You dont have javascript enabled! Please enable it!

রণনীতিগত ধারণাসমূহ এবং প্রচলিত যুদ্ধ

আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘােষণার মাত্র ৫ দিন পরে বাংলাদেশে পরিস্থিতি পাকিস্তানি আর্মির কাছে অত্যন্ত কঠিন মনে হতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল ভারতীয় আর্মি ঢাকার দিকে চেপে আসছে। ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঢাকা থেকে বিদেশে নাগরিকদেরকে বিমানে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি চাইল। ৯ ডিসেম্বর গভর্নর মালেক এবং জেনারেল নিয়াযি ইসলামাবাদে একই সঙ্গে আলাদা আলাদা বার্তা পাঠালেন যে পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতররা এবং গভর্নর মালেক তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির ও রাজনৈতিক নিস্পত্তির অনুমতি চাইলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সম্মত হতে দ্বিধা করলেন না। তখন গভর্নর মালেক ঢাকায় জাতিসংঘের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হেনরিকে ধরে তাকে একটা যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। স্বভাবতই এই খবর ছড়িয়ে পড়ল এবং অনেকগুলি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হল। জেনারেল মানেকশ’ও পাকিস্তান ফোর্সের উদ্দেশ্যে একটা বিশেষ বার্তা প্রচার করে বললেন যে তারা নিজেদের নিরাপত্তা চাইলে তক্ষুনি তাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত। পাকিস্তানি সৈন্যরা ও তাদের কমান্ডারা এ পর্যায়ে বুঝল যে তারা হেরে গিয়েছে, কিন্তু সরকারি বিবৃতির অপেক্ষার সময় গুনতে লাগল । মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেল যখন ঢাকায় গভর্নমেন্ট হাউযের যে হলে গভর্নর মালেক গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে একটা সভা করছিলেন তখন, বেলা ১১ টার সময়, সেই হলেই ছাদের ওপর ভারতীয় মিগগুলি আঘাত হানল। তার একটু আগেই ইসলামাবাদে পাঠানাে তারবার্তা ভারতীয় পক্ষের কাছে ধরা পড়েছিল এবং বিমানবাহিনী তাদের নিখুঁত বােম্বিং -এর প্রমাণ দেওয়ার জন্য একটা সুযােগ পেল। গভর্নর ও তার উপদেষ্টারা দৌড়ে এয়ার রেইড শেল্টারে গিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এয়ার রেইড শেল্টার -এ বসে গভর্নর তার পদত্যাগ পত্র লিখলেন এবং বােমাবর্ষণ শেষ হলে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের নিরাপত্তায় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে উঠলেন। মিগগুলি বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাঁপিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণে প্রবুদ্ধ করলেও পাকিস্তানি আর্মির তাদের জিনিশপত্র বাঁধাছাদা করার আগে ঢাকার মধ্যে ভারতীয় আর্মির বড় বড় দলের আগমনের পক্ষে কিছু শক্ত প্রমাণ দরকার ছিল।

যখন অকুতােভয় জেনারেল সগত মেঘনা নদীর অপর পাড়ে তার ফর্মেশনগুলিকে জড়াে করার জন্য তখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন তখন মাউন্টেন গানাররা (ভারতীয় আর্টিলারির এলিট অংশ) ৬৫ মাউন্টেন রেজিমেন্টের গানগুলিকে বুলে ঘাড়ে করে নিয়ে এসে ঢাকার ভিতরের লক্ষ্যবস্তুগুলিতে গােলা দাগাল । তাতে শুধু ৫৭ ইনফ্রান্ট্রি ডিভিশনের ঢাকার উপকণ্ঠে আগমন ঘােষিত হল না। পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাকারীদের বাধাছাদা করার অবশ্য প্রয়ােজনীয়তার কথাও ঘােষিত হল। ঘটনাক্রমে জেনারেল চৌধুরী (ডাকনাম মূছু) দেশভাগের অব্যবহিত পরে হায়দ্রাবাদে পুলিশ অ্যাকশনের সময় ধর্মান্ধ রাযাকারদেরকে (যারা সশষ গুলি ও শেষ যােদ্ধা পর্যন্ত লড়তে চেয়েছিল) একই চাতুরি দ্বারা জান নিয়ে পলায়নে মনস্থ করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি ৪০ মিডিয়াম রেজিমেন্টের একজন সৈন্য দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলির ওপর শেষ দাগিয়েছিলেন, তারপর পদাতিকদেরকে অগ্রসর হতে দিয়েছিলেন। মাত্র চারটা ২০০ পাউন্ডের শেল দমাদম ঠিক ঠিক জায়গামতাে পড়তেই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তারপর শুধু সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাওয়া। জেনারেল নিয়াযি ঢাকাস্থ মার্কিন কন্সাল জেনারেল মি. স্পিভাক -এর মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাঠানােয় এবং মি. স্পিভাক প্রতিটি বার্তা ওয়াশিংটনের মাধ্যমে পাকিস্ত েিন বা ভারতে পৌছাতেন বলে মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষের পাকিস্তান ফোর্সের মনােবলের অবস্থা জানতে বাকি রইল না, ফলে তাদের উদ্ধারে সপ্তম নৌবহরের অগ্রগমণ ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ মিইয়ে গেল। মেজর জেনারেল নাগরা, বীর ভারতীয় জেনারেল, যখন পাকিস্তানি সেন্যদের আত্মসমর্পণের শর্তাবলি আলােচনা করতে জেনারেল এ কে কে নিয়াযির সদর দফতরে গাড়িতে করে গেলেন তখন তাঁর কাছে নিয়াযির প্রথম মন্তব্য ছিল, “পিন্ডিতে বসে থাকা হারামজাদারা যুক্তরাষ্ট্রকে চেটে চুপসে দিয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব অতঃপর খুব শিগগিরই পাকিস্তান আর্মির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া সহ সেখানে পৌঁছলেন। এর পরে খুব শিগগিরই একটা হেলিকপ্টার ফর্মেশন জেনারেল অরােরা ও তার স্ত্রী, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ভাইস। অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল সগত সিং ও তার ডিভিশনাল কমান্ডারগণ-এঁদেরকে বহন করে সেখানে যায়।

