চৌ এন লাই ও মাও কে লেখা খ্যাতনামা
চীন সমর্থকদের খােলা চিঠির বক্তব্য
(দর্পণের সংবাদদাতা)
সারা পৃথিবীব্যাপী পরিচিত চীন বিল্পব সমর্থকেরা চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের পাকিস্তান ইয়াহিয়াশাহীর সাম্প্রতিক সমর্থনে প্রচণ্ড মর্মাহত। তাঁদের মধ্যে অনেকেই, যাঁদের জগতজোড়া খ্যাতি, চেয়ারম্যান মাও সে তুং আর প্রধানমন্ত্রী চৌকে একটি খােলা চিঠি’ দেবার সিদ্ধান্ত করেছেন।
এই ‘খােলা চিঠি’তে যাদের স্বাক্ষর আছে তাদের মধ্যে আছেন ফরাসি দেশের জাঁ পল সার্তর এবং তার বান্ধবী সাইমন দ্য বুভােয়া, বৃটেনের জোয়ান রবিনসন, আরব গেরিলা নেতা ইয়াসের (ইয়াসির আরাফাত, মার্কিন দেশের ব্ল্যাক প্যান্থার বিপ্লবী নেতা হুয়ে নিউটন প্রভৃতি। এই চিঠির একটি খসড়া নিয়ে সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন ইউরােপের বিখ্যাত যুবনেতা তারিক আলি। তারিকের উদ্দেশ্য ছিল চিঠিতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় চীনপন্থী নেতা মৌলানা ভাসানীর স্বাক্ষর জোগাড় করা।
তারিকের খবর ছিল ভাসানী সাহেব হয়ত কলকাতায় অথবা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও আছেন। অনেক খোঁজ খবর করে কোনাে হদিস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে তিনি ইউরােপে ফিরে গেছেন।
তারিক কলকাতায় এসেছিলেন ছদ্মবেশে-মাথার বড় চুল ছােট ছােট করে হেঁটে আর গোঁফ কামিয়ে। পরণে ছিল পায়জামা আর পাঞ্জাবি। তার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরাই তাকে চিনতে পারেন নি।
ছদ্মবেশের কারণ ছিল। সম্প্রতি সিংহলে যে সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়ে গেল এবং যে বিদ্রোহ দমন করতে সিংহল সরকারকে ভারত সােভিয়েত এবং মার্কিনীরা যুক্তভাবে সবরকম সাহায্য দিল সেই বিদ্রোহের আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন তারিক আলি। তাই তারিকের সন্দেহ হয়েছিল হয়ত বা ভারত সরকার এ দেশে তার উপস্থিতি পছন্দ করবে না। তারিকের সন্দেহ বােধ হয় অমূলক ছিল না।
‘খােলা চিঠি’র শুরুতেই চীনের প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়াকে বাবােই এপ্রিলের বার্তা থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা হয়। উদ্ধৃতিতে আছে : ‘আমরা বিশ্বাস করি আপনার এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের উদ্যোগে পাকিস্তানে সুনিশ্চিতভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। আমাদের মতে পাকিস্তানের ঐক্য এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঐক্যের ভিত্তিতেই পাকিস্তান শক্তি ও ঐশ্বর্যের পথেই অগ্রসর হতে পারে।’
এই উদ্ধৃতির উল্লেখ করে খােলা চিঠির স্বাক্ষরকারীরা বলেছেন : “আমরা আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চীন বিপ্লবের নিঃশর্ত সমর্থক। পাকিস্তানে যে মিলিটারি রাজ পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চূর্ণ করার বর্বর উদ্যোগে নিযুক্ত সেই মিলিটারি রাজকে এই তাৎপর্যপূর্ণ সমর্থনে আমরা বিশেষভাবে মর্মাহত।
‘দুইটি কারণে ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি শাহীর গণহত্যার প্রকাশ্য সমর্থন মার্কসবাদ-লেলিনবাদ বিরােধী। প্রথমত, এই সমর্থন সমস্ত জাতির জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের লেনিনবাদী মৌলিক নীতির বিরােধী। অন্যন্য শশাষিত জাতির মতাে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের পক্ষে এই নীতি প্রযােজ্য। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জোরের সঙ্গে ঘােষণা করে। বিভিন্ন কায়দায় আন্দোলনে এবং এখন সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে উন্মুক্ত সংগ্রামে তারা একই আকাক্ষা প্রকাশ করছে। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রশক্তি এই আন্দোলন ধ্বংস করার কাজে ব্যাপৃত। এই রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদায়ী ঔপনিবেশিকতাবাদীদের সমর্থনে। কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনের ভিত্তিতেই এই রাষ্ট্রের ঐক্য নির্ভরশীল। ধনবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিভূ এই রাষ্ট্র শাসিত হচ্ছে সৈন্যবাহিনীর এক চক্রের দ্বারা যার সহযােগী বর্তমানের ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। পূর্ব বাংলার বর্তমান সংগ্রামে মার্কসবাদী লেনিনবাদীরা পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের দাবিই কেবলমাত্র সমর্থন করতে পারে।
‘দ্বিতীয়ত, আমরা বিশ্বাস করি যে, চীনের জনগণতন্ত্র পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিপ্লবের স্তর উন্নয়নে সাহায্য করবে। পাকিস্তানে বর্তমানে যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে পাকিস্তানের বিপ্লবী শক্তির বিশেষ দায়িত্ব আছে এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের পক্ষে এই পরিস্থিতি অভূতপূর্ব সুযােগ এনে দিয়েছে।
‘চীন বিপ্লবের প্রথম সারির বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলায় প্রচুর খ্যাতি ও সম্মান আছে। এই খ্যাতি ও সম্মান পূর্ববঙ্গে বিচ্ছিন্ন এবং ঘৃণিত দখলদার শক্তির সহায়তায় নিযুক্ত হলে সেখানকার বিপ্লবীদের মধ্যে কেবল প্রচণ্ড বিভ্রান্তি ও বিভেদের সৃষ্টি করতেই সাহায্য করবে। পূর্ববঙ্গে জাতীয় ও সামাজিক মুক্তির গণসংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়াই চীনা নেতাদের কর্তব্য। এই সংগ্রাম চীনের গণসংগ্রামের মতাে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন থেকে পুরােপুরি সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও ধনতন্ত্রবাদ বিরােধী শিবিরে পরিণত হতে পারে।
‘আওয়ামী লীগ যে এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারে না এবং আন্দোলনের বর্তমান কর্মসূচিতে যে সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে তা এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম তার পরিচয় ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে।
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে শ্রমিক কৃষক ও ছাত্রদের যে উত্তাল আন্দোলনের ফলে আয়ুবশাহীর পতন হল সেই আন্দোলন তারই উত্তরসুরি অতি কষ্টে দমন করেছিল। পাকিস্তানের উভয় অংশে জনগণের বিপ্লবী চেতনা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। সেই সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও জনগণতন্ত্র নিচুপ ছিল। এখন চীন পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণকে দমনের অভিযানের সমর্থনে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে এসেছে। চীনের এই সমর্থন সেখানকার বিপ্লবের স্তর উন্নয়নের বিরােধী।
‘চীনের প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণা সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ভারতীয় সরকার ও শাসকশ্রেণীর কার্যকলাপকেই সহায়তা করবে। ভয়ঙ্কর এবং চক্রান্তকারী ভারতের শাসক গােষ্ঠী এবং তাদের সরকার মরণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ববঙ্গের বিপ্লবকে বিপথে চালিত করার জন্য। কারণ এই বিপ্লব পশ্চিমবঙ্গে এবং এই উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। বস্তুত ভারত পাকিস্তান ও সিংহল সরকার সিংহলের বিপ্লবী সংগ্রাম দমনে লক্ষণীয় শ্রেণী সংহতির পরিচয় দিয়েছে। এই তিন সরকার যুক্তভাবে তাদের সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিয়ােগ করেছে এবং আমেরিকা, বৃটেন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে।
‘এই উপমহাদেশে বিপ্লব বিরােধী প্রতিক্রিয়ার এই সংহতির সামনে বিপ্লববাদীদের প্রয়ােজন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বচ্ছতা এবং বিপ্লবী ঐক্য। চীনের আচরণ এই ঐক্য ও স্বচ্ছতার পক্ষে সহায়ক নয়।
‘আমরা বিশ্বাস করি যে, সারা এশিয়ায় বিপ্লবী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামই চীন বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ মিত্র। ইন্দোচীনের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে আজকের গণমুক্তি আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ভারতীয় উপমহাদেশে চীনের প্রকৃত বন্ধু হল সেই সমস্ত গণআন্দোলন যা এখন সেখানে ফেটে পড়ছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কেবল এই আন্দোলনগুলােই চীন বিপ্লবের দৃঢ় এবং প্রকৃত মিত্র হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
‘তাই ইয়াহিয়া খানের মিলিটারিশাহীর সমর্থনে আপনার বিপর্যয়কর ঘােষণা অবিলম্বে প্রত্যাহার করার জন্য আমরা আপনাকে আন্তরিক অনুরােধ জানাচ্ছি।
সূত্র: দর্পণ
২৮.০৫.১৯৭১