You dont have javascript enabled! Please enable it! সংস্কৃতিকেন্দ্র ঢাকা : তখন ও এখন | কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

সংস্কৃতিকেন্দ্র ঢাকা : তখন ও এখন | কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত

বাঙলাদেশ জ্বলছে। জ্বলছে ঢাকা শহর, এখনকার বাঙলাদেশের রাজধানী। শুধু জ্বলেনি, অনেক পরিমাণে নিশ্চিহ্ন। যেমন বাঙলাদেশের আর সব গ্রামে ও শহরে তেমনি পূর্ববঙ্গের এই ইতিহাস-প্রসিদ্ধ সংস্কৃতিকেন্দ্র ঢাকায়ও হানা দিয়েছে মনুষ্যত্বহীন বিবেকবুদ্ধি বর্জিত মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত রক্তচক্ষু শাসকের নরখাদক বাহিনী। ঢাকা এখন ধ্বংসস্তুপ, লড়াই চলেছে এখানে-সেখানে। নির্জন পথঘাটে শ্মশানের স্তব্ধতা।
এই ঢাকা শহরেই জন্মেছিলাম, কাটিয়েছি শৈশব থেকে যৌবনের বেশ কিছু সময় পর্যন্ত। কখনাে ভাবিনি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। খাওয়া-দাওয়া সস্তা, লেখা-পড়ার সুযােগ পর্যাপ্ত, বারাে মাসে তেরাে পার্বণের ঢেউ। ঢাকা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রও নিশ্চয়। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ঢাকায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ ছেলেদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের উদ্বোধন, শরীরচর্চা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবােধকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা। শিক্ষার সঙ্গে স্বদেশ-চিন্তা অঙ্গাঙ্গীভাবে মিলেমিশে ছিল, আলাদা করে দেখার উপায় ছিল না। হিন্দু-মুসলমানের বিরােধকে জিইয়ে রাখবার জন্যে বাঙলাদেশকে দু-ভাগ করতে চেয়েছিল তৎকালীন বৃটিশ শাসক। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের ফলে ১৯০৫ সনের বঙ্গবিভাগ রদ হলেও পূর্ব-বাঙলার মুসলমান সমাজের জন্য কতকগুলাে সুযােগ-সুবিধা অব্যাহত রাখা হলাে ঢাকা শহরে। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই সুযােগ-সুবিধার শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ অব্যাহত থাকবে। অথচ শেষ পর্যন্ত ফল হলাে অন্য রকম। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মৈত্রীর সৌধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়েছিলেন বাঙলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও মনীষীবৃন্দ।
আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের ছাত্রজীবন এখন সুবর্ণ যুগের একটি অধ্যায় বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে, চতুর্দিকে দুর্যোগের ঘনঘটা। সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ ছিল, রাজনীতি সম্পর্কেও সচেতন হয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডােরে, মাঠে, গাছের নিচে ছাত্রদের সাহিত্য ও রাজনীতির আলােচনা। টেররিস্ট যুগের অবসানের পর ঢাকার রাজনীতি তখন নতুন মােড় নিয়েছে, দেশের যুবশক্তি ক্রমশই মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকেছে, নতুন উদ্দীপনা আর আলােড়ন প্রত্যেকের মনে। সাহিত্য যারা ভালােবাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং পাঠাগারের আকর্ষণ তাদের কাছে ছিল দুর্নিবার। দেশী-বিদেশী অনেক পত্র-পত্রিকা হাতের কাছেই পাওয়া যেত। বিরাট হলঘর, ছাত্ররা বসে বসে পড়ছেন, কোথাও শব্দ নেই। ছাত্রাবাস গুলাে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি; ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, সলিমুল্লা হল। প্রতিটি হল থেকে একটি করে বার্ষিকী প্রকাশিত হতাে ছাত্র এবং অধ্যাপকদের রচনায় সমৃদ্ধ হয়ে। আমি সে-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে সময় কৃতি অধ্যাপকের সংখ্যা অনেক। কলা বিভাগে ছিলেন মােহিতলাল মজুমদার, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রফুল্ল কুমার গুহ, সুশীল কুমার দে প্রভৃতি। বিজ্ঞান বিভাগে স্বনামধন্য জ্ঞানচন্দ্র ঘােষ এবং অধ্যাপক সত্যেন বসু। আরাে যারা তরুণ অধ্যাপক তাদের মধ্যে অমলেন্দু বসু, আশুতােষ ভট্টাচার্য, জসীম উদ্দীন, অমিয়কুমার দাশগুপ্ত, পরিমল রায়। হরিদাস ভট্টাচার্য, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিভিন্ন শাস্ত্রের বিভাগীয় প্রধান। এদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে উচ্চতর পদমর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। গণমাধ্যমে
১৭
তিরিশের শেষাশেষি বামপন্থী রাজনীতির ঢেউ এসে লাগল ঢাকা শহরে। তার প্রভাব দেখা দিল সাহিত্যেও। একদল তরুণ লেখকের উদ্যোগে স্থাপিত হলাে ‘প্রগতি লেখক সঙ্’। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত একটানা দশ বছর এই সঙ্রে কর্মোদ্যোগ ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ১৯২৮-২৯সনে ঢাকায় আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন ছিল প্রধানত বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত প্রগতি’ মাসিক পত্রকে অবলম্বন করে। প্রগতি’র লেখক গােষ্ঠী রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের প্রভাব এড়িয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহী হলেও এই গােষ্ঠীর কোনাে লেখকই রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সাহিত্য আন্দোলনে সামিল হননি। প্রগতি’র লেখকরা ছিলেন মােটামুটিভাবে বিশুদ্ধ শিল্পের সমর্থক, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অজিত দত্ত প্রমুখের তৎকালীন রচনায় যার নিদর্শন। বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জীবনানন্দ লেখা পাঠাতেন বরিশাল থেকে।
ঢাকায় প্রগতি লেখক সম্মের সূচনাকাল থেকেই তরুণতর লেখকদের সাহিত্য সৃষ্টিতেও নতুন স্বাক্ষর। এই সঙ্রে লেখকদের অনেকেই তখন মার্কর্সবাদে বিশ্বাসী। মার্কসবাদে তেমন অভিজ্ঞ নন এমন লেখকও বেশ কিছু যােগ দিয়েছিলেন এই সঙ্ঘের মানবিক, বিপ্লবী ও কল্যাণকর আদর্শকে অনুধাবন করে। সপ্তাহে একবার সাহিত্যসভার আয়ােজন হতাে। এক এক বার এক এক সভ্যের বাড়িতে। কখনাে নারিন্দায়, কখনাে দক্ষিণ মৈশুন্ডী, কখনাে কোর্টহাউস স্ট্রীট, পাটুয়াটুলী, সূত্রাপুর কিংবা গেণ্ডারিয়ায়। সভায় অনেক তরুণ নতুন মুখ দেখা যেত; পরবর্তীকালে এদেরই অনেকে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের এবং সেই সঙ্গে মার্কসবাদী আন্দোলনেরও উৎসাহী কর্মী। সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন অনেক কর্মী এই সময়েই ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দিয়েছিলেন।
ঢাকায় প্রগতি লেখক সম্মের প্রথম সম্পাদক রণেশ কুমার দাশগুপ্তর সঙ্গে একই পাড়ায় বাস করতাম। ইনি তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সােনার বাঙলা’ পত্রিকায় কাজ করতেন। মার্কসবাদী সাহিত্য সম্পর্কে তখনই তার প্রচুর পড়াশােনা ছিল এবং আমরাও তাঁর কাছ থেকে বইপত্র এনে পড়তাম। এখন যেমন সর্বত্র প্রগতিশীল বইপত্র পাওয়া যায় এবং কিনেও পড়া যায় তখন এ-রকম সুযােগ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টি তখন পর্যন্ত বেআইনী এবং যে-কোনাে সময়ে যে-কোনাে অজুহাতে গ্রেপ্তার হবার সম্ভাবনাও বড়াে অল্প ছিল না। নতুন লেখকদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকায় রণেশবাবু তরুণ লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। পাকিস্তান হবার পরেও তিনি ঢাকায় থেকে যান এবং সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছিলেন। এখন তার অবস্থা কী হয়েছে জানি না। ১৯৩৯ সনে কলকাতা থেকে ‘প্রগতি লেখক সঙ্’ের উদ্যোগে প্রগতি’ নামের সঙ্কলন গ্রন্থ সুরেন্দ্রনাথ গােস্বামী ও হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। রণেশবাবু প্রস্তাব করলেন ঐ ধরনের একটি সঙ্কলন যেন আমরা ঢাকা থেকে প্রকাশ করি। আরাে স্থির হলাে যে ঢাকা জিলা ‘প্রগতি লেখক সঘের লেখকরাই শুধু ঐ সঙ্কলনে লিখবেন। তদনুযায়ী ১৯৪০ সালে বেরুলাে ‘ক্রান্তি’ নামের ১৬০ পাতার একটি সঙ্কলন। লেখক সূচির অন্যতম ছিলেন রণেশ কুমার দাশগুপ্ত, সােমন চন্দ, অচ্যুত