You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে এলাম।
বাসবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি পশ্চিমবাংলার ছেলে— পূর্ববাংলা সম্পর্কে কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু বছরখানেক আগে থেকেই ওপার বাংলার বলিষ্ঠ সাহিত্য পড়ে সেদেশের প্রতি খুব আগ্রহশীল হয়ে উঠি। তখন থেকেই পূর্ব বাংলা যাবার খুব ইচ্ছে, কিন্তু হায়! তখন কে জানত যে প্রথমযাত্রাই হবে যুদ্ধের খবর আনতে। যাই হােক প্রথম যাত্রার সেই স্মরণীয় দিনটি ছিল ১৯৭১ এর ২রা এপ্রিল। পশ্চিমবাংলার বনগাঁর পেট্রোপােল সীমান্ত পেরিয়ে যখন পূর্ব বাংলার মাটিতে পা দিলাম তখন ভারতীয় সময় বেলা সােয়া একটা। গ্রামের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। প্রথম যেখানে ঘরবাড়ি দেখতে পেলাম সেখানে বেশ কয়েকটি ৩-৪ বছরের বাচ্চা আমাদের দেখে কচি কচি গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “জয় বাংলা, জয় বাংলা” বলে। উত্তরে হাত তুলে আমরাও বললাম “জয় বাংলা”।….
ধুলােয় ভরা মেঠো পথ দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক জাবেদ আলী। জিজ্ঞেস করলাম, “জাবেদ ভাই, এ গ্রামের নাম কী?” উত্তরে সে বললে, “এটা যশাের জেলার সাদিপুর গ্রাম। এর কয়েকমিনিট পরেই নিয়ে গেল ওখানকার আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে। খড়ের চালের মাটির বাড়ি। কোন রঙিন সাইনবাের্ড, ঝাণ্ডা বা আড়ম্বরতার চিহ্ন নেই। ভেতরে তক্তপােষ ও কয়েকটি বেঞ্চি। গ্রামেই বিজলী নেই তাই সেখানে আলাে, পাখার তাে কোন প্রশ্নই আসে না। কাজকর্ম করতে প্রস্তুত এরকম অনেকেই বসে আছে। জাবেদ ভাই সে গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আইয়ুব হােসেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। উনি হাত বাড়ালেন। আমিও হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে বললাম, “জয় বাংলা,।” উনি শান্ত কণ্ঠে বললেন “আর জয় বাংলা নয়- এবার বলবেন স্বাধীন বাংলা কারণ বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হয়ে গেছে।”
এরপর নানাকথা হতে হতে আমি জিজ্ঞেস করলাম মােটামুটি কবে থেকে আপনারা গেরিলা ট্রেনিং শুরু করছেন?
– দেখুন, যারা আমাদের পক্ষ থেকে এগিয়ে গিয়ে লড়াই করছে তাদের প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে অনেকদিনের অভিজ্ঞ। তারা সাধারণত: প্রাক্তন সেনাবাহিনীর লোেক, মুজাহিদ, আনসার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ ইত্যাদির; তাই তাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তবে কি জানেন, যদি মেশিনগান থেকে হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়ে, রকেট বা বােমা পড়ে তাহলে তাে আর করার কিছু নেই।
৫৮
– সে তাে নিশ্চয়ই।
এছাড়া যেখানেই লড়াই চলছে সেই সব জায়গায় সাধারণ মানুষেরা যখন দেখেছে যে আর কোন উপায় নেই তখন তারা অতি সাধারণ অস্ত্র নিয়েই যে যেভাবে পেরেছে সে সেই ভাবেই প্রতিরােধ করছে। সামনে গুলি দেখে কেউ পালায়নি বা ফিরে আসেনি আবালবৃদ্ধবণিতা প্রত্যেকেই এগিয়ে গেছে, মেরেছে, মরেছে। সেইজন্যেই তাে আমাদের বেসামরিক জনগণ অত মারা গেছে।
–আচ্ছা, ঐ সমস্ত মৃতদেহগুলাে কি আপনারা সুবিধেমত সরিয়ে ফেলছেন না পড়েই থাকছে?
