দেশদ্রোহী কাকে বলে? একটি সংজ্ঞা নিরূপণ চেষ্টা
নারায়ণ চৌধুরী
জেনারেল ইয়াহিয়া খা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তার অন্তহীন কথাবার্তার পালা অকস্মাৎ সাঙ্গ করে দিয়ে ঢাকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তথাকথিত “জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে” এই বলে অভিযােগ করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টুকরাে টুকরাে করে ফেলছেন এবং তিনি একজন “দেশদ্রোহী।” এটা খুবই আশ্চর্যের যে, যে ব্যক্তিটির পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার উপরে কোনাে ন্যায়সঙ্গত হক্ নেই বরং দু’বছর আগে তারই মতাে আরেক জঙ্গীনায়ক জেনারেল আয়ুব খাঁকে ভাঁওতা দিয়ে জোর করে যে ক্ষমতা দখল করেছে, সে কিনা বলছে যে মুজিবুর দেশদ্রোহী, বিশ্বাসহন্ত্রী। ইয়াহিয়া খাঁর পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের ইতিবৃত্ত অতিবিচিত্র। আয়ুবকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরাবার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে জাহির করলেন এক স্বয়ংনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট, যার পিছনে জনসাধারণের কোনাে অনুমােদন নেই। তার ক্ষমতায় আসার কলাকৌশল বিচার করলে দেখা যায় যে, তিনি একজন জবর দখলী রাষ্ট্রনায়ক, যে শীর্ষাধিপতির ভূমিকায় তিনি নিজেকে আরূঢ় করেছেন তার পিছনে আছে না শাসনতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক না নৈতিক সমর্থন।
এহেন ব্যক্তির মুজিবকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া এক উৎকট পরিহাস! এখানে মুজিবের একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। মুজিব কে? না এমন এক ব্যক্তি যিনি পাকিস্তানের পূর্বাংশের অবিসম্বাদী নেতা, যে পূর্বাংশ পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংখ্যাশক্তিতে বৃহত্তর; যার পিছনে ঐ অংশের সকল শ্রেণীর মানুষের অপ্রতিপাদ্য সমর্থন রয়েছে। এটা একটা ঘটনা হিসাবেই মাত্র সত্য নয়, এই ঘটনার সত্যতার সাংবিধানিক প্রমাণও সুপ্রতিষ্ঠিতও হয়েছে ব্যালট বাক্সের রায়ের মধ্যে। মুজিবের চালিত আওয়ামী লীগ গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে শুধু যে পূর্ববঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে তা নয়, গােটা পাকিস্তানের হিসেবেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৬৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তার মধ্যে ১৬১টি আসনই তারা দখল করে। গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব বিজয়। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের পক্ষ হয়ে কথা বলার অধিকার সুতরাং, বির্তকাতীত, নিঃসংশয়। গণতন্ত্র কথাটার যদি কোনাে মানে থাকে তাহলে কোনাে শক্তিই মুজিবুর রহমানকে তার ঐ অখণ্ডনীয় অধিকার থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।
৬৮
কিন্তু এই কিত, অদ্ভুত পৃথিবীতে সবই সম্ভব। পাকিস্তানে যে জঙ্গীচক্রের রাজত্ব আজ বারােবছরেরও ওপর হল একটানা চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত প্রচলিত ধারণাই যেন বদলে গেছে। নইলে এমন অবিশাস্য ঘটনা কি ঘটতে পারতাে, যে-ব্যক্তি নিজে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করেছে, যার পিছনে গণ সমর্থনের বাম্পও নেই, সে কিনা একজন পুরােপুরি গণতান্ত্রিক নেতাকে বলছে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।
আভিধানিক অর্থ