গােস্বামী, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, সরলানন্দ সেন এবং আরাে কেউ কেউ। প্রগতিশীল চিন্তাধারার পরিপােষক এরূপ একটি সাহিত্য সঙ্কলন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ সাড়া পড়ে যায় এবং কলকাতার লেখক সমাজও এই লেখক গােষ্ঠীকে স্বাগত জানান। ঢাকা ‘প্রগতি লেখক সঙ্’ের পক্ষ থেকে সােমেন চন্দ এই গ্রন্থের প্রকাশক হয়েছিলেন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘বনস্পতি’ এই সঙ্কলনেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সঙ্কলনটি বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কয়েকজন নতুন লেখককে আমরা সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য জীবন চক্রবর্তী ও রণেন মজুমদার। এঁরা দু-জনেই দু-চারটি গদ্য রচনায় অসামান্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। জীবন চক্রবর্তী দেশ বিভাগের কিছু আগে বিমানে বর্মা যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। রণেন মজুমদার ঠিক ঐ সময়েই কলকাতায় চলে আসেন এবং বস্তীতে বসবাস করতে শুরু করেন শ্রমজীবী জনসাধারণের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানবার আশায়। সম্রান্ত পরিবারের সুশিক্ষিত এই যুবক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক না রেখে দারিদ্র ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণও করেছিলেন। মার্কসবাদে বিশ্বাসী চিন্তার জগতে পরিশুদ্ধ এই যুবক যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন; তঁার এ-ধরনের মৃত্যুবরণের তাৎপর্য তার বন্ধুদের অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।
১৮
‘ক্রান্তি সঙ্কলন প্রকাশের পর থেকেই ঢাকা প্রগতি লেখক সঙ্’ের আসর জমজমাট হয়ে উঠেছিল। এই সময় থেকে তরুণ মুসলমান লেখকরাও কেউ কেউ যাতায়াত শুরু করেন। ১৯৪১ সনের জুন মাসে সােভিয়েত ইউনিয়ন হিটলার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হবার পরে প্রগতি লেখক স’ ফ্যাসিস্ত বিরােধী লেখক ও শিল্পী সম্মে’ রূপান্তরিত হলে ঢাকা প্রগতি লেখক সঙ্’ের উদ্যোগে ঢাকায় ‘সােভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ সংগঠিত হয়। এই সমিতির সম্পাদক ছিলেন বর্তমান প্রবন্ধকার এবং দেবপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন কৃতি ছাত্র। ঐ বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশন হলে এক সপ্তাহব্যাপী সােভিয়েত চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দৈনিক প্রায় তিন হাজার নরনারী ঐ চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে আসতেন। সােভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্যোগেই ১৯৪২ সনের মার্চ মাসে ঢাকায় ফ্যাসিবিরােধী সম্মেলনের আলােচনা করা হয়। কলকাতার বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী ও ট্রেডইউনিয়ন নেতৃবৃন্দও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ১৯৪২ সনের ৮ই মার্চ ঢাকায় সূত্রাপুর এলাকায় এই সম্মেলন যেদিন শুরু হলাে সেদিনই ঘটলাে আমাদের প্রিয়তম সুহৃদ ও তরুণ লেখক সােমেন চন্দের হত্যাকাণ্ড। এই সময় ঢাকা ই.বি.রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সম্পাদকরূপে কাজ করছিলেন। বিকেল তিনটে নাগাদ শ্রমিকদের একটি ছােট মিছিল নিয়ে তিনি যখন সূত্রাপুরে পৌঁছন তখনই রাস্তার ওপরে কমিউনিস্ট বিরােধী রাজনৈতিক দলের লােকদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সােমেন শােভাযাত্রার পুরােভাগে ছিলেন সুতরাং একটি আঘাতও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। যেভাবে সােমেনকে হত্যা করা হয় তা নৃশংস, এখনকার অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের তুলনায়ও তা নৃশংস। সােমেনের হত্যাকাণ্ড তৎকালীন বিধানসভায় তুমুল আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল এবং বাঙলাদেশের প্রায় সমস্ত লেখকই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন। সােমেনের মৃত্যু মাত্র একুশ বছর বয়সে। তার মৃত্যুর ঠিক পরেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলাে তাঁর ‘হঁদুর’ গল্পটি। এই গল্পটি পড়েই বাঙলাদেশের লেখক ও পাঠক সমাজ উপলব্ধি করতে পারলেন এই তরুণের কলমে কতাে সুদূরপ্রসারী প্রতিভার সম্ভাবনা ছিল। ধূর্জটি প্রসাদ, অন্নদাশঙ্কর, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকও বুদ্ধিজীবী এই তরুণ লেখকের অকালমৃত্যুকে স্মরণ করে সেদিন নিঃসঙ্কোচে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
সােমেন চন্দের সংগ্রামী জীবনের শুরু তার শৈশব থেকেই। পিতা সামান্য বেতনের সরকারী কর্মচারী হওয়ায় তখনকার সস্তা জিনিসপত্রের যুগেও ক্রমবর্ধমান অভাব অনটনের সঙ্গে সােমেনকে মােকাবেলা করতে হয়েছিল। ১৯৩৮-৪১ সনে যখন কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী তখন পার্টির অনেক সক্রিয় কর্মী সােমেনের দক্ষিণ মৈশুভীর ভাড়া-বাড়িতে আত্মগােপন করে থাকতেন। প্রায়ই একজন না একজন রাতের দিকে আসতেন; এঁদের খাবার সংগ্রহ করাও এক সমস্যা হতাে। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে সােমেনকে কর্মীদের আহারের ব্যবস্থা করতে দেখেছি। সােমেন অবশ্য এ-ব্যাপারে তার মাকে পেয়েছিলেন সঙ্গে এবং বিস্তর অভাব থাকলেও যে কোনাে সময়ে কর্মীদের জন্যে যথাসম্ভব ব্যবস্থা করতে সােমেন-জননী কখনাে ক্লান্তি বােধ করেননি। সােমেনের অকাল মৃত্যুর পর প্রতিরােধ পাবলিশার্স থেকে ১৯৪৩-এ প্রকাশিত হলাে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সঙ্কেত’। কিছুকাল পরে দ্বিতীয় গ্রন্থ বনস্পতি বার করলেন শরৎ দাস কলকাতার মডার্ন পাবলিশার্স থেকে। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন গােপাল হালদার।
সােমেনের মৃত্যুর সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরােদমে চলছে। মনে পড়ে সােমেনের শবদেহ যখন মশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আরাে অনেকের সঙ্গে সঙ্গী হয়েছিলেন বঙ্কিম মুখােপাধ্যায় ও জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসু শ্মশানে আমার পাশেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, আর তাঁর পাশেই চিরকালের বিপ্লবী, ঢাকার রণেশ দাশগুপ্ত। শ্মশানযাত্রীদের মধ্যেই কে একজন যেন ছুরির ফলা দিয়ে দেয়ালে লিখেছিলেন: ‘সােমেন চন্দ: আমাদের প্রিয় সংগ্রামী লেখক। তখন যুদ্ধের দরুন ব্ল্যাক আউট চলছে, ঢাকা শহরের রাস্তাগুলাে অন্ধকার, অন্ধকার নীলিমা নক্ষত্রের মালা। সােমেনের শেষকৃত্য সমাধা হবার পর সবাই ফিরে এলেন জীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকতর দৃঢ়তা ও প্রত্যয় নিয়ে।
জীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশের ব্যাপারে আমরা সক্রিয় হয়েছিলাম। অল্পকালের মধ্যেই প্রতিরােধ’নাম দিয়ে একটি পাক্ষিক পত্র প্রকাশিত হলাে ঢাকা কোর্ট হাউস স্ট্রীট থেকে। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস এবং কোর্ট কাছারির পেছনের এই গলিটাতে
১৯
প্রতিরােধ’পত্রিকার খুব কাছেই ছিল ঢাকা জিলা কমিউনিস্ট পার্টিরও সদর কার্যালয়। পার্টির ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহৃত হওয়ায় কার্যালয় এ-সময় কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছিল। একসময় খবর পেলাম আন্দামান প্রত্যাগত সদ্যমুক্ত রাজবন্দীরা প্রায় সকলেই এসে উঠেছেন পার্টি কার্যালয়ে। শুনেই গেলাম। এই প্রথম এতাে বেশি সংখ্যক বিপ্লবীদের একসঙ্গে দেখার সুযােগ পেলাম। মনে পড়ে তাদের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবী লালমােহন সেন যিনি কিছুকাল পরেই নােয়াখালি জেলার সন্দ্বীপে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বিপ্লবী লালমােহনের অসামান্য আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যে নিবেদিত দুটি কবিতা লিখেছিলেন একালের দুজন বিশিষ্ট কবি, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে। অনেক কাব্যপাঠকই হয়তাে সে-কবিতা দুটি পড়েছেন।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত প্রতিরােধ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম দুবছর সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্ররূপে এবং পরবর্তীকালে ত্রৈমাসিক আকারে। প্রথম দুবছর বাঙলাদেশের অনেক সুপরিচিত লেখকের রচনাবলী প্রতিরােধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিদের মধ্যে ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, বিমলচন্দ্র ঘােষ, অরুণ মিত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এবং প্রবন্ধ ও গল্প লেখকদের অন্যতম ছিলেন গােপাল হালদার, বিনয় ঘােষ, সন্তোষকুমার ঘােষ, নবেন্দু ঘােষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। মনে পড়ছে সে সময় পত্রিকাটি যাতে কিছুকাল অন্তত প্রকাশিত হতে পারে তার জন্যে সাহায্য করেছিলেন ভারতীয় চা’ কোম্পানীর তল্কালীন কর্মকর্তা প্রভু গুহঠাকুরতা। প্রতিরােধ’ যখন প্রকাশিত হয়েছে তখন শুরু হলাে আগস্ট আন্দোলন এবং তারপরেই শুরু হলাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আমি এবং অচ্যুত গােস্বামী পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম এবং রচনা সংগ্রহ ও নির্বাচন করতাম। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রতি সংখ্যার জন্যে লিখে দিতেন রণেশ দাশগুপ্ত। দাঙ্গার সময় পাড়ায় পাড়ায় শান্তি কমিটি করে পাহারা দেবার দায়িত্ব আমার এবং আরাে অনেক লেখকেরই তখন নিতে হয়েছিল। ১৩৫০ এর মন্বন্তর শুরু হবার পরেই সারা বাঙলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমরাও অভূতপূর্ব দুর্যোগের মুখােমুখি হয়েছিলাম। চাল, তেল , নুন যেমন পাওয়া যায় না তেমনই দুপ্রাপ্য মূদ্রণের কাগজ। ‘প্রতিরােধ’ পত্রিকার প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ল। শেষের দিকে মিলের কাগজের অভাবে দেশী তুলােট কাগজেও দু-তিনটি সংখ্যা ছাপা হয়েছিল। এই সময় প্রতিরােধ পাবলিশার্স নাম দিয়ে ঢাকায় জি.ঘােষ লেনে একটি পুস্তক প্রকাশক ও বিপণন কেন্দ্রও ভােলা হয়। দেশী-বিদেশী প্রগতিশীল বই ও পত্র পত্রিকা ছাড়াও ঢাকার লেখকদের কিছু কিছু বই ও পুস্তিকা প্রতিরােধ পাবলিশার্স-এর তরফ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল । উল্লেখ্য এই ধরনের বইয়ের অন্যতম ছিল অনিল মুখার্জীর ‘সাম্যবাদের ভূমিকা, ‘ সরলানন্দ সেনের ‘মাও সে তুং’ এবং সসামেন চন্দের ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’। এছাড়া সােমেনের স্মৃতিতে ঢাকা কোর্ট হাউস স্ট্রীটে সােমেন পাঠাগার নাম দিয়ে একটি নতুন পাঠাগারও স্থাপিত হয়েছিল। জি.ঘােষের গলিতে একটি ত্রিতল বাড়ির একতলায় ছিল প্রতিরােধ পাবলিশার্স, দোতলায় ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের ঘর যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হতাে। ঐ সময় ঢাকার লেখকদের উদ্যোগে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কলকাতা থেকে এইসব অনুষ্ঠানে যােগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে মনােরঞ্জন ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখােপাধ্যায়, বিনয় রায়, বিনয় ঘােষ, গােপাল হালদারের নাম মনে পড়ছে। এক সময় ঢাকা শহরের ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপকের ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘের তরুণ লেখকদের সঙ্গে যােগাযােগ ঘটেছিল মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিমল রায়, অমিয়কুমার দাশগুপ্ত, পৃথ্বীশ চক্রবর্তীর নাম উল্লেখ্য । শহীদুল্লাহ এবং কাজী মােতাহার হােসেনের উৎসাহ থেকেও প্রগতি লেখক সঙ্’ বঞ্চিত হয়নি। এক সময় পুরনাে পল্টনের একটি বাড়িতে প্রগতি লেখকদের উদ্যোগে একটি সাহিত্যের আলােচনাচক্রে সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সংস্কৃতি কেন্দ্র ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমাজের এই সক্রিয় ভূমিকা পাকিস্তান হবার পরে আরাে ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলাে ছিল ছাত্র সমাজের সাংস্কৃতিক ক্রিয়া কর্মের ক্ষেত্র। ছাত্রজীবনে আড্ডার মৌতাত সেখানে অনেকের মতাে আমিও উপভােগ করেছিলাম। কার্জন হলে হতাে বিশ্ববিদ্যালয়-এর নানা অনুষ্ঠান। প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের বাৎসরিক প্রীতি-সম্মেলন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ।
২০
প্রতিরােধ প্রকাশিত হবার পর থেকেই ঢাকার তরুণ মুসলমান লেখকদের সঙ্গে যােগাযােগ হলাে। এঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। প্রগতি লেখক সঙ্’ের বৈঠকে অনেকেই নিয়মিত আসতেন, রচনাদি পাঠ করতেন এবং নানা আলােচনায় অংশ নিতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সর্দার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, সানাউল হক; ছিলেন সৈয়দ নুরুদ্দিন, আহমদুল কবীর ও খায়রুল কবীর ভ্রাতৃদ্বয়। খায়রুল ছিলেন ‘আজাদ পত্রিকার বার্তা-সম্পাদক। সর্দার ফজলুল করিম পকিস্তান হবার পরেও বেআইনী কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন এবং কারাবরণও করেছিলেন। সানাউল হক পূর্ববাঙলার কবি সম্প্রদায়ের অন্যতম এবং বর্তমানে পাকিস্তান অ্যাডমিনেস্ট্রেটিভ সার্ভিসের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত। মুনীর চৌধুরী অধ্যাপক এবং সম্প্রতিকালে বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধাদিও লিখেছেন বাঙলা আকাদমির মুখপত্রে এবং অন্যত্র। সৈয়দ নুরুদ্দিন কবিতা লিখতেন প্রতিরােধ’ প্রত্রিকায়। আজাদ পত্রিকার বার্তা-সম্পাদক ছিলেন, পরে সংবাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রগতি লেখক সম্মের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন আবদুল মতিন চৌধুরী, আলমুতি শরাফউদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং উপন্যাসিক আবু জাফর সামসুদ্দিন। সৈয়দ আলী আহসান এবং তার ভাই আলী আশরাফ উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আলী আহসান কবি হিসেবে এখন সুপরিচিত এবং বাঙলা আকাদমি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও কিছুকাল পূর্বেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আলী আশরাফও এখন বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তান হবার পরে আমার পরিচিত যেসব অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মুজাফর আমেদ চৌধুরী, অজিত গুহ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অন্যতম। অজিত গুহ প্রগতি লেখক সঙ্’ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাঁর ও আমার সম্পাদনায় ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান হবার পরে ক্রান্তি সঙ্কলন গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। ইনি গতবছর পাকিস্তানেই কুমিল্লায় তার বাসভবনে হৃদরােগে হঠাৎ মারা যান। অধ্যাপক জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার মৃত্যু হলাে বড়াে সাংঘাতিক। ইয়াহিয়ার বেতনভুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এই বছরের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে গভীর রাত্রে যখন মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের হত্যা করতে শুরু করেছিল তখন শহীদ হলেন এই অধ্যাপক। জানতে পারলাম ঐ কালরাত্রে শহীদ হয়েছেন কবীর চৌধুরীও [খবরটি ছিল ভুল]। আরাে একজনকে মনে পড়ছে। ইনি সারওয়ার মুরশেদ। সারওয়ার মুরশেদের সঙ্গে আলাপ ছিল। অমিয় চক্রবর্তী (বর্তমানে যাদবপুর বিজয়গড় কলেজের প্রধান) যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন তখন ১৯৪৯ সনে তার ও মুরশেদের যৌথ সম্পাদনায় ঢাকা থেকে নিউ ভ্যালুস’ (New Values) নামের একটি ইংরেজি মাসিকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাগজের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী তরুণ সমাজকে আকর্ষণ করেছিল। কবীর চৌধুরী ছিলেন মুনীর চৌধুরীর ভাই এবং তিনি খুব সম্প্রতি ঢাকার বাঙলা আকাদমির প্রধান হয়েছিলেন।
