শেষ কথা
শেখ মুজিবের হত্যা বিশ্বকে শােকাভিভূত করল
আমি তখন আমেরিকাতে একটা ধর্মীয় শুভেচ্ছা মিশনে সেখানে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে আমি জানতে পারলাম যে শেখ মুজিবকে তার গােটা পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে যার মধ্যে আছে তার দুই পুত্র কামাল ও জামাল ও তাদের স্ত্রীগণ, এবং আট বছরের পুত্র রাসেলও, যারা সকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছে এবং গভীর দুঃখ-কষ্ট ভুগেছে। এ খবর আমাকে এমনভাবে মর্মাহত করল যে আমি সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ফিরে আসলাম। এটা ছিল একটা অভ্যুত্থান। বাংলাদেশ আর্মির পাঁচজন বিপথগামী মেজর গুলি করে শেষ করে দিলেন শেখ মুজিবের গােটা পরিবারকে যারা আগে থেকে কিছু সন্দেহ করতে পারেনি। তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন ট্যাংক ইউনিটের কমান্ডার; তিনি তাঁর ট্যাংকগুলি বের করেছিলেন কোনও গােলা ছাড়াই মিথ্যা ভয় দেখাতে। ট্যাংকগুলি প্রথমত বের করা হয়েছিল একটা আশঙ্কিত বিক্ষোভ প্রদর্শনকে দমন করার অজুহাতে, কিন্তু আসলে মুজিবের সমর্থকদের সন্ত্রস্ত করতে। গােলশূন্য ট্যাংকের ফাকিটা কাজে দিয়েছিল। প্রতিটা অ্যুত্থানের পর একটা সমপ্রতিক্রিয়াধারা ঘটে থাকে। এই আর্মি ভাড়াটেদেরকে সিংহপুরুষ বানিয়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি শিগগিরই নিজে স্থানচ্যুত হলেন। তাঁর মুজিবপন্থী উত্তরাধিকারীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। একটা স্বার্থপর সহিংস কাজের শান্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ইতিহাসে কখনও হয়নি। মুজিব শুধুমাত্র একটা পচনশীল দেহ ছিলেন না। উপমহাদেশে চলি-শের বেশি বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিত্তিতে দাঁড়ানাে একটা চিন্তাধারার তিনি প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলার মুসলিম লীগের এক শক্তিশালী নেতা ছিলেন তিনি। পরে তিনি এইচ এস সােহরাওয়ার্দির ও ফজলুল হকের সহকারী হলেন। তারা সাম্প্রদায়িকতার কোনও ভবিষ্যৎ নেই বলে পুরাপুরি অনুধাবন করে ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিসমূহ গড়ে তুলেছিলেন। মুজিবের এই চিন্তাধারা গণতন্ত্রকে দেখেছিলেন সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। এসব ধারণা বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত হলেও তাঁর ভক্তরা এগুলিকে একযােগে নাম দিল মুজিববাদ এবং নামটা রয়ে গিয়েছে । এই চিন্তাধারার জন্যই বাংলাদেশের হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলমান তাদের জীবনসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে। বাংলাদেশের এক কোটি হিন্দু ৭ কোটি মানুষের ইসলামি রাষ্ট্রে সুখী হতে পারে না। ঠিক তেমনি ভারতের সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান অস্বস্তি বােধ করবে যদি ৬৫ কোটি হিন্দুর দেশ ভারত একটা হিন্দু ধর্মশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধর্মের উচিত সম্পর্ক মজবুত করা এবং সবগুলি ধর্মের উচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রচার করা।
আমরা এখন প্রায় একবিংশ শতাব্দিতে প্রবেশের পথে। দুর্ভাগ্যবশত সঠিক শিক্ষা এবং শিক্ষার বহুল বিস্তারের অভাবে এখনও কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে সরল এবং ধর্মীয় ব্যাপারে আবেগপ্রবণ মানুষের আধিক্যের সুযােগ নিয়ে তাদের ওপর তথাকথিত ধর্মীয় সরকার কৌশলে বসিয়ে দেওয়া। কিন্তু তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। মানুষ তাদের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ সে ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে। আমি একটা উন্নত বাংলাদেশের ছবি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি। এর পরিশ্রমী এবং সমরূপ জনগণ, তার সাথে এর বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতুলভাবে তার এই ভবিষ্যৎ দাবি করে। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন উচ্চ সংস্কৃতিবান ও রাজনৈতিকভাবে পরিপক বাংলাদেশের বুদ্ধিশালী সম্প্রদায় ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ধারালাে করে তুলবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যরা তাদেরকে অনুসরণ করবে। মনশ্চক্ষে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের কবরের জন্য ঢাকায় একটা প্রকাণ্ড মহিমান্বিত সমাধিসৌধ, তার প্রতি মানুষের ঠিক সেই সম্রম যেমন সভ্য দেশগুলিতে মহান নেতাদের ব্যাপারে দেখানাে হয়। মানবাধিকারের এই মহান যােদ্ধার কাজগুলির কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাতা ও তার ইতিহাসের মহত্তম শহীদের প্রতি উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা দেখানাে পর্যন্ত সে তার বিবিধ দুর্দশা থেকে উদ্ধার পাবে না। সেজন্য বাংলাদেশকে তার স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে ও তাকে যারা হত্যা করেছিল তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। আমি যখন শেখ মুজিবের কাছে তার দুর্বল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা তুলেছিলাম তখন তিনি কী জবাব দিয়েছিলেন তা আগেই উলে-খ করেছি। তিনি তাঁর দেশবাসীকে এত ভালবেসেছিলেন এবং তাদের স্বাধীনতার জন্য এত বিপুল আত্মত্যাগ করেছিলেন। যে তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতেন না কোনও বাংলাদেশি তার সম্বন্ধে ক্ষতিকর কিছু ভাবতে পারে, তাকে ও তার পরিবারকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা তাে দূরের কথা। তিনি খুব বেশি বিশ্বাস করার শাস্তি পেলেন কিন্তু তাঁর দেশ সেই ক্যারিশম্যাটিক নেতাকে হারাল যেমন নেতা ইতিহাস অনেকগুলি দশকে মাত্র একজন সৃষ্টি করে, সুতরাং দেশকে ফল ভুগতে হবে দীর্ঘকাল ধরে। শক্তিশালী প্রশাসকদের ও দেশপ্রেমিক।
অর্থনীতিবিদদের অভাব না-ও হতে পারে যারা হয়তাে নতুন জাতিকে আবার পায়ের ওপর দাঁড় করানাের জন্য তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, কিন্তু মানুষ তাদের বিশ্বস্ত পারিবারিক চিকিৎসকের তিক্ততম বড়ি খেতেই প্রস্তুত থাকে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের বহুল-প্রচারিত অষুধ নয়। মানুষ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের মাথা ঘিরে একটা জ্যোতিশ্চক্র দেখতে পছন্দ করে। সে জ্যোতিশ্চক্র গড়ে তুলতে সাহায্য করে শুধুমাত্র ঐ নেতাদের আত্মত্যাগের পর আত্মত্যাগ -এর এক লম্বা ঘটনামালা। যারা এই নতুন জাতির প্রতিষ্ঠা ও স্থিতির জন্য এত কিছু করল সেই ভারতীয় নেতৃত্ব ও জনগণের এই বিয়ােগাত্মক ঘটনায় নীরবে যন্ত্রণা ভােগ করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল । ভারতের অবস্থায় থাকলে অন্য অনেক জাতিই হস্তক্ষেপ করাটা ন্যায়সংগত বলে মনে করত যেখানে পরিস্থিতিটা এমন যে মুষ্টিমেয় আততায়ী একটা গােটা জাতিকে জিম্মি করে ফেলেছিল । এটা ভুক্তভােগী প্রজন্মগুলির বলার কথা যে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের দ্বারা এ ধরনের অ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি জাতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বিবেচিত হওয়া উচিত কি না। বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে সন্ত্রাসবাদ সম্মানের আসন এবং স্বীকৃতি অর্জন করছে। এটা আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য ভাল আভাস দেয় না। কিছু চরম ক্ষেত্রে একথা সংগত হতে পারে কিন্তু পাঠক স্বীকার করবেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন নয়।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান