বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকদের অভিমত
(দর্পণের সংবাদদাতা)
বেশ কয়েক ডজন বিদেশি রিপাের্টার, ফটোগ্রাফার আর টেলিভিশনের লােক কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশের সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের কথা সারা বিশ্ববাসীকে জানাবার জন্য। এদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বিপ্লব দেখেছেন, সেই সম্পর্কে লিখেছেন আর বিপ্লব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
এদের সকলেরই প্রায় একই অভিমত যে, বিপ্লবের নজির হাল আমলে কোথাও কোথাও দেখা যায়নি। দেশের প্রায় সমস্ত লােক একসঙ্গে প্রতিরােধে নেমেছে, সৈন্যবাহিনীর অত্যাচার প্রায় চেঙ্গিস খার বর্বরতাকেও হার মানায়, আর তার ওপর আছে অত্যাচারীর আধুনিক অস্ত্রসম্ভার যা এসেছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন আর বৃটেন থেকে আবার বিপ্লববাদী রুশ আর চীন থেকে।
প্রতিরােধে বদ্ধপরিকর মানুষ অত্যাচারী শাসকের এই নির্মম আক্রমণের জন্য হয়তাে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু অপ্রস্তুতির জন্য প্রাথমিক প্রচণ্ড ক্ষয়-ক্ষতিতে মানুষ দমে যায়নি-বরং তার প্রতিরােধ আরও দুর্বার হবার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এর নজির হাল আমলের কোনাে বিপ্লবেই মেলে না।
বিদেশি সাংবাদিকরা তাে একেবারে হতবাক, এও কি সম্ভব। তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। তারা কেউ কেউ সব বাধা অতিক্রম করে এখন একেবারে ঢাকা যাবার ফন্দি আঁটছেন।
এরা সকলেই মনে করছেন যে, এ ‘যুদ্ধ’ দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য তাই অবিলম্বে ওরা বিভিন্ন জায়গায় সংবাদ ঘাঁটি করতে চায়। ওদের ধারণা যে, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক একটি গাড়ি কিনে নতুন রঙ লাগিয়ে টানা ঢাকা যাবার মতলব করেছেন। এই কয়েকদিনে তারা বাংলাদেশের নতুন পতাকা জোগাড় করেছেন আর সঙ্গে থাকবে পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকাও। বাংলাদেশে যখন যে এলাকায় যে পতাকা দরকার তখন সেই পতাকা ওড়ানাে হবে। বাধা বিপত্তি অনেক, বিপদও আছে। তবু অদম্য।
এদের মধ্যে প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি মুক্ত এলাকায় ঘুরে এসেছেন, ইংরেজি জানা বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরােধ সংগঠনের বিভিন্ন কর্মীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়েছেন ওরা। এদের অনেকেই হয়ত কোনাে বিপ্লব সমর্থন করেন না, আবার কেউ কেউ হয়ত নিজেদের দেশের সরকারের কাছে বিপ্লবের গতি, সংগঠন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা গােপন সংবাদ পাঠান।
অবশ্য এ রকম ধরনের সংবাদ আরও অনেকেই পাঠাতে পারেন, এখানকার সাংবাদিকরাও। কিন্তু তাতে গণঅভ্যুত্থানের বিশেষ ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। বিপ্লবের বিশেষ স্তরে সংগঠনের প্রয়ােজনে বিপ্লবীরা বুঝতে পারে, নিরাপত্তার কী বিশেষ ব্যবস্থা করা দরকার।
সবাইকেই সি আই এর দালাল বলে হটিয়ে দিলে বিপ্লব খুব বেশি এগুবে না। আর যেহেতু বিপ্লবীদের নৈতিক যুক্তি ও পদ্ধতি সম্পর্কে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই, তাই অবিলম্বে সন্দেহ বাতিক থেকে সবাইকে দালাল বলারও প্রয়ােজন নেই। তবে শেষ পর্যন্ত যখন গেরিলা যুদ্ধ আরও উচ্চস্তরে পৌছুবে তখন বিপ্লবীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই ঠিক করবেন।
সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১