স্তব্ধ বিবেক
সুত্রঃ দ্যা গার্ডিয়ান
তাঃ ১৩ মে, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
আগামিকাল, বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে, অবশেষে সংসদে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। এর ফলে পরিস্থিতি সকলেই বুঝতে পারবে বা এই আলোচনায় খুব কাজ হবে, এমনটা আশা করা উচিত হবে না কারোই। বাঙালির স্বাধীনতার দাবীর যে আন্দোলন তা দমনের জন্য ছলনা শুরু হয়ে গেছে। একদিকে ভারতের কাছ থেকে প্রচুর ও বিভিন্নমুখী সতর্কবার্তা, অন্যদিকে স্যার অ্যালেক ডগলাসের প্রচুর সংখ্যক নীরস ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ক্ষমতার এই খেলায় নানা মাত্রা যোগ করে যাচ্ছে। সাত সপ্তাহ আগে, সপ্তাহান্তের শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। আগামিকালের বিতর্কে যারা অংশগ্রহন করবেন, তারা চান এইচ এম জি যেন অবিলম্বে শান্তিস্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেয়, যদিও ৭০,০০০ বেয়নেটের আঘাতে শান্তি পালিয়ে গেছে।
বেশিরভাগ কূটনৈতিক নীতি অনুযায়ী, এখন জোরাল তদবির বা নৈতিকতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা, কিংবা যুদ্ধ প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা গ্রহন করার সময় চলে গিয়েছে। ইসলামাবাদের আর্মি জেনারেলদের কেউ পরোয়া করেনা, কিন্তু একিসাথে এত নির্দয় একটি বাহিনী এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে থাকবে, তা কোন সরকারের জন্যই হাল্কাভাবে নেয়া উচিত হবে না। সেখানে একজন বিদেশী কর্মকর্তা হয়রানির স্বীকার হলে কি করেন? নীরবতা পালন করেন, রাওয়ালপিন্ডির কারো জন্য এখন চট্টগ্রামের কাউকে সাহায্য করা সাহসিকতা নয় বরং লজ্জার বিষয়। এসকল বিষয় ভুলে যেয়ে শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ পীড়িত জনগনের ত্রাণ নিশ্চিতকরনের দিকে মনোনিবেশ করা কি যথার্থ? শরণার্থীদের জন্য কর্মসূচী দেয়া বা বিমানে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করেই কি আমরা মুল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যেতে থাকব?
এর মধ্যে অনেকগুলোই অত্যন্ত জরুরী হলেও, প্রতিটি কর্মসূচিরই একটি দৃঢ় উদ্দেশ্য থাকতে হবে, এবং সে উদ্দেশ্যটি অবশ্যই নৈতিক এবং যুক্তিযুক্ত হতে হবে। পার্লামেন্ট এখনও হোমের সদস্যদের এই বার্তাটি বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। সাত সপ্তাহ আগে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা, যিনি নির্বাচনে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তান শাসনের ক্ষমতা পেয়েছিলেন, তিনি একজন অনিরবাচিত সামরিক প্রেসিডেন্ট এর সাথে সমঝোতা আলোচনায় বসার কিছুদিন পর গ্রেফতার হন। এই আলোচনা কোন সমাধানের দিকে যাচ্ছিল না। মুজিব নির্বাচনে জয়ী হয়ে কিছুটা দাম্ভিক হয়ে উঠেছিলেন এবং কিছু আদর্শগত অবস্থান থেকেও চাপের মুখে থেকেও তার দাবিগুলো আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, ইয়াহিয়া কেবল ভুট্টোর সাথেই কথা বলে যাচ্ছেন, যাকে তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ধরেই নিয়েছিলেন। পশ্চিমের ভুট্টো, পূর্বে তেমন গুরুত্ব না পেয়ে যেভাবে যখন সম্ভব, আলোচনায় কেবল বিঘ্নই ঘটাচ্ছিলেন। তারপর হঠাত করেই তা স্থগিত হয়ে যায়। জাহাজে করে সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে পুরোদমে হামলা শুরু করে ঢাকায়। মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়, তার অনেক সহযোগীকে হত্যা করা নিজের বাড়ির আঙ্গিনাতেই। কয়েক সপ্তাহ টানা এলোপাথাড়ি সংঘর্ষ চলে, যেন একদিকে প্রতিপক্ষের যুদ্ধ বিমান আর অন্যদিকে তীরধনুক, কেননা অন্যান্য অস্ত্রধারী বাঙালি বাহিনীদের উপর সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চালানো হয়।
এর ফলে ঠিক কতজন নিহিত হয়েছে? বাঙ্গালীদের কথা অনুযায়ী সংখ্যাটি প্রায় দশ লক্ষ। অন্যদিকে ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি বলছেন সম্ভবত ১৫,০০০। যদি তাও হয়, তারপরও যদি যুক্তি দিয়ে বিচার করা হয়, তবে ধারনা করা যেতে পারে যে ১৫,০০০ নিহতের বিনিময়ে যদি পাকিস্তানের এই দুই প্রদেশ আবার একত্রিত হয়, তবে সেই ঐক্য খুব বেশি দৃঢ় হবেনা।
পূর্বের বাঙ্গালিরা যদি পশ্চিমের সাথে কোনভাবে সংযুক্ত থাকতো, তবে ক্ষতির চেয়ে তাদের লাভই বেশি হত কিনা সে বিতর্ক তুলছেন অনেকেই, দ্যা গারডিয়ানের মতে তাদের লাভই হত। মুজিব ও বেশিরভাগ প্রচার মাধ্যমে এমনটিই বলেছিলেন। তিনি কখনও গনতান্ত্রিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তিনি কেবল শোষণের হাত থেকে বাঙ্গালীকে রক্ষা করতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী স্বায়ত্বশাসনের দাবী করে যাচ্ছিলেন, এবং সেই অবস্থানেই অনড় ছিলেন। তার এই দাবীতে তিনি জনগনের কাছ থেকেও বিপুল সারা পেয়েছিলেন। যতক্ষন পর্যন্ত ইয়াহিয়া এবিষয়ে দরকষাকষি করছিলেন, তার কর্মকাণ্ড সম্মানজনক পর্যায়ে ছিল। ঠিক যে মুহূর্তে তিনি আলোচনা বন্ধ করে দিলেন, সে মুহূর্ত থেকেই তিনি মূর্খের মত অপকর্মের পথ বেছে নিলেন। তিনিই নির্বাচন দিয়েছেন। এখন তিনিই সেই নির্বাচনের মুল উদ্দেশ্য ও নির্বাচিত মানুষদের বিরোধিতা করছেন। তিনি যে আসলে গনতন্ত্রের পক্ষপাতি নন, কেন্দ্রিয় সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের জন্য সঠিক হবে না ভুল, তা উপলব্ধি করতে আসলে কারো আওয়ামীলীগের সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো খেয়াল করলেই তা সহজেই বুঝতে পারবে যে কেউ।
স্বাভাবিকভাবেই কিছু মৌলিক বিষয়ে অসংখ্য সমস্যা সকলকেই ভাবিয়ে তুলছে। পাকিস্তান আর ভারতের বহুবছর ধরে চলে আসার শত্রুতার জালে আটকা পরেছে বাংলাদেশ। ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে (এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময় প্রচ্ছন্নভাবে) মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি আসলে মিসেস গান্ধীর সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রধান হতে চেয়েছিলেন। ২০ লক্ষ বাঙালি সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর সেই সাথে অনাহারে থাকার প্রস্তুতিও।
শরণার্থীদের ত্রাণ যদি আরও বিলম্বিত হয় তবে প্রচুর মানুষ অনাহারে মারা যাবে ও আরও বেশি দুর্যোগের কবলে এ অঞ্চল পড়বে বলে মত দিয়েছেন ত্রাণ কর্মকর্তারা। চায়না জল ঘোলা করে তুলছে, অন্যদিকে আমেরিকা সহ অন্যান্য আতঙ্কিত দেশগুলো পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেবার কথা ভাবছে, যদিও তারা জানেন যে এর ফলে অশিক্ষিত দরিদ্র জনগণই দুর্ভোগে পরবেন, ফিটফাট পোশাকের জেনারেলরা নয়।
এমন একটি সময়ে সবাধিনতায় বিশ্বাসী কোন সরকার কি ধরনের আচরন করবে? সেটি নিশ্চয়ই “অভ্যন্তরীণ বিষয়” এর মত কূটনৈতিক বুলি দিয়ে সবকিছুকে আড়াল করতে চাইবে না। তাদের মনোভাব হবে উদার। ইয়াহিয়ার লোকেরা যখন মুজিবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল, তখন তা থামানোর মত সঠিক কাজটা করাই যথার্থ ছিল (শেষ কবে একজন অসৎ বিদ্রোহী নেতা নিজের বাড়িতে বসে বন্দী হবার জন্য সেনাদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন?)
একটি উদার প্রশাসনের উচিত দ্রুত বিচারের জন্য চাপ দেয়া, যত দ্রুত সম্ভব এবং যতখানি সম্ভব ত্রাণ পাঠানো (যদিও নভেম্বরের পরে যথেষ্ট ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল)। নিজ থেকেই এখন পাকিস্তান প্রশাসনের কাছে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া ছাড়াও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর পলিসি পরিবর্তন করে পাকিস্তানের অস্ত্র ক্রয় ও প্রতিরক্ষার জন্য বরাদ্দ সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। একটি উদার মনা সরকারের উচিত উপ্রোক্ত সকল সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে কেবল ত্রাণ এর কাজ করা, শুধু মাত্র ত্রাণ পাঠানো, সেইসব লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য যাদের বেচে থাকার জন্য এখন ত্রাণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে।
এই মুহূর্তে কোন গনতান্ত্রিক কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন নেই, যেমন ধরা যাক এই তাবেদার পূর্বাঞ্চলীয় রাজনীতিবিদদের কাছে এই চলমান অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অনিবার্য স্থানান্তর, কেননা তাতে ইয়াহিয়ার রাষ্ট্র বলতে কিছু থাকবে না। সবচাইতে বড় কথা, এধরনের কাজের ক্ষেত্রে কোন দেরি বা অনীহা দেখানো চলবেনা।
বাংলাদেশের ভাগ্যে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে আজ কিছু পন্ডিত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, চরমপন্থিদের কারনে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনের দাবিতে এই অঞ্চল দীর্ঘদিনের জন্য যুদ্ধাবস্থায় জড়িয়ে পড়বে। আওয়ামী লীগ কার্যত এখন ভেঙ্গে পরলেও সত্যিকারের গেরিলা যোদ্ধাদের একত্রিত করে তাদের যুদ্ধে নামতে হবে, তাতে মাস, বছর কিংবা লাগতে পারে এক দশক ও। কিন্তু কালকের সংসদিয় বিতর্ক, বা কোন সরকারের মুখপাত্রই এই হতাশাজনক স্থবির অবস্থা নিয়ে কথা বলেন না, তারা এখনও ভান করেন যে তারা বিশ্বাস করেন ইয়াহিয়ার রাষ্ট্র মুখ থুব্রে পড়বে না এবং আবার পাক্সিতান একত্রিত হয়ে উঠতে পারবে। যেখানে তাদের ভেঙ্গে যাওয়াটা এখন কেবলি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভেঙ্গে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি কিছুটা শান্তিপূর্ণ ও কম রক্তপাত দ্বারা সম্ভব হত যদি মুজিবকে মুক্ত করে এর ভার দেয়া হত (কেননা, মুজিব এখন পর্যন্ত নিজেকে একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবেই প্রকাশ করে এসেছেন, কখনও কখনও তা ক্লান্তির উদ্রেক করলেও)। এর ফলে শরণার্থীরাও বাড়ি ফেরত যেতে পারবেন, কারখানগুলোকে আবার সচল করে তোলা সম্ভব হবে, নতুন দিনের বীজ বপন হবে। ইসলামাবাদ কোন দুর্ভেদ্য দুর্গ নয়, নিছকই কিছু মরিয়া লোক একে দুর্ভেদ্য কল্পনা করেন। তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব না, কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা মিঃ ভুট্টোর কাছে পরাজিত হচ্ছেন এবং ব্যাবসায়ীরাও তাদের এই ভ্রম ধীরে ধীরে ভুল প্রমানিত করে দিচ্ছেন। সংসদ কি সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আসলে কতজন এমপি এই আলোচনায় অংশ নেবেন। আগামি ছয় মাস ব্রিটেন কিধরনের আচরন করবে তা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের মতামতের উপর প্রভাব ফেলবে, এবং সেটিই জরুরী কেননা এই পাকিস্তানের মতামতের কারনেই গত দুই মাসে এমন সব ক্ষতি হয়ে গেছে যা চাইলেও আর পুরন করা সম্ভব নয়।