ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আশুতােষ ভট্টাচার্য
ইতিহাসে লেখা আছে একদিন বখতিয়ার যখন তার তুর্কী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কামান নিয়ে এসে বিহারের নালন্দা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অতর্কিত কামান দাগতে আরম্ভ করেছিলেন সেদিন কয়েক হাজার দেশ-বিদেশের ছাত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করত, তােপের সামনে তাদের কেউ পালিয়ে বাঁচল, কেউ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সে আজ সাতশ বছরের ইতিহাসের কথা। আমরা জানি, মধ্যযুগ ছিল বর্বরতার যুগ, ধর্মান্ধতার যুগ, সামন্ততন্ত্রের বা স্বৈরাচারের যুগ; কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্রের যুগেও যে সেই মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অথচ তাই ঘটেছে গত ২৫-এ মার্চ মধ্যরাত্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে।
একদিন নালন্দার প্রান্তরে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, যে নিদারুণ দুর্দিনে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ভবনের উপর বখতিয়ারের তােপ এসে পড়ল, সেদিন আবাসিক ছাত্র অধ্যাপকদের মধ্যে কী আতঙ্ক না জানি দেখা দিয়েছিল। তারপর তাদের সর্বস্ব সেখানে ফেলে কেউ প্রাণ নিয়ে পালাবার চেষ্টা করতে তােপের মুখে পড়ল, কেউ হয়তাে প্রাণে বেঁচেও এই নিদারুণ আঘাত শেষ পর্যন্ত সইতে পারল না। সেজন্য নালন্দার চারদিককার জনমানবের মধ্যে তার কোনাে চিহ্নই আজ অবশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তেমনই এক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকটা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতােই বললেও ভুল হয় না; তবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল শিক্ষণীয় বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন, বুদ্ধের মূর্তি সেখানে উপাসিত হতাে, বৌদ্ধ আদর্শে জীবন গঠিত হতাে; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক বিংশ শতাব্দীর আদর্শে গঠিত, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাই সেখানকার শিক্ষা ছিল।
তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটু ভুল ধারণা আমাদের বাইরের জগতের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বাঙলার শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলমান সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যেই সে সময়কার ইংরেজ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ-কথা সত্য, তথাপি আমার সেখানকার মােল বছরের ছাত্র এবং অধ্যাপক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এ-কথা বলতে পারি যে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যত হিন্দু ছাত্র এবং অধ্যাপক উপকৃত হয়েছেন, মুসলমান ছাত্র ও অধ্যাপক তার অর্ধেকও উপকৃত হননি।
১৩
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব একদিন বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে লােকে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে; তুমি ত দেখছ, এর শতকরা দশ ভাগ অধ্যাপকও মুসলমান নয়, সবই হিন্দু আর শতকরা পঁচিশ ভাগ ছাত্রও এখন পর্যন্ত মুসলমান নয়, সবই হিন্দু। সুতরাং একে বরং ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় বলা উচিত।
শহীদুল্লাহ সাহেব যখন এ-কথা বলেছিলেন, তখন সম্ভবত ১৯৩২সন। তার কথা বিন্দুমাত্রও অতিরঞ্জিত ছিল না। এমনকি, দেশ বিভাগের সময় পর্যন্তও হিন্দু অধ্যাপকের সংখ্যা শতকরা পঁচাত্তর ভাগ এবং হিন্দু ছাত্রের সংখ্যাও পঞ্চাশ ভাগের বেশি ছিল। সেইজন্যই বলছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্তও হিন্দু সমাজের যত উপকার হয়েছে, মুসলমান সমাজের তত উপকার হয়নি। সেইজন্য সকল শ্রেণীর ছাত্র অধ্যাপকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে মনে করত। আজ তাই তার এই দুর্দিনে ভারতের হাজার হাজার অধিবাসীর মনে সুগভীর বেদনা অনুভূত হচ্ছে।
আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজের আবাস বা গৃহের মতাে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের কাছে তাই ছিল। অধ্যাপকগণও সেখানে ছাত্রদের থেকে দূরে থাকতেন না, সর্বদা ছাত্রদের সুখ দুঃখের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখতেন। সেইজন্য তাদের সকলেরই পরম আত্মীয় বলে মনে হতাে। ঢাকায় তখন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চলছে, ছাত্রসমাজ পুলিশী নির্যাতনের লক্ষ্য। কত ছাত্রকে যে কত ভাবে কত রকম বিপদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রক্ষা করেছেন, তা কোনােদিনই কোনাে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে লেখা হবে না।
তখন একজন ইংরেজ ভাইস-চ্যান্সেলার ছিলেন, তাঁর নাম জি, এইচ.ল্যাংলি (G.H.Langley) । আমরা তাকে নিজেদের মধ্যে গৌরহরি ল্যাংলি বলতাম। তার পুরাে নাম ছিল জর্জ হামিলটন ল্যাংলি । একদিন কয়েকটি ছাত্র তারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র কি না জানা যায়নি কোনাে একটা রাজনৈতিক অপরাধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনার মধ্যে ঢুকে আত্মগােপন করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ কর্মচারী তাদের ধরবার জন্য ভিতরে প্রবেশ করল। উপাচার্য ল্যাংলি নিজের অফিস ঘরে ছিলেন, তিনি এই সংবাদ শুনবামাত্র তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে পুলিশ কর্মচারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা থেকে তৎক্ষণাৎ বাইরে চলে যেতে বললেন। তারা একজন ইংরেজকে এমন মূর্তিতে দেখতে পাবে বলে আশা করেনি; ইংরেজের সাম্রাজ্য রক্ষায় ইংরেজ সাহায্য করছে না দেখে তারা বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিছু বলবার চেষ্টা করল। তারপর ধীরে ধীরে বাইরে চলে গেল। যতক্ষণ তারা বাইরে বেরিয়ে না গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত উপাচার্য ল্যাংলি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্রোধে এবং মধ্যাহ্ন রৌদ্রের উত্তাপে তার মুখ আগুনের মতাে রাঙা হয়ে উঠল। অপরাধীকে ধরবার পুলিশ কর্মচারীদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলাে।
এইভাবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পাক সৈন্যবাহিনী সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কামান দাগিয়ে ধুলিসাৎ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার অধ্যাপক এবং ছাত্র সমাজের উপর আক্রমণ করে তাদেরও এক বিপুল অংশের প্রাণ নাশ করল। সংবাদপত্রে মৃতের তালিকায় আমার সেখানকার সহকর্মী ছাত্র ও বন্ধুবান্ধবদের নাম দেখতে পেলাম। ভয়ে, বিস্ময়ে এবং ঘৃণায় অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নাড়ীর সম্পর্ক। ছাত্র হয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলাম, দেশ বিভাগের সময় অধ্যাপক রূপে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছি কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পুরােপুরি ছিন্ন হয়নি, আমি তখনও তার বি.এ.অনার্স এবং এম.এ.পরীক্ষার পরীক্ষক। ঢাকা থেকে কোনাে ছাত্র কিংবা গবেষক গবেষণার জন্য কলকাতায় এলে তারা আমার কাছেই আসত, ভারতীয় মুদ্রা দিয়ে তাদের আমি কলকাতার খরচ চালাতে সাহায্য করতাম, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও সাহিত্য পরিষদে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতাম। দেশবিভাগ হবার বার বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৯ সনে তখনও যখন আয়ুব খাঁর সামরিক শাসন প্রচলিত, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বাঙলার লােকসাহিত্য গবেষণার জন্য ‘ডক্টরেট’ দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। সকল সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে উর্ধ্বে ছিল, তা এ থেকেই বুঝতে পারা যাবে। কারণ, তখন আমি ভারতীয় নাগরিক। দুই দেশের মধ্যে তখন যে কুটনৈতিক সম্পর্ক চলছিল, তাতে ‘পূর্ব-পাকিস্তান’এ একজন ভারতীয় নাগরিককে ডক্টরেট দেবার সংবাদে সকলেই বিস্ময় প্রকাশ করল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন মনে করেছিল, ছাত্রর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-এর সম্পর্ককে সকল রাজনৈতিক
১৪
বাদবিসম্বাদের উর্ধ্বে রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদাই তা বজায় রেখে চলেছিল। সেইজন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের কামানের গােলা থেকে সে রক্ষা পেল না।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে মৃতের তালিকায় বাঙলা বিভাগের অধ্যাপিকা শ্ৰীমতী নীলিমা ইব্রাহিমের নাম দেখে চমকে উঠলাম [খবরটি ছিল ভুল]। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা নাটকের উপরে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ-ডি উপাধি লাভ করেছিলেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্য সম্পর্কে তার একখানি বই তার মৌলিক চিন্তাশীলতার পরিচায়ক। এই বিদুষী শান্ত স্বভাবা নারী, কয়েকটি সন্তানের জননী, পাকসৈন্যের কাছে কী অপরাধে অপরাধী ছিলেন, তা কল্পনাও করতে পারি না। তিনি খুলনা শহরের অধিবাসিনী ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলায় এম.এ.পাস করে খুলনারই একজন ডাক্তারকে বিবাহ করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকার পদটি লাভ করেন। তার চরিত্র এবং শিক্ষার গুণে তিনি সকলেরই প্রিয় হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সনে আমাকে যে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টরেট’ উপাধি দেয় তিনিও সেই বছরই তার উক্ত গবেষণার জন্য ডক্টরেট লাভ করেন। একই সমাবর্তন উৎসবে আমরা উভয়ে পাশাপাশি বসে একসঙ্গে তখনকার সামরিক শাসনকর্তা আজম খাঁর কাছ থেকে আমাদের অভিজ্ঞান পত্র নিয়েছি। তারপর থেকে তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের নিবিড় যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছিল। তিনি যখনই কলকাতায় আসতেন, তখনই আমার স্ত্রীর জন্য ঢাকাই শাড়ি নিয়ে আসতেন, আমার জন্য ঢাকার প্রসিদ্ধ প্রাণহরা সন্দেশ আনতেন। বলতেন, এ-জিনিস ত আপনারা এখানে পাবেন না।
সেদিন তার সংবাদ খবরের কাগজে দেখবার পর থেকে আমার পরিবারেও এক বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে, তার ছেলেমেয়ে এবং স্বামীর সংবাদ জানবার জন্য ব্যাকুলতা বেড়েই চলেছে, কিন্তু তাঁদের কোনাে সংবাদই আর জানতে পারিনি।
মৃতের তালিকায় আর একজন অধ্যাপকের নাম পেলাম, আব্দুর রেজ্জাক খ [আবদুর রাজ্জাক : খবরটি ছিল ভুল। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বয়সে আমার কয়েক বছরের ছােট হলেও আমরা প্রায় একসঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলাম। শীর্ণকায়, নিরীহ ব্যক্তি, অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং গভীর রসজ্ঞানের অধিকারী। হয়ত শারীরিক কোনাে অসুস্থতার জন্যই তাঁর প্রকৃতি একটু শান্ত এবং অলস ছিল। ইউনিভারসিটি ক্লাবের সুরম্য ‘লাউঞ্জের মধ্যে তাকে কখনও নিদ্রিত কিংবা কখনও অর্ধনিদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যেত। কিন্তু সেই অবস্থায়ও পৃথিবীর সকল অংশের রাজনৈতিক ঘটনার উপর খবর রাখতেন। কখনও কখনও দাবা খেলায় মন দিতেন, কাউকে সঙ্গী হিসেবে না পেলে একা একাই খেলতেন তবে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজি মােতাহর হােসেনকে প্রায়ই সঙ্গী হিসাবে পেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ অধ্যাপকেরা যখন তাদের জ্ঞান ও বিদ্যার বিষয় নিয়ে তর্কের তুবড়ি ছাড়তেন, তখন তারা দুজন দাবা খেলায় সব কিছু ভুলে গিয়ে রাজা মন্ত্রীর কিস্তি দিতেন। আব্দুর রেজ্জাক খা সর্বদাই খুব গাঁঢ় রংয়ের পােশাক পরতেন, আমাদের সাদা ধূতি পাঞ্জাবীকে ব্যঙ্গ করে বলতেন, আপনাদের বর্ণ জ্ঞান নেই, নইলে সাদা আবার একটা রঙ, আমার আচকানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বর্ণজ্ঞান কাকে বলে। বলে একটা সােফার মধ্যে ছােট শরীরটাকে খুঁজে দিয়ে এমনভাবে হাসতে থাকতেন যে আমার মনে হতাে তার এখুনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। তার এই প্রকৃতিটি আমার বড় মিষ্টি লাগত। একদিন তিনি আমাকে এক অদ্ভুত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। বলেন, আমি হিন্দু মহাসভার সভ্য হতে চাই, হতে পারব না? কেন হতে পারব না, আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
আমি হিন্দু মহাসভার সভ্য হবার নিয়ম কানুন কিছুই জানতাম না, কারণ, আমি কোনােদিনই ও সবের ধার ধারিনি; তবু সাধারণ বুদ্ধিতে এইটুকু বুঝেছিলাম যে একজন হিন্দুর পক্ষে যেমন মুসলিম লীগের সভ্য হওয়ার পক্ষে বিধিগত কোনাে বাধা থাকতে পারে, তেমনই একজন মুসলমানের পক্ষেও হিন্দু মহাসভার সদস্য হতে বাধা থাকতে পারে। আমি বললাম, এগুলাে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান; ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোেককে সেখানে সম্ভবত প্রবেশ করবার অধিকার দেওয়া হয় না।
তিনি বললেন, আমি ভারতের মাটিতে জন্মেছি, মুসলমান হয়ে যদি জন্মে থাকি তাও আমার ইচ্ছায় জন্মাইনি, জন্মাবার পর যখন আমি দেখলাম, আমি মুসলমান, তবে কেন আমি হিন্দু মহাসভার সদস্য হব
১৫
না, আমাকে ঐ কথা বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি বললাম, আপনি সরকার কিংবা ডা: মুঞ্জের নিকট চিঠি লিখুন আমি আর বেশি কিছু বলতে পারব না। পরিচিত হাসিটিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সত্যই যে সেদিন হিন্দু মহাসভার সভ্য হতে চেয়েছিলেন, সে কথা সভ্য নয়, তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলাের অন্তঃসারশূন্যতা সেদিন এইভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর তিনি উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য লন্ডন ঘুরে এসেছিলেন, সেখানে গিয়েও তিনি তাঁর উদ্যমহীনতা, কিংবা অলসতার হাত থেকে পরিত্রাণ পাননি। সুতরাং কিছুই করতে না পেরে তাকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রীডার হয়েছিলেন।
নিহত অধ্যাপকের তালিকায় আর একজন অধ্যাপকের নাম দেখলাম তিনি আমার বন্ধুস্থানীয় লােক ছিলেন। তাঁর নাম গােবিন্দ চন্দ্র দেব। তিনি দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন; দর্শন কেবল তার শিক্ষা এবং অধ্যাপনার বিষয় ছিল না, দার্শনিক সত্যকে তিনি-জীবনেও আচরণ করতেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন, একটু উদাসীন প্রকৃতির লােক। মানুষের চরিত্রে যে কোনাে দোষ থাকতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতেন না, সব রকম মানুষকেই বিশ্বাস করে তিনি সংসারে যেন ঠকতেই ভালােবাসতেন।
দেশবিভাগের পর পূর্ববাঙলা থেকে হিন্দু দলে দলে পালাতে লাগল, তখন তিনি পশ্চিমবাঙলা থেকে পূর্ববাঙলার রাজধানী ঢাকা শহরে গিয়ে হাজির হলেন, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি নিলেন। তারপর থেকে বিভাগটি নিজের হাতে গড়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অত্যন্ত সুনাম ছিল, তার প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ল্যাংলি, তিনিই প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হটিস চলে যাবার পর উপাচার্য নিযুক্ত হলেন। তার কথা আগে উল্লেখ করেছি। তারপর যিনি এর অধ্যক্ষ হন তিনি ভাটপাড়ার পণ্ডিত বংশের সন্তান অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য। বি.এ.তে আমার দর্শনশাস্ত্র ছিল, এমন কৃতী অধ্যাপক আমি কল্পনাও করতে পারিনে। ছাত্র এবং সহকর্মীদের সমান প্রিয়, ইংরেজি এবং বাঙলায় অসাধারণ ঝগী। দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে তিনি অবসর গ্রহণ করলেন। তারই ছাত্র গােবিন্দ চন্দ্র দেব দর্শন বিভাগে দেশবিভাগের গােড়া থেকেই যােগ দিয়েছিলেন। তিনি নানা ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বােধহয় সেই অপরাধেই তাকেই প্রাণ বলি দিতে হলাে; আরও যেসব অধ্যাপকের নাম মৃতের তালিকায় দেখেছি তারা অধিকাংশই আমার ছাত্র। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিষয়ে অধ্যাপক হয়েছিলেন। আমি তাদের কথা কিছুই লিখতে পারব না, কারণ, আমি এখনও বিশ্বাস করি তারা বেঁচে আছেন, এই বিশ্বাস নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই, তারা সকলেই বয়সে তরুণ, তাদের কাছে দেশ অনেক কিছু আশা করেছে, দেশের এবং সমাজের সে-আশা পূর্ণ করবার তাঁদের ক্ষমতাও আছে। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিনই বিশ্বাস করব যে তারা বেঁচে আছেন, আবার সুযোেগ মতাে আত্মপ্রকাশ করবেন। কারণ, তারা আমার একান্ত স্নেহের ছাত্র এবং বিশ্বাসভাজন।
ঢাকা রমনার মাঠে, সবুজ ঘাসের বিস্তৃত চত্বরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষে, ছাত্রাবাসে এক অনুপম প্রাকৃতিক পরিবেশে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সােল বছর কেটেছে। তার স্বপ্ন এখনও মাঝে মাঝে দেখ পাই। যখন বসন্তকাল আসে তখন স্বপ্নে দেখতে পাই যেন পথিপাশ্বের সারি সারি অশােক গাছে অশােকের স্তবক মুখরিত হতে আরম্ভ করেছে সুদীর্ঘ কৃষ্ণচূড়ার বিস্তারিত শাখা-প্রশাখা লাল রঙের ফুলে ভরে গেছে, কালবৈশাখী ঝড়ে ফুল শুদ্ধ ডালগুলাে ভেঙে মাটিতে কাদায় জলে লুটিয়ে পড়েছে, ঝড়ের বেগ সইতে না পেরে একটা মাছরাঙা পাখি আমাদের জগন্নাথ হলের ছাত্রাবাসের দেয়ালে এসে বার বার মাথা ঠুকছে, তারপর কালবৈশাখীর ঝড় থেমে গেছে, রমনার পিচঢালা পথগুলাে জলে ভিজে চক চক করে উঠেছে, তার উপর দিয়ে ঘােড়ার খুরে একরকম শব্দ করে আবার সুদৃশ্য পাল্কী গাড়িগুলাে তালে তালে চলতে আরম্ভ করেছে। এই রমনা যারা চোখে দেখেনি, কোন প্রাকৃতিক পরিবেশে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল তারা তা বুঝতে পারবে না।
বাঙলা ভাষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টির মূলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বাঙলা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সেখানে বাঙলা দেশের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত এবং সাহিত্যিকের সমাবেশ হয়েছিল, তারা সবাই পশ্চিমবাঙলার অধিবাসী ছিলেন, প্রথমত মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং তারপর আচার্য সুশীল কুমার দে বিভাগীয় অধ্যক্ষ হলেন, ১৯৩৭ সনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হলেন। অধ্যাপক
১৬
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি সমালােচক মােহিতলাল মজুমদার আগে থেকেই ছিলেন। তার বহুদিন পর তাঁদেরই ছাত্ররূপে প্রথমে শ্রীযুক্ত গনেশচরণ বসু, পরে আমি বাঙলাবিভাগে প্রবেশ করলাম। এ-কথা ভাবতে আমি গৌরব অনুভব করি যে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে আরম্ভ করে এই যে ক্ষুদ্র আমি, আমরা সকলে মিলে বাঙলা ভাষার সৈনিকদের সেদিন প্রেরণা দিয়েছিলাম। কারণ পরবর্তী কালে আমাদের ছাত্রেরা বাঙলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মবলি দিয়েছিল।
পরিচয় বাংলাদেশ সংখ্যা ১৩৭৭-৭৮