You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.01.25 | পাঁচ লক্ষ লোকের সমাবেশ : পুলিশের গুলীবর্ষণে অন্ততঃপক্ষে ৪ জন নিহত ও বহু আহত | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

আজাদ
২৫ জানুয়ারী ১৯৬৯
পাঁচ লক্ষ লোকের সমাবেশ : পুলিশের গুলীবর্ষণে
অন্ততঃপক্ষে ৪ জন নিহত ও বহু আহত
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

হরতাল পালনরত ও বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের কয়েকবার গুলিবর্ষনের ফলে গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকা শহরে ন্যূনপক্ষে ছাত্রসহ চারিজন নিহত এবং এগারজন আহত হইয়াছে। তাহাছাড়া কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জে আরও প্রায় পঞ্চাশ ব্যক্তি আহত হইবার সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।
একজনকে বেয়নেট চার্জ করা হইয়াছে বলিয়া জানা যায়। হারিশ ও শহীদুল নামক দুইজন পুলিশের গুলীতে নিহত হইবার পর পুলিশ লাশ লইয়া গিয়াছে বলিয়া দাবী করা হইয়াছে। এই দুইজনকে ধরিলে গুলীতে নিহতের সংখ্যা ছয় জনে দাড়ায়।
সেক্রেটারীয়েটের এক নম্বর গেটের নিকট গুলীতে শেখ রুস্তম আলী (১৪), মতিয়র রহমান (১৭), মকবুল (১৫) এবং অপর একজন নিহত হইয়াছে। চতুর্থ ব্যক্তির লাশ পুলিশ রাস্তা হইতে টানিয়া সেক্রেটারীয়েট ভবনের অভ্যন্তরে লইয়া যায় এবং তাহার পর খোঁজ পাওয়া যায় নাই। বিক্ষুব্ধ জনতা অপরাহ্নে ট্রাষ্টের সরকার সমর্থক ইংরাজী দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ ও বাংলা ‘দৈনিক পাকিস্তান’ অফিস ভবনে অগ্নিসংযোগ করিয়া সম্পূর্ণরূপে পোড়াইয়া দিয়াছে। তাহাছাড়া দৈনিক ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিসও জনতা আক্রমণ করে এবং অগ্নি সংযোগের চেষ্টা চালায়।
একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের জনৈক বিডি সদস্যের বাসা ও স্থানীয় কনভেনশন লীগ অফিসেও আগুন ধরাইয়া দেয়। নবাবপুরস্থ একটি হোটেল এবং দুইট গাড়িসহ একটি দমকল বাহিনীর গাড়ি জনতা পোড়াইয়া দিয়াছে।
গতকাল ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী সন্ধ্যার পর সামরিক বাহিনী দায়িত্ব নেওয়া পর্য্যন্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। একদল লোক প্রাদেশিক কনভেনশন লীগ অফিস আক্রমণ করিয়া আগুন লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। বেলা সাড়ে দশটার দিকে দশ হাজার লোকের এক বিরাট জনতা সেক্রেটারীয়েট আক্রমণ করিয়া অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা চালায় এবং প্রথম ও দ্বিতীয় গেটে আগুন লাগাইয়া দেয়।
গতকাল সমগ্র শহরটি যেন বিক্ষোভের শহরে পরিণত হইয়াছিল। প্রায় পাঁচ লক্ষ নাগরিক শহরের রাজপথে নামিয়া আসিয়া স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজায় যোগদান করে। জানাজার পরে শোক মিছিলে ন্যূনপক্ষে দেড় লক্ষ লোক যোগদান করে৷
রাস্তায় একটি সাইকেলও দেখা যায় নাই-একটি দোকানও খোলে নাই। কেবলমাত্র কয়েকটি এ্যাম্বুলেন্সকে ও সাংবাদিকদের কয়েকটি গাড়ি চলাফেরা করিতে দেওয়া হয়। সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষ হইতে আসাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য এই হরতাল দিবস পালনের আহ্বান জানান হইয়াছিল।
মতিঝিল ও অন্যান্য এলাকার সরকারী ও বেসরকারী অফিসের হাজার হাজার কর্মচারী অফিস ত্যাগ করিয়া ছাত্রদের বিক্ষোভে যোগদান করিয়াছিলেন। এমনকি ওয়াপদা, ডি আই টি ও এডিসির চেয়ারম্যানগণও ছাত্র-জনতার আহ্বানে অফিস ছাড়িয়া রাস্তায় বাহির হইয়া আসেন।
গতকাল ছিল ছাত্রদের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্ম্মঘট। প্রতিটি মানুষ সাড়া দিয়াছিলেন এই ধৰ্ম্মঘটে। গতকাল ভোর হইতে শহরের রাজপথে কোন যান-বাহন চলে নাই। এমন কি সাইকেলের মত সাধারণ যানও গতকাল শহরের রাজপথে বিরল দৃষ্ট হয়।
যান শূন্য শহরের রাজপথে সরকারী ও বেসরকারী কর্ম্মচারীরা অফিসের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া পড়েন। এবং সেই সঙ্গে বাহির হন শহরও শহরতলি হইতে ক্ষুদ্র বৃহৎ অগণিত বিক্ষোভ মিছিল। নিউ মার্কেটের ছাদের উপর এবং নিউ মার্কেটের আজিমপুরের দিকের গেটে ই, পি,আর বাহিনী মোতায়েন থাকিতে দেখা যায়। কিন্তু ই পি আর বাহিনীর লোক কালো পতাকাবাহী বিক্ষোভ মিছিলকে বাধা দেন নাই বা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন নাই।

শিল্প এলাকা
সকাল হইতেই টঙ্গী, হাজারী বাগ, তেজগাঁ প্রভৃতি শিল্প এলাকা হইতে ধৰ্ম্মঘটি শ্রকিমবৃন্দ মিছিল সহকারে বেলা প্রায় দশটার দিকে শহরে প্রবেশ করেন এবং শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়া ষ্টেডিয়ামে জানাজা নামাজে শরীক হন।

ছাত্ৰ মিছিল
ঢাকার মহম্মদপুর, তেজগাঁ প্রভৃতি বিভিন্ন এলাকার ছাত্রবৃন্দও মিছিল সহকারে শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন। শ্রমিক ও ছাত্র সকল মিছিলেই কালো পতাকা ছিল। শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক গৃহে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রকৃত পক্ষে গতকাল সমস্ত শহরই বিক্ষোভ ও মিছিলের শহরে পরিণত হয়।

মতিঝিল কর্ম্মচারীদের হরতাল
সকাল সাড়ে নয়টায় বিভিন্ন অঞ্চল হইতে ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিল মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের বৃহত্তম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানী ও বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কম্মচারিগণ দলে দলে অফিস হইতে বাহির হইয়া আসেন এবং ছাত্র মিছিলে যোগ দিতে থাকেন। ছাত্রগণ অফিসের কর্ম্মচারীদের হরতাল পালনের আহ্বান জানান।
ছাত্র-জনতা প্রথমে ওয়াপদা অফিস ঘেরাও করিলে কর্মচারিগণ শ্লোগান সহকারে রাস্তায় বাহির হইয়া আসে। কর্মচারীদের সঙ্গে ওয়াপদা’র চেয়ারম্যান জনাব মাদানীও রাস্তায় নামিয়া আসেন এবং ছাত্রদের নিকট বলেন যে, মিছিলে অংশ গ্রহণ করা কর্ম্মচারীদের ইচ্ছাধীন। ইহাতে তাঁহার কোন আপত্তি নাই বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।
ইহার পর জনতার মিছিল ডি-আই-টি আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ডি-আই- টি’র চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের সহ কর্ম্মচারিগণ অফিস হইতে বাহির হইয়া আসেন। চেয়ারম্যান জনাব খায়ের মিছিলের সঙ্গে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক পর্য্যন্ত আগমন করেন এবং ছাত্রদের নিকট অনুমতি চাহিয়া মিছিল হইতে অব্যাহতি পান। অতঃপর মিছিল এ-ডি-সি অফিসের নিকট উপস্থিত হইলে অনুরূপ ভাবে এ-ডি-সি’র কর্ম্মচারিগণও বাহির হইয়া আসে। সেই সঙ্গে এ- ডি-সি’র চেয়ারম্যান জনাব এস, এম, আহসানও রাস্তায় বাহির হন।
ক্রমান্বয়ে মিছিলে তখন ছাত্র অপেক্ষা অফিস কর্মচারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছিল। ইহার পর ছাত্র ও অফিস কর্মচারীদের খণ্ড খণ্ড মিছিলগুলি জিন্নাহ এভেন্যুর ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া এক সভায় মিলিত হয়। একই সময়ে তোপখানা রোড দিয়া এবং জিন্নাহ এভেন্যু বরাবর হইতে দুইটি বৃহৎ মিছিল আসিয়া ষ্টেডিয়ামের গেটের কাছাকাছি উপস্থিত হয়। উক্ত স্থানে বিক্ষোভকারীদের একটি স্বতঃস্ফূর্ত সভা অনুষ্ঠিত হইবার পর বিরাট ছাত্র-জনতা আবদুল গনি রোড দিয়া সেক্রেটারীয়েটের প্রথম গেটের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। এই বিরাট বিক্ষোভ মিছিলটির মধ্যে অফিস কর্ম্মচারীদের সংখ্যাই ছিল অধিক।

সেক্রেটারিয়েট আক্রমণ
বেলা দশটার মধ্যে সমগ্র আবদুল গনি রোড এলাকা জনাকীর্ণ হইয়া পড়ে। প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্র জনতার মিছিলটিকে পুলিশ বাধা প্রদান করে। কিন্তু জনতার চাপে পুলিশ বাহিনীকে পিছু হটিতে হয়। মিছিলকারিগণ সেক্রেটারীয়েটের অভ্যন্তরস্থ কর্মচারীদের হরতাল পালন করিয়া মিছিলে অংশ গ্রহণের জন্য পুন:পুন: আবেদন জানাইতে থাকে। ছাত্রদের আবেদনে কয়েকশত সরকারী কর্ম্মচারী সেক্রেটারীয়েটের প্রথম গেট দিয়া বাহির হইয়া আসেন।
এই সময় পুলিশের ‘রায়ট কার’টি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া জিন্নাহ এভেন্যুর নিকট ও প্রথম গেটে আসিয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিবার উদ্দেশ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ব্যাপকভাবে লালপানি নিক্ষেপ করিতে থাকে। এই রায়ট কারটির আগমনে মিছিলকারীরা আরও বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠে এবং ব্যাপক ইষ্টক বর্ষণের ফলে রায়টকারটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করিতে বাধ্য হয়।
কিছুক্ষণ পরেই সেক্রেটারীয়েটের প্রথম গেট হইতে আরও কয়েকশত কর্ম্মচারী বাহির হইবার চেষ্টা করিলে সশস্ত্র পুলিশ ভিতর হইতে সেক্রেটারিয়েটের গেট বন্ধ করিয়া দেয়। তখন বেলা আনুমানিক পৌণে এগারটা। হঠাৎ পুলিশ সেক্রেটারীয়েটের অভ্যন্তর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া জনতাকে ধাওয়া করে। এই সময় পুলিশ ও জনতার মধ্যে ব্যাপক ইষ্ট বর্ষণ বিনিময় হয়। পুলিশ তখন সেক্রেটারীয়েটের অভ্যন্তর হইতে সমানে কাদুনে গ্যাসও নিক্ষেপ করিতেছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা আবার নিক্ষিপ্ত গ্যাসের শেলগুলিকে বুমেরাং করিয়া পুলিশের দিকেই নিক্ষেপ করিতে থাকে। জনতার আক্রমণ ব্যাপক হইতে ব্যাপকতর হইয়া উঠিলে এক পর্যায়ে ছাত্র- জনতা প্রথম গেটের অভিমুখে অগ্রসর হয়। সেই সময় একজন যুবক কর্ম্মচারীদের ধর্ম্মঘট করিবার আহ্বান জানাইতে জানাইতে বেলা ১১-৫ মিনিটে গেটের দিকে অগ্রসর হইলে পুলিশ তাহাকে লক্ষ্য করিয়া প্রথম রাউণ্ড গুলীবর্ষণ করে। গুলীতে মকবুল হোসেন নামে উক্ত যুবক হাটুতে গুলীবিদ্ধ হইয়া ঘটনাস্থলে পড়িয়া যায়। তাহাছাড়া পুলিশ একই সঙ্গে আরও কয়েক রাউণ্ড গুলী নিক্ষেপ করিলে সর্ব্বমোট ছয়জন বিক্ষোভকারী আহত হয়।
এই গুলীবর্ষণের পর জনতা সাময়িকভাবে আক্রমণ বন্ধ রাখে। কিন্তু গুলী নিক্ষেপের খবর দ্রুত ছড়াইয়া পড়িলে দলে দলে লোক সেক্রেটারীয়েটের দিকে জড় হইতে থাকে। ইতিমধ্যে তথায় প্রায় দশ সহস্রাধিক মানুষের সমাগম হয়। দুপুর বারটার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা আবার সেক্রেটারীয়েটের প্রধান ভবনের দিকে লক্ষ্য করিয়া শিলাবৃষ্টির ন্যায় ইষ্টক বর্ষণ করিতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে জনতা প্রথম গেটের সন্নিকটে টিনের সেডে অগ্নি নিক্ষেপ করিলে তাহাতে আগুন ধরিয়া যায়। ইতিপূর্বেও জনতা একবার অপর একটি সেডে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হয়। সেক্রেটারীয়েটের অভ্যন্তরস্থ দমকল বাহিনী আগুন নিভাইবার চেষ্টা করিবার সময় রাস্তার নিকট হইতে অগ্নিসংযোজিত কাঠ ও বাঁশের টুকরা উক্ত আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করিতেছিল। ফলে আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে।
বেলা ১২-৫ মিনিটের সময় একদল পুলিশ হঠাৎ বাহির হইয়া আসিয়া বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করে এবং একই সময় অভ্যন্তর হইতে জনতার উপর কয়েক রাউণ্ড গুলী বর্ষণ করা হয়। কেহ কেহ দাবী করিয়াছেন যে, সেক্রেটারীয়েটের দোতালার উপর হইতে এই গুলীবর্ষণ করা হইয়াছে।
এই সময় আরও ছয় ব্যক্তি গুলীবিদ্ধ হয় এবং ঘটনাস্থলে দুইজন নিহত হইয়াছে।
বেলা ১২-২০ এবং ১২-২৮ মিনিটে পর পর আরও দুইবার গুলী বর্ষণ করা হয়। এই সমস্ত গুলী নিক্ষেপের সময় অভ্যন্তর হইতে অনবরত কাদুনে গ্যাস নিক্ষিপ্ত হইতেছিল। ক্রুদ্ধ ছাত্র-জনতা এই গুলীবর্ষণের পর নিরস্ত্র হয় নাই এবং মুহুর্মুহ সরকার বিরোধী শ্লোগান দিয়া বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল বাহির করিতে শুরু করে। ইতিপূর্ব্বে জনতা একটি ভাঙ্গা বাস আনিয়া পুলিশের বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আবদুল গনি রোডে ‘ব্যারিকেড’ সৃষ্টি করে। তাহারা ‘উন্নয়ন দশকের কয়েকটি সাইনবোর্ড’ ভাঙ্গিয়া অগ্নিসহ সেক্রেটারীয়েটের কৃষি ভবনের কোণ হইতে ভিতরে নিক্ষেপ করে।
সেক্রেটারীয়েটের সম্মুখে বিভিন্ন পর্যায়ে গুলীর ফলে ন্যূনপক্ষে চার জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এবং নিহতদের একজনের লাশ পুলিশ সেক্রেটারিয়েটের অভ্যন্তরে দ্রুত টানিয়া লইয়া একটি শেডের নিকট ফেলিয়া রাখে। কয়েকজন সাংবাদিক উক্ত লাশটি অভ্যন্তরে গমন করিয়া দেখিতে পান। কিন্তু জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারের আপত্তির পর সাংবাদিকগণ ফিরিয়া আসেন। একটি এম্বুলেন্স লাশটি আনিতে যাইয়া ব্যর্থ হয়। সন্ধ্যা পর্য্যন্ত উক্ত লাশটির কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
ছাত্র-জনতা ঘটনাস্থলে নিহত রুস্তম আলী ও মকবুলের লাশ বহন করিয়া অন্যত্র লইয়া যায়। ইহার পর বেলা দেড়টার দিকে জনতা নর্থ সাউথ রোডের পার্শ্বস্ত দেওয়ালের উপর কেরোসিন ঢালিয়া আগুন ধরাইয়া দেয়। পুলিশ আগুন নিভাইয়া ফেলে। বেলা প্রায় দুইটায় পুরানা পল্টনের মোড়ে ভিড় বাড়িয়া যায় এবং একদল অগ্রগামী বিক্ষোভকারী তোপখানা রোডে সেক্রেটারীয়েটের দ্বিতীয় গেটে অগ্নিসংযোগ করে। সশস্ত্র পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করিয়া এক রাউণ্ড গুলী নিক্ষেপ করে। ফলে একজন গুলীবিদ্ধ হয়। ই-পি-আর ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বায়তুল মোকাররম হইতে পুরানা পল্টন এলাকা ঘিরিয়া রাখে।

এম-এন-এ’র বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ
এই স্থান হইতে একটি মিছিল মতিঝিলের দিকে অগ্রসর হইয়া ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের বিপরীত দিকে অবস্থিত কনভেনশন লীগ দলীয় এম-এন- এ জনাব এন, এ, লস্করের বাড়ী আক্রমণ করে। এই আক্রমণের পূৰ্ব্ব মূহূর্তে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সশস্ত্র পুলিশ উক্ত স্থানে আগমন করিলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়।। ক্ষুব্ধ জনতা উক্ত বাড়ীর মহিলাদের গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাইতে সাহায্য করে এর গৃহের আসবাবপত্র বাহিরে আনিয়া অগ্নিসংযোগ করিতে থাকে। সেই মুহূর্তে উক্তস্থানে গুলীবর্ষণের শব্দ শোনা যায়। কেহ কেহ দাবী করেন যে, উক্ত বাড়ী হইতেই গুলী করা হইয়াছে। গুলীতে কয়েকজন আহত হয়। গুলীবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে জনতা আরও ক্ষেপিয়া উঠে এবং উক্ত বাড়ীতেই অগ্নিসংযোগ করিয়া দেয়। এই বাড়ীর অন্যান্য আসবাব পত্রের সহিত গ্যারেজের দুইটি গাড়ী পুড়িয়া ভস্মীভূত হইয়া যায়। বাড়ীর আগুন বিকাল চারটা পর্য্যন্ত দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে ছিল। দমকল বাহিনী বা পুলিশ আসিয়া বাড়ীটিকে রক্ষা করিতে পারে নাই।
অপরাহ্নে ও সন্ধ্যার পরেও নূতন ও পূরাতন শহরের সর্ব্বত্র খণ্ড খণ্ড অসংখ্য মিছিল সরকার বিরোধী শ্লোগান সহকারে রাজধানী প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। সমগ্র রাজধানী শহর যেন একটি বিক্ষোভের শহরে পরিণত হইয়া পড়ে। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মাইকযোগে এবং বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে শহরে চব্বিশঘণ্টাব্যাপী সান্ধ্য আইন জারী হইবার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় ক্রমেই দ্রুত কমিতে থাকে। সান্ধ্য আইন জারীর পরে বহু সংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ। রাত আটটার পর হইতে বিক্ষুব্ধ রাজধানী নিস্তব্ধ হইয়া পড়ে।

শাহজাহানপুরে আক্রমণ
সকালে শাহজাহানপুর হইতে একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকা ষ্টেডিয়ামের দিকে অগ্রসর হইবার সময় শাহজাহানপুরের একটি বাসা হইতে কতিপয় লোক মিছিলটির উপর ঝাপাইয়া পড়ে এবং মিছিলে অংশগ্রহণকারী কয়েক ব্যক্তিকে ছুরিকাহত করে বলিয়া অভিযোগ পাওয়া গিয়াছে।
প্রকাশ, উক্ত শাহজাহানপুর এলাকার মিছিলটি অগ্রসর হওয়ার সময় আক্রমণ করিলে মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা পাল্টা আক্রমণ করে এবং বিক্ষোভরত মিছিলটি মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় আসিয়া পৌছে।
প্রকাশ, বিক্ষোভরত মিছিলটি স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য (সরকারী) আবদুল মান্নাফের বাড়ীতে এবং স্থানীয় মোছলেম লীগ অফিসেও অগ্নি সংযোগ করে বলিয়া জানা গিয়াছে।

জানাজা ও শোক মিছিল
অপরাহ্ন দুইটার সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হইতে গুলীতে নিহত রোস্তম ও মকবুলের লাশ লইয়া মিছিল বাহির হয়। রোরুদ্যমান জনতার মিছিলের সম্মুখে ফেষ্টনে লেখা ছিল।
-“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই………।”
ইহা ছাড়া বিভিন্ন দাবী-দাওয়া সম্বলিত বহু পোষ্টার ও মিছিলে বহন করা হয়।
মিছিলটি ঢাকা যাদুঘরের সম্মুখ দিয়া জিন্না এ্যভিনুতে পৌছাইলে এক বাণিজ্যি ভবনের উপর হইতে বেশ কিছু সংখ্যক কালো পতাকা মিছিলের উপর নিক্ষেপ করা হয়। উক্ত কালো পতাকা বহন করিয়া মিছিলটি আউটার ষ্টেডিয়ামে প্রবেশ করে।
এই স্থানে আসাদুজ্জামানের মৃতুতে শোক ও প্রতিবাদ সভা হইবার কথা ছিল। উক্ত শোক ও প্রতিবাদ সভা জানাজায় পরিণত হয়।
মেডিক্যাল কলেজ হইতে মিছিলের যাত্রা শুরু হইলে প্রবাহমান জনস্রোত মিছিলের কলেবর বৃদ্ধি করিতে থাকে।
বিভিন্ন শিল্প এলাকা ও শহরের অন্যান্য স্থান হইতে হাজার হাজার লোক আউটার ষ্টেডিয়ামে হাজির হন। প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।
আউটার ষ্টেডিয়ামে প্রবাহমান শোকবিধুর জনতার স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বায়তুল মোকাররম, জিন্না এ্যভিনু, ডি, আই,টি এ্যভিনু, নওয়াবপুর রেল ক্রসিং প্রভৃতি আউটার ষ্টেডিয়ামের আশে-পাশের সমস্ত এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এই বিশাল জনতা নিজ নিজ স্থান হইতে জানাজায় শরীক হয়।
জানাজা নামাজের লক্ষাধিক লোকের এক মিছিল নর্থ-সাউথ রোড, তোপখানা রোড হইয়া কেন্দ্ৰীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হয় এবং মিছিল উক্ত স্থানেই শেষ হয়।
ইহার পর মিছিলের একটি অংশ একবাল হল প্রাঙ্গণে সমবেত হন। এই স্থানে পুলিশের গুলীতে নিহত ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কর্মচারী জনাব আজাহার আলী মল্লিকের পুত্র মতিয়ার রহমান মল্লিকের লাশ উপস্থিত করা হয়। লক্ষাধিক লোকের এই সমাবেশে নিহত মতিয়ারকে পিতা জনাব আজাহার মোছলেম লীগ অফিসটিতে আক্রমণ করে এবং অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। সেই সময় শহরে কারফিউ জারীর সংবাদ মাইকযোগে প্রচার করা হইতেছিল। এবং একদল পুলিশ আক্রমণকারীদের হাতে হইতে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। শেষ পৰ্য্যন্ত প্রাদেশিক মোছলেম লীগ অফিসটি রক্ষা পায়।

টঙ্গী শিল্প এলাকা
গতকাল টঙ্গীর সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকগণ ছাত্রসমাজের হরতালের ডাকে সাড়া দিয়া পূর্ণ ধর্ম্মঘট পালন করে। ধর্ম্মঘটের পর শ্রমিকগণ সারা শিল্প এলাকা প্রদক্ষিণ করিয়াছে। মিছিলশেষে পুলিশের গুলীতে নিহত শহীদদের গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
পাঁচ হাজার ছাত্র-জনতা মোহাম্মদপুর এলাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক বিক্ষোভ মিছিল বাহির করে।
মিছিলে অংশ গ্রহণকারী ছাত্র-জনতা পরে এক সভায় মিলিত হয়। ওয়াহিদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় আইয়ুব পার্ক শহীদ আসাদ পার্ক নামকরণের দাবী জানান হইয়াছে। সভায় বক্তৃতা করেন খুরশীদ আহমদ, আলী আশরাফ, শাহজাহান প্রমুখ ছাত্র।

রুস্তমের লাশ
বারোটা পঁচিশ মিনিটের সময় পূর্ব্ব পাকিস্তান সেক্রেটারীয়েটের দক্ষিণ পার্শ্বের আবদুল গনি রোড হইতে সহস্রাধিক শোকার্ত মানুষ পুলিশের গুলীতে নিহত কিশোর রুস্তম আলী শেখের রক্তাক্ত লাশ কাঁধে কাঁধে বহন করিয়া ষ্টেডিয়ামের দিকে ছুটিয়া আসে। এই ক্ষুদ্রাকার মিছিলটি জিন্না এ্যভিন্যুতে আসিয়া পৌছিবার সাথে সাথেই রাস্তায় সমবেত হাজার হাজার জনতা মিছিলে যোগদান করিতে থাকে। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে মিছিলটি প্রায় পৌনে একমাইল দীর্ঘ হইয়া যায়। রুস্তমের রক্তাক্ত লাশ বহন করিয়া শ্লোগান সহকারে এই মিছিলটি যখন আগাইতে ছিল তখন ছাত্রদের আহ্বানে মরহুম রুস্তমের আত্মার সম্মানার্থ সকলেই পায়ের জুতা খুলিয়া ফেলেন। মিছিলটি জিন্না এ্যভিন্যু হইতে দ্রুত গতিতে টেলিগ্রাফ অফিসের সম্মুখ দিয়া শহীদ মিনারের দিকে আগাইতে ছিল। যখন ঢাকা সার্কেল রেল অফিসের সম্মুখে আসে তখন শহীদ মিনারের দিক হইতে অপর একটি মিছিল আসে। তখন এই দুইটি মিছিল একত্রিত হইয়া শহীদ মিনারে দিকে অগ্রসর হইতে শুরু করে। রেল হাসপাতালের সম্মুখে রুস্তমের লাশ আসিলে নিকটবর্তী নাগরিকগণ লাশ বহনের জন্য একটি খাটিয়া সরবরাহ করিলে উহাতে রুস্তমের লাশ উঠানো হয়।
যাদুঘরের নিকট মিছিল আসিলে কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তার পার্শ্বে অপেক্ষমাণ জনতা রুস্তমের লাশের ওপর পুষ্পবর্ষণ করে। ইহার পর লাশটি নিয়া বেলা একটা পাঁচ মিনিটে দীর্ঘ মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়। সেখানে উপস্থিত জনতার নিকট রুস্তমের পরিচয় প্রদান করা হয় এবং রুস্তমের দাদা ইদ্রিস মিয়া জনতার উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলেন।
বেলা একটা পনেরো মিনিটে ইকবাল হল হইতে পূঃ পাক সেক্রেটারীয়েটের নিকট পুলিশের গুলীতে নিহত অপর এক ব্যক্তির (যাহার নাম পরিচয় অজ্ঞাত) লাশ সহকারে শহীদ মিনারে শোকস্তদ্ধ কিছু শপথ বলিষ্ঠ জনতা আগমন করে।
ইহার পর দুইটি লাশ বহনকারী এই দুই দল জনতা শহীদ মিনার ত্যাগ করিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পশ্চিম পার্শ্বের সদর ফটকের নিকটস্থ চৌরাস্তায় লাশ দুইটি নিয়া এমনভাবে বসিয়া পড়ে যাহাতে কেহ লাশ দুইটি ছিনিয়া লইয়া না যাইতে পারে।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