আমি ঢাকায় গেলাম
বাংলদেশ তখন মুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তখন নিবেদিত প্রাণ নেতা তাজুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের অধীনে পূর্ণাঙ্গ সরকার হিসাবে ঢাকায় কাজ করতে শুরু করেছে। শেখ মনি প্রস্তাব করলেন আমার ঢাকায় যাওয়া উচিত মুজিববাহিনীর সেই শত শত ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যারা আগে থেকে অনুপ্রবেশ করে বিপুল আত্মত্যাগের সাহায্যে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মনােবল ভেঙে দিয়েছিল। সম্প্রতি নাটকীয় ঘটনাবলির মধ্যে দিয়ে একজন ভারতীয় মেজর বেগম মুজিবকে পাকিস্তানি হেফাজত থেকে মুক্ত করেছেন। শেখ মনি চাইলেন আমি সেই বেগম মুজিব -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি ঢাকায় গিয়ে রাজনৈতিক আবহাওয়া বুঝে দেখতে চাইলেন। ভুট্টো তখনও শেখ মুজিবকে মুক্ত করে দেননি এবং শেখ মনি নিশ্চিত ছিলেন না তিনি কখনও তা দেবেন কি না। যাহােক, আমি যখন আমার হেলিকপ্টারে উঠছিলাম তখন দেখি মনি একটা কম বয়সি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমার আকাশযানের দিকে আসছেন। ছেলেটি এমন ভীষণভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আসছিল যে তাকে কোনও মতে খাড়া রাখার জন্য অন্য দুজন ছেলেকে দুদিক থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসতে হচ্ছিল। আমি তাকে চিনলাম । সে আমাদের কাছে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল, ধরা পড়েছিল এবং তাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। তারা তার কাছে থেকে কোনও তথ্য বের করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাকে এখন ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যুবকটি আমার কাছে আসতেই দেখি তার মুখে প্রচুর হাসি, সে আমার পা ছোঁয়ার চেষ্টা করল- সকল বাঙালির মধ্যে সাধারণভাবে চালু জ্যেষ্ঠের প্রতি সম্মানসূচক অভিবাদন। আমি তাকে আলিঙ্গন করে বললাম- “তুমি একটা বাঘ ।” সে বলল- “স্যার, আপনার অধীনে প্রশিক্ষণের সময় আপনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।” আমরা ছেলেটাকে আমাদের সঙ্গে নিলাম এবং ঢাকা বিমানবন্দরে পৌছলাম। সেখানে দেখা গেল হাজার হাজার মুজিববাহিনীর ছেলে ও তাদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, যারা আমার অপরিচিত, আমাকে মুক্ত ঢাকায় সংবর্ধিত করার উদ্দেশ্যে জড়াে হয়েছে। গােটা এয়ারফীন্ডটা মানুষে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছিল।
জনতা আমাকে ঘিরে ফেলল অনেকে আমার সঙ্গে করমর্দন করল। কেউ কেউ আমার সঙ্গে ফটো তুলিয়ে নিল। যখন আমি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল -এ পেীছলাম, আমি আবিষ্কার করলাম যে শ্ৰী ডিপি ধর, জেনারেল মানেকশ’, শ্রী কাও এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইতিমধ্যে পৌঁছেছেন এবং হােটেলটিতে অবস্থান করছেন। আর্মি চীফ সকল ফীল্ড কমান্ডারকে একটা ভােজে আপ্যায়িত করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি একজন অপ্রচলিত সৈনিক হওয়ায় তাতে নিমন্ত্রিত ছিলাম না। পরে যখন তারা দেখলেন আমি পৌছেছি, লাঞ্চের জন্য আমাকে শেষ মুহূর্তের নিমন্ত্রণ দেওয়া হল এবং আনুষ্ঠানিক খানা টেবিলে আমার জন্য একটা আসন রাখা হল । আর্মি জেনারেলরা যেমন সাধারণত হয়, আত্মগরিমায় আর তারা প্রত্যেকে এই বিরাট