—না, না, যেখানে যতদূর সম্ভব তা পরিষ্কার করেই ফেলা হচ্ছে তবে ঢাকায় কী হচ্ছে তা বলতে পারব না ।
—এই অবস্থায় আপনারা যােগাযােগ রাখছেন কীভাবে?
যশাের, খুলনা, বেনাপােল ইত্যাদি জায়গায় আমাদের নিজেদের ওয়্যারলেস ঠিক আছে আর তাতেই কাজ চলছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের খবর পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে এক এক জনে কিছুটা করে এসে দিয়ে যাচ্ছে। শ্রীঘ্রই আমরা transport চালু করার চেষ্টা করব তবে আমাদের পেট্রোল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদির খুব অভাব।
—এছাড়া আর কোন অভাব আপনাদের নেই?
—আছে, আছে। সে হােল অস্ত্রশস্ত্র আর টিনে ভরা খাবার। ওষুধ পত্রের বিশেষ প্রয়ােজন নেই কারণ আমাদের আহতের সংখ্যা কম, তবে পরে কী হয় তাতাে বলা যায় না, আর যুদ্ধ শেষে তাে অনেক কিছুরই প্রয়ােজন।
এরপর আইয়ুব সাহেব নিজেই বলে চললেন, “বিহারীরা খুব বেইমানী করেছে এবং পাঞ্জাবীদের অনেক সাহায্য করেছে। তা নাহলে উত্তরাঞ্চলে রক্তপাত হয়ত এতটা হােত না। এছাড়া পাঞ্জাবীরা পালানাের ব্যাপারে একটা নতুন কৌশল নিয়েছে তা হােল যখন তারা আর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না তখন সিভিল ড্রেস পরে মুখে “জয় বাংলা” বলতে বলতে জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে তারপর পালিয়ে যাচ্ছে।”
এসব শুনে জিজ্ঞেস করলাম, “এতাে গেল অবাঙালিদের কথা কিন্তু বাঙালিদের কেউ বেঈমানী করেনি।” প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ওনার পাশের এক প্রবীণ ভদ্রলােক নিচু গলায় বললেন, “হা, প্রথম দিকে কয়েকজন তাে করেছিলই তবে আমরা তাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন সকলেই আমাদের পক্ষে। নেতা আমাদের একজনই—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”
তারপরের প্রশ্ন ছিল, “আপনাদের এ অঞ্চলে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি কে?” উত্তরে জানালেন, “জনাব, মশিউর রহমান ও তবিবুর রহমান সর্দার। দুইজনেই আওয়ামী লীগের।”
এবার আইয়ুব সাহেবের কাছে সাম্প্রতিক কালের কোন “ইত্তেফাক”, “পূর্বদেশ, ” “সংবাদ” ইত্যাদি যে কোন দৈনিক পত্রিকা আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে উনি দুঃখিত হয়েই জানালেন যে গতকালই কোলকাতার কয়েকজন সমস্ত পত্রিকা নিয়ে গেছে। তখন “খুলনা টাইমস” “দেশের ডাক” বা যে কোন ডিস্ট্রিক্ট পেপার হলেও চলবে বললাম।
—তাও নেই। আর এখন সব পত্রিকাই বন্ধ। কারণ পাকিস্তানী সৈন্যরা সমস্ত রেডিও স্টেশন ও পত্রিকার অফিস তছনছ করে দিয়েছে।
এরপরে আর বলার কিছু নেই। তাই ঐ গ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে প্রকাশ করাতে আইয়ুব সাহেব বললেন, “শুনুন, আমাদের গ্রামে কোন মুক্তিযােদ্ধা নেই কারণ আমাদের গ্রাম একটি সম্পূর্ণ মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযােদ্ধারা যশাের ক্যান্টনমেন্টে লড়তে গেছে। তবে আপনি যদি বেনাপােল যান তাহলে ই, পি, আর এর লােকের সাক্ষাৎ পাবেন।”
বললাম, হাঁ নিশ্চয়ই যাব। তখন উনি একজনকে বেনাপােলের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে নির্দেশ দিলেন।
আইয়ুব সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এগােলাম বাংলাদেশের যশাের জেলার শেষ সীমান্ত শহর বেনাপােলের দিকে। গ্রামের পথ দিয়ে শুকুর আলী মণ্ডল নিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্য স্থানে। মাঝে মাঝে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মাটির বাড়ি। হাঁস, মুরগি, ছাগলের মেলা। গাছে গাছে ছােট ছােট আম, কাঁঠাল
৫৯
ঝুলছে। পাখিরা তাদের মিষ্টি গানে জানাচ্ছে তাদের অভ্যর্থনা। তারই সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলছে গ্রামের অনাড়ম্বর জীবন যাত্রা।
বাচ্চারা মাঠে খেলছে। একদিকে চেঁকির কাজ, আর অন্যদিকে বুড়াে মিঞা বিড়ি খাচ্ছেন পরম সুখে বাড়ির দাওয়ায় বসে। শহরের হাটে যাবেন বলে থলে হাতে বেরুলেন গহর চাচা। সঙ্গে তার ছােট ছেলে আবদুল। উনি বললেন যে হাজার হানাদার আসুক, হাজার অত্যাচার হােক, তবুও তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন আর কখনও প্রিয় গ্রাম ছাড়বেন না। আন্তরিক অথচ দৃঢ় কণ্ঠে এই কথা শুনে মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগেই ঢাকার বিদ্রোহী বেতার কেন্দ্র থেকে শােনা একটি গানের দুটি লাইন :
আমি প্রাণের চেয়ে ভালবাসি দেশের মাটিরে
আমি মনের সুখে মাটির বুকে তাইত থাকি রে…
যাইহােক, বাংলার মাটি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বাংলার হাওয়ায় শ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে গাছে গাছে বাংলার ফলমূল দেখতে দেখতে বেনাপােলে এসে যখন টিউবওয়েলে বাংলার জল খেয়ে ওপারে ভারতের পতাকা উড়তে দেখলাম তখন কিন্তু একদম মনে হলাে না যে আমি বিদেশে এসেছি। বাংলা দেশে প্রবেশ করার আগে ‘ফরেন যাচ্ছি বলে মনের মধ্যে যে ভাবটা ছিল তা কখন যে উবে গেছে তা খেয়ালই করিনি। আর বার বার মনে এসেছে কোলকাতায় পড়া কবিতার কটি লাইন–
দুয়ারে খিল
টান দিয়ে তাই
খুলে দিলাম জানালা
ওপারে যে বাংলাদেশ
এপারেও সেই বাংলা
বেনাপােলের পিচের রাস্তা। একদিকে ভারত। অন্যদিকে সােজা চলে গেছে যশাের শহর। E.P.R. এর লরি দাঁড়িয়ে। কাছেই দুজন E.P.R. এর সশস্ত্র কর্মী। চোখ লাল। কয়েকদিন হলাে তাদের ভাল ঘুম হয়নি। তবুও তাদের দৃঢ় মনােবল। ক্লান্তির সংগা তারা ভুলে গেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপােষহীন সংগ্রামই হলাে তাদের এগােবার একমাত্র রাস্তা।
E.P.R. এর ট্রাকের পাশে বেশ কয়েকজন ছাত্র ঘােরাঘুরি করছে মুক্তিফৌজদের সাহায্য করার জন্যে। তাদেরও চোখে ঘুম নেই। চুল উসকো খুসকো ভাবে উড়ছে। এই অবস্থায় আলাপ হলাে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র মুহম্মদ মিজানুর রহমানের এর সঙ্গে। যশাের জেলার হাড়িয়া গ্রামে বাড়ি। কলেজ বন্ধ। বেনাপােলে কাজ পড়েছে। মিজানুর-এর আরও কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আলাপ হলাে। একজন E.P.R.এর লরি থেকে একটা বড় ডাব কেটে আমার দিকে এগিয়ে দিল। প্রথম থেকেই ওভাবে আমার ডাব খাবার আপত্তি ছিল তাই বললাম, “দেখুন, আমি মােটেই ক্লান্ত নই, একটু আগেই টিউবওয়েলের জল খেলাম ঐ ডাব একজন মুক্তিযােদ্ধা এই মুহূর্তে খেলে তারই ভাল। পরে সব ঠিক হয়ে যাক, আপনাদের গ্রামে এসেই থেকে খেয়ে যাব। Please, কিছু মনে করবেন না” বলে E.P.R.এর হাতে তুলে দিলাম। তারপর ওদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হলাে। ওদের গভীর দেশপ্রেম, নিয়মানুবর্তিতা, ত্যাগ ও সুন্দর ব্যবহারের পরিচয় পেলাম।
ইতিমধ্যে যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটি গাড়ি এল । তাতে জনাকয়েক সশস্ত্র ব্যক্তি। একজন আহত ছেলেও রয়েছে। আর সামনে উড়ছে স্বাধীন বাংলার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। গাড়ির গায়ে লেখা বাংলায় নম্বর। যেমন ধরুন চট্টগ্রাম ক ৭৩২৪’, বা যশাের ৬৫৪২’ ইত্যাদি।
যাইহােক, মিজানুরদের বিদায় জানিয়ে এগােলাম বেনাপােল বাজারের দিকে। রাস্তা সােজা চলে গেছে যশাের ক্যান্টনমেন্টের দিকে। রাস্তার ডানদিকে আছে রেললাইন। সেও ঐ যশােরের দিকে। বেনাপােলের পর স্টেশনগুলাে হলাে যথাক্রমে নাভারন, গাদখালি, কিকরগাছা ঘাট, যশাের জংশন। রাস্তার বাঁদিকে UPU TE GTIGE G9317 12165 East Pakistan time is 1/2.. an hour Indian Standard time and +6 hours with G.M.T. এটি দেখে ঘড়ির কাঁটা অবশ্য ঘােরাই নি কারণ সেদিনই ভারতে ফিরে আসব। তবে এটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারলাম যে এমন দিন আসবেই যেদিন সারা পূর্ব বাংলায় “ইস্ট পাকিস্তান”
৬০
কথাটি মুছে যাবে আর তার পরিবর্তে আসবে “বাংলাদেশ”। সেদিন নিশ্চয়ই এ বাের্ডেও লেখা হবে। Bangla Desh time is….।
এদিকে এগােতে এগােতে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়া E.P.R.এর হেডকোয়ার্টাস ফেলে এলাম বেনাপােল বাজারে। বাজার সেদিন স্বাভাবিক। সবরকম দোকানপাটই ভােলা। এখানকার এক ভদ্রলােকের সঙ্গে কথা বলতে এগােচ্ছি। একটি ছােট দোকান থেকে উনি সিগারেট কিনলেন। নাম “রূপালী সিগারেট”। সাদা বাক্সের ওপর ইংরাজি ও বাংলায় লেখা। খুলনা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লি: এর তৈরি ১০টি সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫ পয়সা। ফিল্টারহীন এই সিগারেটের ওপর বাংলায় লেখা “রূপালী”। রূপালী সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলেছেন জনাব আনােয়ার আহমেদ। বাড়ি পদ্মার ওপারে। এখানে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছেন। এমন সময় হঠাৎ জঙ্গী ইয়াহিয়া বাংলাদেশের মানুষকে নামিয়ে দিয়েছেন সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামের রাস্তায়। উনি যখন ঢাকা ছেড়ে আসেন তখন সেখানে চলছিল অহিংস অসহযােগ আন্দোলন আর এখন ঢাকার চেহারা অন্যরূপ। উনি বললেন, “সংগ্রামী বাংলা আজ গর্জে উঠেছে, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, মানুষের ওপর মানুষের শােষণ অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে, বাঙলাকে অবশ্যই বাঙলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে তাই খানদের (পশ্চিমীদের) বিরুদ্ধে আজ আমরা সংঘবদ্ধ । আজ আমাদের বাঙালিদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। দলমত নির্বিশেষে আমরা সকলেই আজ তাদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ছি এবং লক্ষ্যে না পৌছনাে পর্যন্ত জান দিয়ে লড়ে যাব।”
ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটি দোকানে ঢুকলাম। ইচ্ছে কিছু পত্র-পত্রিকা দেখব। কোথাও পাচ্ছি না কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ স্টেশনারী দোকানেই গেলাম। কয়েকটি “ইত্তেফাক.” “Morning News” “আজাদ” ও “সংবাদ” রয়েছে। সবই পুরােনাে। আর সে সময় ওখানে প্রকৃতপক্ষে সমস্ত পত্রিকাই বন্ধ। “ইত্তেফাক” ও “The people” এর অফিসততা নষ্টই করে দিয়েছে আর যে দৈনিকগুলাে পরে বেরিয়েছে তাতে একপাতায় মার্শাল ল’ এর নােটিশ ছাড়া আর বিশেষ কিছু থাকে না। এছাড়া পরে স্বাধীন বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে সাইক্লোস্টাইলে একটি পত্রিকা বেরিয়েছে বলে অবশ্য সংবাদে প্রকাশ।
প্রথমেই দেখলাম ৮ই মার্চের “ইত্তেফাক” টি। তার আগের দিনে রমনার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর বক্তৃতা দেবার ও তা শােনার জন্যে উত্তাল জনতার ছবি সহ বিরাট সংবাদ। সে সম্পর্কে কিছু লেখার প্রয়ােজন নেই কারণ তা আপনারা এখানকার পত্রিকাতেই দেখেছেন ও বক্তৃতার কিছু অংশ কলকাতা বেতার কেন্দ্রেও শুনেছেন। তাই ঐ দিনের পত্রিকায় “১৫ বছর আগে এই দিনে মােসাফির এর কলাম থেকে” শিরােনামে প্রকাশিত কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। “পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাঙালি অবাঙালি, পূর্ব পাকিস্তানী–পশ্চিম পাকিস্তানী কোন কিছুরই প্রশ্ন উঠে নাই। সকলেই আমরা পাকিস্তানী এবং সকলের উন্নতি বিধনিই রাষ্ট্রনায়কদের লক্ষ্য হইবে, ইহাই ছিল সকলের কামনা। কিন্তু আল্লাহর কি মর্জি, আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান কায়েম হইলেও ঠকবাজরা আল্লাহর প্রিয় ধর্ম ইসলামের মুখােস পরিয়া আল্লাহর রহমত হইতে মানুষকে বঞ্চিত করিল। একদম বৃটিশ আমলের অবস্থা—শাসক ও শাসিত—এই সম্পর্ক করিয়া তুলিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। গত আট বৎসরের মধ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে হৃদয়হীন বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা হইয়াছে, আমরা তাহার বহু তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ করিয়াছি।” এটি হলাে ১৯৫৬ সালের ৮ই মার্চের লেখা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য হলাে যে “মােসাফির” হােল ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা জনাব তফাজল হােসেনের (মানিকমিয়া) ছদ্মনাম। তাঁর লেখার জন্যেই তাকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয় এবং “ইত্তেফাক”ও কয়েকবার বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বছর কয়েক আগে মারা যান এবং সম্প্রতি “ইত্তেফাক” বন্ধ হবার আগে পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন মইনুল হােসেন ও কার্যনির্বাহক সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হােসেন। প্রকাশিত হােত ১নং রামকৃষ্ণ মিশন রােড, ঢাকা-৩ থেকে। যাইহােক, একদিন যে “ইত্তেফাক” গড়িয়াহাটের মােড়ে বিক্রি হতে দেখতাম তারপর পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতে সােজাপথে ঐ পত্রিকা আসা বন্ধ হয়ে যাবার পর সেদিন আবার ঐ ইত্তেফাকই দেখলাম খােদ ইত্তেফাকের দেশে বসেই। ওখানে মূল্য ২৫ পয়সা ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৩০ পয়সা।
এবার ১০ই মার্চের “ইত্তেফাক” এ প্রকাশিত ৯ই মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে মৌলানা ভাসানীর বক্তৃতার কিছু অংশ তুলে ধরছি :
৬১
“একদিন ভারতের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা করিয়া, জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মান্তিক ইতিহাস রচনা করিয়া, অত্যাচার-অবিচারের বন্যা বহাইয়া দিয়াও প্রবল পরাক্রমশালী বৃটিশ সরকার শেষ রক্ষায় সক্ষম হয় নাই। শেষ পর্যন্ত তাহাদের শুভবুদ্ধির উদয় হইয়াছে। পাক-ভারত উপমহাদেশকে শত্রুতে পরিণত না করিয়া সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে সরিয়া যাওয়াই তাহারা মঙ্গলকর মনে করিয়াছেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যে একদিন সূর্য অস্ত যাইত না, রূঢ় বাস্তবের করাঘাতে সে সাম্রাজ্যের সূর্যও আজ অস্তমিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলি, অনেক হইয়াছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নেই। “লাকুম দ্বী” নুকুম অলইয়দ্বীন’-এর (তােমার ধর্ম তােমার, আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও।” মুজিবের নির্দেশমত আগামী ২৫শে তারিখের মধ্যে কোন কিছু না হইলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত মিলিয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন শুরু করিব । খামাকা কেহ মুজিবকে অবিশ্বাস করিবেন না। মুজিবকে আমি ভাল করিয়া চিনি।” আর “আপােষ করিলে মুজিব বল, ভাসানী বল কাহারও আর নিস্তার থাকিবে না। এছাড়া ঐ জনসভায় জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন, “এই মুহুর্তে আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘােষণা করুন। বাংলার মানুষ আজ এক কাতারে সারিবদ্ধ হইয়াছে। এই ভ্রান্তিকাল আর আসিবে না। বাংলার সকলেই জাতীয় সরকারের হুকুম মানিয়া চলিবেন। আমাদের আর কোন দাবী নাই।”
আর একদিনের কাগজে একটা সংবাদ চোখে পড়ল—যার শিরােনাম ছিল—“বাচাও! বাঁচাও!! বাংলার অসহযোেগ পশ্চিমা শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস।” ঐদিনের পত্রিকাতে (ইত্তেফাক—১৫, ৩, ৭১) একটি বিশেষ ছবিও দেখলাম। সেটা নৌ-মিছিলের। খাল বিল, নদ-নদীতে ঘেরা পূর্ব বাংলার গণমিছিল যে শুধু পিচঢালা পথেই হয় তা নয়, সেটা ছবি দেখেই বুঝলাম। পূর্ব পাকিস্তান আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে স্বাধীকার আদায়ের দাবীতে ও বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার সমর্থনে নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীতে বেশ কয়েকটি লােকভর্তি মাঝারী ধরনের অংশগ্রহণকারী জাহাজের ছবি।
এরপর দেখলাম মৌলানা আক্রাম খাঁ প্রতিষ্ঠিত “আজাদ” এর এক কপি। “আজাদ” ও শেখ মুজিবের সমর্থনেই সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করেছে। খবরের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার বায়তুল মােকাররমে অনুষ্ঠিত জনসভার ওপর সংবাদ। সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন জনাব নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ: স: ম: আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখন। তারা ঘােষণা করে, “বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যতীত অপর কাহারও নির্দেশ মানিয়া চলিবে না। এছাড়া অন্যান্য খবরের মধ্যে রয়েছে খেতাব বর্জনের খবর। যারা খেতাব বর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন, জাতীয় পরিষদের সদস্য শেখ মােবারক হােসেন ও ফরিদপুরের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য শেখ মােশাররফ হােসেন। সম্পাদকীয়তে জনাব ভুট্টোকে সমালােচনা করে লেখা হয়েছে, “পিপলস্ পার্টি প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ইতিমধ্যেই যে দুষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দান করিয়াছেন তাহাকে এক কথায় নজীরবিহীন বলা যাইতে পারে। পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের হােতা জনাব ভুট্টো রাজনীতির খেলা খেলিতে গিয়া দেশ ধ্বংসের শেষপ্রান্তে লইয়া আসিয়াছেন। দেখিয়া শেখার লােকও তিনি নহেন, তাহাই তিনি প্রমাণ করিতেছেন।”(আজাদ—১৬, ৩, ৭১)।