‘প্রতিরােধ’ প্রত্রিকা প্রকাশের সময় থেকে সত্যেন সেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরােভাগে। বস্তুত ঢাকায় রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হতে দেখেছি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তাঁকে কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁকে প্রায়ই গােপন ভাবেও থাকতে হতাে। যে কজন হিন্দু সাংবাদিক ও লেখক পাকিস্তান হবার পরেও পূর্ববঙ্গে থেকে যান এবং তরুণ মুসলমান লেখকদের সহায়তায় প্রগতিশীল ভাবধারা প্রচারে যত্নবান ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত এবং সত্যেন সেন তাদের অন্যতম। জানতে পেরেছি কিছুকাল আগে উল্লেখযােগ্য উপন্যাস লেখক হিসেবে সত্যেন সেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এখন তার কী অবস্থা জানতে পারা যায়নি। এই সঙ্গে মনে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক আহম্মদ শরিফের কথা। ইনিও সাহিত্যকর্মের জন্যে আদমজী পুরস্কার পেয়েছিলেন। খবর পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী ফৌজ যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায় তাতে ইনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন (খবরটি ছিল ভুল)।
১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই পূর্ববঙ্গে সাংস্কৃতিক জগতে নবজাগরণের শুরু, বাঙলাদেশ ও বাঙলা ভাষার প্রতি বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এসময় লক্ষণীয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী শুরু থেকেই বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কণ্ঠরােধের যে গভীর ষড়যন্ত্র করেন তা বিফলে যায়। পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিককালের এই অধ্যায়ের সঙ্গে এপার বাঙলার
২১
পাঠকসমাজ সুপরিচিত। বদরুদ্দীন উমর-এর ‘মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ প্রবন্ধটি সাম্প্রতিককালে বাঙলাদেশে আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল এ-তথ্য এখানকার অনেক পাঠকেরই অজানা নয়। পাকিস্তান হবার পর থেকেই সেখানকার অবাঙালি শাসকদের চেষ্টা হয়েছিল বাঙলা ভাষার প্রভাবকে খর্ব করা। ভাষাই জাতির প্রাণ; সুতরাং ভাষাকে খর্ব করতে পারলে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানকেও আয়ত্বে রাখা সম্ভবপর হবে। বাঙলাদেশ ও বাঙলা সংস্কৃতিকে সামনে রেখে নয়, আরব-ইরান-তুর্কী জগৎকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকবে এ-রকম একটা ফতােয়া যেন অলিখিতভাবে জারি করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, অন্তত কিছুকালের জন্যে বাঙালি মুসলমান লেখক সমাজের একাংশ এই চিন্তাধারায় আচ্ছন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাে স্বদেশ ও সমাজের বুকের কাছে; বাঙলাদেশের তরুণ চিন্তাবিদ লেখক ও শিল্পীরা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে স্বদেশ জননীর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিবেদন করলেন, সম্ভব হলাে। প্রত্যাবর্তন। তারপর গত কয়েক বছরের সাহিত্য চিন্তায় পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে পূর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালির নবজাগরণ এবং এই মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ প্রাণ আহুতি দিয়েও রক্তচক্ষু শিশুঘাতী নারীঘাতী দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্যে ঘরে ঘরে চলেছে বাঙালি মুসলমানের নিরবচ্ছিন্ন প্রস্তুতি।
বাঙলাদেশ জ্বলছে, জ্বলেছে ঢাকা শহর। কিন্তু ঢাকা শহরের যে বৈপ্লবিক ইতিহাস ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা একদা গড়ে উঠেছিল তার উত্তরাধিকার বাঙলাদেশের জনগণকে, তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আবার বাঁচিয়ে তুলবে এ বিষয়ে সন্দেহ করবার কিছু নেই; বরং একথা প্রবল প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারিত হবার যােগ্য।
পরিচয় বাংলাদেশ সংখ্যা ১৩৭৭-৭৮