বিজয়ে যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তার তৃপ্তিতে ভরপুর ছিলেন। তাদের এমন ভাব যেন কোনও কালে আমার কথা বা পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধের কথা শােনেননি। সে সম্বন্ধে শুধু আর্মি চীফ ও জেনারেল অরােরা জানতেন আর কোর সদর দফতর জানত আমি তাদের দোষ দিই না। সে এক অতুলনীয় বিজয় ছিল, তা অনেকগুলি মাথাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমি আর্মি চীফ -এর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি শ্রী ডিপি ধর ও শ্রী কাও -এর সঙ্গে বসা ছিলেন। আর্মি চীফ ও শ্রী ধর আমাকে অজস্র অজস্র অভিনন্দন জানলেন। আমি যা কিছু অর্জন করেছি তার ব্যাপারে মুগ্ধতা প্রকাশের জন্য আমাকে আলিঙ্গন করার প্রবল ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলেন না শ্রী কাও। এসএফএফ ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য সর্বোচ্চ কৃতিত্ব বয়ে এনেছে। তিনি বললেন-“আমি জানি এমনটা করা হয় না (মানে একজন ঊর্ধ্বতন সিভিলিয়ান একজন আর্মি জেনারেল-কে আলিঙ্গন করেন না) কিন্তু এভাবে আমার মুগ্ধতা প্রকাশ না করে আমি পারলাম না।” শ্রী ডি পি ধর এবং উপস্থিত সকলের কাছে ঢাকায় আমার অঘােষিত আগমনের জন্য ক্ষমা চাইলাম । শ্রী ধর আমাকে স্থানীয় ইংরেজি দৈনিকগুলি দেখালেন। সেগুলিতে আমার আপাদমস্তক ফটো ছাপা হয়েছে এবং ঢাকা বিমানবন্দরে আমার অভ্যর্থনায় যে বিপুল হৈ হৈ কাণ্ড হল তার কথা বলা হয়েছে। তিনি বললেন- “সারা দুনিয়া জানে যে শীর্ষ গেরিলা নেতা ঢাকায় হাজির। আমরা যখন এসেছি, কেউ আমাদের প্রতি সামান্যও লক্ষ করেনি। এমনকি আর্মি চীফও লাল গালিচা সংবর্ধনা পাননি যা আপনি পেয়েছেন।
আপনি বাংলাদেশের বিপ্লবী যুবাদের হৃদয় জয় করেছেন।” আমি নীরবে এই প্রশস্তি শুনলাম। তারপর তিনি আমাকে একদিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি আমার চার নেতা মনি, তােফায়েল, রাজ্জাক, সিরাজ -এর মধ্যে একজনকে নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে প্রবুদ্ধ করতে পারি কি । আমি কথা দিলাম চেষ্টা করব। চারজন নেতা সবাই শেখ মুজিবের বাসায় আমার সঙ্গে গেলেন। বাসাটা তখন একটা তীর্থস্থানে পরিণত । বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য বেগম মুজিবের (তাকে সবাই সস্নেহে ভাবি বলে ডাকতেন) কাছে সবাই আসতেন । আমি বেগম মুজিবের সঙ্গে এক কাপ চা খেলাম। শেখ মুজিবের সবচেয়ে ছােট ছেলে রাসেল -এর সঙ্গে আমার দেখা হল শেখের দ্বিতীয় ছেলে জামাল কঠিন দিনগুলিতে আমার সঙ্গে থেকেছে এবং আমাদের কাছে থেকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়েছে। সে তার মা -এর কাছে আমার ও আমার পরিবার সম্বন্ধে এত কথা বলেছে যে ওখানে আমার সঙ্গে পরিবারের একজন সদস্যের মতাে ব্যবহার করা হল সবচেয়ে বড় ছেলে কামাল কথা দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তির পর রাঙামাটিতে আমার অবকাশ যাপনের ব্যবস্থা করবে। আমি এখন পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম সে রাঙামাটিতে অবকাশ যাপনে যেতে চায় কি না। উলেখ্য রাঙামাটি তখনও আমার সদর দফতর । আমরা আনন্দপূর্ণ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটালাম । কিন্তু পাক কাস্টডি থেকে শেখ মুজিব জীবিত ফিরবেন কি না সে ব্যাপারে তখনও অনিশ্চয়তা ছিল। বেগম মুজিবের সঙ্গে পরামর্শক্রমে চার নেতা ঠিক করলেন মুজিব না ফেরা পর্যন্ত সরকারে যােগ দেবেন না এবং যদি তিনি না ফেরেন তাহলে পরে তারা তাদের নতুন পন্থা ঠিক করবেন। যখন আমি এই নেতাদের সঙ্গে আমার আলাপের ফলাফল জানালাম, শ্রী ডিপি ধর দারুণ হতাশ হলেন। নতুন বাংলাদেশ সরকার অননুমােদিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সকল অস্ত্র উদ্ধারের আদেশ দিল। কিন্তু সর্বপ্রথম যাদেরকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দিতে বাধ্য করা হল তারা হচ্ছে মুজিববাহিনীর ছেলেরা। মনি এতে অত্যন্ত কষ্ট পেলেন।
তিনি আমার কাছে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিযােগ করলেন যে তাজউদ্দিন যে পলিসি নিয়েছেন তা, তাঁর মতে, ক্ষমতায় থাকার জন্য ও বামপন্থী বাহিনীসমূহ গড়ে তােলার জন্য। তিনি এমনকি আমাকে কিছু সশস্ত্র কম্যুনিস্ট যুবককে দেখালেন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল -এর করিডােরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মাথায় কালাে কাপড়ের ব্যান্ড বাঁধা। অস্ত্র সংক্রান্ত এই প্রশ্নে শ্রী ধর এবং মনি’র মধ্যে অত্যন্ত কড়া বাক্য বিনিময়ের একজন সাক্ষী আমি হয়েছিলাম । মনি শ্রী ধরকে বলেছিলেন যে শেখ মুজিব ঢাকায় না পৌছানাে পর্যন্ত তারা কখনও অস্ত্র জমা দেবেন না এবং তেমন প্রয়ােজন হলে এক গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেবেন। এই সময় মনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শ্রী ধর মুষড়ে পড়েছিলেন তা দেখেই বােঝা যাচ্ছিল। মনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে তার আগের এই মত নিশ্চিতি পেয়েছে যে শ্রী ধর তার দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। পরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে এর প্রভাব পড়েছিল। এটা খুবই জানা কথা যে শেখ মুজিব ক্ষমতা নেওয়ার পর তাঁর সরকারের কাছে শ্ৰী ডিপি ধর একজন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হয়ে পড়েছিলেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ তাকে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিশাবে গ্রহণ। করতে অস্বীকার করেছিল শ্রীমতি গান্ধী ব্যাপারটা মসৃণ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ তিনি বাংলাদেশের জন্য যা করেছিলেন তার জন্য শেখ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ ছিলেন। সব মিলিয়ে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ঢাকার আবহাওয়া আমার কাছে মেঘলা বলে মনে হল । সরকারকে মনে হচ্ছিল যেন তার প্রয়ােজনীয় কর্তৃত্ব নেই বা সেই ছটা নেই। যা জনপ্রিয় জননেতারা প্রদর্শন করে থাকেন। আমি ভারী মনে রাঙামাটি ফিরে এলাম । আমরা যত আত্মত্যাগ করলাম তা সব কি মুজিবের অভাবে বৃথা যেতে বসেছে? এবং মুজিবের দেশে ও ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু? আমি বান্দরবান রাজার (বােমং সর্দার -এর) দেওয়া এক সংবর্ধনায় শরিক হতে গেলাম। এই সেদিন পর্যন্ত তিনি আমাদের শত্রু ছিলেন এবং পাঠান ও মিযােদেরকে আতিথ্য দান করছিলেন। তিনি তাঁর ভাই সহ বিমান অবতরণ ক্ষেত্র পর্যন্ত আসলেন আমাকে নিয়ে যেতে। তিনি আমার জন্য উপহার হিশাবে একটা শাল নিয়ে এসেছিলেন। আমি সেটা সেখানেই একজন গরিব মানুষের হাতে ধরিয়ে দিলাম। তিনি আমাকে চা দিলেন, এবং নতুন জাতির প্রতি আনুগত্যের নিশ্চয়তা অনেক করে প্রকাশ। করলেন আত্মসমর্পণের চিহ্ন হিশাবে কর্নেল পুরকায়স্থের মাধ্যমে তিনি তার তলােয়ার আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
আমি সেটা শেখ মুজিবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম পাক কর্তৃপক্ষের প্রতি তার অতীতের সমর্থনের ব্যাপারে রাজাকে ক্ষমাপ্রদর্শনের সুপারিশসহ । আমি কক্সবাজারে উড়ে গেলা। খবর ছিল সেখানে কাছের পাহাড়গুলিতে প্রায় ৪শ’ বর্মি ডাকাত এসেছে এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু রাযাকার তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছে। জানা গেল যে বর্মি ব্রিগেড তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এই অবাঞ্ছনীয় লােকদের প্রবেশ ঠেকানাের জন্য। কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদেরকে এ ব্যাপারে খুব অস্থির। ও উদ্বিগ্ন মনে হল। আমি এই নতুন উৎপাতের ব্যাপারটা হাতে নিতে পারতাম কিন্তু আমাদের তখন প্রত্যাহৃত হয়ে ভারতে ফেরত যাওয়ার কথা। কাপ্তাই -এ একটা সংবর্ধনায় আমাকে হাজির হতে হল । আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, জনাব সুলতান আহমদ এবং অন্যরা আমাদের অভ্যর্থনা। জানালেন। আমাদের সম্মানে কালেক্টরের আয়ােজন করা একটা সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী দেখলাম আমরা। এসব হচ্ছিল ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে নববর্ষের আগের দিন । আমি ভারতে আমার সব বন্ধুকে নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠালাম। সুন্দর কথা লেখা। আছে বলে আমার মনে ধরেছিল এমন একটা কার্ড আমি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠালাম। পয়লা জানুয়ারিতে আমি অফিসারের আরও একটা তালিকা সাহসিকতার পদকের জন্য সুপারিশসহ পাঠিয়ে দিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা ছয়টা বীর চক্র পেলাম কর্নেল পি সি পুরকায়স্থ, মেজর আর কে মালহােত্রা, মেজর এস সি শর্মা, মেজর এস এস নেগি এসিসি, জি বি বলংকর এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাসজি -এর জন্য। এঁরা অসম্ভব রকম ভাল করেছিলেন। পাঁচটি বিশিষ্ট সেবা মেডেল যারা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমাদের বিখ্যাত সার্জন মেজর পি সি মেহতা। বাংলাদেশের পীড়িত ভাই-বােনের প্রতি ভারতের সশস্ত্র বাহিনীগুলির সমবেদনার কথা জনমনে ছড়িয়ে দিতে তিনি অনেক কিছু করেছেন। একটি বিশিষ্ট সেবা মেডেল পেলেন কর্নেল কে এল বসুদেব বিভিন্ন সীমান্ত বরাবর আর্মির সঙ্গে অসাধারণ সমন্বয় কাজের জন্য। এছাড়া। পাঁচটা সেনা মেডেল এবং এগারােটা মেনশন ইন ডেসপ্যাচেস প্রদান করা হল । আমাকে দেওয়া পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল এবং ব্রিগেডিয়ার বি বি ভাটনাগর-কে দেওয়া অতি বিশিষ্ট সেবা মেডেল ধরে পুরস্কারের সংখ্যা দাঁড়াল মােট ২৯।
চরম দুরূহ পরিস্থিতিতে বেতার যােগাযােগ চালু রাখার জন্য কমান্ডার অব সিগনালস মেজর এম এল দত্ত বিশিষ্ট সেবা মেডেল পাওয়ায় আমি খুশি হলাম। অ্যাসিস্ট্যান্ট কোম্পানি কমান্ডার টি এস বাওয়া পদক থেকে বাদ পড়তে আমি দুঃখিত হলাম। তাঁর জন্য সুপারিশ দেরিতে দেওয়া হয়েছিল এবং আমার মনে হয় পদকের জন্য আমাদের কোটা শেষ হয়ে যাওয়াতে তিনি বাদ পড়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাহসের সাথে লড়াই করেছিলেন কিন্তু তার সাহসিক কাজগুলাে নজরে এসেছিল দেরি করে। আমি আমার সিভিলিয়ান ব্যক্তিগত সহকারী শ্ৰী এস ডি ক্যালি-‘র কথা উলে-খ করা থেকে বিরত থাকতে পারি না। তিনি সবসময় কর্তব্যের চাহিদা থেকে বেশি পরিমাণে ও বেশি সময় কাজ করেছেন। অত্যন্ত পারদর্শী সাটলিপিকারদের মধ্যেও তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন। চরম দুরূহ পরিস্থিতির মধ্যে তিনি সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য তাঁর নামে একটা বিশিষ্ট সেবা মেডেল যােগ করে তার জন্য আমার স্বীকৃতি স্পষ্টভাবে দেখাতে পারতাম। এই বই -এ তাঁর উল্লেখ করে তার জন্য আমি সবচেয়ে কম যা করতে পারতাম তাই করেছি। এসএফএফ -এর ভারতে ফিরে যাওয়ার বিশদ ছক কলকাতার কমান্ড সদর দফতরের সঙ্গে আলােচনা করে ঠিক করা আবশ্যক ছিল। ২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে আমি কোলকাতায় উড়ে চলে গেলাম। সাক্ষাৎ করলাম পুরনাে বন্ধু জ্যাকবের সঙ্গে, যিনি জেনারেল অরােরার সমৰ্থ চীফ অব স্টাফ ছিলেন। তার সঙ্গে কিছু তথ্য বিনিময়ের পর আমাদের ফিরে আসাটা বিশদভাবে নির্ধারণ করে ফেললাম। আমি জানতে পারলাম আমার আধ্যাত্মিক গুরু বাবা ওংকারনাথ (বিখ্যাত বাঙালি সাধু) কোলকাতায় আছেন। সদ্যই তার একটা চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলাম। সঙ্গে নিলাম শেখ মনি (মুজিবের ভাগ্নে) -কে। বাবার চোখে ব্যান্ডেজ, তিনি শুয়ে ছিলেন, কিন্তু আমার আসার কথা শুনে তিনি পুলকিত হলেন। আমাকে তার প্রথম প্রশ্ন ছিল বিজয়ের পরে বাংলাদেশের অবস্থা সম্বন্ধে ।
আমি বললাম- “সব কিছু খান খান হয়ে যাচ্ছে মুজিব না থাকায় । উনি এখনও পাকিস্তানে বন্দি হয়ে আছেন।” তারপর আমি তার কাছে মনির পরিচয় দিলাম । বাবা দু’হাত জোড় করলেন এবং বললেন-“মাগাে (দেবীকে সম্বােধন করে), মুজিব বাংলাদেশের আত্মা । ঐ দেশটার জন্য যখন এত কিছু করলে, দয়া করে মুজিবকে এখনি মুক্ত করিয়ে দাও।” তারপর মনির দিকে ফিরে বাবা বললেন-“চিন্তা কোরাে না। মুজিব আসবে এবং সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।” এই আশীর্বাদের সঙ্গে উপহার হিশাবে বাবা মনিকে একটা শাল দিলেন। মনি অভিভূত হয়ে গেলেন। তার চোখে জল দেখা দিল। আমি এখন নিশ্চিত হলাম যে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক ঐ দিনই অপরাহ্নে আমরা রেডিও শুনছিলাম, আমরা শুনলাম যে ভুট্টো প্রকাশ্য ঘােষণা দিয়েছেন তিনি মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে যাচ্ছেন। এমন সব অবস্থায় এমনকি নাস্তিকরাও ঈশ্বর বিশ্বাসে ফিরে আসে। মনি সকালে বাবার দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী এবং একই দিনে তার সত্যে পরিণত হওয়া নিয়ে কথা তুললেন। তিনি পরদিন সকালে আমাদের ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে কিছু ফল ও ফুল নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। বাবার সঙ্গে আবার দেখা করার ও তার আশীর্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হল। ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন ও রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার সঙ্গে নিজের ফটো তােলার ব্যাপারে ব্যগ্র হলেন কোলকাতায় আমাদের পুরনাে যােগাযােগের কারণে, | কিন্তু ফটোগ্রাফার আসতে লম্বা সময় নেওয়ায় তা আর হল না, আমাকে রাঙামাটি ফেরার জন্য উড়ে যেতে হল আমাদের ফেরত যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। আমরা ডােগরা রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট-কর্নেল চোপরার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করলাম। উত্তর ও দক্ষিণ কলাম গুটিয়ে ফেলে তাদেরকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেওয়া হল বিশ্ব বিজয় নামক জাহাজে চড়ার জন্য। এই জাহাজেই আমার সকল সৈন্যের কোলকাতায় যাওয়ার কথা। আমি জানতে পারলাম শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি ও নতুন জাতির জনক হওয়ার জন্য ঢাকার পথে রয়েছেন। দিলি-তে তিনি গৃহীত হলেন শ্রীমতী গান্ধীর দ্বারা। তিনি নিজে তার সম্মানে শে-গান তুললেন এবং তার হৃদয় অধিকার করে সারাজীবনে তার যত বন্ধু ছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্ধু হলেন। চট্টগ্রামের চা সমিতির সেক্রেটারি কর্নেল জে এ হিউম যুদ্ধের কঠিন দিনগুলিতে তার রাজকন্যা স্ত্রীকে যত সাহায্য দিয়েছিলাম তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এলেন। রাজমাতা আমার সঙ্গে সাক্ষাতে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তখন পর্যন্ত কাস্টডিতে থাকা তার পুত্রদের ব্যাপারে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে পারি কি না। আমি প্রয়ােজনীয় সব কিছু করার কথা দিলাম এবং আমি তা করেছিলাম।
শেখের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বহু-প্রতীক্ষিত দিনটি এল আমি ঢাকাতে শেখের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের দিনক্ষণ স্থির হয়েছে আমার বন্ধু যুবনেতাদের মাধ্যমে আমি তার বাসায় পৌঁছনাের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল, তিনি উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে আলিঙ্গন করতে করতে বলতে লাগলেন-“আপনি আমার ভাই, আমার সত্যিকারের ভাই আপনি আমার জাতি, আমার বন্ধুগণ ও আমার পরিবারের জন্য যা করেছেন তা আমি কখনও ভুলতে পারব না। আমার সঙ্গে কখনও ফর্মাল হবেন না এ বাসাটা আপনার নিজের বলে মনে করবেন “আমি জানি আমাদের সাহায্য করার জন্য বহুবার আপনি আপনার জীবনবাজি রেখেছেন। আমি কোনও দিন তা ভুলব না…।” এইভাবে তিনি চালিয়ে গেলেন। শত শত মানুষ তার বাসার চারপাশে জড়াে হচ্ছিল শুধু তাকে একটু দেখে কৃতাৰ্থ বােধ করতে । তার একটা ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্ব ছিল। তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন, সহজেই আত্মহারা হতেন। ভাল করে না ভেবেই মুহূর্তের উদ্দীপনায় তিনি সিদ্ধান্ত দিতেন এবং ইতিমধ্যে তিনি একজন স্বৈরাচারীর মতাে আচরণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ করার মতাে তিনি একাই ছিলেন তাঁর ঢাকায় প্রত্যাবর্তনে প্রচুর আনন্দ উল-সি হয়েছিল । লাখ লাখ মানুষ বিমানবন্দরে এসেছিল তাকে স্বাগত জানাতে, তারপর তারা ঢাকায় থেকেও গিয়েছিল মুজিবের অধীনে স্বাধীনতা উপভােগ করতে। আশা উৗঁপানে | ধেয়ে যাচ্ছিল, সাধারণ মানুষ বােধ করছিল যেন-বা জাদুর কাঠির সাহায্যে অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধান হয়ে যাবে। সারা দুনিয়ার গরিব মানুষই এরকম । আস্থা পােষণ, ভক্তি করা, সৎভাবে শ্রম দিয়ে যাওয়া আর সব সময় আরও ভাল দিনের আশা পােষণ করা, যা কখনও আসে না। বাঙালির আরেকটা বাড়তি গুণ আছে ধৈর্যের সম্পূর্ণ অভাব এবং উচ্চমাত্রায় উত্তেজিত হওয়ার মতাে মেজাজ । এই যুদ্ধ বাংলাদেশকে ব্যাপক ধ্বংসের মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছিল। তার সকল