You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি
পরাজয় ঢাকতে পাকিস্তানিরা ভারত আক্রমণ করতে পারে

(দর্পণের সংবাদদাতা)

মুজিবনগরে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী বলেন, বিধ্বস্ত মনােবল পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যবাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে যে কোনাে মুহূর্তে ভারত আক্রমণ করতে পারে। এই আক্রমণ পশ্চিম রণাঙ্গনেও শুরু হওয়া বিচিত্র নয়।
কর্নেল ওসমানীর মতে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে তাদের বিলুপ্তির দিন ঘনিয়ে এসেছে এই সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে শেষ মরীয়া চেষ্টা করবে সরাসরি ভারত আক্রমণ করে যাতে বাংলাদেশ আন্দোলন গৌণ হয়ে যায় আর বিশ্ব জনমতের সামনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ সম্ভব হবে এবং এই হস্তক্ষেপে অখণ্ড পাকিস্তান তত্ত্বের মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান মীমাংসার কথা ওঠানাে যেতে পারে।
প্রবীণ সেনাপতি কর্নেল ওসমানী বহুকাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সিয়াটো, সেন্টো প্রভৃতি পশ্চিমী যুদ্ধ জোটে তিনি বহুকাল পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করে এসেছেন। তাই পাকিস্তানি গতিবিধি ও আচার-আচরণ সম্পর্কে তার অজানা কিছুই নেই।
কয়েকদিন আগে তিনি মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমস্ত সেক্টর ঘুরে তিনি গত সপ্তাহে ফিরেছেন মুজিবনগরে। সব সেক্টরেই পাকিস্তানিরা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করছে আর মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতির সামনে দখলদাররা অনেক সময়ে বিনা প্রতিরােধেই পলায়মান।
মুক্তিবাহিনীর দুই পৃথক অংশ অবশ্য একই অধিনায়কত্বে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী আর গােপন গেরিলা সংগঠন। সৈন্যবাহিনীতে আছে চল্লিশ হাজার সুশিক্ষিত এবং সমস্ত রকম আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত দৃঢ় মনােবল মুক্তিকামী তরুণ সেনানী। এদের নেতৃত্বে আছেন পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর প্রাক্তন মেজর আর ক্যাপ্টেনরা।
গেরিলারা সংখ্যায় প্রায় এক লক্ষের মতাে। ঢাকা শহরেই আর অন্যান্য শহরকে ঘিরে আছে প্রায় পঁচিশ হাজারের মতাে অস্ত্রে দীক্ষিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া গেরিলারা।
গত সপ্তাহেই গেরিলাদের এক শাখা সংবাদ দেয় সৈন্যবাহিনীকে চট্টগ্রামে খাদ্যবাহী এক মার্কিন জাহাজ পৌছানাে সম্পর্কে। আরও দু-একটি জাহাজ একই সঙ্গে এসে পৌছয় চট্টগ্রাম বন্দরে। সংবাদ পাওয়ামাত্র মুক্তিবাহিনীর কমান্ডােরা আক্রমণ শুরু করে বন্দরে বাঁধা জাহাজের ওপর।
বর্তমানে ঢাকায় অবস্থিত সানডে টেলিগ্রাফের ঝানু মহিলা সাংবাদিক ক্লেয়ার ইলিংওয়ার্থ এই জাহাজ আক্রমণের বিশদ সংবাদ পরিবেশন করেছেন গত রবিবারের সংবাদপত্রে। তিনি বলেছেন, জাহাজ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বহু জায়গায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ গেরিলা ও কমান্ডােরা বিদেশি খাদ্যশস্য গুদামজাত করেছে, বিলিব্যবস্থার কোনাে উদ্যোগ নেই। কারণ পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীর স্থির বিশ্বাস যে, খাদ্য বিতরণ মানেই গেরিলাদের পরােক্ষ সাহায্য। ওদের হাতেই অথবা ওদের প্রভাবিত এলাকাতেই খাদ্যশস্য পৌছে যাবে। ইলিংওয়ার্থের মতে খাদ্যবাহী জাহাজ ও খাদ্যগুদাম আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সহায়ক রাষ্ট্রদের বােঝাতে চাইছে যে, তাদের পাঠানাে কোনাে সাহায্যই বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে আসছে না।
বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল নেতাদের এবং মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের তথ্য অনুযায়ী মুক্তি অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই। প্রস্তুতি সম্পূর্ণ।
মুক্তিবাহিনীর এখন আর অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে বিশেষ কোনাে অভিযােগ নেই। মুক্তিবাহিনী এখন সম্মুখ সমরে নামবে বিভিন্ন সেক্টরে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আশঙ্কা যে, পাকিস্তানিরা ভারত আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও। ওরা মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার অপবাদ নিতে চায় না। ওরা দেখাতে চায় ওদের পরাজয় হয়েছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হাতে।

সূত্র: দর্পণ
২.১১.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!