স্মৃতির গায়ে রক্ত
চিত্ত ঘােষ
পুরনাে ছবিগুলাে দিনে দিনে আবছা হয়ে আসছিল। অনেক দিনের পুরনাে সব ছবি।
পূর্ব বাঙলা এখন বাঙলাদেশ। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। সেখানে আমার জীবনের উদ্দাম দুরন্ত দিনগুলাে কেটেছিল। সেই স্মৃতির গায়ে এখন শুধু রক্ত।
অনেক সব কথা মনে পড়ে এখন। অনেক মুখ জেগে ওঠে যেন। ঢাকা ছাড়ার কথা মনে পড়ে। দেশভাগ হওয়ার কথা মনে পড়ে। তারপর আর দেশে যাওয়া হয়নি। দেশ তখন বিদেশ।
জন্মভূমি পরভূমি হওয়ার ব্যাপারটা দিনে দিনে সয়ে গিয়েছিল। পুরনাে স্মৃতির ওপর নতুন স্মৃতির স্তুপ জমা হচ্ছিল। মাঝে মাঝে ঢাকা ফেরত কোনাে বন্ধুর মুখে শুনতাম শহরের গল্প। ঢাকা শহরের দিন বদ গল্প। মন বদলের গল্প।
কী এক আশ্চর্য মায়াবী সেতু তৈরি হয়েছিল দিনে দিনে। সাহিত্যের সেতু আর এক মানসিক গভীরতার মধ্যে সংযােগ স্থাপিত হয়েছিল। সেখানে সীমান্ত নেই। সেখানে শুধু বাঙলা ভাষা।
ওপার বাঙলার কবিতা পড়েছি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়েছি। গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি; মনে হয়েছে পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গা অস্তিত্বে এখনাে তরঙ্গ তােলে। ভাষা সত্তার শিকড়ে এখনাে টান ধরায়। তখন যেন বাড়ি যাওয়ার কথা মনে হয় গােয়ালন্দ হয়ে যেমন আগে যেতাম। মনে আছে গাড়ি যখন গােয়ালন্দে পৌঁছুত, আকাশে তখন শুকতারা। পদ্মার একঝলক উদ্দাম বাতাস লাগত চোখে মুখে। আস্তে আস্তে হাল্কা হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। পদ্মার ওপরে সাদা ভাের একটু একটু করে লাল হয়ে উঠত। আর ঢেউএর ধাক্কায় খাড়া পাড় থেকে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ত রূপাের মতাে বালু।
ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার ঘটে গেল। তার পুরাে চেহারাটা এখনও যেন বােধের মধ্যে আনতে পারিনি। মানুষের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর অমানুষিক আরাে একটা অধ্যায় জুড়ে গেল। দুঃস্বপ্নের বিশাল বিপুল শবাকীর্ণ গহ্বর যেন চোখের সামনে। তারপর একটা বিরাট শব্দ একেবারে ভেতরের দিক থেকে উঠে এল। আর একটা একরােখা জেদ ঘুরপাক খেল রক্তের মধ্যে।
খবরের সময় রেডিওর দিকে কান পেতে না রেখে উপায় নেই। সীমান্তের খবরের দিকে কান পেতে না রেখে উপায় নেই। শােনা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে আছেন জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতাও। এ-খবর রেডিওতে ঘােষণা করা হলাে। এখবর কাগজে বেরুল। চোখ দুটো মনের মধ্যে খুঁজে পেল সেই মুখ। জ্যোতির্ময় মুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেই মুখ কত পরিচিত ছিল। মধুর চায়ের দোকানে, লাইব্রেরিতে, করিডরে বা কমনরুমে। জ্যোর্তিময় আমাদের চেয়ে বড় ছিলেন। পড়ায়ও। তীক্ষ, পরিহাসপ্রিয়, বিদগ্ধ একজন। দেশভাগের পর এপারে আসেননি। ওপারেই থেকে গিয়েছিলেন। ওপারেই থেকে গেলেন। বন্দুকের গুলি না কামানের গােলা বুকে নিয়ে, তাঁর সমস্ত অস্থি, মজ্জা, রক্ত, সত্তা বাঙলাদেশের মাটিতে মিশে থাকল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন আলী আহসান, কবীর। ওদের কী হয়েছে? ওরা কি বেঁচে আছে? জানি না। কেউ হয়তাে জানে। কামানের গােলায় বিধ্বস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শবদেহ এখন দিন ও রাত্রির অন্ধকার ঘিরে আছে। জগন্নাথ হল বলতে বােঝায় ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়ানাে কয়েকটি নিঃসঙ্গ থাম। আর তার সংলগ্ন মাঠ এখন পৃথিবীর নির্জনতম, নিষ্ঠুরতম কবর।
১১
কবীরকে মনে পড়ে। উচ্ছল, উদ্দীপ্ত, মেধাবী। আলী আহসানকে মনে পড়ে। শান্ত, তীক্ষ, বুদ্ধিমান। জ্যোতির্ময়কে মনে পড়ে। পরিহাসপ্রিয় বিদগ্ধ একজন। ওদের সবাইকে কি হত্যা করা হয়েছে? কেউ কি বেঁচে নেই?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি আর কবীর ক্লাসে পাশাপাশি বসতাম। অবশ্য পেছনের বেঞ্চে। প্রায়ই পাতা ভর্তি কবিতা লেখা হতাে। ও এক লাইন আমি এক লাইন। ছাত্র-অধ্যাপকদের নাকি দেয়ালের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছে।
বুড়িগঙ্গার ধারে সদরঘাটে, পাটুয়াটুলিতে, বাঙলাবাজারে, রমনায়, পুরনাে পল্টনে, সিদ্ধেশ্বরীতে, দয়াগঞ্জে, নারিন্দায়, রাজার দেউড়িতে, সূত্রাপুরে চতুর্দিকে ছড়ানাে মৃতদেহের মধ্যে রাজধানী ঢাকার জীবনের একটা অধ্যায়ের অবসান ঘটল। এবার অন্যদিন শুরু। এমন দিন আর আগে কখনাে আসেনি।
ঢাকার পথঘাট অলিগলি আমার নখদর্পণে ছিল একদিন। টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তখনকার দিনে সাড়ে চার আনা পয়সা হলেই রূপমহলে বুক ফুলিয়ে বায়স্কোপ দেখা যেত। আর ছিল মুকুল থিয়েটার। ওখানকার বাদাম গাছগুলােতে অসংখ্য বাদুড় ঝুলে থাকত সারাদিন। শুধু ইংরেজি ছবি দেখানাে হতাে রমনার ব্রিটানিয়ায়। ঘােড়ার গাড়ির ওপরে বসে একদল লােক বাদ্য বাজিয়ে লাল কাগজে বিলি করত। বায়স্কোপের কাগজ।
আমি থাকতাম গেণ্ডারিয়ায়, ধােপখােলায়। জায়গাটা ঢাকা-নারানগঞ্জ রেল লাইনের ধারে। একটা পুকুরের চারদিকে বাড়িগুলাে সাজানাে। পুকুরটা বেশ গভীর ছিল। বর্ষাকালে বাজি ধরে মাটি তােলা হতাে পুকুরের মাঝখান থেকে। রেল লাইন ধরে পূবের দিকে কিছুদূর হাঁটলেই স্টেশন। গেণ্ডারিয়া স্টেশন। রাস্তার ডাইনে রজনী চৌধুরীর বাগান। এই রাস্তার ওপরই একটা কালভাট ছিল। আমাদের আড্ডার জায়গা। বাদিকে গ্রামের দিকে চলে গেছে পায়ে-হাঁটা রাস্তা। ওখান থেকে আসত ইল্লাস মিঞা। ইল্লাস মিঞা আমাদের দুধ দিত। জলমেশানাে দুধ নয়, খুব খাটি দুধ। আর নিয়ে আসত যেদিনের যা। পেয়ারার দিনে পেয়ারা, আখের দিনে আখ। শক্ত সমর্থ চেহারা ইল্লাস মিঞার। একমুখ কালাে দাড়ি। দাড়িতে হাত বুলিয়ে কখনাে হেসে বলত“আমার ক্ষেতের আউখ, পােলাপানরে খাইতে দিলাম, দাম লাগবে না।
রেল লাইনের উল্টোদিকের রাস্তাটা ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলেই পাওয়া যেত মানেদার মুদি দোকান। তার পাশেই ছিল ইস্ট এন্ড ক্লাবের খেলার মাঠ। আর ওই রাস্তা ধরেই যাওয়া যেত লােহার পুল পেরিয়ে ঢাকা শহরের নানা দিকে।
গেণ্ডারিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম আমরা। গেণ্ডারিয়ার পরের স্টেশনই ঢাকা। স্টেশন থেকে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে লাগত আটদশ মিনিট। সেই রাস্তার দুদিকে ছিল অনেকগুলাে অর্জুন গাছ। সেই অর্জুন গাছগুলাে কি এখনাে আছে?
স্কুল কলেজ ছুটির দিনে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে। সদরঘাট থেকে তখনকার দিনে নৌকা ভাড়া পাওয়া যেত। প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগত গ্রামে পৌঁছুতে। নৌকোয় বসে দেখা যেত ঢেউএর মাথায় বালিহাঁস আর শুশুকের ভেসে-ওঠা। আর দেখতাম বাড়ির ধারে ছেলেদের মাছ ধরা। জাল শুকানাে। নৌকোয় গাব দেওয়া। যে জায়গায় নৌকো ভিড়ত সেই ঘাটের কাছে অনেকগুলাে মাদার গাছ ছিল মনে আছে। তারপর খানিকটা এগিয়েই একটা বট। তার পাশেই লিচু বাগান। আর সেখানে গ্রামের ডাকঘর। তারপর একটা খাল। গ্রীষ্মকালে খালে জল থাকত না। বর্ষাকালে জলে টইটম্বুর। তখন নদী থেকে খালের ভেতর দিয়ে গ্রামে ঢুকতে হতাে। নৌকো এসে ভিড়ত বাড়ির ঘাটে। আজো আমার মনে পড়ে মুদি নৌকোর কথা। একটা গােটা মুদি দোকান নিয়ে নৌকো ভেসে চলত এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। চারদিকে শুধু জল। আর সবুজ গাছপালা। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে যেতে হলেই চাই নৌকো। শুকনাের দিনে হেঁটে আসতাম নদীর ঘাট থেকে বাড়ি। চালতে সপেদা গাছের তলা দিয়ে রাস্তা। মাঝে মাঝে বেত ঝােপ। বেতের ফলের চোখ। দেওয়ান বাড়ির রান্না ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যেত সেদ্ধ ধানের গন্ধ।
মহীউদ্দিনের কথা মনে পড়ে। আমার স্কুলের বন্ধু মহীউদ্দিন। সামু খলিফার ছেলে মহীউদ্দিন। কালীগঞ্জ স্কুলে পড়তাম ওর সঙ্গে। একবার থিয়েটার হলাে গ্রামে। মানময়ী গার্লস স্কুল। মহীউদ্দিন সেজেছিল নীহারিকা। তারপর শুনেছিলাম ও হয়েছে গ্রামের রাজা। ওর রাজত্বে গ্রামে কখনাে দাঙ্গা হয়নি।
১২
মহীউদ্দিন হতে দেয়নি। মহীউদ্দিন এখন নিশ্চয়ই মুক্তি-সংগ্রামের নেতা হয়েছে। এখন কোথায় আছে, আছে কিনা কিছুই জানার উপায় নেই।
জন্মাষ্টমীর মিছিল হতাে ঢাকায়। দুটো মিছিল দুদিন বেরুত। নবাবপুরের মিছিল আর ইসলামপুরের মিছিল। সােনার চৌকি রূপাের চৌকি বেরুত। তার সঙ্গে সং বেরুত। নানারকম রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা প্রতিফলিত হতাে এই সব সং-এ। সারা শহর এই দুদিন যেন উৎসবে মেতে উঠত।
বাঙলাদেশের মানুষ আজ দাঁড়িয়ে উঠেছে এক পায়ে। এমনভাবে মানুষকে দাঁড়াতে খুব কমই দেখা গেছে। এমন ভাবে ট্যাঙ্কের সামনে, মেশিনগানের সামনে, মৃত্যুকে এতটুকু পরােয়া না করে জ্বলন্ত গােলার সামনে। একটা ভীষণ তােলপাড়ের মধ্যে আমরা এখন। আমাদের চোখের সামনে এমন এক দেশ, বাঙলাদেশ। স্মৃতির গায়ে এখন শুধু রক্ত।
এপার বাঙলায় এক নিস্ফল রক্তপঙ্কে আমাদের দিনযাপন। ওপার বাঙলায় রক্তস্নানে এক শুদ্ধির জন্য প্রাণপাত। কিন্তু কেন? আমাদের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের মধ্যে এই ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা ছিল যেন। তাই তর্পণ হচ্ছে রক্তে।
পরিচয় বাংলাদেশ সংখ্যা ১৩৭৭-৭৮