You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.08 | বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমন্বয় কমিটির ঘােষণা | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক
সমন্বয় কমিটির ঘােষণা

সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের বিভিন্ন দল ও সংগঠনের একটি সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি কঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে পরিচালিত), শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এই সমন্বয় কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে যে ঘােষণা প্রণয়ন করেছেন তা দর্পণের হস্তগত হয়েছে। তার থেকে উল্লেখযােগ্য অংশ আমরা প্রকাশ করছি।
সমন্বয় কমিটি মনে করেন যে, অপ্রস্তুত হলেও বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরােধ শুরু করেছেন এবং যেভাবেই পেরেছেন শশাষকগােষ্ঠির সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করেছেন। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর ও পুলিশ বাহিনী সশস্ত্র প্রতিরােধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে, আপােসের পথে মুক্তি আসবে না। বাংলার জনগণকে বেঁচে থাকার তাগিদেই হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ার আহ্বান : কমিটি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, বর্তমান সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, গণসংগঠন ও শ্রেণীসংগঠন এবং প্রতিটি নাগরিকের মহান কর্তব্য পরস্পরের সমঝােতা রক্ষা করে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মােচনের উদ্দেশে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, কেননা এই যুদ্ধ সমগ্র জাতির যুদ্ধ, সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। গত পয়লা জুন উপরিউল্লিখিত রাজনৈতিক দল, গ্রুপ ও গণসংগঠন ও শ্রেণী সংগঠনগুলাে মিলিত হয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকার ও মুক্তি সংগ্রামরত সকল শক্তির সংযােগ ও সমন্বয় সাধন করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এই সমন্বয় কমিটির তরফ থেকে আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী সকল দলমত ব্যক্তির সমন্বয় একটা সুসংহত জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানানাে হয়েছে।
এই সমন্বয় কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য বাংলাদেশকে হানাদার দস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করে বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরােধী একটি স্বাধীন, সুখী, সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই বাংলা হবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর বাংলাদেশ-জনতার বাংলা।
সমন্বয় কমিটি মনে করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত ও সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করার কর্মসূচি রূপায়িত করাই কমিটির আশু কর্তব্য। যেহেতু হানাদার বাহিনী সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী এবং অন্যদিকে জনগণ প্রায় অস্ত্রহীন এবং যেহেতু বিদেশি বর্বর হানাদার বাহিনী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির তুলনায় সংখ্যায় নগণ্য, সেহেতু কমিটি মনে করে যে, একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী জনগণের গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েই শত্রুর শক্তিকে ক্রমাগত দুর্বল করে চূড়ান্ত জয়লাভের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। জনগণের শক্তির পূর্ণ ব্যবহার করেই, কোনাে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে নয়- এই জনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। প্রস্তাবিত গেরিলা যুদ্ধে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরাই গণফৌজের মূল শক্তি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের ঘাটি হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধন করে এই যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
এই উদ্দেশে সমন্বয় কমিটি জনগণের সম্মুখে আশু করণীয় কর্তব্য উপস্থিত করেছেন। তার মধ্যে প্রতিটি গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গণমুক্তি পরিষদ গঠন এবং গ্রামীণ মুক্তি পরিষদ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সর্ববিধ কর্তৃত্ব গ্রহণ করবে। গণআদালত গঠন করে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করবে; পাক জঙ্গিশাহী সরকারকে দেয় খাজনা, ট্যাক্স, ঋণ ও সুদ পরিশােধ বন্ধ; মুনাফালােভীদের মজুদ বাজেয়াপ্ত করে গরিব মানুষের কাছে ন্যায্য দরে বিক্রয় ব্যবস্থা; শাসক গােষ্ঠীর সঙ্গে কোনাে প্রকার সহযােগিতা সাহায্য অথবা শত্রুর চর হিসেবে কাজ করলে গণমুক্তি পরিষদ মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোরতম শাস্তি দেবেন; যেসব জোতদার জাতীয় মুক্তির স্বপক্ষে থাকবে তাদের সঙ্গে আলােচনা করে কৃষক শােষণের ব্যবস্থা লাঘব করা; অন্যদেশে শরণার্থী বাস্তুত্যাগীদের পরিত্যক্ত বিষয় সম্পত্তির তদারক ও সংরক্ষণ: পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে গ্রামীণ যথাসম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা; শিক্ষাক্ষেত্রে পুরনাে কলুষিত ভাবধারা বর্জন করে সম্পূর্ণ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন; গ্রামে গ্রামে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দল সংগঠন; তাদের সুশিক্ষিত করে শত্রুর ওপর পরিকল্পনানুসারে অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা ও অস্ত্র সংগ্রহ; হানাদার বাহিনী যাতে বাংলাদেশের মাটিতে চলাচল, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রেখে যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস করা; গেরিলা দলকে জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা অর্জন করতে হবে বলে দৃঢ়ভাবে জনগণকে রক্ষা, জনগণকে সাহায্য ও জনগণকে শ্রদ্ধা করার তিন নীতি গ্রহণ; জাতীয় মুক্তির স্বপক্ষে প্রকাশ্য ও গােপন রাজনৈতিক প্রচার কার্য; দেশের যে কোনাে ব্যক্তি পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহযােগিতা করলে তাদের জাতীয় শত্রু বলে ঘােষণা এবং তদন্ত করার পর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তাদের খতম করা; জনগণের মনােবল নষ্ট করবার উদ্দেশে প্রচার; সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রভৃতি কাজকে মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অপরাধ বলে ঘােষণা; ডাকাতি, রাহাজানি ও অন্যান্য অসামাজিক ক্রিয়াকলাপরত ব্যক্তিদের প্রাণদণ্ডসহ কঠোরতম শাস্তিদান; জঙ্গিশাহীর সমস্ত সামরিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ অসহযােগ; ‘আঘাত কর ও সরে পড়াে’ এই নীতির ব্যাপক প্রয়ােগ এবং সর্বোপরি জঙ্গিশাহীর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ত্বরান্বিত করার জন্যে শ্রমিক ও কৃষক শ্ৰেণীকে সক্রিয় তৎপরতা দেখানাের আহ্বান— এই আশু কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্যে সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের বীর মুক্তিফৌজ, বীর জনগণ, পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধী, বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবি কৃষক ও শ্রমিক জনগণের নিকট আবেদন করেছেন।
বিশ্বের সমস্ত স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অস্ত্র, অর্থ, ঔষধপত্র, রসদ ও নৈতিক সমর্থন দানের জন্য কমিটি আবেদন জানিয়েছেন।

সূত্র: দর্পণ
৮.০৬.১৯৭১