউ । সিদ্দিকি আরাে লিখেছেন, যখন প্রাণের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদরা আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে তখন তাদের খালি আসনে যে সব নির্বাচন হলাে সেখানে ভূট্টোর পিপিপি, আসগর খানের তেহরিক ই ইস্তেকলাল [অংশ নেয়নি), জামায়েত ইসলামী সবাই অংশ নিল। এর চেয়ে মর্মান্তিক কী হতে পারে। তিনি মনে করেন সেনাবাহিনী যা করেছে। তা ক্ষমা করা যায় না। সিভিল সমাজও যা করেছে তাও লজ্জাকর। তার ভাষায়ই শেষ করি “Thus, while the military junta cannot be forgiven for its unwarranted use of brute force against East Pakistani civilians, the West Pakistan based civilian leadership the high Judiciary in truth the civil society as a whole- can not get away with their own share of blame and shame. Their sins of omission in the final tally, would almost evenly balance the military’s sins of commission. (পৃ. ২১৫]। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির বই পড়ে মনে হলাে না এটি একজন পশ্চিম পাকিস্তানি লেখক বা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তার লেখা। মাঝে মাঝে কিছু পূর্ব ধারণার রেশ আছে কিন্তু সমগ্র বর্ণনার তুলনায় তেমন কিছু নয়। এমন কী বাঙালি কোনাে জামায়াতি বা বিএনপি সমর্থকের লেখা বইও এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। বইটি পড়ে মনে হবে বইটি ১৯৭১ সালের কোনাে বাঙালির লেখা যে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে আর চারদিক থেকে শত্রুরা ঘিরে ধরে তাকে হত্যা করতে চাইছে।
সূত্র : পাকিস্তানী জেনারেলদের মন -বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন