ঐসলামিক আদর্শের আলােকে বাঙলার মুক্তিসংগ্রাম
এম. এ. রকীব
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
মুজিব-উর-রহমান। বিশ্বে আর অপরিচিত নয় এ নামটি। বালাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাক্ষা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু মুজিব আপন দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে প্রতিটি বাঙালি তথা বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরই প্রিয় হয়ে উঠেছেন। আপন উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম তিনি হবেন কিনা একথা এখনই বলা খুব সহজ না হলেও, আজ অনেকেই মনে প্রাণে চাইছেন এবং এ বিশ্বাস পােষণ করছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে বিজয়ীর সম্মানই হবে তার শিরােপা।
বাঙলাদেশ আজ যে অনুপম গণসংগ্রামের ভিতর দিয়ে নবজন্মলাভের তােরণ দ্বারে এসে হাজির হয়েছে দূর অতীতের দিকে তাকালে এরূপ আর একটা ঘটনার সাক্ষাৎ আমরা পাবাে সেটাও মুসলিম ইতিহাসের এক গৌরবময় ট্রাজিক আলেখ্য। গণতন্ত্র ও ন্যায়কে বাঁচিয়ে রাখতে সপরিবারে হজরত ইমাম হাসান ও হাসেনের আত্মত্যাগ। কারবালার মহাপ্রান্তরে প্রবঞ্চক ও অন্যায়পথানুসারী এজিদের এক বিশাল মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে, সত্য ও ন্যায়ের অনুগামী মানব প্রেমিক হােসেনের আর এক মুসলমান সৈন্য বাহিনীর সংঘর্ষও ইতিহাসের এমনি এক মর্মবিদারক করুণ অধ্যায়। সেদিনেও এই ন্যায় যুদ্ধে হাসান-হােসেনের পক্ষে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল তখন, যখন দেখা দিয়েছিল এজিদের পক্ষের সৈন্যের বর্শার ফলকে পবিত্র কোরআনের আয়াত লেখা ও মুখে আল্লাহু আকবর ধ্বনি। এই বিভ্রান্তি অপনােদনের জন্যে হাসানহােসেনের পক্ষে নির্দেশ দেওয়া হলাে শয়তানের বর্শা ফলকে যদি পবিত্র কোরআনের আয়াত থাকে তবে তা ঝুটা কোরআন। ন্যায় ও সত্যের খাতিরে ওদের ধ্বংস কর ।
আজও সত্যভ্রষ্ট ইয়াহিয়া খা ও তার অনুগামী তাদের শয়তানী মতলব হাসিল করার জন্যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের ছদ্মবেশে মুসলিম জাহানে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। বলা বাহুল্য এর শিকার যে কেউ হচ্ছে না তাও বলা যায় না। তাই তাদের কাছে আমাদের নিবেদন প্রকৃত শয়তানকে চিনে নিন।
এবার আসুন আমরা বিগত দিনের ইতিহাসের দিকে একটু নজর ফেরাই। দুশাে বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান হলাে। ভারতবর্ষ হলাে স্বাধীন, হলাে দ্বিখণ্ডিত। একটি বিশালখণ্ডের জননায়কগণ নীতিগত ভাবে এটিকে দিল ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের রূপ। আর অন্য খণ্ডের নায়কেরা সেটাকে দিল একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রের রূপ। আর গর্ববােধ করল এই ভেবে যে, সেটা হলাে বিশ্বের বৃহত্তম ঐসলামিক রাষ্ট্র। সেদিনও কিন্তু মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন প্রকৃত ইসলামীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষ এটাকে ইসলামীয় চিন্তাধারায় তথা মহান ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মােহাম্মদের শুভচিন্তার শুভ পরিণতি বলে ধরে নিতে পারেননি।
৬২২-২৩ খৃষ্টাব্দে হজরত মােহাম্মদ মদিনাতে একটা অপূর্ব শুভবুদ্ধির ও কর্মক্ষমতার যে নিদ যান যা অসাধারণ শুধু ধর্মের দিক দিয়েই নয়, মানব সভ্যতার দিক দিয়েও সেটি হচ্ছে মদিনার মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য মুসলিম গােত্রের সহায়তায় একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। এই চেষ্টার মূলে ছিল পরস্পর বিপরীত চিন্তা রুচি ও ধর্মভাব সম্পন্ন ইহুদী, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের, দেশের সাধারণ স্বার্থরক্ষা ও মঙ্গল বিধানের জন্যে একই কর্মকেন্দ্রে সমবেত করার এবং তাদেরকে একটা রাজনৈতিক জাতি বা কওমে পরিণত করার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নীতি। যাতে করে এক দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় হতে পারে এবং এরূপ হওয়াই কর্তব্য। জগতে সর্বপ্রথম এই গণতান্ত্রিক উদার আদর্শ স্থাপন করলেন হেজাজের মরুপ্রান্তরবাসী নিরক্ষর হজরত মােহাম্মদ। আর আজ প্রায় তের চৌদ্দশ বছর পরে তারই অনুগামীদের একটা দল কোন আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই মহাননেতার মহান আদর্শকে
৫৭
কবরস্থ করে ধরল বিপথ? সেদিন এই ভূখণ্ডের অনেক মুসলমানই ব্যথিত হয়েছিলেন তাঁদের মহাননেতার আদর্শের এই অদ্ভুত পরিণতি লক্ষ্য করে।
তারপর দীর্ঘ ২৩ বছর পরে যারাই ঐ খণ্ডের ঐসলামীক রাষ্ট্রের ইতিহাস লক্ষ্য করেছেন তারাই ব্যথিত হয়েছেন ওদের অ-ইসলামীক কার্যকলাপ দেখে। তবুও এরই মধ্যে পূর্ব খণ্ডে জন্ম নিয়েছিল এমন একটা গােষ্ঠীর যাদেরকে ধর্মের আফিম খাইয়ে শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত করতে পারে নি ঐ শয়তান চক্র। নবজাত এই গােষ্ঠীর অন্তরে আশ্রয় করেছিল ইসলামের ধর্ম, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বীজমন্ত্র । তারা হলাে মুক্তি সম্প্রদায়ভুক্ত মানব প্রেমিক। এঁদের মন্ত্র হলাে স্বদেশ প্রেম এবং এটাই এদের ধৰ্ম্ম “হুববুল ওতান মিনাল ইমান।” শােষণহীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এঁরা দেখতে লাগল, আর গড়তে চাইল মনুষ্যত্বে পূর্ণ আস্থাবান এক তরুণ সম্প্রদায়। এই গড়ার কাজ চলেছে ঐ বাল্লাদেশে ধীরে ধীরে এই দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে। এর পিছনে আছে অনেক তরুণের আত্মত্যাগ, অনেক বুদ্ধিজীবির কঠিন পরিশ্রম।
আজকের মুজিব-উর-রহমান সেই মহতী প্রচেষ্টা আর প্রযত্নেরই মূর্ত প্রকাশ।
অ-ভীত অ-কপট ন্যায়াদর্শের জয় যদি ঐশ্বরিক বিধান বা ধ্রুব সত্য হয় তবে বাঙালি মুজিবুরের এবং সেই সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন আর সাধনা হবে ইতিহাসের অক্ষয় সম্পদ— এই সুদৃঢ় আশাই হােক আমাদের আজকের দিনের চলার পাথেয়।
নবজাতক, সপ্তম বর্ষ
পঞ্চম সংখ্যা, ১৩৭৭