শ্রীমতী অরােরা বাদে এঁরা সবাই ছিলেন বাংলাদেশ যুদ্ধের নায়ক। জেনারেল অরােরা সম্ভবত শ্ৰীমতী অরােরাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন যাতে নিয়াযির কাছে আত্মসমর্পণের মর্মাঘাতটা একটু নরম হয় । ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে এক দর্শনীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে লেফটেন্যান্ট-জেনারেল নিয়াযি ও লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। তখন উপস্থিত ছিল লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি যাদের কেউ কেউ তাদের সাবেক অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রাগে টগবগ করছিল। এর সাথে ৯০ হাজারের বেশি যুদ্ধবন্দি ভারতীয় আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনী এবং অন্য যারা দুর্ভোগ ভূগেছিল। তাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য আবেদন করল। এটা দুঃখজনক যে কর্নেল এমএজি ওসমানী, যিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশের সাময়িক সরকার কর্তৃক মুক্তিবাহিনীর চীফ হিশাবে নিয়ােজিত হয়েছিলেন, যিনি মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে এত কিছু করেছেন, এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না যদিও তার উপস্থিত থাকার হক ছিল । গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বাংলাদেশ বাহিনীগুলির প্রতিনিধিত্ব করলেন। কেউ একজন নৈতিক ভুলটা করে বাংলাদেশ আর্মির সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার একটা ঐতিহাসিক সুযােগ নষ্ট করেছিল।

এসব কী করে ঘটল?

আমার যখন শিলং -এ ২২ মাউন্টেন রেজিমেন্টের কমান্ডে পােস্টিং ছিল তখন একবার বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান বলে পরিচিত) -এর সীমান্ত পরিদর্শন করা হয়েছিল আমার। সেখানে অনেকগুলি স্রোতস্বিনী পরস্পরকে ছেদ করে বয়ে যাচ্ছিল, স্থানটা গাছপালায় ঠাসা ও ছায়াচ্ছন্ন ছিল। এই দেখে আমার ধারণা হয়েছিল যে এমন স্থানে অল্প কিছু সংখ্যক দৃঢ়সংকল্প ও উত্তমরূপে সশস্ত্র লােক, ফর্মেশনসমূহ ও ডিভিশনসমূহের অগ্রগমণ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত করতে পারে। ট্যাংক খুব কমই কাজ লাগবে এবং বিমানবাহিনী খুবই কম সমর্থন জোগাতে পারবে এত গাছপালা ও ছায়াচ্ছন্নতার কারণে। বৃষ্টিবহুল এলাকা হওয়ায় এখানে ফীল্ড গান ও ভারী কামান কাদায় আটকে যাবে। এটা একটা অতি উত্তম গেরিলা যুদ্ধের স্থান যেখানে জন্তুর পিঠে বওয়া মাউন্টেন গানের সমর্থনে শক্তসমর্থ পদাতিক সৈন্যই একমাত্র সম্ভাবনা। আমি আসলে গর্ব করেই একটা সভায় বলেছিলাম যে আমাকে একটা পদাতিক ডিভিশন নিয়ে এই এলাকাটার প্রতিরক্ষার ভার দিলে আমি যে কোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকাল ধরে লড়াই চালাতে পারব এবং এই ভূমিতে, বিশেষত বর্ষাকালে, মেকানাইযড ফর্মেশনগুলি। সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারবে অথবা কোনও ভূমিকাই রাখতে পারবে না । তাহলে ৫টি ডিভিশনের বেশি সুসজ্জিত ও শক্তসমর্থ পাকিস্তানি সৈন্য লড়াই -এর ১৪ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করল, এটা কেমন করে হল?

স্ট্রাটেজিক ডিরেকশন

ভারত সব যুদ্ধই হচেছ মূলত মনের লড়াই-শুধু পরস্পর বিরােধী ফর্মেশন কমান্ডারদের মনের নয় বরং যে বেসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের আগে যুদ্ধের সময়ে এবং যুদ্ধের পরে জাতিসমূহের জীবন -এরণ সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করে তাদেরও মনের। ভারতের সৌভাগ্য হয়েছিল যে সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম একজন মহিলা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিশাবে পেয়েছিল। তিনি সহায়তা লাভ করেছিলেন এই অপারেশনের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রী ডিপি ধর -এর মতাে একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকের, শ্রী পিএন হাকসার -এর মতাে কয়েকজন সবচেয়ে পারদর্শী সিভিল অফিসারের, একজন অসাধারণ বিদেশ সচিব শ্রী টিএন কাউল -এর। বহির্দেশীয় গােয়েন্দা তৎপরতা ছিল শ্রী আরএন কাও -এর দক্ষ হাতে। অভিজ্ঞতা ও মেধায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। যাতে পরাশক্তির জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে এমন একটা যুদ্ধ চালানাের জন্য উপরিস্তরে এর চেয়ে ভাল ও এর চেয়ে সুসমম্বিত সমাহার কোনও দেশ কামনা করতে পারে না। এই নেতাদেরকে ঠাণ্ডা ও ধীরস্থির মনে হত এবং প্রায়ই একটা অ্যাকাডেমিক পরিষদের মতাে মনে হত কিন্তু তাঁদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সামনে দিয়ে কোনও কিছু এড়িয়ে যেতে পারত না। কোনও ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত, তা যতই ঝুঁকিপূর্ণ হােক, গ্রহণে তাঁদের কখনও দেরি হত না। প্রতিরক্ষা সেট-আপও একই রকম সুসমন্বিত এবং সক্ষম ছিল। জেনারেল (এখন ফীল্ড মার্শাল) এসএইচএফ জে মানেকশ’ এমসি-কে তার ব্যক্তিগত আকর্ষণি ক্ষমতা এবং দক্ষতার জন্য তার সহকর্মী বিমানবাহিনীর এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল ডিএফসি এবং নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ ভালবাসতেন ও সম্মান করতেন। এই সব ক’জনেরই অবস্থান ছিল দিলি-তে সুতরাং পরামর্শের জন্য সকলকেই পাওয়া যেত। চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ সিস্টেম যাতে তিনটি সার্ভিসই একজন ব্যক্তির কমান্ডের অধীনে আসে, তার পক্ষে অনেক কথাই বলা হয়েছে।

এর সুবিধা ও অসুবিধা দুইই আছে এবং আমি মনে করি ভারতের জন্য এটা একান্ত আবশ্যক নয়। আমাদের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে যাতে চীফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব চক্রায়িত হয়ে একেক টার্মের জন্য আর্মি নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর চীফদের মধ্যে ঘুরতে থাকে, তা মুক্ত আলােচনা ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতার সৃষ্টি করে, ফলে তার পক্ষে সুপারিশমূলক অনেক কিছু বলার থাকে। এই সময় কালে ফীল্ড মার্শাল মানেকশ ছিলেন চেয়ারম্যান এবং তিনি বিস্ময়করভাবে কাজ চালিয়েছিলেন। রণরঙ্গমঞ্চ পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশ অপারেশনসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসিইন-সি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জে এস অরােরা শিলং -এ এয়ার মার্শাল এসি দেওয়ান পিভিএসএম এবং ভিসাখাপটনম -এ ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃঞ্চান -এর সঙ্গে একত্রে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য তাঁদের সঙ্গে সংস্পর্শ বজায় রাখতেন। হয়তাে তিনজনই একটি স্থানে, যেমন কলকাতায়, সংস্থিত হলেই আরও ভাল হত, কিন্তু তাতে সমস্যা ছিল এবং বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদর দফতর যেখানে তার কমান্ড সবচেয়ে ভালভাবে কার্যকর করা যায় সেই সেই স্থানে সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে ভাল বলে মনে করা হয়েছিল। সন্দেহ নেই এই তিন বাহুর মধ্যে দ্রুত যােগাযােগের জন্য লিয়ােযে অফিসাররা পূর্বাঞ্চল কমান্ড সদর দফতরেই অবস্থান করতেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ইউনিটগুলি যেমন ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলস মুক্তিবাহিনীর ভলান্টিয়ারদের সাথে সাথে বিভিন্ন সীমান্তে ছড়িয়ে যাওয়া ফর্মেশনগুলির কমান্ডের অধীনে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল আর তাদের চীফ কর্নেল ওসমানী কলকাতায় জেনারেল অরােরার সদর দফতরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকতেন।

পাকিস্তান

পাকিস্তানের কোনও বেসামরিক সেট-আপ ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সবগুলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান। এমন পরিস্থিতিতে একটা মানুষ যদি ক্ষমতার সবগুলি আসন দখল করে থাকে তবে সে এ অবস্থায় যেমন, তার চেয়ে বেশি করুণাযযাগ্য আর কোনও অবস্থায় হতে পারে না, বিশেষত যদি তার যােগ্যতা অত্যধিক সীমিত থাকে । একমাত্র রাজনৈতিক নেতা জনাব যেড এ ভুট্টো তার সকল উপযােগিতা নিঃশেষ করেছিলেন রাজনৈতিক প্রশ্ন মীমাংসায় সাহায্য করতে শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে লােক দেখানাে সংলাপে অংশগ্রহণের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গী হয়ে এবং শেষে চট্টগ্রামে টিক্কা খানের পাইকারি হত্যাযজ্ঞ অনুমােদনপূর্বক এই কথা বলে যে-“খােদাকে ধন্যবাদ । এই হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা হল। পাকিস্তানি জেনারেলদেরকে সমর্থনের খেসারত পরে। তাকে দিতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি পাখায় ভর করে অপেক্ষা করছিলেন পরিস্থিতি অনুকূল হলেই পাকিস্তানের পরবর্তী বেসামরিক একাধিকপতি হিশাবে ক্ষমতা গ্রহণের আশায়। ইতিমধ্যে তিনি ৫ নভেম্বর একটা পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে পিকিং গেলেন যুদ্ধে তাদের সমর্থন চাইতে।

রণনীতি

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝােতা ঘটানােয় পাকিস্তানের ভূমিকার পুরস্কার হিশাবে তারা এই দুটি দেশ থেকে শক্তিশালী সমর্থন আশা করছিল, যার ওপর ভিত্তিশীল ছিল তাদের রণনীতি। ৯ আগস্ট ১৯৭১ -এ স্বাক্ষরিত ইন্দো-সােভিয়েত বন্ধুত্ব চুক্তিতে অপেক্ষমান বিপর্যয়ে কোনও প্রভাব সৃষ্টির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন অক্ষের কার্যকারিতা কাটাকাটি হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (বা তাদের অনুরােধে জাতিসংঘের) হস্তক্ষেপের আশা পাকিস্তানে চালু ছিল, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল একটা প্রতিরক্ষামূলক লড়াই লড়ে যাওয়ার, যাতে তাদের জেতার কোনও আশা ছিল না। তার ওপরে নিয়াযি এমন এক টেকনিক বেছে নিলেন যাতে এমনকি তাদের পরাজয়ে বিলম্ব হবে না এবং তাদের বন্ধুরা তাদের সাহায্যে আসারও সুযােগ পাবে না। নিয়াযি সদ্য পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট-জেনারেল হয়ে এসেছিলেন। তাকে কাজ দেওয়া হয়েছিল “অভ্যন্তরীণ নাশকতা ঠেকাতে এবং বহিরাগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে । প্রথম অংশ, অভ্যন্তরীণ নাশকতা ঠেকানাে একটা নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষত যখন সমগ্র জনগণ তীব্র অসন্তোষে টগবগ করছে এবং ভিন্ন জনগােষ্ঠীর দখলদার বাহিনীর প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু পােষণ করছে না। “বহিরাগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা” কাজটা রাজনৈতিক বা সামরিক কোনও পরিভাষাতেই পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না। কোনও লিখিত ডিরেক্টিভ বা ইন্সট্রাকশন জেনারেল নিয়াযিকে দেওয়া হয়নি। তাকে কেউ ব্রীফ করেনি। এটা সত্যি তাজ্জবের ব্যাপার যে জেনারেল নিয়াযি এই অবস্থার মধ্যে নিজের সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখাতে কোনও লিখিত ব্রীফ বা ইন্ট্রাকশন -এর জন্য তাগিদ দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। এ পর্যায়ের একজন সামরিক কমান্ডারের একটা লিখিত ব্রীফ বা ইন্সট্রাকশন। ছাড়া এক পা-ও অগ্রসর হওয়ার কথা নয়। যদিও সেপ্টেম্বর ১৯৭১ -এ দায়িত্ব নেওয়ার সময় জেনারেল নিয়াযির কাছে এটা দিনের আলাের মতাে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে তার উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় আর্মি উন্মুখ ও প্রস্তুত হয়ে আছে, তবু তিনি নিজেকে এই বিশ্বাসে প্রবুদ্ধ করলেন যে ভারতীয় আর্মির একমাত্র লক্ষ্য পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পাকিস্তানি শরণার্থীদের সরিয়ে আনার ও একটা সাময়িক বাংলাদেশ সরকার বসিয়ে দেওয়ার মতাে যথেষ্ট বড় এলাকায় ঘাঁটি গাড়া।

সুতরাং তিনি শক্রর এই লক্ষ্য অর্জন ঠেকাতে তাঁর দায়িত্বাধীন প্রতি ইঞ্চি ভূমির সামগ্রিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিলেন। বিশেষত তিনি চাইলেন ভারতীয় আর্মি যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ শহর হস্তগত না করে। কারণ তাতে করে রাজনৈতিক হেডলাইন – এর সুযােগ সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং তিনি যেখানে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছে সেই পর্যন্ত বড় বড় লড়াই চালানাের জন্য তার সৈন্যদেরকে ছড়িয়ে দিলেন। শহরের প্রতিরক্ষা দারুণ ব্যাপার, অনেক শহরের প্রতিরক্ষা ইতিহাসের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কে পরিণত হয়েছে যেমন স্তালিগ্রাদের প্রতিরক্ষা। সুতরাং তিনি সীমান্ত বরাবর সড়কগুলির গায়ে পড়ে এমন শহর যেমন চট্টগ্রাম, কুমিল, ভৈরববাজার, সিলেট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রংপুর, বগুড়া, ঝিনাইদহ এবং যশোর বাছাই করলেন। এবং সেগুলিকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে প্রয়ােজনে শেষ গুলি এবং শেষ মানুষটি পর্যন্ত সেগুলি রক্ষা করতে হবে এমন আদেশ দিলেন। জেনারেল নিয়াযির পরিকল্পনা পাক আর্মি সদর দফতরে অনুমােদিত হল। পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার-ইন-চীফ জেনারেল হামিদ জেনারেল নিয়াযি কর্তৃক দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তার সঙ্গে সাক্ষাতে এসেছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন। তিনি অবশ্য বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ঢাকাকে চূড়ান্ত রকমের গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এটা অবশ্য সুস্পষ্টভাবেই বােধগম্য । আমি নিশ্চিত যে নিয়াযি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং তার সৈন্যরা প্রয়ােজনে ঢাকার প্রতিরক্ষায় হটে আসুক সেটা তার পকিল্পনার মধ্যে ছিল কিন্তু তিনি। তার কোনও অধস্তন কমান্ডারকে কখনও এর বিন্দুমাত্র আভা দেখাননি পাছে তাদের মনােবল ভেঙে যায় এবং তারা যথাসময়ের আগেই হটে আসতে শুরু করে। অবশ্য এই দায়িত্বে মােতায়েন তাঁর ৩৬ পদাতিক ডিভিশনের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকার কাছাকাছি অন্যান্য ফর্মেশনগুলির সাহায্যে ঢাকার প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারার কোনও কারণ ছিল না। এই শহরগুলিই ভারতীয় আর্মি ফর্মেশনগুলির প্রথম লক্ষ্যস্থল করা হবে নিয়াযির এই হিশাব ঠিক ছিল কিন্তু ভারতীয় আর্মি কখনও এগুলিকে পাশ কাটিয়ে রণাঙ্গনের কেন্দ্রস্থল ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে না এটা ভাবা তাঁর ভুল হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের নিমরূপে মােতায়েন করা হয়েছিল।

উত্তর-পশ্চিম সেক্টর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরে শিলিগুড়ি করিডাের যা পূর্বাঞ্চলকে ভারতের সমগ্র বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করে এবং যা চুম্বি উপত্যকার চীনা ঘাঁটিগুলির অনায়াস নাগালের মধ্যে। এই সেক্টরে আরও দক্ষিণে হিলি-গাইবান্ধায় ছিল আরেকটি করিড়াের যা সমগ্র পাকিস্তানি বাহিনীকে দক্ষিণে আটকে রাখতে পারে এবং সকল শর্ত পূর্ণ করে একটা সীমিত আক্রমণের যা ভারত আশা করছিল। ১৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নযর হােসােইন শাহ-কে এই সেক্টরে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তার জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল ১০টা পদাতিক ব্যাটালিয়ন, একটা মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন এবং এক রেজিমেন্ট চাফী ট্যাংক। দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর। গােয়ালন্দ ঘাট ফেরি এর মধ্য দিয়ে গিয়েছে । এই গােয়ালন্দ ঘাট ফেরি হয়ে পুরনাে পথে কোলকাতা থেকে ঢাকা নিকটতম দূরত্বে অবস্থিত । গুরুত্বপূর্ণ শহর যশাের ও খুলনা ছাড়াও চালনা বন্দর এর মধ্যে পড়ে। এর প্রতিরক্ষায় ছিল মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারির ডিভিশনের ৮টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং এক স্কোয়াড্রন চাফী ট্যাংক।

কেন্দ্রীয় সেক্টর। এই সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল টাঙ্গাইল ও ঢাকা । এটা সব দিকেই নদী দিয়ে ঘেরা এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। এর প্রতিরক্ষা দেওয়া হয়েছিল ৩৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদ খান-কে। মাত্র দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান এবং একটা মটার ব্যাটারি তাকে দেওয়া হয়েছিল । এবং কোনও আমার নয়। পূর্ব সেক্টর। এখান থেকেই ঢাকার দিকে হ্রস্বতম পথ । উত্তর দিকে সিলেট মুক্তিবাহিনীর অপারেশন চালানোের চমৎকার সুযােগ দিয়েছিল আর দক্ষিণে চট্টগ্রাম একমাত্র বন্দর যা শক্তিবৃদ্ধির জন্য প্রয়ােজনীয় আনয়ন এবং উদ্ধার কাজে ব্যবহার করা যেত সুতরাং একে প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনের উর্ধ্ব স্থানে রাখার যােগ্য বলে বিবেচনা করা হল। জেনারেল নিয়াযি এই সেক্টরের দায়িত্বে দেন দুটি ডিভিশনকে যাতে ছিল ১৪টা পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং এক স্কোয়াড্রন আর্মার। চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষার কাজে একটা বিগ্রেড গ্রুপকে লাগানাে হয়েছিল । নভেম্বরে এই দক্ষিণ অংশে বলবৃদ্ধি করা হয়েছিল কারণ তখন নিয়াযি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতের তরফ থেকে প্রধান ধাক্কাটা এই দিক দিয়েই আসছে। নিয়মিত সৈন্য ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিরাটসংখ্যক চীনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিযযা এবং পাকিস্তান থেকে আসা আধা-সামরিক বাহিনীসমূহ মােতায়েন করা হয়েছিল, শুধু বন্দরটির নিরাপত্তার জন্যই নয়, আবশ্যক হলে চূড়ান্ত পশ্চাদপসরণের জন্য চট্টগ্রাম থেকে বার্মার দিকে যাওয়া আরাকান রােড -কে মুক্ত রাখার জন্যও। মিয়াে ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেতা লাল ডেংগা তার সদর দফতর রেখেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে। পাক আধা-সামরিক বাহিনীগুলি পর্বতসারি বরাবর একবারে কক্সবাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। পাকিস্তানি আর্মি তার উদ্ধারের অতীত ধ্বংসের জন্য এইভাবে নিজেকে বিন্যস্ত করেছিল। তারা সামরিক আবশ্যকতাকে রাজনৈতিক কাম্যতার অধীন করেছিল। তারা ভারতীয় মহানগরগুলিতে বােমাবর্ষণের সাথে যুদ্ধ ঘঘাষণার জন্য সময় বেছে নিল। মৌসুমি বৃষ্টির সময় নয় যখন ভারতীয় আর্মি কাদায় আটকে যেত এবং প-বিনে উপচে পড়া নদীগুলির পারাপারে আটকে থাকত কারণ কোনও যােগাযােগ ব্যবস্থাই কাজ করত । যুদ্ধ ঘােষণা তারা করল ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ -এ যখন যন্ত্রায়িত ভারতীয় আর্মি ভূমির ওপর দিয়ে শ শ করে এগিয়ে যেতে পারত, তা করার জন্য সম্পূর্ণ তৈরিও ছিল, যখন উত্তরের গিরিপথগুলি তুষারপাতে আটকে গিয়েছিল ফলে চীনারা এমনকি ইচ্ছা করলেও পাকিস্তানকে সাহায্য করার অবস্থায় ছিল না।

বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি

কিছু সামরিক পরাকৌশলী বাতলেছিলেন যে এপ্রিল (১৯৭১) -এর প্রথম ভাগই ছিল ভারতীয় আক্রমণের জন্য সবচেয়ে ভাল সময় কারণ তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র প্রায় এক ডিভিশনের সমান শক্তি ছিল, উত্তরের গিরিপথগুলি তখনও তুষারে আটকানাে। ছিল, এবং আক্রমণের এলাকার কাছে-পিঠে ভারতীয় আর্মির যথেষ্ট সৈন্য উপস্থিত ছিল। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী ডিসেম্বরে যা করেছিল তেমনই কার্যকারী ভূমিকা। তখনও রাখতে পারত। আমি অনুভব করি তখন যদি জয়লাভ হতও, এমন দর্শনীয় বিজয় হত না এবং যথেষ্ট পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির অভাবের কারণে আমাদের আক্রমণ ব্যর্থও হতে পারত। পরিপূর্ণ প্রস্তুতি পর অপারেশন হাতে নেওয়ার জন্য পূর্ণ কৃতিত্ব ফীল্ড মার্শাল মানেকশ’-কে দেওয়া উচিত। তিনি জনমত বা রাজনৈতিক চাপের খপ্পরে পড়ে গেলে বিশাল বিজয়ের দ্বারা তিনি যে উচ্চতা লাভ করেছেন তা করতেন না। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে পরিকল্পনা হয়েছিল খুঁটিনাটি ব্যাপারে পর্যন্ত অতি সতর্কতার সাথে। অন্য রকম হওয়ার যাে ছিল না কারণ চীফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ছিলেন একজন দক্ষ অফিসার। জেনারেল অরােরার বিশেষ যােগ্যতাও ছিল পরিকল্পনায় এবং প্রশিক্ষণে। সার্ভিস জীবনে এ দুটিতে তার ভাল রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরিকল্পনাটা যথেষ্ট সাহসী পরিকল্পনা ছিল না এই মর্মে যে সমালােচনা করা হয়ে থাকে তার মধ্যে কিছু সারবস্তু রয়েছে। পরিকল্পনা ততটা সাহসী হতে পারে যতটা তার কার্যনির্বাহের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডাররা ও সৈন্যরা সাহসী এবং উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্য। ব্যবহার্য সাজসরঞ্জামাদির প্রাপ্যতা যতখানি। এই যুদ্ধের একজন প্রখ্যাত কমান্ডার জেনারেল লক্ষ্মণ সিং তার অসাধারণ বই ভিক্টরি ইন বাংলাদেশ -এ মন্তব্য করেছেন যে ভারতীয় আর্মিকে জারি কর আদেশাবলিতে ঢাকা দখলের কোনও উলে-খ ছিল না সুতরাং নদীর বাধাসমূহ অতিক্রম করার অথবা হেলিকপ্টারের সাহায্যে ওপর থেকে ঢাকাকে আচ্ছাদনের পরিকল্পনার অভাব ছিল । আমাদের কোনও হেলিকপ্টার বহর ছিল না এবং আমাদের যে সীমিত সংখ্যক এমই৪ হেলিকপ্টার ছিল তা আর্মির প্রশিক্ষণ ও ব্যবহারের অবিচ্ছিন্ন অংশ ছিল না।

প্রাথমিকভাবে সেগুলি ছিল প্রশাসনিক কাজে এবং হতাহতদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যবহার্য বিমানবাহিনীর দায়িত্বাধীন হেলিকপ্টার। আধুনিক যুদ্ধ ব্যাপারে এটা একটা গুরুতরাে শূন্যতা এবং এর একটা সমাধান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা উচিত। কিন্তু ১৯৭১ -এ যুদ্ধে একটা আবশ্যিক প্রয়ােজন হিশাবে আর্মি এগুলি চাওয়ার কোনও প্রচেষ্টাই নেয়নি বা এই দিকটির কোনও প্রশিক্ষণই চালায়নি। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে আমাদের জেনারেল সগত সিং এবং জেনারেল গন্যালভেস ছিলেন প্যারাট্রুপার এবং তারা তাদেরকে দেওয়া অল্পসংখ্যক হেলিকপ্টারের চমৎকার ব্যবহার করেছেন মেঘনা নদী পাড়ি দিতে ও ঢাকায় পৌছতে। আসলে জেনারেল সগত তাকে দেওয়া হেলিকপ্টারগুলি কখনও তার নজরের বাইরে যেতে দেননি এবং ঠিক এই উদ্দেশ্যে। সেগুলি ব্যবহারের সুযােগের জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলেন। তার পার্শ্বে থেকে অসম সাহসের সাথে লড়াই -এ রত আমার স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে একটিও হেলিকপ্টার না দেওয়ার জন্য জেনারেল সগতের বিরুদ্ধে আমার নিজের অভিযােগের উৎস এই সূত্রটিই। আর্মি বা কমান্ড সদর দফতর ঢাকাকে লক্ষ্যস্থল হিশাবে উলে-খ করেনি এই মর্মে জেনারেল লক্ষ্মনের অভিযােগের প্রতি সম্মান রেখেই আমি বলব যে যদিও ঢাকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল, কিন্তু সেটা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক দুর্গনগর ছিল না। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারকে প্রদত্ত করণীয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীগুলির বিপুলাংশকে ধ্বংস করা। এই লক্ষ্য একবার অর্জিত হয়ে গেলে ঢাকাতে হেঁটে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়াটাই বাকি থাকে। ঘটনাক্রমে পাকিস্তানি সৈন্যরা সর্বত্র পরাজিত হওয়ার পরও ৪ কোর সঠিক সময়ে ঢাকার পথে পা বাড়ায়নি। এটা ঠিক যে বাংলাদেশের অপারেশনের মতাে মস্ত অপারেশনের প্রথম পর্যায় শুরু করার পর প্রথম পর্যায়টা সমাপ্ত হওয়ার ফলে বা আগে থেকে আন্দাজ না করা কোনও ঘটনাচক্রে, চূড়ান্ত লক্ষ্যস্থলের ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন হল কি না সে সম্বন্ধে সিনিয়র কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, প্রায়ই এমনটা হয়। কিন্তু সবগুলি সম্ভাব্য-চূড়ান্ত-লক্ষ্য পরিস্থিতির জন্য আলাদা আলাদা বিকল্প পরিকল্পনা রণরঙ্গমঞ্চের কমান্ডাররা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আগে থেকেই ভালভাবেই চিন্তা করে রাখেন। যা হােক, অনেক আগে থেকে সৈন্যদের বিশেষত যারা ঢাকার সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল তাদের দ্রুত নদী পার হওয়ার কোনও প্রস্তুতি না রাখার পক্ষে কোনও চলনসই কৈফিয়ত বা ওজর নেই।

ঢাকাকে উপরে থেকে আচ্ছাদনের অর্থাৎ ঢাকাতে ওপর থেকে অবতরণের কোনও পূর্ববন্দোবস্ত না রাখা সম্বন্ধেও একই কথা। আমি সত্যি বিস্ময়ে চমকে গিয়েছিলাম এটা জেনে যে ফর্মেশনগুলির কাছে প্রস্তুতকৃত পরিকল্পনা তুলে দেওয়া হয়েছিল সে অনুযায়ী কাজ করে যাওয়ার জন্য, কিন্তু নিচের ফর্মেশনগুলি যে সচরাচর নিজ নিজ পরিকল্পনা তৈরির অনুশীলন করে থাকে এবং উচ্চতর পর্যায়গুলিতে সেগুলির সমন্বয় করে থাকে তেমন কিছু করা হয়নি। তার জন্য প্রচুর সময় ছিল আর লড়াই -এর দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদেরকে আগেই পরিকল্পনায় সংশি-ষ্ট করলে নিশ্চয়ই ভাল হত । সে যাই হােক ভারতীয় আর্মিকে নিম্নলিখিত বিন্যাসে মােতায়েন করা হয়েছিল। উত্তর পশ্চিম সেক্টর। ৩৩ কোর -এর জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল থাপার ছিলেন পূর্বাঞ্চলে একমাত্র জেনারেল অফিসার যিনি আগের কোনও লড়াই -এ ডিভিশন কমান্ড করেছিলেন। তাঁকে দেওয়া হল হিলি-গাইবান্ধা করিডােরের কটিরেখা বরাবর কেটে দক্ষিণে বগুড়া ও উত্তরে রংপুর দখল করার কাজ। অধিকন্তু তাঁর জন্য ২০ মাউন্টেন ডিভিশন, একটা অতিরিক্ত পদাতিক ব্যাটালিয়ান, এক-স্কোয়াড্রন-কম দুটি আর্মারড রেজিমেন্ট এবং একটা ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড। তদুপরি উত্তর দিক থেকে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের কাজ করার কথা রইল। রণনীতিগত দিক থেকে এটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর সুতরাং শত্রুর মােতায়েনকৃত শক্তি এবং ভালভাবে প্রস্তুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসমূহ বরাবর তার প্রতিরােধ, দুই-ই ছিল সবচেয়ে ভারী। এই সেক্টরে প্রধান আক্রমণটি চালিয়েছিল মেজর জেনারেল লক্ষ্মণ সিং বীর চক্র -এর অধীন ২০ মাউন্টেন ডিভিশন। তিনি আমারের ব্যবহারে ও তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনে দারুণ চমৎকারিত্ব দেখালেন। দুর্ভাগ্যক্রমে কোর এবং ডিভিশনাল কমান্ডের উপদেশের বিরুদ্ধে জেনারেল অরােরা নিজে হিলির সজাগ প্রতিরক্ষাসমূহের বিরুদ্ধে একটা সরসরি আঘাত হানার আদেশ দিলেন যাতে তিনি আমার -এর ব্যবহারও নিষেধ করলেন। এই আক্রমণ এবং হিলির বিরুদ্ধে আরও কিছু সামনাসামনি আক্রমণ ব্যর্থ হল, যেমন হওয়ার কথা ছিল, এবং এতে ভারী রকমের ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হল। পরে স্থানীয় কমান্ডারদের অনুরােধে কমান্ড সদর দফতর থেকে পরিকল্পনাসমূহ সংশােধন করা হল। এটা ছিল সবচেয়ে শক্ত লড়াইসমূহের একটা এবং এটা ২৩ নভেম্বর থেকে আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত চলেছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর। কোলকাতার সবচেয়ে কাছের সেক্টরটি দেওয়া হল সম্প্রতি পদোন্নতিপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ২-কোর -এর লেফটেন্যান্ট-জেনারেল টি এন রায়না এমভিসি-কে। তিনি ১৯৬২ -এর চীনা যুদ্ধের একজন পক সৈনিক। পরে তিনি ভারতীয় আর্মির চীফ অব স্টাফ হয়েছিলেন।

কোর সদর দফতরটিকে অক্টোবরে দুটি ডিভিশন, এক-ব্যাটালিয়নকম এক প্যারাশুট ব্রিগেড এবং অতিরিক্ত এক স্কোয়াড্রনসহ এক আর্মারড রেজিমেন্ট -এর নিয়ন্ত্রকে উন্নীত করা হয়েছিল। যশাের ও খুলনায়-চালনা দখল তাদের কাজ ছিল। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড এই কোর -এর বিভিন্ন ফর্মেশনকে সময় বাঁধা লক্ষ্য অর্জনের দায়িত্ব দিয়েছিল এবং তাদের চোখ থাকার কথা ছিল ঢাকার দিকে। সময় বাঁধা দায়িত্ব দেওয়া একটা সঠিক কাজ ছিল। মেজর জেনারেল এমএস ব্রার -এর কমান্ডে ৪ মাউন্টেন ডিভিশন (রেড ঈগল) এবং ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল দলবীর সিং -এর কমান্ডে উক্ত ডিভিশন কতকগুলি শক্ত রকমের লড়াইয়ের মাধ্যমে যথাক্রমে ঝিনাইদহ সেক্টর ও যশোর সেক্টর হস্তগত করেছিল। কেন্দ্রীয় সেক্টর। এই সেক্টর ছিল ঢাকার সবচেয়ে কাছে তবু যুধ্যমান উভয় পক্ষই একে সবচেয়ে কম অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এই সেক্টরের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে এখানে ছিলেন বাঘা সিদ্দিকী, একজন বাঙালি গেরিলা নেতা যিনি পাকিস্তানি বাহিনীগুলির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে তার টাঙ্গাইল এলাকাকে শত্রু সৈন্য থেকে মুক্ত রেখেছিলেন। এই দেশপ্রেমিক পরে অগ্রসরমান ভারতীয় আর্মির সঙ্গে যােগ দিয়ে তাদেরকে দারুণভাবে সহযােগিতা দিলেন। পাকিস্তানি আর্মির আত্মসমর্পণের খুব অল্প পরেই ঢাকায় তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। ১০১ কমিউনিকেশন যােন -এর মেজর জেনারেল গার্বক্স সিং গিল -কে জেনারেল অরােরার সরাসরি কমান্ডের অধীনে এই এলাকাটা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার এস কে খার -এর অধীনে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং ব্রিগেডিয়ার। সন্ত সিং -এর অধীনে এফ টি সেক্টর তার সঙ্গে ছিল, আরও ছিল একটি মাউন্টেন রেজিমেন্ট, ভারী মর্টারের দুটি ব্যাটারি এবং একটা ফীল্ড কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারস। জেনারেল একটা মাইন বিস্ফোরণে গুরুতররা আহত হলে তার জায়গায় আসলেন জেনারেল জি সি নাগরা । তিনি আরও শিগগির ঢাকা পৌছনাের জন্য আরও শক্তিবৃদ্ধির অনুরােধ করে উত্তরে রীতিমতাে ধমক খেলেন। সাহসী অফিসার সুলতান আহমেদ – এর অধীনে পাকিস্তানিরা ভাল লড়াই দিল। জেনারেল নাগরা উত্তর দিক থকে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হলেন। টাঙ্গাইল এলাকায় প্যারাশুটে করে ভারতীয় সৈন্য নামতে দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা মনােবল হারিয়ে ফেলল।

টাঙ্গাইল এলাকা আগে থেকেই সিদ্দিকীর অধীনে মুক্ত এলাকা ছিল । পূর্ব সেক্টর। এই সেক্টর ঢাকার সবচেয়ে কাছাকাছি। এর জন্য ছিলেন ৪ কোর -এর কমান্ড নিয়ে লেফটেন্যান্ট-জেনারেল সগত সিং যিনি জানতেন কখন সাহসের সাথে কাজ করতে হয়। এই কোর -এর জন্য বরাদ্দ ছিল এক বিগ্রেড কম তিনটি ডিভিশন (৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন, ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন এক ব্রিগেডকম ৮ মাউন্টেন ডিভিশন)। কিলাে সেক্টর বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭টি ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন, আধাসামরিক বাহিনীসমূহ ও মুক্তিবাহিনীকে। ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রাও-কে সিলেট সেক্টর শত্রুমুক্ত করার কাজ দেওয়া হয়েছিল। আগে তিনি ছয়টি পদাতিক ব্রিগেড নিয়ে নাগাল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। পরে বিস্তর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি চীফ অব আর্মি স্টাফ -এর কাজ করেছেন। এই সেক্টরে অনেক কিছু নতুন প্রবর্তন করা হয়েছিল। জেনারেল সগত ৪/৫ গুখ। রাইফেলসকে হেলিকপ্টারে করে সিলেটের কাছে নামানাের সিদ্ধান্ত নিলেন। নয়টা এমআই-৪ দেওয়া হয়েছিল দেড় ঘন্টার মধ্যে এক কোম্পানি শক্তির বেশি লােক। সেখানে জড়াে করতে। পরে দুটি মাউন্টেনগানও হেলিকপ্টারে করে সেখানে নেওয়া হল কিন্তু শক্র আরও বেশি সৈন্য হেলিকপ্টারে নিয়ে অবতরণ করানাে অসম্ভব করে তুলল। ১৬ ডিসেম্বর ভােরবেলায় সিলেট কৃষ্ণ রাও -এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। ভৈরব বাজার সেক্টর। মেজর জেনারেল বি এফ গনলভেস আখাউড়া দখলের পর তার সমান দুঃসাহসী কোর কমান্ডার সগত সিং -এর সাথে পরামর্শ ক্রমে কমান্ড সদর দফতরের পাঠাননা মূল পরিকল্পনা থেকে দিক পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বদলে দাউদকান্দির দিকে গেলেন । এর ফলে মেঘনা নদী ও ঢাকার অধিকতর কাছাকাছি পৌছলেন। আর্টিলারি পিছনে ফেলে রেখে আসা হয়েছিল, তেমনি আরও অনেক আবশ্যক খুচরা জিনিশ যা দ্রুততায় তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারত না। এর খুব শীঘ্র পরেই জেনারেল সগত সিং এই সিদ্ধান্তে আসলেন যে শক্র সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে ফলে হেলিকপ্টারে করে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকার দিকে কাছিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সামনে চলে আসছে। সগত ও গন্যালভেস উভয়ই ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বাগে এনে এবং তাকে কাটিয়ে গিয়ে মেঘনা পাড়ি দিয়ে দ্রুত ফল অর্জনের জন্য ঢাকা পৌছনাের ব্যাপারে একমত হলেন। এখানেই স্থানীয় কমান্ডারদের উদ্যোগ ও সাহস বিজয়কে এত তাড়াতাড়ি আমাদের নাগালের মধ্যে এনে দিল। নরসিংদি এলাকা শত্রুর আর্টিলারি ফায়ারের নাগালের বাইরে ছিল এবং দ্রুত পাক আগমনের মতাে কোনও সড়ক দ্বারাও যুক্ত ছিল না। এই নরসিংদিকে মেঘনা পারাপারে সেতুবন্ধ হিশাবে নির্বাচন করা হল।

জেনারেল গনযালভেস একজন খ্যাতিমান বিমান পর্যবেক্ষণ পােস্ট অফিসার এবং একজন অভিজ্ঞ প্যারাট্রপার ছিলেন। তিনি ৫৭ ডিভিশনের সৈন্যদের এই অগ্রযাত্রা কমান্ড করছিলেন। সাহসের জন্য পরিচিত গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং এই আকাশ বাহিত অপারেশনে সহায়তা করলেন। এ একটা সফল অপারেশন হল এবং যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিল। আমার ঝোক এই বিশ্বাসে যে সগত গনযালভেস ও চন্দনের মতাে অফিসারদের একত্র হওয়া পরিকল্পিত ছিল, ঘটনাচক্রে তা হয়নি। চাঁদপুর সেক্টর ২৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আর বি হিরা, এমভিসি এর ভার পেয়েছিলেন। কাজ ছিল কুমিল-, লাকসাম ও চাঁদপুর বাধাহীন করা। শক্তিশালী শত্রু অবস্থানসমূকে সামলে এবং পাশ কাটিয়ে আমাদের সৈন্যরা চাঁদপুর পেীছল; ৯ ডিসেম্বর শত্রু স্থানটা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর সকালে ময়নামতী। ১৮১ ব্রিগেডের কাছে আত্মসমর্পণ করল এবং ৪ কোর -এর সৈন্যরা আত্মসমর্পণের ঘােষণার পর ১৭ ডিসেম্বর কোনও লড়াই ছাড়া চট্টগ্রামে প্রবেশ করল। চট্টগ্রাম। এই যুদ্ধে চট্টগ্রামের গুরুত্ব এত যে তা বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের সবচেয়ে দুরধিগম্য ভূমির প্রাণকেন্দ্র নয়, পাকিস্তানি ফোর্সের বলবৃদ্ধি আনয়নের প্রধান বন্দর, তাদের জীবন রক্ষার রশি । চট্টগ্রাম পাক সৈন্যদের পলায়নের একমাত্র স্থলপথ আরাকান রােডকে আগলাত ও নিয়ন্ত্রণ করত। এই আরাকান রােড কক্সবাজারের কাছে বার্মায় প্রবেশ করেছে। এটা একটা আদর্শ এলাকা যেখানে দ্রব্যসামগ্রীতে ভাল রকম মজুতসম্পন্ন পাক সৈন্য ও আধা-সামরিক বাহিনীসমূহ প্রায় অনির্দিষ্ট কাল লড়ে যেতে পারত যদি তারা রুখে দাঁড়ানাের সিদ্ধান্ত নিত; এমনকি মার্কিন সপ্তম নৌবহর তাদের তুলে নিতে পারত। এই নৌবহর আত্মসমর্পণের সময় চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ১০০ কিলােমিটার দূরে ছিল।

এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ভার আস্থার সাথে সঁপে দেওয়া হয়েছিল মেজর জেনারেল এস এস উবানের কমান্ডের অধীনে পাহাড়ি মানুষদের মধ্য থেকে গ্রহণ করা স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর গেরিলাদের হাতে । এই মেজর জেনারেল উবান পার্বত্য চট্টগ্রামে তার সদর দফতর থেকে সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে মুজিববাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৪ কোর -এর প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল চট্টগ্রাম। জেনারেল উবান ফীল্ড মার্শাল মানেকশ’র কাছে আবেদন করেছিলেন চট্টগ্রাম দখলের কাজটা তার অপ্রচলিত বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা হােক। তিনি মানেকশ’কে বিশ্বাস করাতে পারেননি যে প্রায় এক ব্যাটালিয়ান শক্তির এক গেরিলা দল মটার আটিলারি বা বিমান সমর্থন ছাড়া এবং নদী পার হওয়ার কোনও উপকরণ ছাড়া ঐ লক্ষ্যস্থলটি দখল করতে পারবে। উবান তখন মন্ত্রী ডিপি ধরকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করলেন। তিনি এমন একটা কঠিন কাজ একটা গেরিলা ফোর্স কর্তৃক গ্রহণের সম্ভাবনায় রােমাঞ্চিত হয়ে মানেকশ’কে বুঝিয়ে বলার অঙ্গীকার করলেন। পরে অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর অসাধারণ সাফল্য এই ফোর্সের সম্ভাবনাকে পুনর্মূল্যায়ন করতে আমি চীফকে উদ্বুদ্ধ করল। তখন তিনি এই ফোর্সকে “পুবের আর্মি” বলে অভিহিত করে মূল্যবান পুরষ্কার চট্টগ্রামকে তাদের লক্ষ্যস্থল হিশাবে দিতে সম্মত হলেন। কিসব কারণে তা করলেন, এই বই -এ তার বিবরণ আছে।

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!