যাইহােক নাড়াচাড়া করতে করতে কয়েকটি পত্রিকাতে সিনেমার বিজ্ঞাপনও দেখলাম। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ওখানে সিনেমার শশা-এর সময় হােল যথাক্রমে বেলা একটা সাড়ে তিনটে ও সন্ধ্যা ৬টা। কয়েকটি চলতি সিনেমার নাম হলাে, “ঢেউ এর পরে ঢেউ”, “আবিভাব”, “আগন্তুক”, “সুখ-দুঃখ, ” “পীচ ঢালা পথ”, “আদর্শ ছাপাখানা,” “জলছবি” ইত্যাদি। এর মধ্যে মধুমিতা ফিল্মসের “জলছবি” তে অভিনয় করেছেন কবরী, ফারুক ও আনােয়ার হােসেন। বছরের সেরা সামাজিক চিত্রটি ঢাকা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের “হংস, খুলনার “উল্লাসিনী” ও “বৈকালী” বরিশালের “সােনালী” ও কুমিল্লার “দীপিকা” প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। এরপরে “ইত্তেফাক” প্রকাশিত একটি সংবাদ চোখে পড়ল। সেটা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি :
৬২
“ঢাকার প্রেক্ষাগৃহসমূহ বন্ধ থাকিবে। গত বুধবার ঢাকা এক্সিবিটার্স গ্রুপের এক সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যেহেতু বাংলাদেশ এখনও স্বাধিকার আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে শােক পালন করিতেছেন, সেহেতু প্রেক্ষাগৃহগুলি প্রমােদকেন্দ্র বিধায় পুনঃসিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হইবে।” কিন্তু হায়! সেই যে বন্ধ হয়েছে তা আবার কবে খুলবে এবং শেষ পর্যন্ত কটি হল বিনা মেরামতে চালু হবে তা এই মুহূর্তেই বলা সত্যিই কঠিন।
যাইহােক, এরপর কয়েকটি “Morning News” উল্টেপাল্টে দেখলাম। তার মধ্যে ২২শে মার্চের Emancipation of Bangla Desh Supplement টা ভাল লাগল। উপরেই রয়েছে সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ষােল লাইনের বাংলা কবিতা “দুর্মর” । তার থেকে ক’টি লাইন তুলে দিচ্ছি—
সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নােয়াবার নয়।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুর দুটি সুন্দর ছবি রয়েছে। প্রথমটিতে তাঁকে একটি নৌকার মডেল উপহার দেওয়া হচ্ছে এবং দ্বিতীয়টিতে শেখ মুজিব বাংলার গ্রামের দিকে চেয়ে আছেন আর পাশের নদীর ওপরেই একটি নৌকা। এই প্রসঙ্গে এটা বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে নির্বাচনে শেখ মুজিবের প্রতীক ছিল নৌকা তাই সেই নৌকার সঙ্গে তাঁর যােগাযােগের চিহ্নস্বরূপ ফটো দুটি তুলেছেন বিজ্ঞ ফটোগ্রাফার। আর একটি জিনিস চোখে পড়ল তা হােল ইংরেজি পত্রিকায় বেশিরভাগ বাংলায় বিজ্ঞাপন যা আমাদের কোলকাতায় দেখা যায় না বললেই চলে। বিজ্ঞাপনগুলােতে রয়েছে বাংলাদেশেরই কথা। এখানে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। বিজ্ঞাপন দিয়েছেন জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন। ছবি ছাড়া যে ভাষা তারা দিয়েছেন তা হােল, “সােনার বাংলা। সবুজ ক্ষেত। সােনালী বাঁশ। কিষাণের হাসি।…. সব যেন হারিয়ে ফিরে পেয়েছি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের সত্ত্বা। পাণ্ডুর বাংলাদেশে আবার ফিরে আসুক সে সব সােনাঝরা দিন।”
হাঁ, আবার আসবে ফিরে সে সব সােনাঝরা দিন। নিশ্চয়ই আসবে। আবার বাংলার গ্রামে গ্রামে দেখা যাবে গােলাভরা ধান, গােয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ। কিষাণ, মজুরদের মুখে ফুটবে নতুন দিনের নতুন হাসি।
যাক, দোকানের ভদ্রলােককে অতগুলাে পত্রিকা দেখাবার জন্যে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর ওনার কাছে কয়েকটি পত্রিকা চাওয়াতে উনি একটি “ইত্তেফাক দিয়ে বললেন, “অন্যগুলাে একজন রেখে গেছে কাজের জন্যে।” অগত্যা কয়েকটি প্রয়ােজনীয় অংশ টুকে নিয়ে ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আহমেদ সাহেবকে বিদায় জানিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বসন্তের বিকেলের শেষ। তাই ইচ্ছে থাকলেও আর ভেতরে যাওয়া হােল না। ঘরে ফেরার ডাকে সাড়া দিয়েই এগােলাম বেনাপােল চেকপােস্টের দিকে। বারুদের গন্ধেভরা স্বাধীন বাংলাদেশের হাওয়ায় নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে শুনতে পেলাম বিদ্রোহী সুরে বিপ্লবী আহ্বান, “রক্ত দাও, স্বাধীনতা পাবে।” মনে পড়ল অবিভক্ত বাংলার পরলােকগত বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে যাদবপুরে এক সাক্ষাৎকারের কথা। সেদিন তার কাছে পূর্ব বাংলার যুব-ছাত্রদের সম্পর্কে জানতে চাওয়াতে তিনি বলেছিলেন, “তারা বলে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের দেশ। সূর্য সেন ক্ষুদিরামের বাংলা আমার বাংলা। আমার বাংলা তােমার বাংলা সােনার বাংলা।” এছাড়াও বাংলা বিভাগের পর পূর্ব বাংলার যুব ছাত্র ও জনগণের নেতাজী সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে কী ধারণা তা জিজ্ঞেস করাতে উনি খুব জোরের সঙ্গে আবেগভরা কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, ” ও: খুব, খুব। তাদের খুব ভাল ধারণা। তারা নেতাজীকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে আর নেতাজীর দেশপ্রেমের আদর্শকে তারা প্রয়ােগ করেছে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।” সত্যিই তাই। ব্যর্থ হয়নি ১৯৫২র রক্তঝরা ২১শে ফেব্রুয়ারি। সেদিনের শহীদরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে বিপ্লবী পূর্ব বাংলায় জন্ম দিয়ে গেছে লাখ লাখ বরকত, রফিক, আজাদকে।
৬৩
আজ তাই গর্জে উঠেছে চট্টগ্রাম। পূর্ব বাংলার শহরে গ্রামে, গঞ্জে মানুষ আজ শিকলভাঙার পণ নিয়েছে। এসেছে তুফান। পদ্মার পানিতে উত্তাল তরঙ্গ। ইয়াহিয়ার শশাষণ ও শাসনের নাও পাড়ে এসে আছাড় খাচ্ছে। পাল ছিড়ে গেছে। টুটেছে হাল। আর উপায় নেই। তবুও ইয়াহিয়া তােমার ক্রেডিট আছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের ডায়ারকে ডাউনতাে দিলেই, আর ইয়া এক তুড়ি মেরে হিটলারের আত্মাকে এমন হিট কোরে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করলে যে নৃশংসতার গােল্ড মেডেলটা অমনি তােমার ভাগ্যেই জুটে গেল। তাই বাংলাদেশে তােমার কবরের একটি সুন্দর জায়গা হয়েছে এবং সেদিন সুদূর নয় যেদিন তােমাকে সদলবলে ঐখানেই চলে যেতে হবে।
যাক্ বেনাপােল চেকপােস্টের কাছ থেকে আবার ধরলাম গ্রামের মেঠোপথ। আবার সেই সাদিপুর হয়ে ভারত। সারাদিনের অনেক কথাই মনে পড়ছিল। মনে পড়েছিল, নেতা যুব ছাত্র, কর্মী, E.P.R. এর রাইফেলম্যান, মুক্তিসেনা, চাষী, মাঝি, রিক্সাওয়ালা, দোকানদার, শিক্ষক ইত্যাদি নানা স্তরের লােকের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। সবতাে আর লেখা যায় না তবে তাদের সঙ্গে কথাবাত্তায় যা চোখে পড়ল তা হােল তাদের একতা, ডিসিপ্লিন, সুন্দর ব্যবহার ও সর্বোপরি গভীর দেশপ্রেম। তাদের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছি তা খেয়াল করিনি। হুঁস হােল ‘ননা ম্যান্স ল্যান্ড’ পেরিয়ে ভারতের মাটিতে পা দিয়েই। আবার পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালাম। দুচোখ দিয়ে দেখলাম গােধূলির আলােয় বাংলাদেশ। সেই বাংলার আকাশ লাল-এ লাল। যেন নতুন প্রভাত হচ্ছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ গাইছে “জয় বাংলা” গণসঙ্গীত। পূর্বের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে আলােকে আলােকময়…
নবজাতক, সপ্তম বর্ষ প
ঞ্চম সংখ্যা, ১৩৭৭

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!