‘দেশদ্রোহী’ কথাটার আভিধানিক অর্থ হলাে এমন একজন, “যে বিশ্বাসের পাত্র হয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করে, যে রাষ্ট্রকে অমান্য করবার অপরাধে অপরাধী, একজন বঞ্চনাকারী।” অভিধানের এই সংজ্ঞার আলােকে পঁচিশে মার্চ তারিখে “বাংলাদেশে” যা ঘটেছে তার পূর্ববর্তী কতকগুলাে ঘটনার দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। একথা মােটেই সত্য নয় যে, মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ববঙ্গকে আলাদা করে নিতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর নির্বাচন কালীন ছয়-দফা ঘােষণায় এই দাবি করেছিলেন যে, সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামাের মধ্যে তার প্রদেশ পূর্ববঙ্গকে অটোনমি বা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হােক। মুজিব কখনও পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করেন নি। অথবা কোনােরূপ শত্রুতাচারণ দ্বারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তিনি উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন তারও কোনাে প্রমাণ নেই। তাঁর বিরুদ্ধে আনুগত্যহীনতার এমন কোনাে নিদর্শনই দেখানাে যাবে না যার সঙ্গে দেশদ্রোহীতার দূরতম সম্পর্কও রয়েছে। তার নির্বাচনকালীন বক্তৃতায় বা তাঁর সংবাদপত্রের বিবৃতিগুলাের মধ্যে এমন কিছুই নেই থেকে মনে করা যেতে পারে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন। একথা সত্য যে মুজিব শেষ অবধি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। কিন্তু সেপরিণামের পুরাে দায়িত্ব ইয়াহিয়া এবং তার পাঞ্জাবী জঙ্গীচক্রের সাঙ্গোপাঙ্গোদের, যারা ছলে বলে কৌশলে যে-কোনাে উপায়ে পূর্ববঙ্গের উপর তাদের অধিকার কায়েম রাখতে চেয়েছিল। মুজিব পরে যে-অবস্থায় উপনীত হয়েছেন সে-অবস্থায় তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে, সংকট ঘনিয়ে তােলার এ একটা ইচ্ছাকৃত ষড়যন্ত্র। মুজিবের এটা আত্মরক্ষামূলক সংগ্রাম, যার প্রথম করণীয় ছিল পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর জান প্রাণের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষা। আজ পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা তাদের দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করবার জন্য শহরে বন্দরে গায়ে গঞ্জে মরিয়া হয়ে লড়াই করছেন। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য কাতারে কাতারে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। এর সবটাই ঘটেছে ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে। ইয়াহিয়া সুপরিকল্পিত চাতুর্যের সহিত মুজিবকে যে অবস্থায় এনে ফেলেছিলেন তাতে মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা ও একটি অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
অন্য দিক
এবারে ঘটনার অন্যপ্রান্তে একটু চোখ ফেরানাে যাক্। জেনারেল ইয়াহিয়ার পক্ষে এই দাবি করা হয় যে, তিনি পাকিস্তানের জনসাধারণের হাতে সত্যি সত্যি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। তার প্রমাণ, তিনি জনগণের সাধারণ নির্বাচনের দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং পরে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। যথাদিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্যন্ত সবই ভালাে। অন্তত: এ বিষয়ে তাে সন্দেহ নেই যে, পূর্ববর্তী জঙ্গী শাসক আয়ুবের “বুনিয়াদী” মার্কা, গণতন্ত্রের পরিধি অনেক বিস্তৃততর ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে “অপ্রীতিকর’ বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে ইয়াহিয়ার অযথা কালক্ষেপণের মনােভাব ও অন্যান্য লক্ষণ বিচার করলে বােঝা যায় ইয়াহিয়া মুখে যা বলেছিলেন তা থেকে তাঁর অন্তরের কথা ভিন্নতর ছিল। তিনি আশা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে-ঘােরতর ভেদ বিসংবাদ রয়েছে তা মুজিবকে কোনােক্রমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে দেবে না এবং তার ফলে ঐ ভেদ বিসংবাদকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার অভীষ্ট গণতন্ত্রকে ঠেকিয়ে রাখার কাজ সিদ্ধ করবেন। এটা তিনি ভাবতেও পারেননি যে, পূর্ব বঙ্গের লােকেরা তাদের সমস্ত ভেদ বিবাদ ভুলে গিয়ে মুজিবের পশ্চাতে সংঘবদ্ধ ভাবে দাঁড়াবেন এবং তার আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত করবেন।
৬৯
এই অবাঞ্ছিত (ইয়াহিয়ার পক্ষে) সত্যের মুখােমুখি হওয়ার পর থেকে ইয়াহিয়া অদ্ভুত সব আচরণ করে যেতে লাগলেন। তিনি সাধারণ নির্বাচনের রায় নাকচ করার মতলবে একটির পর একটি অছিলা আবিষ্কার করতে লাগলেন। প্রথমে তিনি বিভিন্ন দলগুলাের মধ্যে মতৈক্যের অভাবের অজুহাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখবার চেষ্টা করলেন, যে-জাতীয় পরিষদের উপরে চার মাসের মধ্যে পাকিস্তানের জন্য একটি সর্বসম্মত সংবিধান রচনা করবার ভার ছিল। কিন্তু যখন তার এই চাল ব্যর্থ হলাে তখন তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচাল করবার অন্য রাস্তা খুঁজলেন। অবশেষে জনমতের চাপে পড়ে যখন আর পরিষদের অধিবেশন কোনােমতেই ঠেকানাে গেলনা তখন তিনি অধিবেশনের একটি দিনক্ষণ স্থির করলেন বটে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত আবার খারিজ করে দিলেন। এই প্রতিশ্রুতিভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগত বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন এবং এক সর্বাত্মক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দ্বারা ইয়াহিয়ার বিশ্বাস ভঙ্গের সমুচিত জবাব দিলেন। সে-আন্দোলন এতই প্রবল আকার ধারণ করে যে, ইয়াহিয়াকে তার পাঞ্জাবী সামরিক চক্রের হােমরা-চোমরাদের নিয়ে ঢাকায় ছুটে যেতে হয়। ইয়াহিয়ার ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে মুজিবুরের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা চালানাে কিন্তু পরবর্তী ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তার ওই আলােচনা ছিল একটা লোেক-দেখানাে ঠাট আসলে অভিসন্ধি ছিল অন্য।
কয়েকদিন আলােচনা চলবার পর ধূর্ত ভুট্টো এসে আলােচনায় যােগ দিলেন। তাতে ইয়াহিয়ার আরও সুবিধা হয়ে গেল। সমস্ত ঘটনার ধারাটাই প্রমাণ করেছে যে, ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর মধ্যে আগে থেকেই একটা সমস্বার্থ ঘটিত বােঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। এবং তাদের দুজনেরই চেষ্টা ছিল মুজিব যাতে তাঁর নির্বাচনের সুফল ভােগ করতে না পারেন তদুদ্দেশ্যে সর্ববিধ কলাকৌশল প্রয়ােগ করা। মুজিবের ন্যায়সঙ্গত ভাবে লব্ধ অধিকার ও আধিপত্যকে ভণ্ডুল করবার জন্য দুই চতুর নায়ক কোনাে ছলের আশ্রয় নিতেই পশ্চাপদ হলেন না। গণতন্ত্রকে বানচাল করবার এ এক জঘন্য স্বৈরতন্ত্রী ষড়যন্ত্র।
হীন চক্রান্ত
প্রশ্ন হলাে কে কার প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে? এর সঠিক উত্তর পেতে মােটেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যদি আমরা ঢাকায় আলাপ-আলােচনা চলাকালীন বৈঠকের কয়েকটি তাৎপৰ্য লক্ষ্য করি। ইয়াহিয়া খা দিনের পর দিন ইচ্ছাপূর্বক আলােচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন সময় কর্তনের কৌশল হিসাবে। ওটা ছিল একটা ধাপ্পা লােকের চোখে ধুলাে দিয়ে সেই অবসরে জাহাজে ও বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বঙ্গে দলে দলে সৈন্য চালান করার কৌশল। পূর্ববঙ্গের অটোনমি আন্দোলনকে দাবিয়ে পূর্ববঙ্গবাসীদের সমুচিত শাস্তি দেবার ঐ ছিল এক পাকা মাথার পরিকল্পনা যার প্রতিটি খুঁটিনাটি সম্পন্ন হয়েছিল ক্যালেন্ডারের তারিখ আর ঘড়ির ঘণ্টা-মিনিটের কাঁটা লক্ষ্য করে। ভুট্টোও ছিলেন এই শয়তানী চক্রান্তের অংশীদার। জাহাজ ও বিমান বাহিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদলে যে-মুহূর্তে পূর্ব বঙ্গ ভরে গেল, অমনি ইয়াহিয়ার হঠাৎ খেয়াল হলাে যে আলােচনা একটা অচলাবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে, আলােচনা চালিয়ে আর কোনাে ফায়দা নেই। চতুর পাকিস্তানী জঙ্গীনায়ক অকস্মাৎ আলােচনা বন্ধ করে দিলেন এবং কাউকে না জানিয়ে রাত্রির অন্ধকারে চোরের মতাে ঢাকা পরিত্যাগ করলেন। ভুট্টোও সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পশ্চাদ অনুসরণ করলেন।
এটা ২৫শে মার্চ তারিখের রাত্রির ঘটনা। সেই রাত্রেই শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানী ফৌজের বীভৎস তাণ্ডব, নৃশংসতায় ও নারকীয়তায় সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে-তাণ্ডবের সম্ভবত কোনাে পূর্ব নজির নেই। এক নিরস্ত্র অসহায় নির্দোষ জনমণ্ডলীর উপর পাকিস্তানী দস্যুর দল ঝাঁপিয়ে পড়ল হিংস্রশ্বাপদের রক্তলােলুপতা নিয়ে। দেখতে দেখতে ঢাকা শহর মৃতের স্তুপে ভরে উঠল। পূর্ববঙ্গের মানুষ পাকিস্তানী ফৌজী নায়কের অভূতপূর্ব বিশ্বাসঘাতকতার বলি হলাে। এর পরের ঘটনা সুবিদিত। এখানে আর সে সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পাঠকের মনকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না।
এই বিশ্বাসঘাতকতা “অভূতপূর্ব এই কারণে যে সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে এই জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার সমদৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফ্যাসিস্ট বিশ্বাসঘাতকতাকেও এ হার মানিয়েছে। মধ্যযুগের ইতিহাসে এই জাতীয় বিশ্বাসসহন্ত্রিতা সম্ভব হলেও হতে পারতাে। কিন্তু আধুনিক কালের
৭০
ইতিহাসে এর কোনাে প্রতি তুলনা নেই। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের শীর্ষাধিপতির পক্ষে তারই রাষ্ট্রের একজন সর্বসম্মত গণতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে সমস্ত প্রকার মানমর্যাদা ও আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করা যে সম্ভব, তা কল্পনাও করা যায় না। স্বকার্য সাধনের জন্য আধুনিক কোনাে রাষ্ট্র নায়ক এতটা নীচে নামতে পারে এটা অতিশয় ক্ষমাপ্রবণ বিচারধারার মানদণ্ডেও অকল্পনীয় ব্যাপার।
সমালােচকেরা বলতে পারেন যে, ইয়াহিয়ার এ কৌশল মুজিবের আগেভাগেই ধরে ফেলা উচিত ছিল এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল, কিন্তু ঘটনার ধারা পর্যালােচনা করে মনে হয়, মুজিবকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য যে ফাঁদ পাতা হয়েছে মুজিব তার ভয়াবহতা পূর্বাহ্নে সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। এবং সেইজন্যই বােধহয় তিনি যথােচিত সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেননি।
মহৎ ব্যর্থতা এ
টা একধরনের ব্যর্থতা, নিঃসন্দেহে কিন্তু এমন এক ব্যর্থতা, যা মুজিবকে আরও বেশি গৌরবে মণ্ডিত করলাে। এর দ্বারা মুজিবের স্বভাব সুলভ উদারতা ও মানুষের প্রতি সহজাত বিশ্বাসেরই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অপর মানুষের চরিত্র অনুধাবনে তিনি হয়তাে কতকটা সরল বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়েছেন। কিন্তু এই সরল বিশ্বাস মহানুভবতারই লক্ষণ। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন যে, মুজিবের এই ব্যর্থতা মহত্বের ব্যর্থতা, সে স্তরে পৌঁছুতে ভুট্টোর মতাে লােকেরা কোনােকালেই পারবে না। (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০, ৪, ৭১) প্রবঞ্চিত হয়েও শেষ অবধি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা ভালাে, তবু বিশ্বাসভঙ্গ কদাপি নয়।
নবজাতক, সপ্তম বর্ষ
১৩৭৮