যশাের শহরে
অসীম রায়
মুক্তিফৌজের রিলিফ বাস যখন আমাদের যশাের সদর হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে গেল গত তেসরা এপ্রিল তখন বেলা এগারােটা।
প্রথমেই যে অনুভূতি পরিব্যাপ্ত করে তা এক বিশাল নির্জনতার অনুভূতি। নিশুতি রাত, সর্বাত্মক হরতাল কিংবা দাঙ্গা পরবর্তী থমথমে জীবনযাত্রার চেয়েও ব্যাপক এ অনুভূতি। কারণ সারি সারি নিস্তব্ধ বাড়ির ভেতরেও সামান্য আওয়াজ নেই, একটিও খােলা জানালা-দরজা নেই। কোর্ট কাছারি স্কুল বাড়ি ঘর দোর চায়ের দোকান লন্ড্রি সব কুলুপ আটা। রাস্তায় একটা নেড়িকুত্তাও নেই।
এই বিশাল রৌদ্রঝলকিত মরুভূমির মাঝখানে একমাত্র মরূদ্যান হাসপাতালটি। গুলি ও মর্টার শেলবিদ্ধ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের আহত সৈনিক ও সাধারণ নাগরিক। ডাক্তার রােগী দেখছে। দুটি নার্স রিলিফের উপকরণ গুনতে গুনতে হাসছে, কথা বলছে।
করিডােরে বেরােতেই কামানের আওয়াজ এবং নিস্তব্ধতা সচকিত করে ক্রমাগত মেশিনগানের গুলি। নির্জন রােদে ঝলমল রাস্তা দিয়ে শহরের সবচেয়ে বড় চৌরাস্তা, দড়া টানার মােড়ে আসতেই ক্যান্টনমেন্টে মাইল দুয়েক দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা যায়। মুক্তিফৌজ ও পাকিস্তানি ফৌজের গােলাগুলির উত্তর প্রত্যুত্তরে চারদিক প্রতিধ্বনিত।
আমরা পেছন দিকের রাস্তা নিলাম। হেলমেট পরা একটি ই পি আর-এর সৈনিক ছুটন্ত শেল সম্পর্কে আমাদের সাবধান করে দেয়। রাস্তা ছেড়ে দু’ধার দিয়ে এগিয়ে এক নারকেল কুঞ্জে এসে পৌছই। এই ই পি আর হেড কোয়ার্টারে আশ্চর্য মনােবল ও সাহসের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়। ফেরার সময় গাড়ি নেই কারণ রিলিফ বাস ফিরে গেছে। আর পেট্রোলের দুরন্ত টান। এ অবস্থায় আমরা যখন কিঞ্চিত বিহ্বল তখন ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির এক অংশের এক নেতা পৌছে দেন হরিদাসপুর বর্ডার। নেতা সােজা রিলিফের একখানা গাড়ি চালিয়ে আমাদের একেবারে আসবার সময় শহরের বাইরে চাচড়ের মােড়ে বিধ্বস্ত বাস ও দগ্ধ কুঁড়ের ছবি তােলা হয়। আমরা ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তিফৌজ যশোের শহর থেকে হটে আসে।
রিপাের্টার হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যশােরে ঘুরে আসা এমন এক জীবন্ত অনুভূতি যার সঙ্গে সচরাচর রাজনৈতিক মিটিং মিছিলের কিঞ্চিত তফাত আছে। আমরা যারা স্বাধীনতার পরবর্তী কাল থেকেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি কখন অন্ধকার মাঠ ঘাট কাঁপিয়ে বিপ্লবের ট্রেন আসবে তাদের কাছে এ অভিজ্ঞতা এক উজ্জ্বল সান্ত্বনা। কারণ বারে বারেই ট্রেন আসেনি। কলকাতার রক্তরঞ্জিত রাজপথে দাঁড়িয়ে কিংবা উনিশশাে সাতষট্টি সালে এক নতুন আরম্ভের রাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকেও এ ট্রেনের হদিস পাইনি। সেদিন যে ছবি স্বল্পক্ষণের জন্যে হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তা হলাে আমাদের যৌবনের স্বপ্ন এখন বাংলাদেশে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের সেই ঈপ্সিত ট্রেনের ফ্লাড লাইট আমাদের গায়ে এসে পড়ল। বর্ডার পেরিয়ে এসেও আমরা হুইসেলের আওয়াজ শুনেছি।
সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১