বর্ধমান জেলার জে কে নগরে দ্বিতীয় বাংলাদেশ’
দ্বিতীয় বাংলাদেশ’ তৈরি হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। দলে দলে শরণার্থী আসছেন বর্ধমান জেলার জে কে নগরে; বাংলাদেশের নয় পশ্চিমবঙ্গেরই হতভাগ্য অধিবাসী তারা। সম্প্রতি পুলিশের গুলি বর্ষণে নিমচা কোলিয়ারীতে সাত ব্যক্তির মৃত্যুর পর থেকে এরাও ছেড়েছে তাদের বাসস্থান।
হয়েছিল বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণী ও কোয়ালিয়ারীর এজেন্ট (নাম বলব না) কর্তৃক নিযুক্ত তিনশ সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী ও কিছু সংখ্যক পুলিশের মধ্যে। শ্রমিক শ্রেণীর সম্বল ছিল শুধু শাবল আর হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রতিপক্ষের ছিল ভারী রাইফেল। ফলে মরতে হয়েছে সাতজন শ্রমিককে, অবশ্য তারা আহত করেছে। বেশ কয়েকজনকে।
এতক্ষণ মিলিটারির কোনাে চিহ্ন ছিল না। হঠাৎ ঘটনাস্থলে প্রচুর মিলিটারি এসে পৌছাল। শুরু হলাে ব্যাপক ধরপাকড়, অত্যাচার। ভীত, সন্ত্রস্ত, নিরীহ মানুষগুলাে নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে প্রাণের ভয়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে লাগল।
গত শুক্রবার গেলাম জে কে নগরে। দেখলাম ছিন্নমূল শরণার্থীরা স্রোতের মতাে এসে ঢুকছে শহরে। যেখানে পারছে আশ্রয় নিচ্ছে। স্থানীয় এক যুবক জানালেন যে, সাড়ে তিন হাজারের মতাে শরণার্থী এসেছে, আরও আসছে এবং আসবে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ বৃদ্ধ, নারী এবং শিশু। একটা বাড়ির বারান্দায় তিনটি শিশু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাদের মা তার ভাষায় সন্তানদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। একজন বাঙালি যুবক জানালেন যে, ঐ শিশু তিনটির খেলার সাথী ছিল কয়েকটা মুরগি আর ছাগল। আসার সময় তারা তাদের নিয়ে আসতে পারেনি।
যুবকটির সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। একটা গাছের ছায়ার নিচে কুড়িজন মেয়ে বসেছিল। তারা সেই দিনের কথা মনে করতে পারে না, যেদিন মানুষের খােলস পরা পশুগুলাে তাদের নারীত্বের চরম অবমাননা ঘটিয়েছে। তাদের চোখে জলের পরিবর্তে আছে জমাট আতঙ্ক।
একটা শেডের নিচে কিছু সংখ্যক বৃদ্ধ বসেছিল। শুনলাম তাদের মধ্যে একজন বলছে, ‘আল্লাকো নাম লে ভাইয়া’। বলতে বলতে তার কুঁচকানাে গালের উপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বাকিরাও ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
সবাই কাঁদছে। অনেকের চোখে জল নেই। থাকবেই বা কী করে? চোখের জল তাে তাদের শুকিয়ে গিয়েছে। ক্ষুধার্ত শিশুগুলাে কান্না ভুলে যােবা দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। হয়ত ভাবছে এ কোথায় এলাম, কেন এলাম? খানিকটা তফাতে একটি যুবতী বসেছিল। পরণে সাদা থান, কিন্তু সিঁথিতে লাল আভা রয়েছে তখনও। ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে চুপ করে বসে আছে। সে জানে সেই ভয়াবহ দিনটিতে তার সব গেছে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে টানা চোখ দুটো তুলে তাকাল, পাতলা ঠোট দুটো একটু কাঁপল, কিছু বলতে পারল। হয়ত বলতে চেয়েছিল, জান, পশুগুলাে আমার সব কেড়ে নিয়েছে?
এই নিঃসহায় মানুষগুলােকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে জে কে নগরের যুবসমাজ। চাদা তুলে খাদ্যসামগ্রী দিয়ে এই সর্বহারা মানুষগুলােকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, অসুবিধা তাে হচ্ছেই। কিন্তু এরাও তাে মানুষ, এদের তাে বাঁচতে হবে। আর একজন প্রশ্ন করলেন, কেন এমন হচ্ছে বলতে পারেন? এই মানুষগুলাে কী দোষ করেছে? কেন এত অত্যাচার করছে সরকারি পক্ষ?
সূত্র: দর্পণ
২০.০৮.১৯৭১