শিল্প, যােগযােগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল। বিশ্বের সর্বোত্তম শুভেচ্ছাও যদি মেলে তবু বাংলাদেশের অর্থনীতির টলমলে অবস্থা ঠিক করে তুলতে এক দশক সময় লেগে যাওয়ার কথা ছিল। এমনতরাে পরিস্থিতির মধ্যে যদি একজন লােক ক্ষমতায় বসে এমন একটা দেশে যার জনগণ হচ্ছে বাঙালি জনগােষ্ঠীর মতাে সহজে জ্বলে ওঠা বস্তু, তাহলে সেই লােকটির জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না সাদর অভ্যর্থনায় উৎফুল- মন নিয়ে আমি মুজিবের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম এবং ভাবলাম ঈশ্বর এমন করলেন যে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে আমার মিশনের সুখকর সমাপ্তি দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হল। আমি একটা বড় পে-ন (এএন ১২) -এ বােঝাই করে দখল করা অস্ত্রশস্ত্র-গােলাগুলি আর্মি কর্তৃপক্ষসমূহের কাছে জমা দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিলাম।
ভারতে ফেরার জন্য ঢাকা ত্যাগের আগে আমার বন্ধু যুবনেতারা আমাকে শুভ বিদায়। জানাতে আসলেন। আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বন্ধুত্ব ছিল অনাগত সকল সময়ের জন্য এবং আমাদের সাধারণ সাফল্য সেই বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। ঐ দেশটার মাটির জন্য আমার গভীর ভালবাসা এবং যে সাহসী পুরুষ ও মহিলাদের নিয়ে ঐ জাতিটা গঠিত তাদের জন্য গভীর সশ্রদ্ধভাব গড়ে উঠেছিল। আমার পে-ন যখন পালামে অবতরণ করল, আমি লক্ষ করলাম ফুলের অনেক তােড়া নিয়ে মানুষ সমবেত হয়েছে, বুঝতে পারলাম না কাকে অভ্যর্থনা দিতে তারা এসেছে। যথাসময়ে দেখা গেল তারা আমার স্টাফ যারা আমাকে আগে একটা চমৎকার অভিনন্দন। জ্ঞাপক সংকেত বার্তা পাঠিয়েছিল এবং এখন বিমানবন্দরে আমাকে অভ্যর্থনা দিতে এসেছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমার বাসার দিকে ছুটলাম । তারা আমার প্রত্যাবর্তনের জন্য উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করছিল। এ ছিল আমার সুখী পুনর্মিলন। আমার সাহসী যুবক ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। জগদীপ সিং উবান, পরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, আমাকে দেখে পরম আনন্দিত হল। আমার অর্জনসমূহের জন্য তাকে গর্বিত বলে মনে হল। হায়! সে কর্তব্যরত অবস্থায় একটা বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করল এমন হঠাৎ করে এবং এত অল্প বয়সে যে, সে আমাদের জীবনে একটা গভীর অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে গেল। সে তার স্কোয়াড্রনে তার প্যারাশুট ঝাপগুলি সম্পন্ন করে যে প্যারা উইং অর্জন করেছিল তা গর্বের সাথে আমাকে দেখিয়েছিল। সে আমাদের যােদ্ধাঐতিহ্য সমৃদ্ধ করেছিল এবং তার মধুর স্মৃতির অ-নি সুরভি আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিল । ঈশ্বর তার আত্মাকে আশিসধন্য করুন। সে আমার ব্যাপারে আরও বেশি গর্ব অনুভব করেছিল যখন সে আমাকে লেখা এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল ডিএফসি -এর চিঠিটি দেখেছিল । সেই চিঠিতে অনেক কিছুর সঙ্গে এই কথাগুলি বলা হয়েছিল: আমার প্রিয় উবান তােমার কার্যকলাপের বিশদ বিবরণ কখনও ছাপা নাও হতে পারে কিন্তু আমি জানি পূর্বাঞ্চলে দ্রুত বিজয় আনয়নে তােমার ফোর্স একটা মস্ত ভূমিকা পালন করেছে…।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান